একটি আশাবাদের কবিতা
আমি সেই ছুরি, যার দিকে তাকিয়ে ভাবছ
সবচেয়ে ধারালো—এই আমি,
ঘাড় থেকে তোমার কেটে নেব মাথা
দ্বিখণ্ডিত করে দেব দেহ, দেব মুক্তি।
বন্ধু, তবে শোনো
প্রায় অন্ধকার একটা কামারশালায় আমার জন্ম।
আমি জানি, হাপরের বাতাস কী করে ছড়ায় দাবানল!
আমি বুঝি, কাকে বলে দহন!
বন্ধু, এই আমিই সেই ছুরি—সবচেয়ে ধারালো
কামারশালায় সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি।
♣
আম্মারে নিয়া
আম্মারে নিয়া পাহাড়ে যাওনের কথা ভাবি।
জানি আম্মার কোমরে ব্যথা, হাঁটতে পারব না।
তবু পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চূড়ার মাচাঙ ঘরে বইসা
আম্মা পাহাড়ের বুকে মেঘের ওড়াউড়ি দেখুক।
আম্মারে নিয়া সোনাদিয়া দ্বীপে যাওনের কথা ভাবি।
জানি আম্মার দুঃখ শোনবার কেউ নাই কতকাল,
হাউকাউ থেকে দূরে নির্জন দ্বীপে বালুচরে দাঁড়ায়া
আম্মা দুঃখ তাহার ভাসায়া দিক সমুদ্রের জলে।
আম্মারে নিয়া সুন্দরবন যাওনের কথা ভাবি।
বনের ভেতর লুকায়িত নদী দিয়া নৌকা চলুক।
সবুজের ভেতরে হারায়া আম্মার মনে পড়ে যাক—
শৈশব, কৈশোর, আব্বার সাথে তার তরুণী দিনের কথা।
আম্মারে নিয়া কতই না জায়গায় যাওনের কথা ভেবে
দেখি—আম্মা সেজদারত পড়ে আছে জায়নামাজে।
মোনাজাতে ফরিয়াদ তাঁর আল্লাহর দরবারে,
যেন কবরে সে যাইতে পারে সহি-সালামতে।
এতো এতো জায়গায় যাওনের কথা যে ভাবি,
আম্মা ক্যান যাইতে চায় না?
যেখানে যাইতে চায় আম্মা,
সেখানে আমারে ক্যান নিতে চায় না!
♣
শঙ্খ
তোমাদের উৎসব থেকে দূরে
আমি সেই শামুক—
নির্জন এক দ্বীপের মালিক।
সৈকতে পড়ে থাকি,
রাত আর দিন। চুপচাপ
গিলে ফেলি সমুদ্রের চিৎকার।
আমাকে বাজাতেই পারো শঙ্খ ভেবে
যদি সইতে পারো সমুদ্রের হাহাকার।
♣
পাহাড়ের সন্তান
যতটুকু পথ গেলে রাইক্ষ্যং ফলস,
তারচেয়েও বহুদূরে মাউন্ট দুমলং।
ঝিরিপথের পাথরে লুকায়িত সিম্বল,
অনুমতি নেই কোনো দুটি পা সম্বল।
অপঘাতে মরি যদি মাগো কাঁদিও না,
রাইক্ষ্যং লেকের জলে আমায় খুঁজো না।
শোকের পাহাড় তুমি গড়িও না বুকে,
ডাবল ফলসের মতো ঝর্ণা দু’চোখে।
প্রাঞ্জংপাড়ার কোনো মা হয়ো গো তুমি
পাহাড়ের সন্তান হয়ে জন্মাব আমি।
♣
জোড়া
জোড়া মূলত বিচ্ছেদের অন্য নাম। যার মতো বেদনার আর কিছু হয় না। জুতা, মোজা, বালার মতোই মানুষও একটা জোড়া। যেমন আপনার নাম যদি জহির হয়, আপনি আসলে আরেকটা জহিরকে সাথে নিয়ে চলেছেন। একবার ভাবুন, এক জোড়া জুতা থেকে একটা জুতা হারিয়ে গেছে। একজোড়া মোজা থেকে একটা মোজা, বালা থেকে একটা বালা। আপনি কি টের পাচ্ছেন অন্য জুতাটার বেদনা, অন্য মোজাটার ক্রন্দন, অন্য বালাটার ঝঙ্কার?
আমি যদি জহির হোন, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন হারিয়ে যাওয়া জহিরের চিৎকার!
♣
ট্রেকার
রাতের ট্রেকার তুমি
কত যে পাহাড় ডিঙাইতেছ জগতে,
অন্ধকারে দিতেছ পাড়ি কত যে ঢালু পথ।
বাবার কবরটাও কম পাহাড় তো নয়,
একবার ডিঙায়া দেখাও।
♣
আত্মপরিচয়
শিমুলগাছ আমার বাবা
শিমুলফুল আমার মা
শিমুলফল মায়ের গর্ভ
গর্ভ ছিঁড়ে আমি সেই তুলো—
বৈরাগ্যের হাওয়ায় উড়ছি…
♣
সংসারে
ক
সংসারে যেও তুমি,
চিংড়ি দিয়া রাধিও মুলাশাক।
দুপুরের টেবিলে সাজায়ো যা সাজাবার
রাতের পাতে নিও তুলে দুঃখ তোমার।
খ
তুমি তো চাষার মেয়ে, অগ্রহায়নে করিও বিয়ে
বছর ঘুরতে না ঘুরতে হয়ো জমজ কন্যার জননী।
পাখি হতে পারোনি, এক কন্যারে ডাকিও পানকৌড়ি
পাহাড়ের কথা ভেবে অন্য কন্যার নাম রাখিও ঝিরি।
♣
চিৎমরম
তোমারে কি চিৎমরমের কথা বলছিলাম?
বলছিলাম কি ধ্যানরত বুদ্ধের কথা!
এইখানে প্রতি সাংগ্রাইয়ে মেলা হয়
দূর পাড়া থেকে এসে ভিড়ে বিবিধ নৌকা।
পাহাড়ি বালক-বালিকা খেলে জলকেলি খেলা
তোমারে কি বলছিলাম, বুদ্ধের ধ্যান তবু ভাঙে না!
এই পথে যেতে যেতে মনে পড়ে—
অনেক কথাই তোমারে তো হয় নাই বলা
সে সকল কথা পাহাড়ের ঢালে,
কবরফুল হয়ে রয়েছে ফুটে।
এখানে আসিও তুমি, থামিও
ফুল ছেঁড়ার নাম করে জেনে নিও—না শোনা কথা।
♣
জন্মান্তর
যদি আর কোথাও না থাকি, ময়মনসিংহ যেও। না পাও যদি সেইখানেও, লোকাল ট্রেন ধরে গৌরীপুর যেও। আর বসে থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছটারে দেখিও। ইঞ্জিন ততক্ষণে ঘুরে গিয়ে পুনরায় টানবে বগি, ঈশ্বরগঞ্জ নামিও। নেমেই যদি দেখতে পাও, কামিনী ফুলের গাছে কয়েকটা ফুল, তবে সর্পিনীর রূপ ধরে দংশিও৷
সর্পিনী পুষব বলেই তো শরীরকে বানিয়ে জমিন, রোপণ করেছি কামিনী ফুলের চারা।
১৯৯১ সালের ৩০ শে জুন, ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে জন্ম।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘মৌন শব্দগুচ্ছ’ তাঁর প্রথম কবিতার বই। দ্বিতীয় ও সর্বশেষ কবিতার বই ‘ঈশ্বরগঞ্জ’ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের অক্টোবরে।