মানুষ দৃশ্য দেখে আনন্দ পায়। অস্বীকার করা যায় না, মর্মান্তিক ঘটনাতেও দেখার এক সুখ আছে। চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে জড়ো হওয়া মানুষরা সন্ধ্যায় টিভি পর্দায় কুসুমের মায়ের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। এখন অপেক্ষা করছে বাস্তব দৃশ্যের শেষ অংশের জন্য। চোর ধরা পড়েছে। কি কি খোয়া গেছে বোঝা যায়নি। চোরকে বসানো হয়েছে উঠোনের একপাশে। কাঁচারি ঘরে সিরিয়াল দেখা দর্শকরা বাড়ি ফেরেনি। যারা টেলিভিশন না দেখে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল বা ঘাড়ের গামছা দোলাতে দোলাতে বাতাস খাচ্ছিল মাঠে, তারাও জড়ো হয়েছে খবর পেয়ে। চোরের মুখ-চোখের ভাবভঙ্গি নির্বিকার। একবার সে বসার ভঙ্গি বদলে নিলো, অনেকক্ষণ একরকম করে মাটিতে বসে থাকলে পায়ে ঝিম ধরে আসে। ঝিম ধরা পা বাঁ পাশ থেকে ডান পাশে টানতে টানতে উদাস কণ্ঠে বললো, কেউ এট্টু পানি খাওয়াবেন? আজমতের চোখে অনুমতির ইশারা পেয়ে কে যেন টিউবওয়েল থেকে এক গ্লাস পানি এনে ধরলো। চোর এক হাত দিয়ে সেই গ্লাস নিলেও বা হাতটা এখনো একই রকম করে গেঞ্জির নিচে ধরে রেখেছে। ওই জায়গাটা মাটির সাজে চিতই পিঠার ফেঁপে ওঠার সমান যায়গা নিয়ে ফুলে আছে। চেয়ারম্যান না আসা পর্যন্ত চোরের গায়ে হাত দেয়া নিষেধ। আজমত মোবাইল ফোনে নির্দেশ পেয়ে তা ঘোষণা করায় কেউ আগাতে সাহস করেনি। চোরের ভাগ্যে কি আছে বোঝা যাচ্ছে না, তার অপরাধ ভয়াবহ। সব গ্রামের নিজস্ব কিছু নিয়ম তৈরি হয়। ছোট চুরি হলে মুখে চুন-কালি মেখে ঘোরানো, মাঝারি চুরিতে চুল ন্যাড়া। আর তার চেয়েও বড় কিছু হলে চোরের হাতের মাঝখান থেকে দুটো আঙ্গুল কটাস করে কাটা হয়। বড় চুরির শাস্তি সবচেয়ে কম সময়ের। কচ করে একটা শব্দ হয় আর চোর চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারায়। তবে আজকের অপরাধ অবিশ্বাস্য। চেয়ারম্যান গেছেন হাটের ওপর নতুন দোকানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ফিরে এলে বিচার হবে।
আর সব গ্রামের মত এ গ্রামেও টুকটাক চুরি হয়। দুপুর বেলা রান্নাঘরের সামনে থেকে অ্যালুমিনিয়ামের জগটা নাই। নতুন বউর শাড়ি মেলেছিল পুকুর পাড়ের ঘাসের ওপর সেটা হাওয়া। শেষ মাথার বাড়ির রেডিওটা দিনদুপুরে গায়েব। সেই রেডিও আবার উদ্ধারও হয় মুনহাফের ঘর থেকে। মুনহাফকে এখন পর্যন্ত কয়েকবার দড়ি কোমরে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয়েছে মোটা চালের ভাত খেতে। ফিরে এসে সে কিছুদিন মাথায় তেল দিয়ে লুঙ্গি ঝারা দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন নিপাট ভালো মানুষ। আবার কদিন পরই অন্য গ্রাম থেকে চুরির খবর এলে তাকে এসে নিয়ে যায়। সেও মেনে নিয়েছে, চুরি যেই করুক পুলিশ তাকেই ধরবে কারণ কেউ তদবির করতে যাবে না। অনেক সময় মুনহাফ নিজেই বুঝতে পারে না, এবারের অপরাধ কোনটা। এ নিয়ে লজ্জা তো নেই-ই বরং এক ধরনের প্রচ্ছন্ন অহংকার আছে। প্রতিবার ফিরে আসার পর গ্রামের লোকজন জিজ্ঞেস করে কিরে মুনহাফ, এইবার খাতির-যত্ন কেমুন হইছে? সে হাসতে হাসতে বলে,
– গতরে চরবি জমছে। কাম নাই, কাজ নাই বইসা বইসা খাও। রসিয়ে রসিয়ে জেলখানার গল্প করে মুনহাফ চোরা। পান খেতে খেতে আঙ্গুলের ডগায় চুন নিয়ে দাঁতে কাটতে কাটতে বলে, বুঝলা মামা তারপর আমারে রহমান ভাই কানের কাছে মুখ আইনা কইলো, আমারে চিনছস আমি জোড়া খুন করছি, পত্রিকায় পড়স নাই। গল্পের এ জায়গায় শ্রোতাদের উৎসাহ বাড়ে। মুনহাফও সেয়ানা কম না, সে পিচিত করে পানের পিচকিরি ফেলে আগ্রহ বাড়াতে আরও একটু সময় নেয়। তারপর আবার গল্প শুরু হয়। তাকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল সেখানে ছিল এক খুনি। খুনি হইলে কি হইবো, লোকটা দিল দরিয়া। হাত পা টিপ্যা দিলে বিড়ির ব্যবস্থা হয়। ধর্মপাশার লোকজনও হামলে পড়ে না দেখা জেলখানার গল্প শুনতে। খুনির সাথে এক ঘরে রাত কাটানোর গল্প একটা রোমাঞ্চকর বিনোদন। এই গ্রামে আরেকটা জ্যান্ত বিনোদন আছে। বছর দুই ধরে মাথা আওলা হয়ে যাওয়া সুজন পাগলা। মুনহাফের সাথে তার সুসম্পর্ক। সুজন সিজনাল পাগল। মাথা খারাপ হলে কিছুদিন নাগরা জুতার সাথে কয়েক জোড়া মোজা পড়ে প্যান্টের নিচের দিকটা সেই মোজার ভেতর গুজে রাখে। হাঁটতে হাঁটতে সেখান থেকে প্যান্টের পা বেরিয়ে যায় বলে চুলের ফিতা, কাপড়ের পাড় দিয়ে বাধে। কারো কাছে চেয়ে চিন্তে খেতে দেখা যায়না, গালাগালও দেয়না। চেয়ারম্যান বাজারের কাছে বাশের বেঞ্চে বসে পা দোলায়। চায়ের ছোট কাপের ভেতর বনরুটি চুবিয়ে দেয়। রুটির ভেতর সব চা ঢুকে ফুলে উঠলে আবার সেটা কাপের উপর ধরে চিপে। টুপ টুপ করে চা কাপে জমে অর্ধেকটা ভরে যায়। আপন মনে হাসতে হাসতে বলে, কাপে চা খাইয়া ফেলছে। একটা লাঠি নিয়ে ঘুরে ঠিকই কিন্তু ভয় দেখানো ছাড়া সেটার ব্যবহার কেউ দেখেনি। এই সুযোগটা পাড়ার ছেলেপেলেরাও টের পায়। তারা গাছের ডালে উঠে দোল দিতে দিতে বলে, পাগলা তোর পাগলি কই/ হারি ভরা চুক্কা দই/ তোর পকেটে হুকনা (শুকনো) খই/ ভয় পাইয়া গেলি কই, পাগলা তোর পাগলি কই। সুজন পেছনে ফিরে দু’এক পা এগিয়ে এসে লাঠি দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে নিজেই হেসে ফেলে। কেউ না খেপলে তাকে খেপানোর যে আনন্দ নেই তা শিশুরাও বোঝে। ব্যর্থতায় মুখ ভার করে তারা আবার মাটিতে লাটিম ছুড়ে দেয়। সুজন দূরে দাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে সেই লাটিমের ঘূর্ণনের দিকে তাকিয়ে থাকে। লাটিম থেমে গেলে সে আবার আপন মনে হাঁটতে শুরু করে। সুস্থ অবস্থায় অসুখের কথা জিজ্ঞেস করলে মিটি মিটি হাসে নিরুত্তর। ভালো সময়ে সুজন পাগলার পোশাক-আশাক ঠিক হয়ে যায়। চুরি ফিতেগুলোও থাকেনা হাতে-পায়ে। গেলাসের ভেতর বন রুটি না ডুবিয়ে ভদ্রলোকের মত ছিড়ে খায়। শুধু ঝুড়ি বটগাছের শেকড়ের মতো চুলের জটাগুলো ঝুলে থাকে মুখের ওপর। ওখানে আর কখনো চিরুনি পড়েনি সুজনের। কে জানে হয়ত গোপন অভিমান। অপ্রকাশ্য অভিমান গভীর হয় বেশি আর যদি তা প্রতিদানের প্রত্যাশা না করে জন্মায় তখন সে অভিমান নিজেকে কুরে খায় স্বয়ং মানুষটাকেই।
যে রাতে শামেলাকে নিয়ে এসেছিল সেদিন মাইক বাজেনি, উঠোনে গীতও গায়নি কোন নারী। বন্ধু-বান্ধবের ইচ্ছে থাকলেও এই বিয়েতে চেয়ারম্যানের অসম্মতি থাকায় সাহস পায়নি সুজনের বন্ধু-বান্ধবরা। শুধু টিনের ঘরের সামনের নিকোনো উঠোনে ছিল নারীর হাসির মত খল খল করা জোসনা। বাড়ির গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ ছিল। নতুন বউয়ের মনটা ম্লান হয়ে গেছে মানুষের অনুপস্থিতিতে। গোপনে নিজের বিয়ে নিয়ে যেসব কল্পনা করেছে তার কিছুই মিলেনি শুধু মানুষটা ছাড়া। তবে মানুষের সংস্পর্শই এমন যে তাতেই শূণ্য দাঁড়িয়ে থাকা যায়গায়ও পৃথিবীর সব প্রাপ্তি এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ে। ঘরে না ঢুকেই মানুষটা নতুন স্ত্রীর সামনে তার পাঞ্জাবী খুলে আড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখলো।
– উফ এত্ত গরম কই থিকা আসে, আমার অস্থির লাগে। বউ তোর গরম লাগতেছে না? এইসব জবর-জং কাপড় পাল্টা, চল পুকুরে ডুব দিয়া আসি। শামেলা ভয়ে ঘোমটার ভেতর থেকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। এই মানুষটার কি মাথা খারাপ?
– নতুন বউ এই রাইতে পানিতে নামবো! কি কন?
– কাইল নাইছিলি পুকুরে?
– হু
– আইজ কি হইলো তাইলে? জন্ম আর মৃত্যু ছাড়া মানুষ নতুন হয় না কখনো বউ।
– আপনে এইসব কথা কই থিকা শিখেন? এত সুন্দর কথা কইয়াই আমার মাথাটা খাইছেন।
– এই বাড়ি কেউ নাই বইলা তোর একটু মন খারাপ হইছে নারে?
– কেমন খালি খালি লাগতেছে, আপনি বাড়ি না থাকলে কেমনে একা থাকব?
– কেন এই যে ঘরের সাথে দুইটা বিশাল জামরুল গাছ। সেইখানে বেগুনি ফুল, আমগাছে চরুই পাখির বাসা, জানলার সাথে জবা ফুলের গাছ আর আমার জন্যি তুই অপেক্ষা করবি। এইত সময় কোনদিক দিয়া যায় বুঝতেও পারবিনা।
শামেলা টের পায় মানুষটা অন্যরকম। গাছ নিয়ে নাকি দোকলা হওয়া যায় ! ঘরে ঢুকে বিয়ের ট্রাংক খুলে অন্য একটা সুতি কাপড় পড়তে পড়তে মানুষটা ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় ডাক দেয়, বউ শোন। শামেলার শরীর কাঁপতে থাকে অজানা ভয়ে আর আনন্দে। সে অপেক্ষা করছিল সত্যি, কিন্তু ঠিক যে মুহূর্তে সেই সময় উপস্থিত হলো তখন টের পেলো এত সহজ না। সুজন কাছে আসতেই শামেলা দুই পা সরে যাওয়ার পায়তারা করে বললো,
– ছি আপনে কি কন!
– হো হো করে হেসে ওঠে সুজন। আমারে চিনস নাই। তরে আহ্লাদ কইরা একটা কথা কইতে গেছিলাম।
লজ্জায় লাল হয়ে যায় সুজনের নতুন স্ত্রী। সেই তাহলে আগ বাড়িয়ে ভেবেছিল অন্যকিছু! অবশ্য মেঘ দেখলে সবারই প্রথম শুকনো কাপড় ঘরে তোলার কথাই মনে হয়। মুখ নিচু করে থাকে শামেলা।
– বিয়ার পর প্রথম একটা অনুরোধ করলাম সেইটাই ফালায় দিবি ? আমার অনেকদিনের ইচ্ছা তোরে নিয়া রাইতে পুকুরে নামব। পানির মধ্যে দাঁড়ায় প্রথম ভালো কইরা দেখবো তোরে।
শামেলা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তার ধারণার প্রচলিত পুরুষের সাথে মেলেনা এই মানুষের স্বরুপ।
– আচ্ছা আমারে কি আপনি আপনি করবি? স্বামীরে কেউ এমনে ডাকে?
শামেলার সারা শরিরের কাপন কেমন কান্না হয়ে ফুঁপিয়ে উঠে। আনন্দের বাতাসে দোল খেতে খেতে বলে আপনি আমার গিরস্ত। এই যে বড় আম গাছটার সাক্ষী। আজ থিকা আপনি আমার গিরস্ত। সুজনও বেশ অবাক হয়েছে নামকরণে। এত সুন্দর করে কেউ ডাকবে কখনো ভাবেনি। জমি, ঘর, ফসল, গাছ সবই সামান্য সামান্য থাকা সুজন টের পায়, তার আসলে এইটুকু ছাড়া খুব বিশেষ কিছু চাওয়ার নাই। এই মানুষটাকে আগলে রাখাই সবচেয়ে বড় চেষ্টা। সেদিন থেকে সত্যি খুব গৃহস্থ হয়ে যায় সুজন।
এত সুন্দর শামেলা তারই বউ এ কল্পনারও বেশি। মেয়েটা যে তাকেও ভালোবাসে সে টের পায়। দুপুর-রাতে খাওয়ার পর পিরিচে করে পানটা সুন্দর করে এগিয়ে ধরে। কোন কোন দিন নিজেই আব্দার করে, আইজ নাওয়ার আগে এট্টু তেল দিয়া দিবেন আমার চুলে?
– দিমু, তুই কি দিবি বিনিময়ে?
– যান খালি সবসোময়ে এক ধান্দা হের।
– বারে এই গ্রামের কাউরে দেখছস, বেডারা বউর মাথায় তেল দেয়?
– সবাই আর আপনে কি এক! আর কারও বউ তার স্বামীরে গিরস্ত কইয়া ডাক দেয়?
শামেলার সপ্রতিভতায় মুগ্ধ হয় তার গিরস্ত। বছর ঘুরতেই শামেলার তলপেট ভারি হয়ে উঠেছে। মাঝামাঝি সময়। মনে মনে কল্পনা করে সুজন, শামেলার মত বুদ্ধি হবে তো সন্তানের! ঘনিষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর কি খারাপ লাগে?
– মা’রে দেখতে ইচ্ছা করে। আপনি যখন বাড়ি থাকেন না তখন কেমন ভয় ভয় লাগে।
– কিন্তু তরে ওই বাড়ি রাইখা আসলে আমি থাকব কি নিয়া? আমার শ্বাশুড়িরে নিয়া আসি কয়দিনের জন্য?
– মা আসপে না। কেউ না কেউ হেরে খারাপ কথা কইবোই গ্রামের, আমারে রাইখা আসেন কয় দিনের জন্য। গিরস্তের মনটা খারাপ হয়। এই সত্যিটা সেও জানে যে শামেলার বাবা-মা এলে কিছু একটা খোটা শুনবেই। সে বুঝে পায়না, সব মানুষ দেখতে একরকম। এমনকি শামেলারাও মুসলমান, সেইত এক আল্লাহ-খোদার ইবাদত করে তাও এত ফারাক কই থিকা আসে?
দুই গ্রাম পরের ছোট গ্রামটার নাম কারিগর ডাঙ্গি। মুখে মুখে কাইরক্যার হয়ে গেছে, কেউ কেউ তার তাচ্ছিল্যের মাত্রা বোঝাতে আরেক ধাপ বাড়িয়ে বলে, ও জোলাগো পাড়া। তাদের ফসলের সাথে বোঝাপড়া নেই, পৌষে-নবান্নে উৎসবও নেই তাই। ওই পাড়া থেকে সারাদিন খটখট শব্দ আসে বলেই হয়ত আশপাশের মানুষ বিরক্ত হয়। সে কারণে নিজেদের ঘরগুলো সেই কবে থেকেই তারা দূরে দূরে বানাতে শুরু করেছিল। মাটির ডেলা ভেঙে ভেঙে, কর্ষণ করে তা থেকে ফসলের প্রাণ জন্মানো তাদের কাজ না। বালি মাটির তরমুজের ভেতরটা টকটকে লাল আর গুড়ো গুড়ো হয় তাও তারা জানেনা। কয় জ্বালে ভালো পাটালি হয়, আর ঠিক তার একটা জ্বাল বেশি হলে গুড়ে তিতা স্বাদ আসে কোনদিন তারা বুঝতে পারেনি। তবে সব মানুষই কিছু না কিছু জানে। এই যে এত সুন্দর সুতোর নকশা করা, নিড়ানি, ছেনি, লাঙ্গলের বদলে মাকু, সুতোর গোলা, মাটির মালশায় রঙয়ের ঢেউ, দড়িতে মেলা রঙিন সুতো আর দুই আঙ্গুলের ভেতর দিয়ে কাপড়ের জমিনে তোলা নকশা সেই কাজ কি আর কেউ জানে! মানুষের গায়ে যে সুন্দর বাহার জন্মাতে তারা জানে সেও কি আর কেউ পারবে ! দুপুরের দিকে অন্যসব গ্রামে যখন ঘর-গৃহস্থালীর শব্দে রমরমা তখন কাইরক্যার পাড়ার থই থই নির্জনতা আরও জমিয়ে তোলে তাতের একটানা খটখট… খটখট শব্দে। তবুও তারা জোলা এটাই বড় পরিচয়। তবে বাজারের ছিটের কাপড়ের কাছে মার খাচ্ছে কারিগররা। মানিক মল্লিকের মোটা সুতি কাপড় আর আরামদায়ক লাগেনা অনেকের। প্রয়োজনের কাছে অহং নত হয় আর সেই অহং যদি অন্যের উপেক্ষা থেকে নিজের মান বাঁচাতে মন গড়া হয় তবে তা আরও দ্রুত বদলায়। মানিক মল্লিকের বড় মেয়ে শামেলা। জমি-জাতি পাওয়া ছেলে পেলে এখন স্বাচ্ছন্দ্যে তুলে দিতে পারে। আকস্মিক একদিন দেখে পছন্দ হওয়ার পর ওপক্ষের সারা পেয়েই প্রস্তাবটা চেয়ারম্যানের কাছে তুলেছিল সুজন।
– গ্রামে মাইয়ার অভাব হইছে নাকি ? জোলার মাইয়া নিকা করতে চাও।
– তারা তো মুসলমানই
– পাক্কা মুসলমান না, তাছাড়া ওইসব বাড়ির মাইয়া কি তোমার জমিন বুঝবো সুজন? ধান উড়াইতে, খুদ কুড়াইতে শিখছে কোনদিন? জানে নাকি ওষুধ না দিয়া ধানের পোকা কেমনে সরায়?
– আমি তো বুঝি, সেও বুইঝা নিবো দুইদিনে, আপনি খালি মত দেন
– আমি মত দেওনের কেউ না, তোমার বাপে থাকলে এই বিয়া মাইনা নিত? নিত না।
এসব বিয়ের আগের কথা। এখন শামেলা তার নিজের মিষ্টি কথায় সবার আপন হয়ে উঠেছে। এমনকি কারও মেয়ের বিয়ের জন্য নকশী কাথা করা, কারও বাচ্চার নতুন জামা বানানো এসব শামেলা ছাড়া হয়না। কয়েকদিন আগে মুনহাফ চোরাই একদিন সুজনকে বলেছিল।
– মিয়াভাই একখান কথা কই, চোরগো চোখ-কান খুব সজাগ হয়। বউ শামলায় রাইখেন
– আস্তাগফেরুল্লা, তুমি কি বললা মুনহাফ!
– জোয়ানকি বয়সের কাছে বেবাকি সমান ভাই। আর ভোগ করনের লাইগাত জাত বিচার লাগেনা। এইকামে হেই কামে বউরে চিয়ারম্যান বাড়ি কম পাঠাইয়েন।
– যাও যাও বাতেলা কইরোনা। খালি আকথা-কুকথা কও মাইনসের নামে। বিয়া পরথম মাইনা নেয় নাই ঠিকই কিন্তু শামেলার মুখ দেইখা চেয়ারম্যান শাড়ি ব্যাবার দিছেনা? তাছাড়া শামেলা বেড়াইতে যায়না। মেহমান কুটুম আইলে কামে কাজে ডাক দেয়, এট্টু হাতাড়ানি সাহায্য করে।
এসব কথা বলে ঘরে ফিরে এলেও মনের ভেতর কোথায় যেন খচখচ করে গিরস্তের। শামেলার মত সুন্দরীত সে আর কাউরে দেখেনা এই গ্রামে। মানুষ আবার মাটি না বুইঝা পারে নাকি! মা হওয়ার পর শরীর পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে আরও বউয়ের। কি সোন্দর লাউয়ের জাংলা তুলছে। শাড়ির পাড় জোড়া দিয়া দিয়া চাঁদোয়া বানাইছে কাঠের চাঙ ঢাকতে। চৌকির উপর চিত হয়ে শুয়ে সেই চাঁদোয়ার নঁকশার দিকে তাকিয়ে থাকে সুজন। শামেলা ঘুমের ভেতর পাশ বদলায়। এতক্ষণ হাতটা মুখের নিচে ছিল, একপাশে চুরির দাগ বসে গেছে সেখানে। হ্যারিকেনের আলোতে সে দিকে তাকিয়ে থাকে সুজন। শামেলার গাঢ় নিশ্বাস পড়ছে। ব্লাউজের দুটো বোতাম খুলে আছে। প্রায় তিন বছর হলো শামেলা তার সবকিছুর মালিক। কই একদিনওত পুরান লাগে নাই। এমনকি মা হয়ে গেলে নাকি মহিলা হয়ে যায় সবাই কিন্তু শামেলারত তেমন হয়নাই। এখন সে কতকিছু বোঝে। মা ডাক শুনে অস্থির হয়ে আধাফোটা ভাত রেখে দৌড়ে আসে। একটু পর পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে গেলে দৌঁড়ে যায় রান্না ঘরে আর মেয়ের বাপ সম্পর্কে ঝাল ঝাড়ে বাতাসের উদ্দেশ্যে। ফিরাত মাইয়া মাইয়া কইরা অস্থির কিন্তু সামলাইতে কেমুন লাগে যদি জানতো। খালি ভালো সময় আছে খাতিরে, আসুক ফিরা। তবে ফিরে আসার অনেক আগেই রাগ মাটিতে মিশে যায়। মেয়েটা সবে হাঁটা থেকে একটু একটু করে দৌঁড় দিতে শুরু করেছে। কয়েক পা দৌড়েই ঝুপুত করে পরে। তার পায়ে রুপার মল ঝুমুর ঝুমুর শব্দে বাজে। বাপের মত নিখুত নাক-চোখ মুখ আর মায়ের মত গায়ের রঙ মিশে মন হয় একটা জ্যান্ত পুতুল হইছে একটা। মায়ের মতো একপাশ হয়ে ঘুমায় আর বাপের মতো আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলতে তুলতে ঘুম থেকে উঠে। সারাদিন মা’র আচলের সাথে সাথে কিন্তু বাপ বাড়ি ফিরলেই আর কাউরে চেনেনা। শামেলা কারিগর কন্যা। পুরনো শাড়ি কেটে নানা নকশা করে মেয়ের ফ্রক বানায় কুচি বসিয়ে বসিয়ে। সুজন দিনরাত জমির ফসল গঞ্জের দোকান নিয়ে ব্যস্ত। টেইলার্সের ভাড়া দোকান তুলে সে নিজেই কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেছে। এবার চেয়ারম্যান একদিন তলব করল তাকে।
– আছো ভালো নাকি সুজন?
– আপনাগের দোয়া।
– জরুরি কামে ডাকছি। গঞ্জের দোকান কেমুন চলে ?
– শুরুত করলাম মাত্র কয় মাস। চলতেছে তয় মালের পিছনে টাকা দিতে পারি নাই।
– আচ্ছা আচ্ছা তা তোমার বউরে যে কয়দিন পাঠান লাগে আমার বাড়ি।
– কেন ?
– তোমার ভাবির শরিরডা ভালো না। বুঝোইত সবাইত আর সংসার সামাল দিতে জানেনা। মেয়েডার নাম রাখছো কি ময়না না? সকালে দেখলাম হাঁটতেছে উঠানে। খুব সুন্দর হইছে মা’র মতো।
সুজনের মাথার ভেতর ততক্ষণে ভোমরা ডাকতে শুরু করেছে। মাথা ঝা ঝা করছে। একবার মুখে কঠিন কথা আসলেও শান্তভাবেই উত্তর দিলো। শামেলা বাপের বাড়ি যাইতেছে আইজকা।
– মাঝেমধ্যে বাপের বাড়ি যাওয়া ভালো। মনটার পরিবর্তন দরকার। ঠিক আছে ফিরত আসুক, পাঠায়ো খোঁজখবর নিতে।
ততক্ষণে সুজনের মাথার ভেতর রাগ উঠছে চিড়বিড়িয়ে। জ্ঞানী মানুষ যদি কথার পেছনের কথা না বুঝে ধৈর্য থাকেনা। রাগ সামলাতে জিজ্ঞেস করলো।
– কেন আপনিত কইছিলেন, শামেলা জোলার মাইয়া জমিন বুঝে না।
– আরে সেইসব কথা এহনো রাগ কইরা ধইরা রাখছো তুমি। তখন শামেলাও ছোটোইত ছিল, নাকি ছিল না ?
– তা ছোটই থাকুক আর এহন বেবাক বুইঝা মহাজ্ঞানী হোক, তার নিজের সংসার আছে।
– অত চেইতনা। মাঝে সাঝে খোঁজ-খবর নিতে কইয়ো। ময়নাতো দেখি প্রায়ই আমার মেয়ের সাথে বইসা খেলা-ধুলা করে। ভালো কথা একটা জরুরি আলাপ ছিল।
আর কি জরুরি কথা সুজন বুঝে না, তার মেজাজ বিগড়েছে।
– ঢাকা থিকা মোবাইল ফোন কোম্পানী আইতাছে। তারা এইখানে দোকান খুলনের লাইগা জায়গা খুঁজতেছে। দোকানডা আমি দিবো তয় জমি লাগবে।
– আমারে কি করতে কন ?
– আমার দোকানডা তাগো কাছে ভাড়া দিবো কিন্তু বলছে আরও বড়ো বানাইতে হবে। বুঝো না কাচের দরজাওয়ালা দোকান বানাইবো তো। তারপর ভিতরে এসি বসাবো। এসি চিনো? ঠান্ডা হাওয়ার কল।
– আমার দোকান তাইলে তুইলা দিতে হবে? দোকান ত আমি তুলুম না চেয়ারম্যান সাব।
– কথা শেষ হওয়ার আগে মুখের ওপর না বইলো না সুজন। বাপ হইছো এখন একটু আক্কেল জ্ঞান কইরা কথা কও।
– যে জ্ঞানই হোক। আমি বুঝি কম। এই মোবাইল জিনিসটা খুব এট্টা ভালো কিছু মনে হয়না আমার। দ্যাহেন না কাজে-কামে মন নাই পোলাপানের। কিন্তু সামান্য ক্ষেতের জমিন ছাড়া আমার আছেই খালি ওই দোকান দুইটা, দিমু না।
– মেজাজ দেখায়ো না সুজন। তুমি ত টাকা পাইবা, ভাইবা দেখো।
– ভাবার কিছু নাই।
– বেতমিজের শাস্তি সহজ না তুমি ত জানো। এত সহবত কইরা না কইলেও ত পারতাম, পারতাম না ? এহন যদি চোর মনে কইরা তোমারে বাইন্ধা নিয়া যায় পুলিশ, কারে লাগবো জামিন পাইতে, আমারে। মামলা খারিজ করতে কারে ডাকবা? আমারে।
– কাউরে ডাকপো না। উপরওয়ালা আছে।
– বিয়ার সময় উপরওয়ালার কথা মনে আছিল, নাকি এহন বাপ হইয়া উপরওয়ালার ভয় ঢুকছে মনে ?
– আপনে যা ইচ্ছা ভাবেন। আমি চললাম।
একই কথাই হয়ত সে বিনয় নিয়েই বলতো। কিন্তু মুনহাফের সেই বক্তব্যের রেশ আর আজকের প্রথম প্রস্তাবেই মাথা গরম হয়ে গেছে সুজনের। সে লুঙ্গি ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিলো। বাড়ি ঢুকে প্রথম দৃশ্য দেখে সারা শরীরের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। মেয়েটা উঠোনে বসে কাদা মাটি ছেনছে আর চুলোর উপর গা মেলে দিয়ে বসে শামেলা ফু দিয়ে আগুন ধরাতে চেষ্টা করছে, আঁচল নেই গায়ে। ছিট কাপড়ের ব্লাউজের ভেতর দিয়ে ঘামে ভেজা পিঠের বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে। কি হলো কে জানে, ধাই ধাই করে যেয়ে এক হাতে চুলের গোছা ধরে টানতে টানতে উঠোনের মধ্যে এনে ফেললো। ঘটনার আকস্মিকতায় শামেলায় থ হয়ে গেছে।
– তুই কারে গতর দেখাস আমি বুঝি না ? তোর এই ছিট কাপড়ের ব্লাউজ কিডা বানায় দিসে মাগী ?
– কি কন আপনি, কি হইছে?
– ন্যাকামি দেখাস জোলার মাইয়া কোনহানকার, ছিলি ফহিন্নি এহন পয়সা চিনছস?
শামেলা হা করে তাকিয়ে আছে গেরস্তের মুখের দিকে।
মেয়েটা সবই দেখেছে চোখের সামনে, ভয়ে ঠোট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো। সুজনের কোনদিক লক্ষ্য নেই। এই তার শামেলা যাকে সবার অমতে সে নিয়ে এসে সবকিছুর আধিপত্য দিয়েছে। আবার মাটি থেকে নিজেই তুলে দাঁড় করিয়ে মুখের ওপর বাঁ হাতে কষে চড়টা বসাতেই ময়না এবার মা বলে চিৎকার করে উঠলো। মেয়ের ডাকে মাথার ভেতরের গনগনে আগুনের ভেতরও মনে হলো একটা পর্দা সরে গেল সুজনের। এত শুধু তার শামেলা না এখন ময়নার মা। দৌঁড়ে কলতলায় যেয়ে এক হাতে হ্যান্ডেল চাপতে চাপতে সে নিজের মাথা এগিয়ে ধরলো কলের মুখের নিচে। এ কি করলো চেয়ারম্যানের কথা শুনে! ময়না এখনো সমানে কেঁদে যাচ্ছে ভয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। সে দ্বিধাগ্রস্থ, মায়ের কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। বাবার দিকেও তাকাচ্ছে না। মাথায় পানি দিয়ে সুজন বসে পড়লো মাটিতে। শরীরের কাপুনি থামলে মেয়েকে কোলে নিতে গেলেই সে ভয়ে চলে গেলো মায়ের কাছে। শামেলা ততক্ষণে উঠোনের দাওয়ায় যেয়ে বসে আছে। তার চোখে এক ফোটা পানিও নেই, রাগ, কষ্ট কিছুই নেই। চুলোর ভাত উথলে পড়ছে। মেয়েটা মায়ের কাছে যেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই তার সামান্য হুশ হলো। সে মেয়ে কোলে নিয়ে উঠে ঘরের ভেতর চলে এলো। সুজন ঘরে ঢুকেই শামেলার পা জড়িয়ে ধরেছে।
– বউ মাফ কইরা দে, বড় অন্যায় করছি
– কিছু হয় নাই, পা ছাড়েন।
– বিশ্বাস কর মাথা ঠিক আছিল না। তুই অনেক কষ্ট পাইছস না? মাফ না করা পর্যন্ত পা ছাড়ুম না। ক মাফ করছি।
– আমি ব্যথা পাই নাই, আপনে পা ছাড়েন।
– তুই কাপড় ভাঁজ করস কেন? খবরদার বাড়ি থিকা পা বাড়াবি না
– মেলা দিন হইছে। আমি এট্টু হয়রান। আপনের সংসার সামলাইতে সামলাইতে আমি ক্লান্ত।
– এইডা তোর সংসার বউ
– না, ময়না ছাড়া এই জগতের কিছুই আমার না। বাপের বাড়ি যে যাবো তাও আমার না। কয়ডা দিন তাও থাইকা আসি। আমার আর সহ্য হইতেছে না।
– এই সংসার তোর না বউ?
– আমার না। আমার হইলে আপনি আগে আমারে জিজ্ঞেস করতেন তারপর গতরে হাত তুলতেন। চেয়ারম্যানের বউর পায়ে মাঝে মধ্যে গরম তেল কি আমি এমনি ডলতে যাই? সেই আমারে কইছে আপনের দোকান নিবো চেয়ারম্যান। তারে হাতে পায়ে ধইরা ভাও করি আর প্রত্যেকবার কই, ভাবি আপনি চেয়ারম্যানসাবরে ঠেকান। সে কথা দিছে তার স্বামীরে বুঝাবো। চেয়ারম্যানের বউ তার গাট্টি ধইরা আনা ব্লাউজের কাপড় থিকা এইটা সেদিন বাইর করা দিয়া কইছে, নে গরমের ভিতর গায়ে দিয়া আরাম পাবি। আপনি আমারে কি ইঙ্গিত দিছেন ভাবছেন কিছু বুঝি নাই আমি? আপনে স্বামী রাগ হইলে গায়ে হাত তুলছেন, পরের বেলা ব্যথা থাকপো না কিন্তু চরিত্র নিয়া কথা বলছেন। আমার অস্থির লাগতেছে আপনার কাছে, জীবনে প্রথম আমি আপনের সামনে দাড়ায়া স্বস্তি পাইতেছি না। মাইয়ারা মা হওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়। সেই সময়ও আমি আপনের মুখ মনে করছি আর শান্তি পাইছি। সেই আপনের দিকে তাকাইতে আইজ খুব কষ্ট হইতেছে, খুব কষ্ট। কয়টা দিনের জন্য ছুটি দেন আমি মায়ের কাছে যাই। একটানা কথাগুলো বলে হাঁপিয়ে উঠলো শামেলা। ময়না ততক্ষণে চৌকির এক কোনায় গিয়ে বসেছে। অন্য সময় এতক্ষণে সে বাপের কোলে উঠে, ঘারে পা ঝুলিয়ে চুল খামচে ধরে নাক কামড়াতো।
সুজনের মনে হচ্ছে শরীরের ভেতর নাড়ী একটা একটা করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। সে কি করলো রাগের মাথায়। যে তারে গেরস্ত বানালো তারে এমন কষ্ট মানুষ পশু না হইলে কেমনে দেয়? শামেলার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে যাবেই। শামেলা যাওয়া মানে ময়নাও কয়দিন থাকবে না। সুজন এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে যেয়েই খিল তুলে দিয়ে বাইরে থেকে চিৎকার করলো। বউ ঘরের ভেতর থাক, আমি গঞ্জে যাবো আর আইসা পড়বো। তুই দেখ আমি কি আনি তোর জন্য। দোকান যায় যাক তোরে আর কোনদিন আমি ওই বাড়ি যাইতে দিমু না। উঠোনের পাশ থেকে বেতের ধামাটা নিয়ে রওনা হলো সুজন। নিজের দোকানটার বন্ধ সাটারের দিকে একবার দেখলো কিন্তু আগালো না। শামেলার চুলে কতদিন হলো সে ভালো করে তেল মেখে দেয়নি। সুগন্ধী তেল কোন দোকানে ভালো পাওয়া যায় সে জানে। ছিট কাপড়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো ব্লাউজের কাপড় দেখতে। পোলাওয়ের চাল, কিছু আনাজপাতিও নিলো। সব কিছু দিয়ে ধামা ভরে তুললো সুজন। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার সবকিছু। আজ রাতে সে রান্না করবে তারপর মেয়েকে ডেকে বলবে, এই যে আম্মা দ্যাখেন আপনের আব্বা আজকে জীবনের সবচেয়ে বড় অন্যায় করছে এখন মাফ চাইতেছে। আপনের মায়েরে বলেন যেন সে মাফ কইরা দেয়। তারপর সে ফ্রকটা পড়িয়ে দেবে মেয়েকে। রাজি হলে আজ শামেলার পায়ে সে নিজে হাতে তেল মালিশ করে দেবে। নিশ্চই চেয়ারম্যানের বউর পায়ে তেল ডলার সময় শামেলা মনে মনে ভাবে, বড় ঘরে বিয়ে হলে তারও পায়ে কেউ এভাবে তেল মাখাতো। এসব ভাবতে ভাবতে সুজনের মনটা হালকা হয়ে গেল। সে ভ্যানে ধামাটা তুলতে যাবে ঠিক তখনই দেখলো মুনহাফ চিৎকার করতে করতে তাকে খুঁজছে।
সুজন ভাই তোমার কি হইয়া গেলো। সুজন মুনহাফের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
তোমার কিছু নাই, সব জ্বইলা গেছে। তোমারে খুঁজতে আগে চেয়ারম্যান বাড়ি গেছি তারপর গঞ্জে আইসা পাগলের মতো খুঁজতিছি। মুনহাফ হাঁপাচ্ছে, সুজন থ মেরে গেছে।
সুজন যখন বাড়ি ফিরলো তখনো আগুনের হলকা আছে। লোকজন জড়ো হয়ে গেছে চারপাশে। দু-একজনের হাতে বালতি ধরা। কেউ কেউ চেষ্টা করেছিল আগুন নেভাতে কিন্তু লাভ হয়নি। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন মন্তব্য করলো । এই আগুন এমনি ধরে নাই, নাইলে ঘরের চারপাশে একসাথে কেমনে জইলা উঠলো। কেউ কিছু ঢালে নাই ত। সুজনের কানে কোন কথা যাচ্ছে না। ঘরের শিকল সে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। ভেতরের কথা কিছু মনে পড়ছে না। ময়না, শামেলার মুখটাও সে চেষ্টা করে মনে আনতে পারছে না। শুধু কানের কাছে কে যেন বিড়বিড় করে ডেকে যাচ্ছে গেরস্ত . . . গেরস্ত। সুজন কোন দিকে যাবে ঠাহর হয় না তার। কিছু মনে নেই শুধু কানের ভেতর একটা শব্দ ভাসে . . . গেরস্ত। সুজনের মাথা খারাপ হয়ে গেছে কথাটা বুঝতে কয়েকদিন লাগলো সবার।
সেদিন সুজনের বাড়িতে আগুন লাগায় যত মানুষ জড়ো হয়েছিল তারচেয়েও বেশি মানুষের ঢল নেমেছে আজ চেয়ারম্যান বাড়ির চুরির ঘটনায়। মানুষ বাস্তব দৃশ্যের চেয়ে কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে বেশি পছন্দ করে। চুরিটা হয়েছিল কুসুমের মায়ের কান্নায় সবাই যখন আবেগঘন ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে সেই সময়। কেউ কেউ নিজের দুর্ভাগ্য কুসুমের মায়ের সাথে মিলিয়ে নিতে নিতে স্বগোক্তি করলো, আহারে বেটিটার জীবন কষ্টে ভরা। কেউ কেউ নিজের অবস্থান মিলিয়ে তুলনামূলক সুখ আহরণ করলো, যাক ওই অবস্থায় সে নিজে অন্তত নেই। মানুষ অধিকাংশ সময় অন্য জীবনের সাথে তুলনা করে ভালো বা মন্দ থাকে। নিরবচ্ছিন্নভাবে ভাবতে পারার যোগ্যতা খুব কমজনেরই হয়। কুসুমের মা দরজা ধরে তাকিয়ে আছে বাইরে উদাস চোখে। তার স্বামী বহুদিন হলো অন্য সংসারে। মেয়েটা কষ্ট করে বড় করেছে সেই কুসুম এক মুসলমান ছেলের হাত ধরে বাড়ি ছাড়ছে। ঠিক তখন পাশের ঘর থেকে কান্নার শব্দ তারপর হুড়মুড় করে জানালা দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েই এক রুমের প্রেক্ষাপট গৃহ থেকে যেন দর্শকরা বাস্তবে আছাড় খেলো। এতক্ষণ তাদের বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে পার্থক্য ছিলো শুধু ঘুমের ভেতর এক শিশুর কান্না। মহিলারা পাশের ঘরে জড়ো হলো, কেউ কলেমা পড়ে বুকে ফু দিলো। পুরুষেরা দৌড়ে গেল অন্ধকার উঠোন পার হয়ে, পুকুরটার গা ঘেঁষে, মাঠের হালট ধরে। একটা মানুষ তারচেয়েও বেশি কালো অন্ধকারের ভেতর প্রাণপন দৌড়াচ্ছে। পেছনে চোর চোর করে টিভি দেখা মানুষগুলো আসছে। সকলে মিলে এক চোরকে ধরতে আর কতক্ষণ লাগে তবে এই মাঠ পথ তাদের যেমন চেনা চোরেরও অচেনা নয়। চেয়ারম্যান বাড়ির বাদিকে পুকুর পার হয়ে উত্তরপাড়ার ধানি জমির মাঠটুকু পর্যন্ত দৌড়ে আসতেই দুপক্ষের মধ্যে দূরত্ব কমেছে। চোর বুনো ঘোড়ার মতন সাঁই করে ডান দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেলো তবে খুব বেশি দূর সম্ভব হয়নি। তার পায়ে লাঠির বাড়ি লেগেছে। লাঠিটা ছুড়েছে আজমত। আজমত মেম্বারের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সে বাড়িতে থাকতে মনিবের বাচ্চা চুরি করতে কেউ আসতে পারে এ কল্পনাতীত। সে প্রথম দৌঁড়টা দেওয়ার আগেই মনে মনে বললো হারামীর বাচ্চা তোর একদিন কি আমার একদিন আইজকা।
অন্ধকার আর আলোর মাঝখানে আরও কিছু থাকে। অসম্পূর্ণ বলে নিজস্ব নাম নেই। অমন একটা আঁধার ছিল উত্তর পাড়ার শুরুর বাদারটায় বড় হিজল গাছের চারপাশে। ডোলা ভরা অন্ধকার ম্লান হয়ে গেছে জোসনায়। মুখ-চোখ চেনা না গেলেও অবয়বটা বোঝা যায়। তবে যারা এতটা পথ ছোট গাছ, নরম মাটির দলা বা সদ্য জন্মানো চারা গাছ ভাঙচুড় করে পেছন পেছন ছুটে এসেছে তাদের আরও স্পষ্ট মুখ চাই। একজনের হাতে টর্চ ছিলো। সে টর্চ ফেলতেই হলুদ গাছের আপাত লম্বাটে কিছুটা প্রশস্ত পাতার ভেতর থেকে স্পষ্ট হলো চোখজোড়া। এইসব চার ব্যাটারীর টর্চে অনেক দূরের জিনিস দেখা যায়, আকাশের দিকে ধরলে তারা স্পষ্ট হয়। গ্রামে রাত-বিরাতে চলাফেরার সময় স্বচ্ছল মানুষ বা ক্ষেত পাহাড়ায় টঙে বসে থাকলে হাতে রাখে। আজমত যদিও এর কোনটাই করে না তবে তার দায়িত্ব আরও জটিল। সে মেম্বার বাড়ির মূল পাহারাদার। বাড়ির পেছনের জামরুল গাছে কাঠবিড়ালি নড়াচড়া করলেও তার উপস্থিতি আজমতের জানা থাকে, সেখানে ভেতর বাড়িতে চুরির চেষ্টা তাও মনিবের ঘুমন্ত কন্যা! আজমতের নাড়ি ধরে কেউ টান দিয়েছে। তার পেছন পেছন আরো চার-পাঁচজন ছুটে এসেছে। চোর ঢুকেছে উত্তর পাড়ার আমবাগানের ভেতর। বেশি ভেতরে যেতে পারেনি, লাফিয়ে নীচু হয়ে যেতেই যায়গাটা ঘিরে ফিলেছে তারা। পেছন থেকে শুধু গেঞ্জি আর ঢলঢলে প্যান্ট দেখা গেছে । চোর উবু হয়ে বসেছে বড় গাছটার গোড়ায়। চোখ দেখে দু’পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে বিশাল দেহের আজমত। আজমতের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে আবার পল্টি খেয়ে উপরে উঠানো। পায়ের গোড়ালীতে ঘিন ঘিনে কাদা। বিকেলের দিকে বৃষ্টি নামায় এখানে সেখানে থকথকে ছিল হালট। সাথে থাকা একজন দৌড়ের উত্তেজনা সামলে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো
– ভাইজান গাইরা থুই? ঝামেলা মিটুক।
– আন্ধারে দ্যাহোস না আমারে? নিয়া চল।
চোরকে নিয়ে আসা হয়েছে তাও প্রায় ঘন্টাখানেক। সবাই যখন পরিণতি দেখতে উন্মুখ হয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা দিচ্ছে তখন মোটরসাইকেলের পেছনে বসে থাকা চেয়ারম্যান নামলেন উঠোনে। তিনি বুদ্ধিমান মানুষ, বললেন দাঁড়া দেখি আগে চুরি কি হইছে জাইনা নেই।
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বললেন। চোর কি আমার মাইয়া নিতে আইছিলো? তাইলে তো বড় শাস্তি পাওনা হইছে। মুনহাফ চোরা ভিড়ের ভেতর দাঁড়ানো ছিল। সেই সাহস করে বইলা উঠলো, আপনের মাইয়া চুরি করতে আইসে কেন মনে হইলো ? চুরি কইরা রাখতো কই?
– তুমি এত বুদ্ধি দিও না। ওই ঘরে ত সিন্দুক নাই, ঢুকছে কেন আর বাচ্চা বেইচা দিওয়া ওয়ান টুর মামলা মুনহাফ।
– পেট্রোল ঢাইলা বাচ্চা আগুন ধরায় দিওয়া যায় কিন্তু চুরি কইরা হজম করা অত সোজা!
আজমত পারলে মুনহাফকে ছিড়ে ফেলতো। চেয়ারম্যান হাত দিয়ে থামালেন। কথায় কোন কথা উঠে বলা যায় না। সুজন বলেছিল বউ বাপের বাড়ি আর ঘরের শিকলও ছিল টানা। এই কথা তার লোকজন সেদিন জানতো না, স্বীকার করলেও আসল খবর বেরিয়ে যাবে। সে প্রসঙ্গ পাল্টালো।
– আজমত দ্যাখ ত ওর গেঞ্জির তলায় কি?
আজমত চোরের দিকে এগিয়ে এলো।
মাথায় বটের ঝুরির মত জট তখনো অবিন্যস্ত। একদিন কেউ কাঁধে উঠে এই চুল আঁকড়ে ধরতো বলে আর কখনো জল-মাটির স্পর্শ পেতে দেয়নি তাই জটা ধরেছে। সে মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো পেটের কাছে। আজমত এক ঝটকায় হাত টেনে বের করলো গেঞ্জির ভেতর থেকে। সেই আলো-অন্ধকারের ভেতর প্রথমে বোঝা গেলো না ছোটো জিনিসটা কি। চোরের হাতের ভেতরেই রয়েছে তখনও, আজমত টর্চ ফেললো। বাস্তব দৃশ্য দেখে আনন্দ পেতে উৎসাহি দর্শকরা অপ্রস্তুত। সেদিন সকালে শামেলা যখন বড় বৌয়ের পায়ে তেল মাখছিল ময়না তখন এ বাড়ির উঠোনে খেলেছে। আজ দুপুরে সুজন পথ দিয়ে যাওয়ার সময় সেটা দেখেছে চেয়ারম্যানের মেয়ের হাতে। আর তখন থেকেই অপেক্ষা করেছে, সন্ধ্যায় সবার চোখ যখন টেলিভিশনে থাকবে তখন সে আসবে। চোরের হাতের ভেতর সেই জিনিসটা দেখে ঘটনার উত্তেজনা শেষ হয়ে সবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুনহাফ বললো —-আহারে সুজন পাগল! চেয়ারম্যান চুপ করে আছে। আজমতের মতো মানুষও সাহস পাচ্ছে না অতটুকু একটা সস্তা জিনিসের গায়ে হাত দিতে। চোর উঁচু করে সবার চোখের সামনে তুলে ধরলো। আমার ময়নার পুতুল …পুতুল চুরি করছি বলেই হা হা করে হাসলো জটা ঝুলে থাকা মুখের মানুষটা।