আগে বলা হতো পানির অপর নাম জীবন। ডিজিটাল যুগে এসে সেই কথারও উন্নতি হয়েছে। এখন বলা হয় বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। উন্নতি সত্যিই হয়েছে। কারণ, বুঝে না বুঝে পানি পান করলে জীবন আর জীবন থাকে না, মুঠোফোনের এসএমএসের ভাষায় গীবন (gibon) হয়ে যায়। বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন, তাই সবাইকে বিশুদ্ধ পানি পানের আহ্বান জানাই। কিন্তু কেবল আহ্বানে তো আর বিশুদ্ধ পানি মিলবে না। বিশুদ্ধ পানির সংস্থানও থাকা চাই, রাখা চাই। বিশুদ্ধ পানিকে বিশুদ্ধ রাখতে ঢাকা চাই।
বিষয় জলাতঙ্ক, আর শুরু করলাম বিশুদ্ধ পানি দিয়ে! বিশুদ্ধ পানি নিয়ে কয়েক লাইন লিখে আসলে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। শুরুতেই আতঙ্কের কথা লিখতে আর কার ভাল লাগে?
জলাতঙ্ক রোগটি সম্পর্কে প্রায় সবার’ই জ্ঞান আছে। অভিজ্ঞতা আছে হয়তো অল্প কিছু মানুষের। জলাতঙ্ক নিয়ে দু’কথা বলে মূল পর্বে যাচ্ছি। এক ধরনের ভাইরাসের আক্রমণে জলাতঙ্ক হয়। এই ভাইরাস মস্তিষ্কসহ পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। এ রোগের লক্ষণ দেখা দেওয়া মানে পরপারের ভিসা-টিকিট নিশ্চিত হওয়া। কিছু ওষুধ এবং সেবা-শুশ্রূষার মাধ্যমে রোগীকে কিছুটা ভাল রাখার চেষ্টা করা যায়। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে বেঁচে যাওয়ার নজিরও আছে। শিয়াল, ভালুক, বাদুড়, বেজি ইত্যাদি বন্য জীবজন্তুর কামড় বা থাবার মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে সংক্রামিত হতে পারে। এছাড়া লোকালয়ে থাকা কুকুর বা বিড়ালও জলাতঙ্কের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে প্রধানত কুকুরের কামড়েই জলাতঙ্ক হয়। বাহক প্রাণীর রক্ত এবং লালায় জলাতঙ্কের ভাইরাস থাকে। কেবল থাবা বা কামড় নয়, আগে থেকে থাকা ক্ষতস্থান প্রাণীর লালার সংস্পর্শে আসার কারণেও জলাতঙ্ক হতে পারে। এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় এবং ধীরে ধীরে পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে। কামড়ের দশদিন থেকে এক বছরের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। তবে গড়ে তিন থেকে সাত সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। আর সাধারণত লক্ষণ দেখা দেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হয়।
হাইড্রোফোবিয়া বা জলাতঙ্ক একটি প্রাণঘাতী রোগ হলেও সময়মতো ব্যবস্থা নিয়ে মৃত্যু এড়ানো যায়। এখন অবশ্য ‘হাইড্রোফোবিয়া’ না বলে ‘র্যাবিস’ বলা হয়। মূলত জলাতঙ্ক র্যাবিসের অনেকগুলো লক্ষণের একটি। বাতাসভীতিও এ রোগের একটি লক্ষণ। গ্রীক পুরাণে চার হাজার বছর আগেও জলাতঙ্ক রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই বলে এটিকে পৌরাণিক রোগ ভাবার কোন কারণ নেই। তাহলে বোঝা যাচ্ছে জলাতঙ্ক কতটা সিরিয়াস বিষয়। আমরা বাঙালি পাঠকমাত্রই সিরিয়াস যেকোন বিষয়ে প্রথমেই যাকে স্মরণ করি তিনি ড্যাশিং বুড়ো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে জলাতঙ্ক নিয়ে আলাপ করতে গেলেও তাঁর কথা ভুলে থাকা যাচ্ছে না। কারণ ঠাকুর বাবুও যে জলাতঙ্কে ভুগেছেন জীবনভর। বিস্মিত হওয়ার মতই তথ্য। আরও বিস্ময়কর সত্য হলো- এই তথ্য এই লেখার মাধ্যমেই প্রথম প্রকাশ করা হচ্ছে।
ঠাকুরপোর (ভাইপো-ভাইয়ের ছেলে; ঠাকুরপো-ঠাকুরের ছেলে) আষাঢ় কবিতাটি না পড়ে বোধহয় এযাবৎ কেউ হালের এসএসসি বা পুরাকালের ম্যাট্রিকুলেশন পাস করতে পারেননি। মনে আছে কবিতাটির কথা?
নীল নবঘনে আষাঢ়গগণে তীল ঠাঁই আর নাহি রে
ওগো, আজ তোরা কেউ যাসনে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিছে দেখ্ চাহি রে
ওগো, আজ তোরা কেউ যাসনে ঘরের বাহিরে।
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে
শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে
খেয়া পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে
পূবে হাওয়া বয় কূলে নেই কেউ
দুকূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ
দরদর বেগে জলে পড়ে জল ছলছল উঠে বাজি রে
খেয়া পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
ওগো আজ তোরা যাসনে গো, যাসনে ঘরের বাহিরে
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহিরে
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল
ওই বেনুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ চাহি রে
ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
চলুন এবার কবিতাটি বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্র’র র্যাবিস বা জলাতঙ্কের লক্ষণগুলো চিহ্নিত করি। আষাঢ় মাসে আকাশে মেঘ জমবে, গুরুগুরু আওয়াজ হবে, বজ্রপাত হবে দ্রিমিদ্রিমি এমনটাই তো স্বাভাবিক। অথচ আকাশে মেঘ দেখেই হাউ-মাউ শুরু করলেন শ্রীযুক্ত রবীন্দ্র। তিনি নিজে আতঙ্কিত বলে অন্যদের মধ্যেও সেই আতঙ্ক ছড়াতে চান। আর তাই সবাইকে ঘরের বাহিরে যেতে নিষেধ করছেন, বলা যায় প্রায় হাতে পায়ে ধরে। কবিতার শেষ চরণেই যার প্রমাণ আছে। আবার কেউ কেউ ধারণা করেন রবীন্দ্রবাবু কবিতাটি বুড়োকালে লিখেছিলেন। নাহলে বৃষ্টির দিনে রাস্তাঘাট পিছল হলে তিনি আতঙ্কিত হবেন কেন? রাস্তাঘাট পিছল হলে তাতে পিছল খাওয়া কতো মজার তা তো আর কোন বুড়োর পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। বুড়োরা তো স্বপ্নেও পিছল খেতে ভয় পান।
এবার আমরা রবীন্দ্রনাথের আরেকটি কবিতা চেখে দেখি। কবিতাটি- সোনার তরী।
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা
কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়া মসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
কবিতার নাম ‘সোনার তরী’ না রেখে রবীন্দ্রনাথ রাখতে পারতেন- জলাতঙ্ক-২। আষাঢ় কবিতাটি জলাতঙ্ক-১। সোনার তরীতে কবি ধান কাটা সারা হওয়ার কথা বলেছেন, আর ধান ঘরে তোলার আগেই বৃষ্টি এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে পারে সেই আশঙ্কা করেছেন। কবি এভাবে বৃষ্টি বিরোধী অবস্থান নেবেন ভাবতেই অবাক লাগে। ধান কাটা সারা হলে কৃষাণ-কৃষাণীরা বৃষ্টিতে আমোদিত হবে। নতুন ধানের চাল থেকে পিঠাপায়েস খাবে। ইলিশ মাছ দিয়ে খিচুড়ি খাবে। ঘরে ঘরে শুয়ে বসে চাষের ক্লান্তি দূর করবে এটাই তো স্বাভাবিক।
পড়ুন-
যখনি শুধাই, ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাসো শুধু, মধুরহাসিনী–
বুঝিতে না পারি, কী জানি কী আছে
তোমার মনে।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকূল সিন্ধু উঠিছে আকুলি,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন
গগনকোণে।
কী আছে হোথায়– চলেছি কিসের
অম্বেষণে?
বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমায়
অপরিচিতা–
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে
দিনের চিতা,
ঝরিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিকবঁধূ যেন ছলছল-আঁখি
অশ্রুজলে,
হোথায় কি আছে আলয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার,
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির
চরণতলে?
তুমি হাসো শুধু মুখপানে চেয়ে
কথা না ব’লে।
হু হু ক’রে বায়ু ফেলিছে সতত
দীর্ঘশ্বাস।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন
জলোচ্ছ্বাস।
সংশয়ময় ঘননীল নীর,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া
দুলিছে যেন।
তারি ‘পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি ‘পরে পড়ে সন্ধ্যাকিরণ,
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি
হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝি না কী লাগি তোমার
বিলাস হেন।
যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি
“কে যাবে সাথে’
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে
নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিম-পানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আলো আশার মতন
কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায়
সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল
কথা না ব’লে।
তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ
কখনো রবি–
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর, কখনো
শান্ত ছবি।
বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়–
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন
অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়,
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি
তিমির-তলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন
কথা না ব’লে।
আঁধার রজনী আসিবে এখনি
মেলিয়া পাখা,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ-আলোক
পড়িবে ঢাকা।
শুধু ভাসে তব দেহসৌরভ,
শুধু কানে আসে জল-কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব
কেশের রাশি।
বিকল হৃদয় বিবশ শরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর,
“কোথা আছ ওগো করহ পরশ
নিকটে আসি।’
কহিবে না কথা, দেখিতে পাব না
নীরব হাসি।
আরও শতশত উদাহরণ পাওয়া যাবে রবীন্দ্রনাথের জলাতঙ্কে আক্রান্ত হওয়ার। রবীন্দ্রনাথের পর আর কোন সাহিত্যিককে আলোচনায় আনা যায়? জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ আলোচনায় আসতে পারেন। তিনি একটা উপন্যাসের নাম দিলেন- আমার আছে জল। পরে সেটিকে তিনি সেলুলয়েডেও চড়িয়েছেন। এখন কথা হলো, আমার আছে জল লিখে বা সিনেমা বানিয়ে হুমায়ূন কি প্রমাণ করতে চাইলেন তিনি জলদ। জল দান করেন যিনি তাকেই নাকি জলদ বলা হয়। তিনি দান করতে যাবেন কেন? ঠিক আছে মানলাম লেখক দাতা না হলেও চলে। তবে তো বলতেই হয়, তিনি জলকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। গ্রীষ্ম থেকে শীতের শুরু অব্দি ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে পানির জন্য হাহাকার থাকে। সে সময় যদি কেউ বলে বসে- আমার আছে জল। কী একটা কৌতুক হবে তা অনুমেয়। আসলে কি হুমায়ূন লিখতে চেয়েছিলেন- আমার আছে জলাতঙ্ক? হতেও পারে। কারণ তাঁর প্রায় প্রতিটি নাটক সিনেমাতেই মাথা গরম একটা চরিত্র দেখা গেছে। যার কাজ লাফ দিয়ে পানিতে নেমে ডুব মেরে থাকা। জলাতঙ্কের রোগীরা জলকে ভয় পায়। হুমায়ূনও সেই ভয়ে ভীত কিন্তু কথাটি লুকোতে হয়তো এই কৌশল তাঁর। আরেকটি বিষয়- আমার আছে জল কথাটি তো বলবে ঢাকা ওয়াসা। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের কাজই হলো জল সরবরাহ ও নিষ্কাষণ করা। অথচ তারা তা বলে না, বলেন হুমায়ূন আহমেদ।
অবাক জলপানের কথা মনে আছে? ওই যে সুকুমার রায় লিখেছেন। তেষ্টায় কাতর এক পথিক জলের সন্ধানে জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও কাউকে বোঝাতে পারছিলেন না তার চাহিদাটা কী। নিন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হয়ে পড়ুন তবে সেই লেখাটি-
পথিক- মশাই, একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
ঝুড়িওয়ালা- জলপাই? জলপাই এখন কোথায় পাবেন? এ তো জলপাইয়ের সময় নয়।
কাঁচা আম চান তো দিতে পারি।
পথিক- না, না, আমি তা বলিনি।
ঝুড়িওয়ালা- না, কাঁচা আম আপনি বলেননি, কিন্তু জলপাই চাচ্ছিলেন কিনা, তা তো আর এখন পাওয়া যাবে না, তাই বলছিলুম।
পথিক- না হে, আমি জলপাই চাচ্ছিনে।
ঝুড়িওয়ালা- চাচ্ছেন না তো, ‘কোথায় পাবো’ ‘কোথায় পাবো’ কচ্ছেন কেন? খামোখা এরকম করবার মানে কী?
পথিক- আপনি ভুল বুঝছেন-আমি জল চাচ্ছিলাম।
ঝুড়িওয়ালা- জল চাচ্ছেন তো ‘জল’ বললেই হয়-‘জলপাই’ বলবার দরকার কী? জল আর জলপাই কি এক হলো? আলু আর আলুবোখরা কি সমান? মাছও যা আর মাছরাঙাও তাই? বরকে কি আপনি বরকন্দাজ বলেন? চাল কিনতে গিয়ে কি চালতার খোঁজ করেন?
পথিক- ঘাট হয়েছে মশাই। আপনার সঙ্গে কথা বলাই আমার অন্যায় হয়েছে।
ঝুড়িওয়ালা- অন্যায় তো হয়েছেই। দেখছেন ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছি-তবে জল চাচ্ছেন কেন?
ঝুড়িতে করে কি জল নেয়? লোকের সঙ্গে কথা কইতে গেলে একটু বিবেচনা করে বলতে হয়।
২.
বৃদ্ধ- কে ও? গোপলা নাকি?
পথিক- আজ্ঞে না, আমি পুবগাঁয়ের লোক-একটু জলের খোঁজ কচ্ছিলুম-
বৃদ্ধ- বলো কী হে? পুবগাঁও ছেড়ে এখানে এয়েছো জলের খোঁজ করতে?-হাঃ হাঃ হাঃ।
তা যাই বলো বাপু, অমন জল কিন্তু কোথাও পাবে না। খাসা জল। তোফা জল।
চমৎকার জল।
পথিক- আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই সকাল থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেজায় তেষ্টা পেয়ে গেছে।
বৃদ্ধ- তা তো পাবেই। ভালো জল যদি হয়, তা দেখলে তেষ্টা পায়, নাম করলে তেষ্টা পায়, ভাবতে গেলে তেষ্টা পায়। তেমন জল তো খাওনি কখনও?-বলি ঘুমড়ির জল খেয়েছো কোনোদিন?
পথিক- আজ্ঞে না, তা খাইনি।
বৃদ্ধ- খাওনি? অ্যাঃ ঘুমড়ি হচ্ছে আমার মামাবাড়ি-আদত জলের জায়গা। সেখানকার যে জল, সে কী বলবো তোমায়? কত জল খেলাম-কলের জল, নদীর জল, ঝরনার জল, পুকুরের জল-কিন্তু মামাবাড়ির কুয়োর যে জল, অমনটি আর কোথাও খেলাম না।
পথিক- তা মশাই আপনার জল আপনি মাথায় করে রাখুন।আপাতত এখন এই তেষ্টার সময় যা হয় একটু জল আমার গলায় পড়লেই চলবে।
বৃদ্ধ- তা হলে বাপু তোমার গাঁয়ে বসে জল খেলেই পারতে? পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে জল খেতে আসবার দরকার কী ছিল? ‘যা হয় একটু হলেই হলো’ ও আবার কী রকম কথা? আর অমন তাচ্ছিল্য করে বলবারই বা দরকার কী? আমাদের জল পছন্দ না হয় খেয়ো না-ব্যস। গায়ে পড়ে নিন্দে করবার দরকার কী? আমি ওরকম ভালোবাসিনে। হ্যাঁ।
সুকুমার রায়ের পর আর আমার কি সাধ্য আছে জলাতঙ্ক নিয়ে কিছু বলার? নাকি আমি এর ব্যাখ্যা দিতে পারবো?
জলাতঙ্কে আক্রান্ত সাহিত্যিকদের কাছ থেকে এবার অন্য জগতে যাওয়া যাক। জল কামানের দৃশ্য বছর দুয়েক আগেও প্রায় প্রতিদিনই টেলিভিশনে দেখা যেতো। হলুদ একটা গাড়ি, ট্যাংকের মতো। ওপরে দুইটা নল। দেখতে হ্যান্ডসাম। অথচ যন্ত্রটার কাজ কিন্তু মন্দ। জলাতঙ্ক ছড়ানোর জন্যই এটা ব্যবহার হয় দেশে-বিদেশে। তাই কেউ কেউ আদর করে এটাকে জলপিপিও বলেন। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং ইত্যাদি ছত্রভঙ্গ করতে এবং বিরোধীপক্ষের মানুষকে সনাক্ত করতেও জলপিপি মাঠে নামে। যন্ত্রটির নল থেকে গরম জলও বের হয়। বের হয় রঙিন জলও। উদ্দেশ্য গরম পানি দিয়ে ভয় দেখানো। আর রঙিন পানির কাজ হলো- কে কে ছিলো ওখানে তাদের ধরতে সহায়তা করা। তার মানে পশুপাখিই কেবল এই রোগটির জন্য দায়ী নয়। মানুষও দায়ী। কারণ মানুষের মাথা থেকেই জলপিপি আবিষ্কারের চিন্তা এবং তা বাস্তবায়ন হয়েছে।
মানুষ-পশু যাই বলি না কেন, রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হওয়াই তার স্বাভাবিক ধর্ম। কারণ মৃত্যুর দিকে পতিত হওয়ার জন্য তার কোন কোন উসিলা তো লাগবেই। তাই বলে একটি দেশও জলাতঙ্কে আক্রান্ত এমন খবরও তো হরহামেশাই আমরা দেখতে পাই। খুব দূরে যেতে হবে না প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিও জলাতঙ্কে আক্রান্ত। বিশ্বাস হলো না? খোলাসা করছি। তিস্তা নদীর কথা একবার ভাবুন তো? কতটুকু জল আমাদের পাওয়ার কথা আর ভারত দিচ্ছে কতটা? তিস্তা নিয়ে চুক্তি হবে হবে করেও হচ্ছে না অনেক বছর। কেন হচ্ছে না। কারণ পশ্চিমবঙ্গ জলাতঙ্কে আক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গের ধারণা ওদের সুইসগেট খুলে দিলে আমাদের তিস্তা নদী ওদের সব পানি শুষে খাবে। আরে বেকুব নদী কী আর রাজনীতিক যে না পারলেও গিলবে? জল হারানোর আতঙ্ক কি জলাতঙ্ক নয়?
আরও একধরণের জলাতঙ্ক আছে। যাতে প্রায় সব মানুষই একটা বয়সে গিয়ে আক্রান্ত হয়। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই জলাতঙ্ককে অন্য একটি নামে নামকরণ করা হয়েছে। অনেকেই নামটা বলতে চান না লজ্জায়। রোগটির প্রকাশমুখ হচ্ছে মানব দেহের লজ্জাস্থান। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই রোগে আক্রান্ত হন। যেকোন বয়সের মানুষই রোগটিতে আক্রান্ত হতে পারেন। আপনারা কী কিছু ধারণা করতে পারছেন? বহুমূত্র। ঘন-ঘন মূত্রত্যাগ করাকেই বহুমূত্র বা ডায়াবেটিক বলা হয়। মূত্র বা হিসু তো শেষমেষ জল’ই নাকি? জল ভিন্ন অন্য কিছু কেউ কি হিসু হিসেবে ত্যাগ করতে পেরেছেন কখনও? এয়ারপোর্টের টয়লেটে গেলে অবশ্য অনেকেই স্বর্ণ ত্যাগ করেন মল-মূত্র হিসেবে। কথায় আছে ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না। তাহলে বোঝা যাচ্ছে জলত্যাগের যে আতঙ্ক সেটাও জলাতঙ্ক।
এবার রাজনীতির ময়দানে দৃষ্টিপাত করা যাক। কী হয় এখানে? সবাই জানেন। ভোটের জন্য দলগুলোর নেতারা বড়-বড় কথা বলেন। বাস্তব-অবাস্তব আশ্বাস দেন। ক্ষমতা পেলে আশ্বাসের কথা ভুলে যান। রাজনীতি আর জলাতঙ্কের মিল কোথায় এই প্রশ্নটি আগে আমার মাথায়ও কুটকুট করতো। যখনই গবেষণায় নামলাম, দেখতে পেলাম রাজনীতি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মানুষ জলাতঙ্কে আক্রান্ত। জলাতঙ্কের লক্ষণগুলো একটু পড়ুন- ক্ষতস্থান চুলকানো, ক্ষতস্থানে ব্যথা, মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হওয়া, উত্তেজনা, স্বল্পমাত্রার জ্বর, গিলতে সমস্যা হওয়া, পানি পিপাসা থাকা, পানি দেখে ভয় পাওয়া, মৃদু বায়ু প্রবাহে ভয় পাওয়া, আবোল-তাবোল বকা, প্যারালাইসিস ইত্যাদি। চুলকিয়ে ক্ষত করা আর সেই ক্ষতস্থানে লবণ মাখিয়ে চুলকানোই তো রাজনীতিকদের কাজ, নাকি? আবার ধরেন তারা লোভের লালা নি:সৃত করেন। জলাতঙ্কের আরেকটা লক্ষণ হলো- উত্তেজনা। রাজনীতিবিদদের কথায় উত্তেজনা, কাজে উত্তেজনা, চিন্তায় উত্তেজনা, খাওয়ায় উত্তেজনা, ঘুমে-জাগরণে উত্তেজনা। রাজনীতির উত্তেজনার মৃদু হাওয়া বইলেই সাধারণের জীবন খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। আর যখন ঝড়ো হাওয়া বা, দমকা হওয়া বয় তখন আমার মতো আমজনতা লারেলাপ্পা গাইতে থাকে মরার ডরে। স্বল্পমাত্রার জ্বর তো রাজনীতির ময়দানেই থাকে। জ্বর মানেই তাপ-উত্তাপ। জ্বর থাকলে তো গিলতে বা খেতে সমস্যা হবেই। আর পানি পিপাসা এবং পানি থেকে ভয় পাওয়া নাকি জলাতঙ্কের বড় লক্ষণ। এই লক্ষণই তো রাজনীতিকদের মধ্যে বেশি প্রকট। পিপাসা কেবল? রাজনীতিবিদদের পিপাসার কোন শেষ আছে? আর শুধু পিপাসা? তাদের ক্ষুধারও কি শেষ আছে? তারা তো সব কিছু গিলে খেতে চায়। গিলে খাওয়া ছাড়া তাদের কোন কাজই নেই। জনগণের সামনে মুলোটা ঝুলিয়ে রেখে রাজনীতিবিদরা সব কিছু খায়। তারা প্রকাশ্যে খায়, গোপনেও খায়। আর দুটো উদাহরণ হলো- মৃদু বায়ু প্রবাহে ভয় পাওয়া, আর আবোল-তাবোল বকা। শেষ লক্ষণ প্যারালাইসড হয়ে যাওয়া।
এবার আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জলাতঙ্কের কথা বলি। আন্তর্জাতিক জলাতঙ্কে কিন্তু বাংলাদেশ লাভবান। কারণ এই রোগ প্রতিরোধে বাংলাদেশ পেয়েছে বিপুল সুদমুক্ত অফেরৎযোগ্য অর্থ সহায়তা। দারুণ ব্যাপার। জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল হিসেবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত ভীতি ও সতর্কতাও একটি জলাতঙ্ক।
উপরোক্ত আলোচনার পরও যদি জলাতঙ্ক নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন থাকে তবে সোজা মহাখালীর জলাতঙ্ক হাসাপাতালে যোগাযোগ করতে পারেন। তথ্য বলছে, জলাতঙ্ক রোগের কারণে পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ষাট হাজার লোকের মৃত্যু হয়। এর প্রায় দুই হাজার জনের’ই মৃত্যু ঘটে বাংলাদেশে। প্রতিবছর কুকুর-বিড়ালের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে জলাতঙ্কের ঝুঁকিতে পড়ে প্রায় তিন লাখ মানুষ। ভারতের পর বাংলাদেশে জলাতঙ্কজনিত রোগীর মৃত্যুসংখ্যা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।