চারু ও আত্মজঃ নকশালবাড়ির পঞ্চাশ বছর পরে এক বিপ্লবী পিতার উত্তরাধিকারের কথা ।। অনুবাদঃ রোকেয়া সামিয়া

২৮ জুলাই, ১৯৭২

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিলো সেদিনও। সশস্ত্র পুলিশের কব্জায় থাকা নিরাপত্তার এক কঠিন গোপনীয় আবহে কলকাতার এসএসকেএম মেডিকেল কলেজ থেকে কেওড়াতলা শ্মশানে নিয়ে আসা হচ্ছে এক প্রাণহীন দেহ। মনে হচ্ছিলো যেন কেউ শহরে কার্ফু জারি করেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর নিষ্প্রাণ দেহটি পৌঁছুল শ্মশানে।

সেখানেও প্যারামিলিটারি আর অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশের প্রহরা। এক নারী, দুজন মেয়ে এবং একটি ছেলে – শোকে কাতর একই পরিবারের চারজন মানুষ এই পুলিশের জঙ্গলের মাঝে একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এক পুলিশ ছেলেটির হাতে মশাল তুলে দিলো তার বাবার চিতায় আগুন ধরাবার জন্যে।

এভাবেই বিপ্লবী চারু মজুমদারের নশ্বর দেহটি আগুনের হাতে সমর্পিত হলো। তিনি ছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলন এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) রাজনৈতিক এবং ভাবাদর্শের প্রণেতা। যে মানুষটি সর্বজনশ্রদ্ধেয়, সেই মানুষটিই সরকারের চোখে ছিলেন সবচে ভয়ংকর শত্রু। তাকে তুলে ধরা হয়েছিলো সহিংস বা নাশকতার রাজনীতির প্রতীক হিসেবে।

ঘটনাটি ঘটেছিলো আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। কিন্তু চিতা থেকে যে আগুনের শুরু তা আজো সাতান্ন বছর বয়েসী অভিজিৎ মজুমদারের স্মৃতিতে জ্বলছে। তিনি তার বাবার পা এক নজর দেখেছিলেন যে পায়ের স্মৃতি তার মনে জ্বলন্ত অঙ্গারের রেখা ফেলে যাচ্ছে আজও – তার বাবা মারা গেছিলেন পুলিশি হেফাজতে। তার পায়ের রং রূপান্তরিত হয়েছিলো কুচকালোতে।

এমন এক বাবার সন্তান হওয়াটা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। তাকে প্রতিনিয়ত এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো – তিনিও কি তার বাবার পথেই এগোচ্ছেন? তার রাজনৈতিক লক্ষ্যগুলোও কি তার বাবারই মতন? এ ধরণের সন্তানদের গণমাধ্যমসহ নানা জায়গা থেকে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়।

“ক্ষমতার উৎস আগ্নেয়াস্ত্র”- সেই ছেলেবেলাতেই কলকাতার দেয়ালে চক দিয়ে লিখলেও বহু বছর রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন অভিজিৎ। তার বাবার মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। বর্তমানে তিনি দার্জিলিং’র সিপিআই (এম-এল)’ লিবারেশানের জেলা সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। শিলিগুড়ির এক কলেজে ইংরেজিও পড়ান।

একই দল হলেও, তার বাবার দলের তখনকার ‘লিবারেশান’ বা সংগ্রামের ধরণের চাইতে অভিজিতের এখনকার দলের সংগ্রামের ধরণ অনেক আলাদা। তারা ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ নয় বরং নির্বাচনেই নিজেদের প্রমাণ করতে চায়।

এই সাক্ষাৎকারে অভিজিত নকশালবাড়ি, তার বাবা-মা এবং নব্য বাস্তবতাগুলো নিয়ে বিস্তারিত বলেছেন। তিনি অকুণ্ঠে জানিয়েছেন ‘আমার বাবাই আমার হিরো’। কেবল একটাবারই তার চোখভরে এসেছে জল – যখন তার মুখে ফোটা শব্দে ছিলো তার মা, লীলা।


“আমরা বুলেটে মরতে পারি কিন্তু ক্ষুধায় মরবো না!”


নকশালবাড়ির প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে। আপনি কি সেই দিনগুলোর কথা মনে করতে পারেন আজও?

যখন নকশালবাড়ি আন্দোলন হচ্ছিলো তখন আমার বয়স মাত্র সাত বছর। তাই আমি হয়তো আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলতে পারবো না। তবে একটা কথা বলতেই হবে। শান্তিপূর্ণ এক নারীদলের ওপর পুলিশ ১৯৬৭ সালের ২৫ মে গুলি চালায়। সেদিন আটজন নারী, দুজন শিশু এবং একজন পুরুষ নিহত হয়। এ ধরণের ঘটনা আজো চলছে… নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, ভাঙ্গর… কেবল পশ্চিমবঙ্গেই নয়… দেশের বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে।

নকশালবাড়ি ঐতিহ্যগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এই ব্যাপারে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সবাই এ সম্পর্কে জানেন… কিভাবে হয়েছে বা এ ধরণের বিষয়। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির আবরণে নকশালবাড়ি আন্দোলন হবার পেছনে কি ঘটেছিলো তা খুব কম মানুষই জানেন। অনেকেই মনে করেন এ কেবল এক সুন্দর সকালে হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোন সংগ্রামের ঘটনা। এটা সত্যি নয়। এটা অনেকগুলো ধারাবাহিক ঘটনার ফল। অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের বহু বছরের কঠোর সাধনা এর পেছনে ছিলো।

নকশালবাড়িতে যা ঘটেছিলো তাতো সশস্ত্র সংগ্রামই, তা নয় কি?

হ্যাঁ…এটা তো অবশ্যই একটা সশস্ত্র সংগ্রাম ছিলো। নকশালবাড়ি আর তার আশেপাশের অঞ্চলগুলো আসলে আদিবাসীদের এলাকা ছিলো। সেখানে বাস করা চা-শ্রমিক এবং কৃষিশ্রমিকরা ভূমিহীন ছিলেন এবং জমিদারদের কাছ থেকে তাদের প্রচণ্ড শোষণের শিকার হতে হতো। এই শোষন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ছিলো এই সংগ্রাম। তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র দিয়েই বিদ্রোহ করেছিলেন। কৃষকদের কোন বন্দুক বা বুলেট বা বোমা ছিলো না। রাষ্ট্রের হাতেই বরং এমন অস্ত্র ছিলো। পুলিশের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বাজেয়াপ্ত করার একটা পরিষ্কার আহবান ছিলো।

আসলে নকশালবাড়ি ছিলো তেভাগা আন্দোলনেরই একটা ধারাবাহিকতা। তেভাগা হয়েছিলো ১৯৪০ সালের শেষের দিকে উত্তরবঙ্গ এবং কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে যে এলাকাগুলো এখন বাংলাদেশের অংশ। যখন তেভাগা আন্দোলন চলছিলো তখন তেলেঙ্গানায় গরীব কৃষক এবং শ্রমিকদের সশস্ত্র সংগ্রামও চলছিলো। এই তেভাগা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আর শিক্ষার জোরেই চারু মজুমদার, কানু স্যানাল, জঙ্গল সাঁওতাল, শরণ ঘোষদের মত নেতা এবং অন্যান্য নেতারা চা-শ্রমিক এবং কৃষিশ্রমিকদের সংগঠিত করা শুরু করেন। যেমনটা আপনাকে বলেছিলাম… বহু বছর ধরেই এই কাজ চলছিলো।

আপনি তেভাগা আন্দোলন নিয়ে কিছু বলবেন?

তেভাগা হয়েছিলো ১৯৪৬-৪৭ সালে। তেভাগা মানে তিনভাগের দুইভাগ। সেইসময় ভূমিহীন ভাগের চাষীরা ফসল ফলালেও যা উৎপাদন করতেন তার অর্ধেকটাই জমিদারদের দিয়ে দিতে হতো। তাদের বলা হত ‘আধিয়ার’ কারণ তারা যা উৎপাদন করতেন তার আধাআধি কর হিসেবে আলাদা করে ফেলতে হতো। তারা ছিলেন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের মতো। তারা এমনকি তাদের উৎপাদনের আদ্ধেকও পেতেন না। ১৯৩০ সালের শেষের দিকে কমিউনিস্টরা এই সমস্যাটিকে আমলে নিয়ে প্রতিবেশী জেলা জলপাইগুড়িতে এই ভাগচাষীদের সংগঠিত করতে থাকেন। ঠিক এই সময়টাতেই আমার বাবা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। এটা ছিলো ১৯৩৯ সালের ঘটনা যখন তার বয়স ছিলো বিশ। ভাগচাষীরা এই বিষয়টার জোর দেয়া শুরু করলো যে তারা যা উৎপাদন করবে তার তিনভাগের একভাগই কেবল তারা জমিদারদের দেবে। যখন তারা সংগঠিত হয়ে গেলো তখন যারা যেটা উৎপাদনের যোগ্য তা উৎপাদন করা শুরু করলো। আন্দোলনটা ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠলো। একইসাথে রাষ্ট্রের নিপীড়নের হাতও কঠোর হয়ে উঠলো। ১৯৪২ সালের মধ্যে চা-শ্রমিক এবং রেলশ্রমিকদের মধ্যেও পার্টির প্রভাব ছড়িয়ে পড়লো। পরের বছর হলো মহাদুর্ভিক্ষ। শ্রমিকেরা না খেয়ে ছিলো। চারু মজুমদার এবং অন্যান্য নেতারা সবাইকে এক হবার ডাক দিলেন। তারা জমিদারদের শস্যের গোলা আক্রমণ করে সেখান থেকে শস্য নিয়ে আসতে বললেন। সেই সময়ের স্লোগান ছিলো “আমরা বুলেটে মরতে পারি কিন্তু ক্ষুধায় মরবো না!”। খুব দ্রুত এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো। কৃষিশ্রমিক আর চাশ্রমিকেরা একসাথে সমাবেশ করলেন। বিদ্রোহ একসময় তেতে উঠলো। শ্রমিকেরা ফসল ফলালেন, শস্যের গোলা আক্রমণ করলেন এবং সেই শস্যভান্ডার সবার মাঝে বিতরণ করলেন। এই বিদ্রোহকে বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রের নিপীড়ন আরো নির্মম হতে থাকলো। এমনি এক সমাবেশে চাষীরা পুলিশের কাছ থেকে রাইফেল কেঁড়ে নেবার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থলেই এগারো জন কৃষিশ্রমিক নিহত হয়।

বিদ্রোহ কি এরপর চলেছিলো?

হ্যাঁ। নেতারা চাষীদের একত্রিত করা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৫৩ সালে নেহরুর সরকার জমিদারি প্রথা বিলোপের এক আইন পাশ করে। কিন্তু এই আইনটি বাস্তব প্রয়োগের জন্যে ছিলো না। এটা ছিলো কেবল জনগণের চোখে ধুলো দেবার জন্য। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ এই ব্যাপারটিকেও তুলে ধরেন। ১৯৫৯ সালে পার্টির জমিদারদের কাছ থেকে বেঁধে দেয়া জমির সীমার বাইরে যে অতিরিক্ত জমি তা কেড়ে নেবার ডাক দেন। আন্দোলনটা দিনকে দিন জোরদার হতে থাকে। কিন্তু পার্টি মনে করতে থাকে এটা তাদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই আন্দোলন বন্ধের নির্দেশ দেয়। আমার বাবাকে ১৯৫২ সালে তার জায়গা শিলিগুড়িতে ফিরে আসতে হয় এবং তিনি দার্জিলিং জেলার চাষীদের সংগঠিত করতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। পার্টির কেন্দ্রীয় এই সিদ্ধান্তে আমার বাবার মতো জেলার দায়িত্বে থাকা নেতারা খুবই অসন্তুষ্ট ও হতাশ হন। পার্টির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে তারা চাষী ও চা-শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজটি চালিয়ে যেতে থাকেন যাতে তারা অতিরিক্ত জমি কেড়ে নিতে পারেন এবং জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন। এটাই শেষে নকশালবাড়ি আন্দোলনে পরিণত হয়।

চারু মজুমদার কি বাবা হিসেবে খুব কঠোর প্রকৃতির ছিলেন?

না, তেমন একটা না। তিনি খুবই যত্ন করতে এবং ভালোবাসতে জানতেন। শ্রমিকদের শ্রেণিশত্রু নিধনে এক নির্মম ও নিষ্ঠুর বিপ্লবী হিসেবে তার যে ইমেজ সেটা রাষ্ট্র এবং মিডিয়াই দাঁড় করিয়েছে। তিনি কখনোই এমন ছিলেন না। তিনি আমাদের খুব কমই সময় দিতে পারতেন। কিন্তু যখনই তিনি বাড়িতে থাকতেন আমাদের খেয়াল রাখতেন। রাজনীতিই শুধু তার একমাত্র আগ্রহের জায়গা ছিলো না। তিনি সাহিত্য আর শাস্ত্রীয় সংগীত ভালোবাসতেন। তিনিই আমার বোনদের (তার বড় বোন অনিতা একজন চিকিৎসক এবং তার দ্বিতীয় বোন মধুমিতা একজন শিক্ষিকা) এবং আমাকে এই ক্ষেত্রগুলোর সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেন। তিনি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের সাথেও পরিচয় করান। শুধু বাংলা সাহিত্যই নয়, তিনি আমাদের ইংরেজি উপন্যাসও পড়তে বলতেন। তিনি বলতেন, ইংরেজি শেখার জন্য শুধু ব্যাকরণ শিখলেই হয় না, ভালো ইংরেজি বইও পড়তে হয়। আমার বাবাই আমার হিরো।

আপনি বলছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় আপনার বয়স মাত্র সাত বছর ছিলো। কি ধরণের শৈশব আপনি পেয়েছিলেন?

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শৈশব অন্যরকম ছিলো। আমাদের বন্ধুরা যেভাবে বেড়ে উঠছিলো আমরা সেভাবে বেড়ে উঠিনি। আমাদের বাড়িটিই ছিলো পার্টির অফিস। সবসময় মানুষ আসতো-যেতো। পার্টির নেতা, ক্যাডার আর ছাত্ররা হরদম আমার বাবার সাথে দেখা করতেন। শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু আর কেরালা থেকেও লোকজন আসতেন। শ্রীকাকুলাম থেকে আসা পঞ্চাদি কৃষ্ণমূর্তিকে পালাসায় পুলিশ যখন মেরে ফেলে, তখন তিনি আমার বাবার সাথে দেখা করে ফিরে যাচ্ছিলেন।
আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেক নেতার সাথে দেখা হবার প্রচুর সুযোগ আমাদের হয়েছিলো। বিপ্লব শব্দটা আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে একটা আটপৌরে শব্দের মতোই ছিলো। অবশ্যই আমরা বাচ্চারা রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না কিন্তু আমরা ভাবতাম এই বিপ্লবে আমাদেরও ভূমিকা আছে। বিপ্লব সম্পর্কে কিছু না জানলেও, আমরা যেন খুব বড় বিপ্লবী তেমন একটা ভাব করতাম। আমাদের কাছে এটা একটা এডভেঞ্চারের মত ছিলো। আন্দোলনের স্লোগানগুলো এরই মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। আমরাও এই স্লোগানগুলো চিৎকার করে বলতে বলতে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের বাড়িতে কাঠের দেয়ালের একটা ছোট্ট ঘর ছিলো। এটা সাধারণত ভাড়া দেয়া হতো। কিন্তু নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় সেটা খালি ছিলো। আমরা বাচ্চারা সেখানে একসাথে হতাম। আমার এখনো মনে আছে আমরা সেই কাঠের দেয়ালে চক দিয়ে এলোমেলো হাতে বড় বড় অক্ষরে আন্দোলনের স্লোগানগুলো লিখতাম যেমন “রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস আগ্নেয়াস্ত্র”, “চীনের চেয়ারম্যান আমাদেরও চেয়ারম্যান” (হেসে)।
আমরা ভেবেছিলাম বিপ্লব আসলে খুব বড় কোন একটা এডভেঞ্চার।

আপনাদের বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিলো? সাংসারিক খরচগুলো কিভাবে চালানো হতো?

আমরা মধ্যবিত্ত পরিবার ছিলাম। হ্যাঁ, অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমাদের মা (লীলা মজুমদার) ইন্স্যুরেন্সের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতেন যেটা আমাদের একমাত্র অর্থের উৎস ছিলো। আমাদের সাথে আমাদের কিছু আত্মীয়ও থাকতেন। মা সবার খেয়াল রাখতেন। তাকে খুব কঠোর পরিশ্রম করতে হতো। পলিসি নেবার জন্য বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মানুষকে বোঝানো, আমাদের খেয়াল রাখা…আমরা সত্যিই তার কাছে সবকিছু…যেভাবে তিনি আমাদের সুশিক্ষা দিয়েছেন… সবকিছুর জন্য ঋণী…

তার কি রাজনীতিতে কোন আগ্রহ ছিলো?

মা’র সম্পর্কে অনেককিছু বলার আছে। আসলে তার সম্পর্কে বলতেই আমার বেশি ভালো লাগে। সবাই আমার বাবা সম্পর্কে জানেন। তাকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার মাকে নিয়ে খুব কম মানুষই জানেন। তিনি আমার জীবনে দেখা সবচে সাহসী নারী। তিনি ভেতরে বাইরে সবদিক থেকে রাজনৈতিক ছিলেন। তিনি তার তেরো চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই রাজনীতি নিয়ে শুনেছেন, কথা বলেছেন, সেখানে নিঃশ্বাস নিয়েছেন।
মায়ের বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার, হরেন্দ্র সেনগুপ্ত। তিনি সরকারি চাকরী করতেন। তার শেষ পোস্টিং ছিলো জলপাইগুড়ি জেলার রাজগঞ্জে। সেই সময় মায়ের বয়স ছিলো তেরো কি চৌদ্দ বছর। সেই দিনগুলোতে সেখানে অনেক মুক্তিসংগ্রামী আসতেন। তাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে মামলা ছিলো বলে তারা জেলা থেকে বেরোতে পারতেন না। সেই আলোকিত ডাক্তারটির চেম্বারে বিভিন্ন ধরনের খবরের কাগজ থাকতো। মুক্তিসংগ্রামীরা সেখানে আসতেন, খবরের কাগজ পড়তেন আর রাজনীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। মা তাদের চা দিতেন, তাদের সাথে বসতেন এবং তাদের আলোচনা মন দিয়ে শুনতেন। এভাবে তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অনুভূতি জোরদার হয়। পরে তিনি কমিউনিস্ট হন। মা পার্টির নারীদলের মধ্যে এবং তেভাগা আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। তারপরে তিনি জলপাইগুড়ি জেলায় পার্টির একজন নেতা হন। তিনি ১৯৪৮ সালে যখন পার্টি নিষিদ্ধ ছিলো, তখন জেল খাটেন। ১৯৫০ সালেও তিনি জেল খাটেন। 

তিনি কি পার্টির সাথে সবসময় ছিলেন নাকি অন্য কোন জায়গাতেও কাজ করতেন?

তিনি সবসময়ই একজন কর্মজীবী নারী ছিলেন। মা কিন্ডারগার্টেনে পড়াতেন। তিনি খুব বড় পরিবার থেকে এসেছিলেন। তাই তাকে কাজ করতে হতো।

তো আপনার মা ও বাবার প্রথম দেখা জলপাইগুড়িতেই হয়?

হ্যাঁ। ১৯৪০ সালের দিকে। তারা দুজনেই কমরেড ছিলেন। তারা পার্টির সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। তারা একসাথে কাজ করতেন, একজন আরেকজনের সম্পর্কে জানলেন এবং জীবনসঙ্গী হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের বিয়ে হয় ১৯৫২ সালে। এরপরে তারা শিলিগুড়িতে চলে আসেন যা ছিলো আমার বাবার জায়গা। তারা দার্জিলিং সিপিআই’র সক্রিয় কর্মী হন। ১৯৬৪ সালে যখন পার্টি বিভক্ত হয়, তখন তারা দুজনেই সিপিআই (এম)কে বেছে নেন। যখন বিভিন্ন ইস্যুতে আমার বাবার বিপ্লবী অবস্থান পার্টি নিতে পারছিলো না তখন তাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনিও পার্টির সাথে আর থাকতে চাচ্ছিলেন না। তিনি এবং তার মতো অন্যান্য নেতারা সিপিআই (এম) থেকে বেরিয়ে আসেন এবং চাষীদের মাঝে নিজেদের বিপ্লবী কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। নকশালবাড়ির পরে ১৯৬৯ সালে তারা সিপিআই (এম-এল) গঠন করেন।

আপনার মা’র কী মত ছিলো? তিনি কী এই রাজনৈতিক রূপান্তরটি মেনে নিয়েছিলেন?

মা কখনোই বলেননি যে তিনি সিপিআই (এম) এর সাথে কাজ চালিয়ে যেতে চান না। কিন্তু একইসাথে তিনি পার্টির সদস্যপদ পুনর্বহালও রাখেননি। পরে তিনি পার্টির কার্যক্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এবং এর পরিবর্তে আমার বাবাকে পার্টির কাজে সহায়তা দিতে থাকেন। এই প্রশ্ন উঠতেই পারে যে একজন নারী তার স্বামীর জন্য নিজের রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে যে ত্যাগ করছেন এটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা? কিন্তু এটাই হয়েছিলো। ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি আমার বাবার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে তার হার্ট অ্যাটাক হয় এবং এরপর থেকে তার প্রায়ই বুকে তীব্র ব্যথা হতো। তার হাঁপানির সমস্যাও ছিলো। এর ফলে আমার মায়ের হাতে কাজের অভাব ছিলো না… বাবার রাজনৈতিক কাজ, তার শরীরের অবস্থা, প্রতিদিন আসা নানান অতিথি সামলানো, সংসার দেখা, আমাদের পড়ালেখা, তার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন, পুলিশের হানা… কিন্তু কোনকিছুই তাকে ভাঙতে পারেনি। তিনি ছিলেন অসাধারণ মানসিক শক্তি আর সাহসে ভরপুর এক নারী।

 

[সাক্ষাৎকারের বাকী অংশ উদ্ধার করা যায়নি…]

শেয়ার