স্কুলের বেঞ্চে, বাথরুমের দেয়ালে আমরা অনেক রকম লেখা দেখতে পাই। এর কারণ দাঁড় করাইতে চাইলে দেখা যাবে যে, মাস্টারের সামনে যে কথা বলা যাইতেছে না, সেটারেই লিখতেছি। স্কুলের নিয়ম-কানুন আছে, নির্দিষ্ট কোরাম আছে আর তা যে সবসময় আপনার-আমার ভালো লাগবে তা না। তো সেই নিয়মের বাইরের যে কথাগুলা আছে, তা তো আর মাস্টার মশাইকে বলতে পারছি না (মাইরের ভয়ে) বা বন্ধু-বান্ধবদেরকে (নানান কারণে), পরে সেই কথাগুলাই দেখা যায় স্কুলের বেঞ্চে। এগুলাই গ্রাফিতি। গ্রাফিতিকে আর্টের মধ্যে পুরোপুরি ফেলা যায় না আবার সাহিত্যেও ফেলা যায় না। গ্রাফিতি হচ্ছে আপনি আমি যা বলতে পারছি না, তা প্রকাশের বিকল্প পদ্ধতি। সংস্কৃতি বলতে আমরা যেইটা বুঝি, গ্রাফিতির অবস্থান তার বিপরীত। গ্রাফিতির ভাষাও গতানুগতিক শিল্পের মতো না। এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে। শিল্প হিসেবে যেইটা আমরা এক্সিবিশনে বা ক্যানভাসে দেখি, তারে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের নিয়তে, সময় নিয়েই আমরা তার কাছে যাই। কিন্তু গ্রাফিতির সেই বিলাসিতা নাই, আছে হঠকারিতা। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা গ্রাফিতি আপনারে গভীর ভাবনায় ফেলে দিতে পারে। যেমন ধরেন, ফ্রান্সের ছাত্র আন্দোলনে প্রেসিডেন্ট ছাত্রদের চুপ থাকার নির্দেশ দিলে, প্যারিসের রাস্তায় দেখা যায় প্রেসিডেন্ট চার্লস একটা বাচ্চারে শিখাইতেছে “Just vote and I’ll do the rest” এইখানে গ্রাফিতির সরাসরি আক্রমণটা দেখা যায়। গ্রাফিতিটি একই সাথে নিপীড়ন, রাজনৈতিক অরাজকতার জবাব দেয় হাস্য উপহাস দিয়ে। অনেকটা সাধারণ জনগণকে দেখানো যে দেখেন কি মাইনা নিতেছেন আর কিরম জীবন কাটাইতেছেন। এই স্বতঃফূর্ত চিন্তা-চেতনা প্রকাশের ক্ষমতাই গ্রাফিতিকে এতো শক্তিশালী করে তুলেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে, গ্রাফিতির শুরুর দিকে আর্টিস্ট এই ফর্ম বেছে নিতো নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে। গুণ্ডা, গ্যাংদের নিজেদের সীমানা বোঝাইতেও পরে গ্রাফিতি বেশ গুরু দ্বায়িত্ব পালন করে। গ্রাফিতির মূল উদ্দেশ্য কখনোই ভ্যানডালিজম বলে ধারণা করা হয় না। এর উদ্দেশ্য মানুষ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজ এমনকি শিল্পের মধ্যে বিরাজমান সমস্যাকে বের করে এনে, সংঘবদ্ধ আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়া। মানুষকে তার বক্তব্য তুলে ধরার সাহস দেয়া।
গ্রাফিতি বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় শিল্প মাধ্যম। রাস্তা, দেয়াল, বাস কিংবা ট্রেন সবখানেই গ্রাফিতির চল। গ্রাফিতি হইতে পারে চিহ্ন, ড্রইং কিংবা পোস্টার। শুধু দেয়ালিকা বা চিকা ভাবলে, এই বহুল ব্যবহৃত মাধ্যমকে ছোট করা হবে। গ্রাফিতি খুব নির্দিষ্ট বার্তা পৌঁছানোর জন্য করা হয়ে থাকে। কয়েক দশক আগেও যা ভ্যানডালিজম বলে গণ্য হতো (এখনো করা হয়), এখন তা শিল্প জগতে বড় নাম। জনপ্রিয়তা থাকলেও এই মাধ্যম যথেষ্ট নবীন। তবে এও সত্য গ্রাফিতির প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব সময়েও। হিপ-হপ সংস্কৃতির মূল একটি অংশ হলেও আজ গ্রাফিতি অনেক বড় এবং বহুলাংশে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে। আমরা এখন গ্রাফিতির প্রাচীনতম নিদর্শন থেকে বর্তমানে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠা নিয়েই কথা বলবো।
গ্রাফিতি শব্দের উৎপত্তি হয় গ্রিক শব্দ গ্রাফাইন থেকে যার অর্থ আঁকা বা লেখা। কিন্তু এই শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই না। গ্রাফিতি শব্দের ব্যবহার প্রথম দেখা যায় ইতালির পম্পেই শহরে ১৮৫১ সালে, ইতালিয়ান শব্দ গ্রাফিতো, যা গ্রিক শব্দ গ্রাফাইন থেকে এসেছে। তার অর্থ আঁচড় দেয়া বা দাগ দেয়া। গ্রাফিতি এক অর্থে এখনো একরকম আঁচড়। গ্রাফিতি করাই হয় আপনার ভাবনায় আঁচড় দেয়ার জন্য বা আপনারে ভাবতে বাধ্য করার জন্যে। আবার গ্রাফিতি আর্টিস্টরা আর্ট স্কুল উৎরায়ে আসা আর্টিস্ট না সবাই, আর হইলেও বিশ্ব জুড়ে গ্রাফিতিরে আইন দিয়া বাইন্ধা ফেলার প্রবণতায়, গ্রাফিতি করার জন্য পাওয়া যায় না অঢেল সময়। তো আপনার রুচিতেও এইটা জাস্ট একটা আঁচড় বইলা মনে হইতে পারে।
গুহায় বসবাস করার সময়ও মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য গুহার দেয়ালে বা মাটিতে নানা পশু ও আকৃতির ছবি আঁকাআঁকি করতো। এই পুরোনো প্রস্তরযুগ, বলতে আমরা প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০০ থেকে ৯০০০ বছর আগের কথা বলছি। এই সময় যেমন আদিম, তাই আমরা এর নামও আদি গ্রাফিতি দিতে পারি।
প্রথম যে গ্রাফিতির আদি ফর্ম আবিষ্কার করা হয়, আর্জেন্টিনার “কেভ দে লাস মানস”, ওইখানে দেখা যায় দেয়াল ভর্তি হাতের ছবি। এ ছবি পৃথিবীতে ভাষার চেয়েও বয়স্ক। এরপর আবিষ্কৃত গ্রাফিতিটি পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিসে। আধুনিক যুগের গ্রাফিতির প্রথম নির্দশন ধরা হয় একে। পাথরে আঁচড় কেটে হাত-পা, মদের বোতল, সংখ্যা আঁকা হয়েছিলো। এটা ইউফেসাস (প্রাচীন গ্রিক এবং বর্তমান তুরষ্কের একটি শহর) এর সবচেয়ে বড় ব্রোথেলের বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহৃত হতো তখন। আজকের সময়ের গ্রাফিতির সাথে এর আদিরূপের বিস্তর পার্থক্য পরিষ্কার। তবে মানুষের মধ্যে এই আর্টের ফর্মের ব্যবহার আমরা পরের সময়েও নিয়মিত দেখতে পাই।
রোমে আসার পর গ্রাফিতির মধ্যে একটা নতুন রূপ দেখা যায়। গ্রাফিতির ব্যবহার করে সরকার বা রাজনীতিবিদদের যে উপহাস করা যায় তা সেই সময়ে প্রচলিত হয়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে বিখ্যাত আলেক্সসেনাস গ্রাফিতি। ধারণা করা হয় এটা ২০০ খ্রিস্টাব্দে আঁকা। ছবিটিতে দেখা যায়, যিশুর শরীরে গাধার মাথা। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, তখন খ্রিস্টানদের অপমান ও উপহাস করার জন্য এইটা করা। উল্লেখ্য যে, যিশু খ্রিস্টের আবিষ্কৃত প্রথম ছবিও এটি। আর্টিস্টেরাও মত প্রকাশের মাধ্যম ও দর্শকদের সাথে আলাপ-আলাপনের রাস্তা হিসেবে একে ব্যবহার করতো।
হাগিয়া সোফিয়া, বর্তমানে তুরষ্কের একটি ঐতিহ্যবাহী মসজিদেও দেখা যায় আদি গ্রাফিতির নির্দশন। “হ্যালডান ওয়াজ হেয়ার”; এইটা জনৈক স্ক্যানডেনেভিয়ান সৈনিক করেন বলে ধারণা করা হয়। এছাড়াও ইতালির পম্পেই, শ্রীলঙ্কার আশিগিরিয়াতেও প্রাচীন গ্রাফিতির নিদর্শন পাওয়া গেছে।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ভবঘুরে লোকেরা ট্রেনে চেপে কাজ খুঁজতে যাইতো, অধিকাংশই পড়তে বা লিখতে পারতো না। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার একটি মাধ্যম তৈরি করে, যা হোবো ল্যাঙ্গুয়েজ নামে পরিচিত। নিজেরা নিজেদের দেখভাল ও নিরাপত্তায় তারা এসব ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতো। এগুলাতে কোথায় পুলিশি নজরদারি বেশি, কোথায় কাজ বেশি, ক্যাম্প কোথায় করলে ভালো হয়, এইসব ইনফরমেশন থাকতো; যা আজকের আপনার আমার কাছে স্রেফ কার্টুন বা স্ট্রিট আর্টও মনে হইতে পারে।
অনেকেই মনে করেন স্ট্রিট আর্ট আর গ্রাফিতি এক। এই ধারণাটা আসলে ঠিক না পুরাপুরি। গ্রাফিতি স্ট্রিট আর্ট থেকে অনেক আগায়ে, আরো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে স্ট্রিট আর্ট হিসেবে আমরা যা দেখি তা অধিকাংশই গ্রাফিতি থেকে অনুপ্রাণিত। গ্রাফিতি এখনো প্রায় বিশ্বের সব দেশেই নিষিদ্ধ। গ্রাফিতি করার সময় আর্টিস্টের জীবনেরও ঝুঁকি থাকে কিছু কিছু জায়গায়। গ্রাফিতি নিষিদ্ধ হওয়ায় এটা রাতেই করতে হয়, অন্ধকারে। আর এরকম ঝুঁকিতে ক্ষতিও হয় অনেক। ওজান নামক লন্ডনের গ্রাফিতি আর্টিস্ট মারা যায় সাবওয়ে ট্রেনের নিচে। পৃথিবীর সবখানেই এরকম দুর্ঘটনা ঘইটা আসছে, তবুও থাইমা নাই আর্টিস্টরা, নিজের কথা বলার তাগিদে। উল্টাদিকে স্ট্রিট আর্ট আসলে কোন জায়গায় অনুমতি নিয়ে আঁকা কিংবা মালিক তার ফাঁকা জায়গায় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য আর্টিস্টকে কমিশন দিয়ে করায়া থাকে। বিভিন্ন কোম্পানি, ইভেন সরকারও করায়। বিজ্ঞাপন হিসাবে। ব্যাপারটা আরো ভালো বোঝার জন্য আমরা ব্রাজিলের “পিক্সাও” এর কথা বলতে পারি। পিক্সাও ব্রাজিলিয়ান আর্টিস্টদের নিজেদের তৈরি করা গ্রাফিতির মতন একটা মাধ্যম। তারা বড় বড় বিল্ডিং পছন্দ করে; তারপর পুরোটা জুড়ে আঁকে নানা চিহ্ন বা ড্রইং। হোবো ল্যাঙ্গুয়েজের মতন এই ফর্মেরও আছে নিজস্ব ভাষা যা অনেকের কাছে দুর্বোধ্য মনে হইতে পারে। তো এইটা থামানোর জন্য ব্রাজিলিয়ান সরকার তাদের নির্দিষ্ট জায়গা দিয়া দিলো। বললো: এইখানেই আঁকো। কিন্তু আর্টিস্ট শুনবে ক্যান! এরপর থেকে তারা ওই বরাদ্ধকৃত জায়গায় না আঁইকা অন্য জায়গায় আঁকা শুরু করলো। স্ট্রিট আর্ট ‘নান্দনিক’ হবে এইটাই মোটামুটি ফিক্সড, কিন্তু গ্রাফিতির এই দায় নাই। ফলে গ্রাফিতির ভাষা আর ধার, স্ট্রিট আর্ট রাখতে পারে না, তখন তা আর দশটা দেয়ালিকায় পরিণত হয়। অথবা এইভাবেও বলা যায়, সকল গ্রাফিতিই স্ট্রিট আর্ট, তবে সকল স্ট্রিট আর্ট গ্রাফিতি নহে। তবে একটা কিন্তু এইখানেও আছে, গ্রাফিতি মাত্রই স্ট্রিটে বিরাজ করে এমন নয়, যেকোন পাবলিক মুতাখানা, টাকা, বাস-ট্রেন, পার্কের সিট-গাছ, সিনেমা হল, হাসপাতাল, হোটেল রুম বা এমন স্পেসও গ্রাফিতির জায়গা হতে পারে। একবার এক সস্তার হোটেলে দেখছিলাম, কোনো এক রুবেল লেইখ্যা রাইখা গেছে, স্বপ্না এখনো তোমারে স্বপ্নে দেখি। আবার চীনের কোন এক ব্যস্ত শহরের পাশে, একটা পরিত্যক্ত বাড়ির পুরোটা লেখায় ভর্তি। পুরোটা জুড়ে লেখা একটা উপন্যাস।
শহুরে গ্রাফিতির প্রচলন হয় ১৯৬০ সালের দিকে আমেরিকায়। এর প্রচলন করেন টাকি ১৮৩ ( TAKI 183) । এই বার্তাপ্রেরক ছিলেন নিউইয়র্কের অধিবাসী এবং ট্রেনে প্রচুর চলাচলের সুবাদে ট্রেনে তার চিহ্ন আঁকান প্রচুর পরিমাণে যা পুরো শহর ঘুরে বেড়ায়। টাকির থেকে প্রেরণা নিয়ে আমেরিকায় তরুণদের দল এই ট্যাগ ব্যবহার করা শুরু করে এবং এই আর্ট আঁকার আকৃতি পাল্টায়ে আসে হিপ-হপ রূপে। ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক টাইমসও টাকিকে নিয়ে প্রতিবেদন করে।
গ্রাফিতির না লাগে কোন ক্যানভাস, না লাগে বড়সড় কোন জায়গা, ফলত পুরো পৃথিবীটাই ধইরা নেয়া যায় ক্যানভাস। তো দেখা যায় গ্রাফিতি এই সুযোগে দ্রুত ছড়ায়া পড়তে পারে। এ কারণে নিউইর্য়কের মেয়র সাহেব গ্রাফিতির বিরুদ্ধে একবার আইন প্রচলন করছিলেন। ট্রেন ও সাবওয়েতে কড়া নজরদারি বসানো হয়। গ্রাফিতিও কমে আসে। কিন্তু ধীরে ধীরে তা অন্যান্য শহরেও দেখা যেতে শুরু করে। বাড়তেও থাকে। গ্রাফিতিকে বৈধতা না দেয়ার রাগ ও নিষিদ্ধ কিছু করার আনন্দ হিসেবে। ৮০’ দশকে কিথ হ্যারিং ও জ্যঁ মাইকেল বাসকুয়েট ছিলেন উল্লেখযোগ্য গ্রাফিতি আর্টিস্ট; যারা গ্রাফিতি করতে করতেই রাস্তা থেকে গ্যালারিতে ঢুইকা যান; মেইনস্ট্রিম আর্টিস্ট হিসাবে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড খ্যাতিও পাইছেন।
নিউইর্য়কের উঠতি হিপ-হপ সংস্কৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যাঙ্কসি নামের এক ১৪ বছরের ছেলে ইংল্যান্ডে গ্রাফিতি আঁকা শুরু করেন। নানান রকম চিহ্ন, ট্যাগ ইত্যাদি দিয়ে আঁকা শুরু করলেও পরর্বতীতে তিনি ইমেজ নির্ভর গ্রাফিতি শুরু করেন। সাথে টেক্সটও বসাইতে থাকেন, মজার-মজার এবং একটু একটু কইরা জনপ্রিয় হইতে থাকেন। তার গ্রাফিতিগুলো পুঁজিবাদের তুমুল সমালোচনা এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে করা। ২০০৩ সালে প্রথম তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইজরাইলের আচরণকে সমালোচনা করে ওয়েস্ট ব্যাংকে গ্রাফিতি আঁকায় প্রচুর আলোচিত হন। আর্মড ডাভ দেখলে মনে হয় কেমন শান্তির বুকে যুদ্ধের লেজার ফুটে আছে। ফ্লাওয়ার বম্ব তার করা অন্যতম শক্তিশালী গ্রাফিতি। সেখানে একটা মুখ ঢাকা যুবক হাতে বোমের বদলে ছুঁড়ে দিচ্ছে ফুল। ব্যাঙ্কসির করা এই ফ্লাওয়ার বম্ব গ্রাফিতির ইউজ করতে দেখা যায় কাশ্মীরে ও সিরিয়াতেও। এইটাতেই বোঝা যায়, যারাই প্রতিবাদ করতে চায়, তাদের সবার কাছেই ব্যাঙ্কসি একটা ভাষা। ব্যাঙ্কসির রেয়ার একটা ইন্টারভিউতে সে বলতেছে এমন, যে রাস্তায় আপনি প্রতিদিন যান সেখানে একটা বড় স্ট্যাচু দাঁড়ায় আছে, আপনি খেয়াল করলেন না কারণ এইটা প্রতিদিনই থাকে। কিন্তু ওইটাতে আমি যদি একটা মুকুট আঁইকা দিই, তাইলে আপনাদের আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দু হইয়া উঠবে ওইটাই। ইন্টারভিউটারে রেয়ার বলতেছি কারণ ব্যাঙ্কসিরে কেউ দেখে নাই, কেউ তার আসল নাম জানে না আর এই আর্টিস্টটের নিজের নাম প্রকাশের সদিচ্ছাও নাই। একটা মজার ঘটনা বলি। আমেরিকায় যখন ব্যাঙ্কসি তার প্রথম এক্সবিশন করলো, হলিউডের তারকা, লেখক, আর্টিস্ট সবাই এলো সেখানে, আর্টে মুগ্ধ হইলো। মিডিয়াও খুটে খুটে ব্যাঙ্কসিরে খুঁজতে শুরু করলো। এ অবস্থায় তখন এক্সিবিশনে প্রবেশ করলো বিকট এক হাতি, পুরো শরীরে লাল রঙ করা। যা সবার মনোযোগ সরায় দিলো, কেউ এনিম্যাল রাইটস নিয়ে, কেউ ব্যাঙ্কসিরে ফ্রড বলে গালাগালি করতে লাগল। পরে ব্যাঙ্কসির সহযোগিদের কাছ থেকে জানা গেল, ওই হাতির দেখা শোনাই করছিলেন খোদ ব্যাঙ্কসি। ব্যাঙ্কসির কান্ডের শেষ নাই। ইংল্যান্ডে একবার ১০ পাউন্ডের নোট তৈরি করে ওইখানে লিখলেন ব্যাঙ্কসি অফ ইংল্যান্ড আর ছবিও দিসিলেন রানী এলিজাবেথের বদলে প্রিন্স ডায়ানার। নিজে আবার বিয়ার কিনে খাইয়া নোট চলে কি না টেস্টও করসেন। পরে ১ মিলিয়ন পরিমাণ নোট সে বিলায় দেয়। আগ্রহ সাথেই কুড়ায়ে পরে বিশাল ফানের মধ্যে পইড়া যায় মানুষ। এই জাল নোটের একটা অবশ্য ২০০৭ সালে ২৪,০০০ পাউন্ডেও বিক্রি হইসে। ফ্রান্সের ল্যুভে জাদুঘরেও তিনি বিকৃত হাসির মোনালিসা ঝুলাইতেও সক্ষম হন। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রাফিতি যা বহুলভাবে আলোচিত তা হলো ডেভেলপড পার্লিমেন্ট, বালুন গার্ল, ফ্লাওয়ার বম্ব, ফলো ইউর ড্রিম, ভোট টু লিভ। ফেমাস হওয়ার সাথে সাথে তার করা গ্রাফিতিগুলাও চড়া দামে বিক্রি হইতে থাকে। ডেভেলপড পার্লিমেন্ট গ্রাফিতিটি বিক্রি হয় ১২.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে।
এইটা নিয়ে একটা মধুর সমস্যাও আছে। ব্যাঙ্কসি যেইটা করে, সেইটা আর্টকে মুক্ত করার উপলক্ষে ধইরা নেয়া যায়। কিন্তু তার এতো জনপ্রিয়তার মুখে, সবাই তার গ্রাফিতি কিনে বাড়িতে সাজাইতে চায়। আর্টের দুনিয়ায় যে ভণ্ডামি চইলা আসতেছে, তার মুখের উপর গ্রাফিতির কড়া প্রতিবাদ করলেও, ব্যাঙ্কসি ভয় করতেছে যে সে নিজেই সমস্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাইতেছে। এর প্রতিবাদে তার স্টান্টটাও মজার। একটা অকশনে ব্যাঙ্কসির বেলুন অ্যান্ড গার্ল অনেক দামে নিলামে বিক্রি হয়। নিলামের শেষ ঘণ্টা বাজতে ছবিটা একা একা নষ্ট হতে শুরু হয়। সবাই খুব অবাক হয় এটা সত্যি। কিন্তু নষ্ট ছবিটার দাম বেড়ে যায় ৫০-৬০ গুণ!!!
গ্রাফিতি সব সময় বির্তকের মুখে থাকলেও ব্যাঙ্কসির সাফল্য বিশ্বজুড়ে একটি নতুন মাধ্যমকে উন্মুক্ত করে দেয় তরুণদের জন্য, তাদের ভাব প্রকাশের জন্য। গ্রাফিতি বাইছা নেয়া তরুণরা কখনোই টাকার আশা কইরা গ্রাফিতি করতে নামে না। গ্রাফিতি করার মধ্যে একটা অহংকার আছে। গ্রাফিতি একটা প্রতিবাদ, মানুষের বর্তমান অবস্থা আর তা দ্রুততম ঘোষণার একটা মাধ্যমই গ্রাফিতি। তাজমহল, পিরামিড কিংবা রোমান স্থাপত্যশিল্পেও এর শ্রমিক দের নাম পাওয়া যায়। এইটা নিশ্চয় অই শ্রমিকরা টাকার জন্য করে নাই, গরীব শ্রমিকদের সেই সাহসও থাকার কথা না। তাহলে গণ্ডগোলটা কোথায়? গন্ডগোল হইলো তাজমহল তৈরির সময় শোনা যায় শ্রমিকদের কারো হাত কাটা হয়, কাউরে কাউরে মাইরা ফেলা হয়। তো এই কারণে ক্ষিপ্ত শ্রমিকরা প্রতিবাদের শেষ মাধ্যম হিসেবে তাদের নাম লিখে রাখেন তাজমহলের নানা জায়গায়, গোপনে। একই ধাঁচের গল্প মিশরে কিংবা রোমেও। তো এখন এই শ্রমিকদের নামকে যদি শিল্পী মর্যাদা দিতে বলা হয়, তাহলে আমাদের একাডেমিক শিল্পীদের কেউ কেউ নাখোশ হইতে পারে, যুক্তিও দেখাইতে পারে: পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের গায়ে এমনতরো ভ্যানডালিজম কি মানা যায়? কিন্তু গ্রাফিতিও তার জায়গায় শক্ত। সে তার মতোন করে প্রতিবাদ করে গেছে তার ক্যানভাসে; সেইটা তাজমহল না ভূতের গলি এইটা কেয়ার করে নাই।
এখানে গ্রাফিতির ধরন নিয়াও একটু আলাপ সারতে পারি। গ্রাফিতির ধরন বলতে কত রকম গ্রাফিতি হইতে পারে! কত রকম গ্রাফিতি বিরাজ করে। এর সীমা নাই আসলে। আমরা অলরেডি হিস্ট্রিতেও দেখলাম, কোথাও শ্রমিকরা নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে যেমন নিজের নাম, হাতের ছাপ রেখে আসে, তেমনি কোথাও দেখা যাবে কোন বিখ্যাত লোকের মুখ, তারে আঁকতে হচ্ছে শিল্পীর। শিল্পী করলো কি, অই বিখ্যাত মাইনষের আশপাশে লুকাইয়া নিজেরে এঁকে রেখে দিতে পারে। তার অস্তিত্বের স্মারক হিসাবে। এটা ডিরেক্টলি হয়তো গ্রাফিতি না, কিন্তু এটাই গ্রাফিতির টেন্ডেসি। এ কারণেই টাকার গায়েও লোকজন নাম লিইখা রাইখা দেয়। প্রকাশের ওয়ে হিসাবে। সে ভাবে কোন একদিন হয়তো সে যার কাছে পৌঁছাইতে চায়, তার কাছে পৌঁছায়া যাবে। অনেকে আবার দেখবেন, রাস্তার পাশের সাইনবোর্ডে ফেমাস কোন মানুষের সুন্দর মুখ, সে করলো কি অই সুন্দর মুখের মাইনষের মুখে ঝামা ঘষে দিলো। বা, ইট বা কয়লা দিয়ে লিইখা রাখলো মাদারচোদ। এটাও গ্রাফিতি। আর এরকম কাম এত হামেশা ঘটে, আমরা এত রেগুলার দেখি, আমাদের গ্রাফিতেই মনে হবে না। আপনারা যদি একটু বিস্তারিত তাকান, দেখবেন সেইম জিনিসই ব্যাঙ্কসি করতেছেন। হ্যাঁ, যে ব্যাঙ্কসিরে নিয়ে আমরা আলাপ করলাম। তিনি করেন কি, পাবলিক কোন টেক্সটকেই, বা কোন ইমজেকে, স্যাটায়ার মিশায়া দিয়া অন্য কিছু বানায় দেন। তখন এটা নতুন একটা আর্ট হয়ে উঠে। যেরকমটা লোকজন টাকার ছবিতে করে। বা কোন পাবলিক পোস্টার, দেয়ালের কোনো ইমেজের। আমরা তো অফ ট্র্যাকের আর্টের কথা বলতেছি, কিন্তু মেইনস্ট্রিম আর্টের দিকেও তাকালে এরকম আকাম-কুকাম পাবো। দেখবো দুশাম্প-দালি অনেকেই মোনালিসার মুখের উপর মোচ আইঁকা দিছেন। এবং পরে ইহা স্বীকৃতিও পাইছে। এরকম বদলায় দেয়া আর্টরে ইমেজ ম্যানিপুলেশন, ফটো-মন্তাজ নামেও ঢাকা হইতেছে। এটা একটা ধরন। এর বাইরে স্টেনসিল-রং দিয়ে কিছু করার পাশাপাশি পোস্টারও গ্রাফিতি হইতে পারে। ধরেন, আপনি তীব্র স্যাটায়ারে ভরা, বা ক্ষোভে ভরা কিছু রাস্তায় লাগায় দিয়ে আসলেন, অইটাও গ্রাফিতি। কোন আন-ইজুয়াল অবজেক্ট কোন ই্উজুয়াল জায়গায় রাইখা আসাও গ্রাফিতি। যেমনটা ব্যাঙ্কসি করেছেন। বিখ্যাত গ্যালারির ভিতর রাইখা আসছেন মোনালিসার ফানি ইমেজ। যেটার গ্যালারির মর্যাদারে যেন ধুলায় মিশায় দেয়। একই রকম সান ফ্রান্সিসকোতে কেউ একজন যখন গান্ধীর চোখের ভিতর লেজার বসায়া দেন, তখন তাও গ্রাফিতিই। বা ধরেন রাস্তায় যে বিলবোর্ডে যে ভিডিও বিজ্ঞাপন, হয়তো কোন প্রোডাক্টের বা বড়সড় নেতার নির্বাচনী আশ্বাসের, তার মাঝে যদি ডিপজলের কোন ক্লিপ ঢুকায়া দেয়া যায়, টাংকি ফুটা কইরা দিমু টাইপের- তাও গ্রাফিতিই। ইদানিং সোশ্যাল মিডিয়ার মারফতে আর নানানভাবে গ্রাফিতি সফট হয়ে নানা জায়গায় ঢুকে গেছে। এগুলারে আমরা গ্রাফিতি হয়তো বলতেছি না, অন্য নাম দিছি, কিন্তু তাও গ্রাফিতিই। আরো নানান কিছুই গ্রাফিতি। নানান রূপে নানান নামে তা আমাদের সামনে আসবে।
গ্রাফিতির ভাষা জায়গার সাথে যেমন পাল্টায়, তেমন সময়ের সাথে সাথেও পাল্টায়, তবে গ্রাফিতি ট্রেন্ডের বাহক মেইনলি যুবকরাই। বাংলাদেশে আন্দোলন ভিত্তিকই গ্রাফিতি দেখা যায় মূলত। কালেভদ্রে সুবোধ বা এ জাতীয়। তো এইখানে গ্রাফিতির প্রতিবাদের ভাষা একটি কাঠামো পরিবর্তনের, আবার ইস্যু ভিত্তিকও বলতে পারেন। আমাদের রাজনৈতিক দল কিংবা ছাত্রছাত্রী কেউই ইস্যুর বাইরে তেমন বিশেষ কিছু করতে পারে নাই গ্রাফিতি দিয়া। কিন্তু পাশেই কাশ্মীরে লক্ষ্য করলে দেখবেন, একটা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে গ্রাফিতি দিয়া। এতো এতো সৈন্যের ভীড়ে মানুষের ঐক্যবদ্ধ হবার জায়গা বিশেষ নাই। তারপরও সেখানে ১৪-১৫ বছরের ছেলেমেয়েও গ্রাফিতিকে অস্ত্র হিসেবেই নেয় আর ঝুঁকি বুইঝাই নেয়। কাশ্মীরের যুদ্ধ থেকে মুখ ঘুরায়ে তার তরুণরা গ্রাফিতি দিয়া প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। প্যালেস্টাইনে তো খোদ ব্যাঙ্কসি গিয়ে গ্রাফিতি করে আসছে প্রতিবাদ জানিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বে কিংবা ইউরোপে গ্রাফিতির ভাষা আবার পরির্বতন হয়। ওইখানে আমরা আর্টের বেশি ব্যবহার দেখি, টেক্সটের পাশাপাশি। অবশ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনাও এর মধ্যে পড়ে, সে বিষয়ে আমরা যাবো না। তো এই অঞ্চলে গ্রাফিতিগুলো মোরাল আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ। গ্রাফিতি দিয়ে ক্যাপিটালিস্টদের প্রতি দুর্বল মানুষদের শিক্ষা কিংবা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করার সৎ সাহস নিয়ে সজ্ঞানে কৌতুক করা হয়।
গ্রাফিতি প্রতিবাদের পাশপাশি মানুষের মধ্যে আশার বীজও বুইনা দিতে পারে। শামসিয়া হাসানি যে কিনা একজন আফগান শিল্পী, যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিদের মনে আশার সঞ্চার করার জন্য গ্রাফিতির হাত ধইরা নিছেন। আফগান সংস্কৃতি আর সমাজের প্রতিদিনের চিত্র পৃথিবীর কাছে আফগানদের নতুন পরিচয় হয়ে উঠছে। শামসিয়া হাসানির মত ল্যাডি পিংক, মিস ভ্যান, সুন, এই নারীরা নিজ নিজ জায়গায় গ্রাফিতির ঝান্ডা বয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রাফিতি যে শুধু ছেলেরাই করবে এমন ভুল ধারণা ভাইঙ্গা দিছেন তারা।
গ্রাফিতিরে চাইলে যুক্তি দিয়ে যেমন খারাপ বানান যায় তেমনই এর ভালোগুলারেও উপেক্ষা করার সুযোগ নাই। গ্রাফিতি দিয়া আপনি ভিন্ন মতামত প্রকাশ করতে পারবেন, সহজেই। আপনারে কেউ তাইড়া আসতে পারবেন না। যদি আপনি আই লাভ ইউ আমেনা দিয়েও শহর ভর্তি কইরা ফেলেন তাও কেউ কিছু বলবে না তার একটা কারণ আপনারে কেউ জানলো না কিন্তু আপনার মেসেজ পৌঁছাবে। এইটা ব্যক্তিপর্যায়ের কথা। কিন্তু এইটারে আপনি বড় কইরাও দেখতে পারবেন চাইলে। ২০১৪-এ ব্রাজিলে ফুটবল বিশ্বকাপ। আমরা ব্রাজিল থেইকা ৮-১০ হাজার কিলোমিটার দূরে থাকলেও উত্তেজনা ঠিকই রাস্তা চিনা আমাদের শরীরে কিংবা ছাদে পৌঁছায় যায়। তো ব্রাজিলে যারা আছে তাদের কথাও ভাবুন। আনন্দে ইউরেকা বলে রাস্তায় দৌড়ায় বেড়াচ্ছে? আংশিক হ্যাঁ আবার না-ও। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ উৎসবে ব্রাজিল খরচ করে ৫.৬ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবার আতিথিতেয়তার কোন কমতি ছিলো না, কোন খামতি ছিলো না উৎসবেও। কিন্তু আরেকটা সাইড যেইটা মিডিয়াতে আমরা ওইভাবে পাই না সেইটা হচ্ছে এই সময়েই ব্রাজিলে না খায়ে থাকা মানুষের কথা! পাবলিকের উপর ট্যাক্স বাড়াইয়া দেবার কথা।ব্রাজিলের গ্রাফিতি আর্টিস্টরা এইগুলারই প্রতিবাদ করে ভরায় দিছে দেয়াল। যেন খেলা দেখতে আসা বিদেশিদের নজরে সত্যটা চোখে পড়ে। আর সরকারি লোকেরা যত তাড়াতাড়ি পারছে, তা মুছে ফেলেছে। শত হইলেও দেশের প্রেস্টিজ বইলা কথা।
মুছে ফেলা থেকেই আমরা আরো একটা বড় বিষয়ের দিকে তাকাইতে পারি, সেইটা হইতেছে সরকার কিংবা রাষ্ট্রপক্ষ এই আর্ট ফর্মটারে এতো ডরায় ক্যান??
যেমন টিভি-রেডিও আমাদের চিন্তাগুলোকে একমুখী কইরা ফেলতেছে, সেখানে গ্রাফিতি হইতেছে আপনার ডিসক্লেইমার। যে টিভি আপনার ব্রেইনে বাসা বানতেছে এখন সেইটা উপেক্ষা কইরা আপনি টিভির ভেতর বসবেন কিনা সেইটা আপনার ইচ্ছা। ভাষা একটা বড় উপাদান বলতে পারেন। এইটাতে ভয় পাওয়া রাষ্ট্রের জায়েজ, যেহেতু রাষ্ট্র দাঁড়ায় আছে ভাষার উপর। ধর্ম রাষ্ট্ররে গাইড করে আর ধর্ম লেখা একটা ভাষা দিয়া। গ্রাফিতি একরকম ভাষা বলেলেও ভুল হবে না। গ্রাফিতির প্রচলনের ইতিহাসে আমরা কয়েকরকম ভাষার কথা জেনে আসছি। আর গ্রাফিতির ভাষা সবসময়ই আক্রমাণাত্মক, ডিরেক্ট। স্লোগান। আমেরিকায় মিশিগানের সব স্টপ সাইনের নিচে রেপ লিখেছিলো একদল আর্টিস্ট, পরে আলো পড়লে স্টপ রেপ দেখা যেতো। পরে এইসব সাইনেই প্রতিবাদ করা হয় বুলগেরিয়া যুদ্ধেও। মুছে দেয়া হইলো সব স্টপ সাইন। তো এই আক্রমাণাত্মক ভাষা রাষ্ট্র তার ক্ষমতাগত দিক দিয়ে পছন্দ করে না। আসলে কোনো প্রতিবাদই রাষ্ট্রের ভালো নজরে পড়ে না। প্রতিবাদই মূলত রাষ্ট্রের ব্যাডবুকে থাকা শব্দ। আবার প্রতিবাদের ভাষা সবসময় এক নয়।
কবি-লেখকদের জেলে যাওয়ার ঘটনা খুব অপরিচিত না বলেই আশা করি। কিন্তু আজকের দিনে তা একটু কঠিন বলেই আমার মনে হয়। এর কারণ কবিতার ভাষা তার তীক্ষ্ণতা হারায় ফেলছে। তীক্ষ্ণতা হারায় ফেললে তারে দিয়ে প্রতিবাদ চালায়ে নেয়া যায় না। চে গেভারা’র হ্যান্ডসাম সুন্দর ছবি দিয়া গেঞ্জি চিন্তা করা আমার জন্য সহজ, বিপ্লব না। স্বয়ং চে আইসাও গেঞ্জি পরিহিতদের বিপ্লবে নিয়ে যাইতে পারবে না বইলা আমরা বিশ্বাস। কিন্তু গ্রাফিতির ভাষা এখনো তীক্ষ্ণ, সোজা, ক্ষেত্রবিশেষে উলঙ্গ।
হোবো গ্রাফিতি। হোবো কোডের অর্থ ” এইখানে সুন্দর নারী আছে, থাকার জন্য ভালো। র্ধমের কথা বললে তোমাকে খেতে ও থাকতে দিবে” ।
পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহর যেমন নিউইয়র্ক, টোকিয়ো, রিও, বার্লিন, প্যারিস, সিডনি কিংবা বার্সালোনা এখন গ্রাফিতির দখলে। আমরা যে সময়ে বাস করছি তাতে খুব ছোট বিষয়েও পাল্টে যেতে পারে ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট। মানুষ সবসময়ই প্রতিক্রিয়া জানাতে পছন্দ করে। এখন সেইটা একটা ব্যতিক্রম আর্ট ফর্মের সাহায্যে হচচ্ছে। আর্টের যে অদৃশ্য একটা সীমানা থাকে যার ওপারে সাধারণ মানুষ দাঁড়ায় থাকে আর্টরে বোঝার জন্য, তা ভাঙতে সক্ষম গ্রাফিতি। এতো দ্রুত এইটা সবার ভাষা হয়ে দাঁড়ায় যাইতে পারে তা অভূতপূর্ব। রাজনীতিবিদরা শুরু থেকেই গ্রাফিতির বিরুদ্ধে এবং এক প্রকার দমনমূলক দৃষ্টিভঙ্গিই পোষণ করেন। নিউইর্য়কে গ্রাফিতি করতে গিয়ে ধরা পড়লে ৫০০০ ডলার জরিমানাসহ দুই বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। ব্যাঙ্কসির করা গ্রাফিতি “If graffiti changed anything, it would be illegal” শাষক শ্রেণির নেয়া এই পদক্ষেপরে জাস্টিফাই করে।
এত বাধা সত্ত্বেও গ্রাফিতি ইতিহাস অনেক শক্তিশালীই বলা চলে। এরচেয়ে বড় কথা, এইটা গতিশীল। গ্রাফিতির ভাষা থাইমা নাই। চলমান। স্প্রে পেইন্টের অক্ষর থেইকা স্টেনসিল বা ইমেজে রূপান্তর হইলেও, একই রকম ধারালো আছে। যেকোন আন্দোলনে মানুষের দাবিকে ভাষা দিয়ে আসছে গ্রাফিতি। ক্ষোভই না শুধু, দুঃখ-যন্ত্রণা সবই প্রকাশ করে মানুষ এর মধ্যে দিয়ে। আরব স্প্রিং-এ বড় ভূমিকায় ছিলো গ্রাফিতি। হংকং কিংবা চিলের চলমান আন্দোলনেও গ্রাফিতির ওপর ভরসা রেখেছে জনসাধারণ। গ্রাফিতির আগেও নানা উপায়ে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে এসেছে। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে গ্রাফিতিকেই এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম বলা যায়। মানুষের প্রয়োজনে প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে পরিবর্তিত রূপ নিয়ে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি আজ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা। আর মানুষের ভাষাকে নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। প্যারিসের ছাত্র আন্দোলনের বিখ্যাত একটি গ্রাফিতি নিয়ে ইতি টানছি। ‘il est interdit d’interdire’ যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় নিষিদ্ধ করা নিষেধ।
উপরের ইংরেজিসহ বাকি দু্ইটা শান্তিনিকেতনে
গ্রিসের গ্রাফিতি। ছবি: অণু তারেক।
জিইসি, চট্টগ্রাম। আর্টিস্ট: Twasin Arafat Twaha
নেপালের কাঠমাণ্ডু শহরে
নেপালের কাঠমাণ্ডু শহরে
“>