গ্রহণকাল | গাজী তানজিয়া


সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতো দৃশ্যগুলো একে একে সামনে এসে হাজির হতে থাকে। ফ্ল্যাশব্যাক শব্দটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলে না। আজকাল অনেক কিছুই মনে থাকে না তোমার।

কিন্তু যে বিষয়টা ভুলতে চাও সেটা বারবার ঘুরে ফিরে সামনে এসে দাঁড়ায়। যেন একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার কোনো জায়গায় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো এসে দাঁড়ায় দৃশ্যপটগুলো। এই দৃশ্যগুলো যেমন সেভাবে মনে রাখতে চাও নাই, আবার ভোলার দরকার হবে, সেটাও কি ভেবেছিলে কখনো! ভুলতে চাও আসলে এক ধরনের স্বার্থপরতা থেকে। কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি পেতে। মানুষ তো আদতে স্বার্থপর।

উপলের সাথে তোমার প্রায় সাত বছরের সম্পর্ক। সম্পর্ক কথাটা কত গভীর, না! প্রেম, বন্ধুত্ব, শরীর কত কিছু জড়িয়ে তবে এমন একটা শব্দের অবতারণা হয়। কিন্তু সে কথাটা কে বুঝবে! বা বুঝতে চাইবে এখন! কারণ পরিবারের সবার অমত ছিল ওকে বিয়ে করায়। কেউ চায় নাই, আবার সেভাবে বাধা দেওয়ার জোরও ছিল না। তাই বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। সামাজিকভাবেই হয়েছিল। কিন্তু সব, সবটা একমাস সতের দিনের মাথায় শেষ হয়ে গেল।

তোমার মা কেমন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভুলে গেলেন। ভুলতে পারলেন! তোমাকেও ভুলে যেতে বাধ্য করতে লাগলেন। মায়ের ধারণা উপল বুঝি তোমাকে জোর করে বিয়েতে বাধ্য করেছিল। ওর রাজনৈতিক পরিচয় এবং তার আড়ালে জোর জবরদস্তি ক্ষমতা এটা তোমার মায়ের মনকে বিতশ্রদ্ধ করে তুলেছিল। কিন্তু শেষের দিকে মা-ও তো ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল! আসলে মা তো ওকে ওর সেই ছোটোবেলায়ও পছন্দ করত; কিন্তু মাঝে কি যে হলো!

ওর রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা কেউ পছন্দ করল না। না ওদের বাড়িতে কেউ, না তোমাদের বাড়িতে। এতো ভালো একটা ছাত্র সে কেন রাজনীতিতে যোগ দেবে এ সময়ে! যখন রাজনীতি শব্দটা আক্ষরিক অর্থেই পচতে বসেছে!

কথাটা তুমিও উপলের কাছে জানতে চেয়েছিলে। উপল যে মাঝে মাঝে বিকেলবেলা তোমার হল গেটে এসে হাজির হতো, অনেক মেয়েই তাকে চিনত কিন্তু সেই চেনার ভেতরে কোনো সম্ভ্রম ছিল না। ওদের চোখ, বডি ল্যঙ্গুয়েজ বলে দিত কথাটা তোমাকে। আবার হলের কর্মচারী দারোয়ান এরা তোমাকে একটু এক্সট্রা খাতির করত এটাও ঠিক। কিন্তু সেই এক্সট্রা খাতিরটা তো তোমার চাওয়া ছিল না।

তুমি উপলকে বলেওছিলে একদিন। আচ্ছা, তুমি কেন রাজনীতিতে ঢুকলা? ওটা কি না করলেই, না? উপল হেসেছিল অনেক্ষণ। ‘আরে বোকা, এখন কে না রাজনীতি করতে চায়! দেখ, এদেশের বেশিরভাগ মানুষের এক্সট্রিম চাওয়া কিন্তু ওই পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়া। এই যে ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, সফল বা ব্যর্থ আমলা, সেনা অফিসার, জনপ্রিয় ক্রিকেট প্লেয়ার থেকে অভিনেতা, অভিনেত্রী সবাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই রাজনীতিই করতে চায়। যে দেশের মানুষের রাজনৈতিক নেতা হওয়া ছাড়া আর কোনো গোল নাই, সেখানে রাজনীতি না করে কোনো উপায় থাকে না।

তুমি খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলো, সেজন্য কি এই রাজনীতি করতে হবে? অনুকূল স্রোতে গা ভাসানো কী করে ছাত্র রাজনীতি হয় বুঝি না!

টিকে থাকতে বড় কষ্ট হয় সোনা! ধরো, যদি আমাকে লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি পেতে হয়, সে বিসিএস থেকে যে কোনো, এ সময়ে আমাকে ভাইভা বোর্ডে একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, আপনি ওমুক পার্টি করতেন কি-না? তখন আমি কি বলব অরিত্রি? একটা অসফল ছেলের সাথে তোর বাবা-মা তোকে বিয়ে দেবে? আর তুই শুধু আমার এই নেতা হওয়ার আড়ালে বখে যাওয়াই দেখলি, আমার স্ট্রাগলটা দেখলি না। ফার্স্ট ইয়ারে এসে দিনের পর দিন গণরুমে থাকা। একটু বাঁকা ত্যাড়া হলেই টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া। আমার অতো সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না অরিত্রি, সত্যি ছিল না। ওই যে আমার রুমমেট তুষার ওকেও একদিন ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। ওদের গ্রুপে ঢুকতে বলেছিল। কিন্তু যখন শুনল তুষারের ভাই আর্মির বড় অফিসার তখন তুষার ছাড়া পেয়ে যায়। আমার তো মামা-চাচার জোর ছিল না। আমি তখন একথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, বিচারহীনতার দেশে আপোষকামিতা একমাত্র মুক্তির পথ। তাই আমি ওদের দলে ঢুকে পড়েছিলাম। আমার কোনো উপায় ছিল না। এই দেখ, এই যে হাত তোকে ছুঁয়েছে, সেই হাত এখনো কাউকে অযথা মারে নাই অরিত্রি। তুই আমাকে বিশ্বাস কর!’

তুমি জানো, তোমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে উপলের কিছু যায় আসে না। ওটা কথার কথা। নইলে উপল এভাবে বদলে গিয়েছিল কীভাবে! বছরের পর বছর সে পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কটিয়ে দিচ্ছিল। এদিকে তোমার লেখাপড়া শেষ হলে, বাড়ি থেকে তোমারও বিয়ের তোড়জোর চলতে থাকে। মেয়ে বড় হলে কোথা থেকে যেন শুধু বিয়ের প্রস্তাবই আসতে থাকে বাড়িতে। তার ওপরে মেয়ে যদি সুন্দরী হয়! আগে তোমাদের বাড়িতে উপলের জন্য যে প্রশ্রয় ছিল বলাই বাহুল্য সেটা আর পরে ছিল না। তুমি চাকরির পরীক্ষার কথা বলে বলে বাড়ি থেকে সময় নিচ্ছিলে। প্রকারান্তরে চাচ্ছিলে বাবা-মা যেন উপলকে মেনে নেয়।

উপলের দিক থেকে যে কোনো সময় বিয়ে করতে কোনো আপত্তি ছিল না। সে যে লেখাপড়া তখনো শেষ করে উঠতে পারে নাই বা উঠে নাই, সে যে কোনো চাকরি বা ব্যবসা করে না সেটা নিয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। উপল বলত, ‘চল, কারো রাজি হওয়ার দরকার নাই। আমরা বিয়ে করে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে হানিমুনে চলে যাই। পাথুরে বিচে টলটলে পরিস্কার পানি। কটেজের পিছনে সিঁড়ি নেমে গেছে পাথুরে নদীতে। তুই সেখান থেকে সাঁতার দিবি। সুইমিংপুলের কৃত্রিম পানি না, রিয়েল একেবারে রিয়েল, আমাদের ভালোবাসার মতো।’

 


তুমি ভাবতা, এগুলা হয়ত সত্যি কথা না, উপল তোমাকে তার স্বপ্নের কথা বলছে। একজন স্টুডেন্ট লিডারের পক্ষে কি করে সম্ভব বিয়ে করে বিদেশে হানিমুনে যাওয়া! 

 

তুমি বলতা, ও চিন্তা বাদ দাও, তুমি আমার সঙ্গে থাকলে দ্বীপ, সমুদ্র তো দূর, অন্ধকার আকাশও মনে হবে হানিমুন।

কিন্তু উপল বলত, ‘আমি চাইলে এখনি যেতে পারি।’

তুমি বুঝতে পারতা না, ও কিভাবে যেতে পারে? তবে শুনেছো ছাত্রনেতাদের নাকি অনেক পাওয়ার। উপলটা যেন দিনে দিনে কেমন হয়ে যাচ্ছিল। সেই ছোটোবেলায় পাশের বাড়ির একটু ছটফটে অথচ পড়ুয়া, মেধাবী ছেলে উপল যেন এ নয়। তবে এই উপলকেও তুমি ভালোবাসো। উপলকে ভালোবাসাটা তোমার ক্ষেত্রে অনেকটা নিয়তির মতো হয়ে গেছিল। সেই কৈশোর পেরোনো সময় থেকেই তুমি উপলকে ভালোবাসো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে বদলে যাওয়া উপলের জন্যও ভালোবাসায় কোনো ছেদ পড়ে নাই। অন্ধ প্রেম বলে একটা কথা আছে না! আসলে শিক্ষা তোমাকে বদলে দিতে পারে নাই! তোমার অভ্যাসের পরিবর্তন করে নাই। কিছুটা দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন ঘটালেও  সেই বিবর্তন তোমার দৃষ্টিকে আরো সংকীর্ণ করেছে! নইলে তুমি সবটা আন্দাজ করতে পেরেও কীভাবে ওই ভালোবাসায় অটল থাকতে পারলা! নাকি উপলের সব বদলে গেলেও হৃদয়ের ওই অংশটা বদলায় নাই!

পল তার পার্টির স্টুডেন্ট উইং-এর বড় নেতা হয়ে উঠেছিল। উপলকে ঠিক ওভাবে মহড়া দিয়ে টেন্ডারবাজি করতে হতো না। আবার তার হাত গলে টেন্ডার এধার ওধার হওয়ার জো-ও ছিল না। একটা ছাত্রত্ব না পেরোনো ছেলের হাতে ছিল ক্যাম্পাসের ও এলাকার সব ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের টেন্ডারের কলকাঠি। এঞ্জিনিয়াররা তাকে সমীহ করে চলত। কমিশনের টাকা তাদের পকেটেও যেত বলা বাহুল্য। তবে দলের মধ্যে গ্রুপিং ছিল। উপলের নেতা দুর্নীতির কারণে হোক বা স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই হোক দিনে দিনে দুর্বল হয়ে যেতে লাগল। শক্তিশালী হয়ে উঠছিল অপর গ্রুপের নেতা। একই দলের নেতা হওয়ায় উপল তলে তলে তার সাথেও সম্পর্ক রেখে চলছিল। একমাস সতের দিনের ওই স্বল্প সময়ে তুমিও সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলে। তুমি বরাবরই একটু বুদ্ধিমতি। একটা সাধারণ রাজনীতিবিমুখ পরিবার থেকে এসেও খুব অল্প সময়ে তুমি উপলের পলিটিক্যাল পালস ধরতে সক্ষম হয়েছিলে। কিন্তু ওকে যে এইসব গ্রুপিং-এর শিকার হতে হবে সেটা বুঝতে পারো নাই।

বিয়ের পর উপল রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে বাসায় চলে আসত। একটা রাজনীতি করা ছেলের জন্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, না!  বন্ধুরা অনেকেই এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছে, কিন্তু উপল গায়েই মখে নাই। সে তোমার সাথেই কাটাতে চেয়েছে সারাক্ষণ সারাবধি। কিন্তু সেদিন রাতে- মানে সেই একমাস সতের দিনের রাত। সেদিন রাত দশটা পেরিয়ে ১২টা বেজে গেলেও উপল ফিরল না। উৎকণ্ঠিত তুমি রাত এগারোটার দিকে ফোন করলা, উপল একটু নিচু গলায় বলল, একটা জরুরি মিটিং-এ আছি। তোমার শাশুড়িমাকেও কেমন একটু চিন্তিত মনে হলো। আবার বললেন, ‘মাঝে মাঝে তো এমন দেরি করে প্রায়ই। তোমাকে বিয়ে করার আগে তো অনেক রাতেই ফিরত না। হস্টেলে থেকে যেত’।

এই একমাস সতের দিনে এমন হলো, উপলকে ছাড়া তোমারও যেন এক মুহূর্ত কাটে না। কেন এমন হয়েছিল কে জানে! উনমনা তুমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে একটু সাজলে। রাতে পরার জন্য একটা সেক্সি লন্ঝরে বের করলে। পোশাকটা হাতে নিয়ে তোমার সারা শরীরে কেমন একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল। ইউটিউবে একটা ফিল্মও দেখার চেষ্টা করলে। কিন্তু কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছিলে না।

ফোনটা এলো রাত একটার দিকে। উপলের নাম্বার থেকেই। কিন্তু ওপাশ থেকে অন্য কেউ একজন অস্থির গলায় বলতে লাগল উপলকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কেন নেয়া হয়েছে, কী জন্য? তুমি ক্রমাগত প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেতে লাগলে কিন্তু আর কোনো উত্তর না দিয়েই লাইনটা কেটে দিলো লোকটা। তোমার শরীরের সমস্ত রক্ত চলাচল যেন থেমে গেছে, হাত-পা সব থরথর করে কাঁপছে। আর তোমার শাশুড়িমা পাগলের মতো বিলাপ করতে লাগলেন।

না, উপল মরে যায় নাই তখনো। বেঁচে আছে। গোটা সাতেক গুলি লেগেছে গাড়িতে এবং শরীর মিলিয়ে। হাসপাতাল থৈ থৈ করছিল উপলের গ্রুপের লোক, অন্য গ্রুপের লোকজনও আছে। সব ক্ষমতার কেন্দ্র যখন একখানে- তখন কে কাকে ডরায়! তারা গোলাকার হয়ে হাসপাতালের এ কোনে, সে কোনে দাঁড়িয়ে ফিসফাস, কোলাহলে মত্ত।

 


বেশ কয়েকজন পোষাকধারী এবং সাদা পোষাকের পুলিশকে নির্বিকার ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। 

 

এমারজেন্সির সামনে একটা চেয়ারে তুমি বসে আছো। তোমার মা তোমার একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছেন। যেন সব রকম অভয় আর নির্ভরতা সেই স্পর্শের ভেতরে। তোমার সরকারি কর্মকর্তা মা খুব শক্ত ধরনের মানুষ। সব পরিস্থিতি খুব শক্ত হাতে মোকাবেলা করতে পারেন। তিনি ভেতরে ভেতরে ভেঙে গেলেও বাইরে কাউকে বুঝতে দেবেন না। তোমাদের পরিবারের ওপর থেকে বয়ে যাওয়া সব ঝড় ঝঞ্ঝায় মা একমাত্র আশ্রয়। তুমি সেই আশ্রয়কে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চাইছো তখন।

একটু দূরে তোমার বাবা ওটির দরজার পাশে দাাঁড়িয়ে আছেন। বাবা সম্পূর্ণ তোমার মায়ের বিপরীত। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর এখন রাতদিন ঘরেই বসে থাকেন, বই পড়েন, বাগান করেন। কত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কনসালটেন্সির অফার এসেছে কিন্তু তিনি যাবেন না কোথাও। তোমার সাদামাটা নির্বিরোধী বাবাকে বড্ড অসহায় লাগছে দেখতে। যদিও ওই মুহূর্তে তোমার কোনো বোধ কাজ করছিল না, তারপরও তোমার কেন জানি তখন মনে হচ্ছিল, তোমার বাবা-মাকে আজ এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার জন্য তুমিই দায়ী।

ছোটোবেলা থেকে তারা উপলকে চিনলেও, ওরকম একটা মেধাবী ছেলেকে মেয়ের জামাই হিসেবে ভাবতে এক সময়ে তাদের কোনো অসুবিধা না থাকলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে উপল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর তারা আর উপলকে পছন্দ করতেন না। বাবা বলতেন, ‘এই বয়সটা আপোষ করার বয়স না। তারুণ্য মানুষের যুদ্ধে যাওয়ার সময়। এই সময়ে যে ছেলে ক্ষমতার মোহে টাকার মোহে পড়ে যায়, সে কখনো ভালোমানুষ হতে পারে না। তুমি কি ভাবো ও কোনোদিন ভালো নেতা হবে? কিভাবে হবে! এদের সামনে কোনো রোল মডেল নাই। আফসোস, এদেশে আর কোনা হিরো জন্মাবে না। জন্মাবে শুধু ক্ষমতার রাজনীতির ক্ষুদ কুড়ো খাওয়া ক্লাউন। অরিত্রি, আমি আবারো বলছি,  তুমি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করতে যাচ্ছো এখন।’

কিন্তু তুমি তোমার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করতে পারলে না। এ তো হওয়ারই ছিল। নষ্ট হয়ে যাওয়া পলিটিক্যাল সিস্টেম একজন মানুষকে কতক্ষণ স্বাভাবিক মানুষ থাকতে দেয়!  উপলও থাকতে পারে নাই।

সে রাতে উপল কোমায় চলে গেলো। উপল বেঁচে আছে, ওই সময়ে এই খবরটুকুই ছিল তোমার জীবনে অনেক বড় সান্ত্বনা। তুমি যেন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো একটা কিছু পেলে। আহত উপলকে নিয়ে তোমরা তখন এক তীব্র যুদ্ধে নেমেছো। উপলকে ফিরিয়ে আনার এক তীব্র লড়াইয়ের রসদ যেন তোমার হাতের মুঠোয় তখন। উপলকে বাঁচিয়ে তোলার এক অসম্ভব যুদ্ধ চলছে তখন তোমার ভেতরে ও বাইরে। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতাল। এক দেশ থেকে আরেক দেশ। তুমি ভীষণভাবে চেয়েছিলে উপল একবার অন্তত বেঁচে উঠুক। এই বয়সটাতো নষ্ট হয়ে যাওয়ার বয়স না, এটাই তো ঘুরে দাঁড়ানোর বয়স, প্রতিবাদে গর্জে ওঠার সময়। উপল কি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না?

তুমি ওর কাছে জানতে চাও। ভীষণভাবে জানতে চাও, ‘কেন তোমরা সবকিছু বদলে দিতে না চেয়ে বরং নিজেরাই বদলে যাও, উপল’?

তুমি এ-ও জানো এই প্রশ্নের কোনো শুদ্ধ উত্তর তোমার জন্য অপেক্ষা করে নেই। তারপরও এ প্রশ্ন তুমি জারি রাখতে চাও।


গাজী তানজিয়া

কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭। ব্যবসায় প্রশাসন ও সামাজিক বিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। প্রথম উপন্যাস জাতিস্মর। প্রকাশিত উপন্যাস পৃথিবীলোক, কালের নায়ক, বায়বীয় রঙ ও আন্ডারগ্রাউন্ড। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জগৎ বাড়ি’। আর কিশোর গল্প ‘সবুজ ঘাসে মুক্ত বেশে’। প্রথম উপন্যাসের জন্য পান আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার ২০১০।

শেয়ার