গল্পকার ও প্রাবন্ধিক আবু হেনা মোস্তফা এনামের নতুন গল্পগ্রন্থ গোলাপ নির্মাণের গণিত-এর নামগল্পটি শিরিষের ডালপালায় প্রকাশ হলো। বইটির প্রকাশক কথাপ্রকাশ।
গল্পের প্রকীর্ণ করতল
অসহায়তা তীব্র হতে হতে নিজের মন ও মস্তিষ্ক কুঁকড়ে যেতে থাকে। ক্রুশকাঠে ঝুলতে থাকি মানবসম্বন্ধের গোপন অন্ধকারে। ভাবি, দু-একটি গ্রন্থপাঠের ঠুনকো স্মৃতি মূলত জ্ঞানকাণ্ডের কোনোকছিুই বুঝতে না পারার অক্ষমতা ও র্ব্যথতা নিয়ে মানবমনের দুষ্পাঠ্য অন্দর কীভাবে আবিষ্ক্রিয়ার দুঃসাহস সঞ্চয় করি? কীভাবে পাখি ও পুষ্পের, মেঘ এবং বিকেলে প্রপঞ্চ ভেদ করি? কীভাবে বস্তু ও ব্যক্তির আন্তঃসর্ম্পক গঠনের বিদ্যা অর্জিত হয়? অথবা সৌরমণ্ডলীর সঙ্গে নিসর্গের সাঁকো নির্মাণের চোরাস্রোতে কীভাবে ফুটে ওঠে গোলাপ? পাখিরা কীভাবে মেঘ হয়ে যায়? এবং এসব কি জাগতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন, আনন্দ থেকে শূন্যতায় ডুবে যাওয়া মানুষের লিখনচর্চার মতো অপচায়িত, কলুষিত ও দূষিত রক্ত বিশুদ্ধ করতে পারে? ভেবে ভয় হয়। দ্বিধা হয়। শঙ্কা হয়। গোপন অসুখের মতো আনন্দ হয়। বিষাদ হয়। অপ্রকাশের গ্লানি হয়। এতকিছু হয় অথচ অনিবার্য হয়ে ওঠে আত্মবিচ্ছিন্নতার চোরকুঠরি। যেখানে আলো-অন্ধকারের অস্ফুট ধ্বনির ভেতর চোখের লণ্ঠন উঁচিয়ে উজ্জ্বল হয় টুকরো টুকরো ব্যর্থ রূপক।
সেসব রূপক চেনা বাস্তব এড়িয়ে নতুন এক বাস্তবতার মধ্যে অর্ন্তলীন হয়ে ওঠে, যা প্রকৃতির সঙ্গে মানবসম্বন্ধের, বস্তুর সঙ্গে মনীষার, শিল্পকলার সঙ্গে অনুভবের নতুন ভুবন সম্প্রসারিত করে। সেখানে কল্পনামনীষার একটা প্রেক্ষাপট সৃষ্টির সুযোগ ঘটে হয়তো।
ফলত, গল্পে চেনা মানুষ ও জনপদ অচেনা হয়ে ওঠে। পরিচিত বাস্তব ভেঙে নির্মিত হয় পরাবাস্তব এবং জাদুবাস্তব জগৎ। সেখানে প্রকৃতি আর মানুষ, বস্তু এবং সজীব প্রাণ একাকার। কখনো সংগীতময়তা, কখনো চিত্রকলা। কখনো রঙের বিন্যাস, কখনো মনোজগতের সূক্ষ্ম অনুভূতি। তাতে বদলে গেছে প্রবহমান সময়ের ধারণা। কাল সেখানে নিরন্তর আবর্তিত। এভাবেই এই বইয়ের গল্পগুলোর বুনন।
এই তবে। আসুন। ভ্রমণ করা যাক এই গল্পের ভুবনে। গোলাপ ও গ্রামের স্মরণে। বিহঙ্গ ও বিকেলের নামে। সোনালি খড় ও ছেঁড়া কাগজের স্মৃতির উন্মোচনে।
শরৎকালের এক ভোরে, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ, কেউ বলে ১২২৬। শরৎ অথবা হেমন্তকালের। গ্রামের লোকেরা বলে, আমাদের গৃহবাসী নিস্তরঙ্গ জীবনে ধীর প্রবহমান নদীর উপর ভাসমান ঘন কুয়াশার ভেতর ভোর হারিয়েছিল। এমন যে, হাজার হাজার পাখির উড়ন্ত ডানার বিলীয়মান ধ্বনি ও ছায়ার ভেতর ভোর হারিয়ে, গ্রামের লোকেরা, অনেক অনেকদিন পর, কুয়াশার ভেতর অসংখ্য গোলাপের লাল পাপড়ি উড়ে আসতে দেখে।
কিন্তু লাল গোলাপ বসন্তই বা কেন, বসন্তে তো অনেক ফুলের রং, এবং ভোর অনেক রকমের আলো স্বচ্ছতার মায়া হয়। আমরা, তবু, হয়তো বা ভোর আর গোলাপেরই প্রতীক্ষা করি। এত বিস্ময়। গোলাপে। ভোরে। আমরা ভোরের নিঃশব্দে এবং কখনো চাপা উল্লাসের ভেতর নীল নরম আলোয় চোখ মেলে দেখি, গোলাপ ফুটছে। আমাদের জানলায় ভোর লাফিয়ে পড়লে ছেঁড়া টুকরো ভোরের ভেতর গোলাপের লাল ছড়িয়ে পড়ে। তখন, আমাদের, ১৩২৬ বঙ্গাব্দের শরৎকালের এক ভোরের কথা মনে হয়; কেউ বলে শরৎ বা হেমন্তকালের। কেউ বলে ১২২৬। যা ভোর বা শরৎকালের অথবা হেমন্তের। বলে, একদিন ভোর, তখন প্রতিদিন ভোর!
অনেক অনেকদিন পর, ঘন মেঘের মতো কুয়াশা খোলা জানলা দিয়ে আমাদের ঘরের ভেতর ঢোকে, মনে পড়ে, ১৩২৬ বা ১২২৬ বঙ্গাব্দের শরৎ অথবা হেমন্তকালের এক ভোরে, গ্রামের লোকেরা, ভোর খুঁজে না পেলে প্রথমে কালো মেঘের বিস্তার ভেবেছিল, অথবা তখনও রাত ফুরায়নি ভেবে পুনরায় নিদ্রা গেলে আচমকা হাজার হাজার উড়ন্ত পাখির ডানার পতপত আওয়াজে তাদের ঘুম ভেঙে যায়, এবং গ্রামের লোকেরা দেখে, তারা ভোর হারিয়েছে। গগনশিরীষ গাছের ছায়ার মতো তাদের চোখে বিভ্রম ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে যাবার পথ হারিয়ে যায়। আলপথ নদী হারায়। শুকনো পাতার ঘুম ঘুম গান হারায়। একদিন দুইদিন তিনদিন চারদিন পাঁচদিন —অনেক অনেকদিন ভোর হারিয়ে গ্রামের লোকেরা দেখে তাদের শস্যখেতজুড়ে মৃত খড়; তাদের উঠান, আলপথ ধুলোময়। তারা ঘুম ভেঙে উঠানে নামলে আলপথে নামলে ধুলো নাকের ভেতর চোখের ভেতর কানের ভেতর কর কর কর কর বাজে, তারা তখন রাতের শিশিরকে বলে ধুলো ভিজিয়ে দিতে, তাদের আনন্দ দৌড়ে যায় গোপন রাতের কাছে, শিশিরের কাছে। তারা রাতের ভেতর দেখে শিশির ঝরছে—ঝরঝর ঝরঝর। রাতের শিশিরের উপর বিন্দু বিন্দু চাঁদ, ঝলমল—এত চাঁদ গ্রামের উঠানে আলপথে মাঠে নদীতে—যেন হাজার হাজার জোনাকি বসে আছে আলো জ্বেলে। গ্রামজুড়ে হাজার হাজার চাঁদ ঝলমল করলে গ্রামের লোকেরা তখন ভোর হারানোর শোক ভুলে যায়। মাঠে শিশিরের রাজ্য শেষ হয় না। যেন হাওয়ার বীজ চূর্ণ করে আলোর গন্ধ বেরিয়ে আসছে, আর একটা ঘাঘরাশাকের ঝাড় উন্মুখ হয়ে উঠছে। গ্রামের লোকেরা কথা বলে জোনাকির ভাষায়। তাদের কণ্ঠস্বর ঘুম ঘুম ঢেউ হয়ে চলে যাচ্ছে হারানো নদীর সঙ্গে। হাজার হাজার চাঁদ জোনাকির ঝিকমিক পুচ্ছ জ্বেলে উড়ে এলে তারা আলোর কথা বলে। ঝোপে। মাঠে। আলপথে। এবং তারা হয়তো ভুল করে—গ্রামের লোকেরা উঠানে নামলে, আলপথে পা বাড়ালে তাদের পায়ে পায়ে শিশির জড়িয়ে গেলে চাঁদ হারায়। গ্রামের লোকেদের পায়ের ভেতর চাঁদের মৃত্যু হলে, তখন, তারা ভীষণ বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং গ্রামের লোকেরা দেখে; তাদের রক্তের বিহ্বলতার ভেতর, যারা হয় জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ, তারা রাতের বিজন জ্যোৎস্নার ভেতর উঠানে আলপথে স্তিমিত আলোয় কানামাছি খেলছে। তখন গ্রামের লোকদের বিস্ময় যে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের পায়ের ভেতর শিশির ছড়িয়ে গেলে বিন্দু বিন্দু চাঁদ হারায় না, বিন্দু বিন্দু শিশিরচাঁদ এই বালকবালিকার পায়ের ভেতর ফুটে থাকে এবং আকুল হয়ে জ্যোৎস্না ঝরায়। গ্রামের লোকেরা তখন বলে, তারা চাঁদবালিকা এবং চাঁদবালক। অনেক অনেক বছর পর আমাদের গ্রামে রাতের কুয়াশার ভেতর উঠানে ঘাঘরাশাকের ঝোপে বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলে উঠলে গ্রামের লোকদের মনে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের সেইসব স্মৃতি জেগে ওঠে।
তখন গ্রামের লোকেরা রোমাঞ্চে শিহরিত হয়, দেখে আমাদের নিঃশ্বাসে গোলাপের গন্ধ ঢুকে গেলে শরীর বিছিয়ে আছে ভোরে। গৃহ এবং উঠান ছড়িয়ে আছে ভোরে। তখন শরীরই যেন গৃহ এবং উঠান যে সে শুধু মায়াময় মৃদু জানলা-দরজা খুলে ভোরকে ডাকে, কিংবা গৃহের ভেতর ভোর ঢুকলে তা ফুলের গন্ধের বিভ্রম আনে। ভোরের গোলাপও নিদারুণ কুয়াশায় আমাদের শরীর লালের অনুকরণ করে; আর গোলাপের গন্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক আসে, গ্রামে; আগন্তুকদের পেয়ে গোপন আনন্দ হয়।
আমাদের গ্রামের সকল গৃহ ভোরের ভেতর, তখন, গ্রামের লোকদের নিদ্রা ও জাগরণে দিনের সূচনার এই বিস্ময় তৈরি হয়। আমরা দেখি গ্রামের ধূলির ভেতর একটা ভোর লুকিয়ে, একটা কুয়াশা লুকিয়ে, একটা আস্ত রাত লুপ্ত হয়ে আছে। এসব ভোর এবং কুয়াশার ভেতর আমরা হাঁটি; গ্রামের পথে, নদীর ভেতর, বৃক্ষের ভেতর, শস্যের ভেতর, পোকামাকড়ের ভেতর। যত হাঁটি—গ্রামের লোকেদের পায়ের ভেতর নদী উড়তে থাকে, বৃক্ষ উড়তে থাকে, শস্য উড়তে থাকে, পতঙ্গ উড়তে থাকে। আর পায়ের ভেতর বাড়ির কাছে বৃক্ষ, বৃক্ষের ভেতর ধূলির কাছে গোলাপবাগান ছড়িয়ে পড়ে।
তখন, বাগানের ভেতর একটা বিষণ্ন পাতাশূন্য ন্যাড়ামুড়ো গাছ মেঘ আর কুয়াশার ভেতর উঁকি দিয়ে। আমরা কত কত কাল এই গাছের দিকে দেখিনি; সে কি মৃত, সে কি সজীব; অথবা হয়তো তার বয়সের গাছপাথর ভেবে, আমাদের অজ্ঞতার ভেতর দেখি, তার শূন্য ডালে মেঘের ঝাপসা ছায়া। দুলছে। মন্থর বাতাসে। কুয়াশাবৃত ন্যাড়ামুড়ো প্রাচীন গাছটা আমাদের গ্রামে কত কত কাল ঐশ্বর্য হয়ে আছে। মেঘের ভেতর দাঁড়িয়ে। মেঘ ছুঁয়ে। তার শূন্য ডাল ফুলের গন্ধের বিভ্রম আনে যে তার স্পর্শে আমাদের স্মৃতি ওলোটপালট খেতে থাকে। এবং বাগানে তারাফুল ফোটে ভোরের স্বচ্ছতার ভেতর। বাগানে, গাছের মাথায় মেঘ। ছুটছে। যেন নদী। বহমান মেঘকে গোলাপ ভেবে আমরা গ্রামের চতুর্দিকে নদী রচনা করি—নদী আমাদের গ্রামের মাঠে। মেঘে। নদীর ভেতর মেঘদলের বিবিধ রং খেলা করে। এসব রং নদী ছুঁয়ে থাকা গাছে ছড়িয়ে গেলে আমাদের গ্রাম রঙিন হয়ে ওঠে; তখন, গ্রামের লোকেরা আগন্তুকদের আমাদের ঘরের দেয়ালচিত্রে গোলাপের আঁকিবুকি দেখায়, জানলা-দরজার চারদিকে লতানো গোলাপের আল্পনা দেখায়; আগন্তুকরা আমাদের প্রপিতামহ পিতামহদের রেখে যাওয়া পথে পথে লেখা গোলাপের এপিটাফ পড়ে। তখন, আমরা গ্রামের ছায়ার ভেতরে প্রবেশ করি, মেঘের ঘুম ঘুম গানের ভেতর প্রবেশ করি, বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছের ডাল ছুঁয়ে দৌড়ানো স্বেচ্ছাচারী মেঘ আর কুয়াশার ভেতর প্রবেশ করি।
মেঘের রং গোলাপের ভেতর ছড়িয়ে। মেঘের কত রং। মেঘের শরীরে টুকরো টুকরো রঙের নদী বয়ে যেতে দেখি। এসব মেঘ এবং গোলাপ আমাদের গৃহে গৃহে বাগান রচনা করে। মেঘের বাগান। গোলাপের বাগান। আমরা বাড়ি থেকে দূরে গেলে মেঘ পায়ে জড়িয়ে যায়, গোলাপের রেণু পায়ের আঁধারবিচূর্ণ অনুভূতির ভেতর শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। দেখি, দূরে এবং নিকটে আমাদের গৃহ এবং শৈশবের ভেতর শিশুহস্তে আঁকা স্থূল মেঘ ভোরের নদীর মতো বয়ে চলেছে। মেঘ তবে কি আমাদের গৃহ এবং শৈশবের নিঃসঙ্গতম প্রতিভা! এই নতুন পরিচয় আবিষ্কৃত হলে আমরা আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ি। এবং গ্রামের লোকেরা ন্যাড়ামুড়ো গাছের ডালে ঝুলন্ত মেঘের ঝাপসা ছায়ার ভেতর থেকে অসংখ্য গোলাপ ফুলের লাল পাপড়ি উড়ে আসতে দেখে; লাল গোলাপপাপড়ি উড়ে উড়ে পড়ে আমাদের গৃহে, মাঠে, শস্যে, আলপথে, শিশুকালের বইয়ের ভাঁজে।
তখন, আমাদের গ্রামে শরৎকালের এক ভোরে, ভোরের কুয়াশা জড়ানো আলো লাল হয়ে ওঠে; ১৪২৬ বঙ্গাব্দে, আমাদের গৃহবাসী নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে, ধীর প্রবহমান এবং নিঃশব্দ নদীর উপর ভাসমান কুয়াশা গ্রামের লোকদের গৃহ, উঠান, শস্যখেত, আলপথ এবং গাছের ডালপাতায় ছড়িয়ে পড়ে। কুয়াশার ভেতর উড়ে বেড়ানো অসংখ্য গোলাপের লাল পাপড়ি আমাদের আচ্ছন্ন করে, আমরা রোমাঞ্চিত হই—যে রোমাঞ্চে বিস্ময় ছিল, যে বিস্ময়ের স্পন্দন নাই অথচ; কেননা তাতে আমাদের বিস্ময় তখনও হয়তো কিছুটা বাকি ছিল; আমরা অনেক অনেকদিন পর আবিষ্কার করি—এই ঘটনার বৃত্তান্ত আমাদের রোমাঞ্চের বাইরে পৃথিবীর দেশে দেশে আশ্চর্য বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। কিন্তু এইসব বৃত্তান্ত গ্রামের লোকদের রোমাঞ্চিত জীবনের উত্তেজনায় কোনো বিঘ্ন ঘটায় না। তখন, গ্রামের ভোরে, তিন সপ্তাহ ধরে ভাসমান কুয়াশায় গোলাপের লাল পাপড়ি উড়ে উড়ে উঠান, ঘরের চাল, রান্নাঘর, বারান্দা, জানলা, বিছানা, শিশুকালের বই, শস্যখেত, আলপথ, নদী, বিল, ঝোপঝাড়, বাঁশবনে ঝরে পড়া শেষ হলে নতুন চঞ্চলতা সৃষ্টি হয়।
আমরা নির্বাক বিস্ময়ে দেখি, ঝরে পড়া গোলাপের লাল পাপড়ি থেকে ধূসর ঘাসের ভেতর গজিয়ে উঠছে আলাভোলা শিশু চারা গাছ। আমাদের বাড়ির পচনশীল পুরোনো খড়ের চালে, মাটির বারন্দার কোণাকাঞ্চিতে, নদীর পাড়ে, রাস্তার ধারে, আলপথে, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গোলাপের শিশু গাছ ছোট ছোট দুটি কচি সবুজ পাতার বিস্ময়ে জন্ম নিলে গ্রামে নতুন ভোর শুরু হয়। তখন, একটা কুয়াশাভোর, একদিন কুয়াশাভোর; তখন প্রতিদিন কুয়াশাভোর—আমরা গোলাপ গাছের অলৌকিক লাল জগতে ঢুকি। আমাদের গ্রামের রোমাঞ্চিত মানুষেরা দেখে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কীভাবে রাত প্রস্ফুটিত হয়, বৃক্ষ প্রস্ফুটিত হয়, শস্য প্রস্ফুটিত হয়। শিশিরের ভেতর গোলাপশস্য ধীরে ধীরে তাদের পাপড়ি মেলে ধরে অস্ফুটে। এবং তখন আমাদের মনে হতে থাকে, গ্রামের ভোরে পুঞ্জিভূত কুয়াশামেঘে হয়তো বর্ষাকাল বয়ে আনবে। গ্রামের মানুষের বিস্ময় যে, আমাদের বিনোদনবঞ্চিত নিস্তরঙ্গ জীবনে সত্যিই একদিন কুয়াশামেঘ ভেঙে বর্ষা নামে। মানুষের বিস্ময় কেটে গেলে আমরা দেখি, বর্ষার ঝর ঝর ঝর জলের রুপালি ঐশ্বর্য বয়ে চলেছে আমাদের নদীর ভেতর ভাসমান মেঘে; দেখি, আমাদের উঠান, শস্যখেত বর্ষার ঝর ঝর ঝর জলে ভিজে গর্ভবতী গাভীর পেটের মতো স্ফিত মাটি, এবং তখন, রসালো মাটির গর্ভ ফুঁড়ে গোলাপের চারাগুলো লকলকিয়ে বেড়ে উঠছে।
তখন, একদিন, ঝর ঝর ঝর বর্ষায় ভেজা গোলাপ চারার সবুজ দুটি পাতা পরস্পর জড়াজড়ি থাকলে, মনে হয়, যুগল মানুষের অবয়ব। বৃষ্টির মধ্যে তারা। মেঘের মধ্যে তারা। তারা বস্তুত গোলাপ চারার পাতা কি না এমন সন্দেহ। মনে হয়, ন্যাড়ামুড়ো গাছের ডালে ঝুলন্ত ছায়া মানুষের শরীর নিয়ে; এবং তারা চাপ চাপ মেঘের মধ্যে দুলছে। মন্থর বাতাসে আমরা প্রাচীন স্মৃতির ভেতর ডুবে যেতে থাকি; সেই অস্পষ্ট স্মৃতি আমাদের মনের ভেতর বিবর্ণ ছেঁড়া টুকরো কুয়াশার মতো ঘুম ঘুম। তখন, গ্রামের লোকেরা, কুয়াশায় ভিজে ভিজে ধূসর ঘাসের ভেতর থেকে খড়ের চাল উঠানের কোনাকাঞ্চি ধানখেত আলপথ আর শিশুকালের পাঠ্যবইয়ের ভেতর থেকে গোলাপের ন্যালাভোলা শিশু চারাগুলো তুলে আনে; অতঃপর চারাগুলো বাগানের ন্যাড়ামুড়ো প্রাচীন গাছের চারপাশে রোপণ করে। গ্রামের লোকেরা ঘরের বাইরে আসে—ভোরে। কুয়াশায়। তাদের পায়ের ভেতর ঘরের প্রতিভায় কুয়াশামেঘ, মেঘের ভেতর পায়ের প্রতিভায় গোলাপের বাগান ছড়িয়ে পড়ে। তখন গ্রামের চারদিকে এত গোলাপ বাগান যে, আমাদের গৃহ ও গ্রামজীবনের সকল সবুজ, ফুল ও পাখি, নদী ও মেঘের নীল বিকিরণকে গোলাপের হৃদয় জয় করেছিল; এবং স্মৃতির ভেতর ডুবে যেতে যেতে মনে পড়ে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের নাম প্রাচীন গন্ধের মতো আমাদের গ্রামের ভোর এবং অস্পষ্ট কুয়াশায় গোলাপ ফুলের লাল পাপড়ির ভেতর উড়েছিল; তখন, হয়তো, ১৩২৬ বঙ্গাব্দ, এবং শরৎকালের একটি ভোর। বিষণ্ন। এবং কেউ বলে ১২২৬। শরৎ বা হেমন্তকাল, এবং এই ভোর বর্ণনার নিদারুণ হয়।
গ্রামের লোকেরা, ঘন মেঘের মতো কুয়াশা খোলা জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলে পুনরায় তাদের ভয় হয়, ভোর হারানোর ভয়ার্ত স্মৃতি ফিরে আসে এবং ঘুম ঘুম আলস্যের ভেতর হাজার হাজার উড়ন্ত পাখির ডানার বিলীয়মান ধ্বনি ও ছায়া শোনার প্রতীক্ষা করে। কিন্তু, এমন যে, তারা কোনো আওয়াজ শুনতে পায় না, তারা দেখে ঘন কুয়াশার ভেতর উড়ে আসছে গোলাপের লাল পাপড়ি। তখন, গ্রামের লোকেরা জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের স্মৃতির ভেতর বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে; তবে, এই যে, আমাদের গ্রামের চারদিকে গোলাপ বাগান, এমনই যে, গোলাপের লাল ছায়ায় জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের হৃদয় রূপায়িত হয়। গোলাপের উন্মোচন অথবা গগনশিরীষের ছায়ায় তাদের চোখ উপচে পড়ে আনন্দের অশ্রুফোঁটা। হয়তো অশ্রু এতই সংক্রামক যে তারা ব্যথিত হতে পারত। তারা টুকরো টুকরো শিশিরের শব্দ হয়ে উঠতে পারত। তাদের বাক্য ছিল না, শুধু অশ্রুর ঐশ্বর্যে তাদের হৃদয় নির্বাক হয়ে ছিল। এবং তারা ব্যথার মাধুর্যে স্তব্ধতায় জোনাকির আলোকিত পুচ্ছের লাবণ্যে দুর্বিণীত হয়ে উঠলে আমরা শস্যখেতে ধান গম আলু মটরশুঁটির পরিবর্তে চাষ করি গোলাপ। এভাবে, তখন, গ্রামের রাতের ভেতর, দিনের ভেতর, ভোরের ভেতর, পাখির ভেতর, নদীর ভেতর, মেঘের ভেতর, পাঠ্যবইয়ের ভেতর গোলাপ ফুটতে থাকলে, এমন যে, আমাদের গ্রাম তখন গোলাপগ্রাম—পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আগন্তুকরা এমনই বলে, গোলাপের পর্যটন; তখন, আমাদের বিনোদনবঞ্চিত হৃদয়ে আনন্দ হয়, গ্রামের লোকেরা হলহল কলকল করে অজস্র কথা বলে; তারা বলে, যখন, পৃথিবী অন্ধকারে ডুবেছিল, আমরা সেই অন্ধকারে গোলাপের গন্ধ নিয়ে আকুল ভোরের ভেতর প্রবেশ করি। গ্রামের লোকদের এইসব গল্পগাছার ভেতর আমরা গোলাপ গাছের মৃত বিষণ্ন ডাল কেটে দিই, ঝরে যাওয়া গোলাপের বিষণ্ন পাপড়ি কুড়াই, আর দেখি কচি মোটা এক একটি শাখা সবুজ পাতার বিস্ময় নিয়ে অঙ্কুরিত হচ্ছে; তখন, এইসব রং মেঘ ছুঁয়ে আমাদের হাতে পায়ে চোখে চিবুকে প্রবেশ করে। গোলাপ এবং রঙের অনুভূতি নিয়ে আমরা ফিরে আসি বাড়িতে, পথে পথে পড়ে থাকে গোলাপপদচিহ্ন; তখন, ঋতুতে ঋতুতে যখন বৃষ্টিপ্রস্তুতি, রৌদ্রের উজ্জ্বল, মেঘ অথবা ছায়া ছায়া কুয়াশার গুঞ্জন—নদী বেয়ে, গোলাপপদচিহ্ন ছুঁয়ে ছুঁয়ে আগন্তুকের দল আসে আমাদের গ্রামে। তারা মেঘের ছায়া দেখে, গাছ দেখে, ধূলিমাটির বিন্যাস দেখে, রংবেরঙের প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখে।
আগন্তুকরা আমাদের গ্রামে অতিথি। তারা আসে হাওয়াঘোড়ায় চড়ে। আমরা তাদের বসতে দিই গোলাপবিছানায়। তারা দেখে, রাতের আহারে চূর্ণ গোলাপপাপড়ির ব্যঞ্জন; দিনের আহারে চূর্ণ গোলাপপাপড়ির সুঘ্রাণ। আগন্তুকরা আমাদের গ্রামের গ্রীষ্ম শোনে, আমরা শরতের গল্প বলি; তারা আমাদের বর্ষা শোনে, আমরা হেমন্তের গল্প বলি আর মেঘাবৃত ভোরকুয়াশার ভেতর উড়ন্ত গোলাপপাপড়ির ভেতর জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের স্মৃতির উন্মোচন দেখি, অথবা দেখি না; তাদের শরীর ভোরকুয়াশার ভেতর দিয়ে স্মৃতির বিস্ময় আনে। এত বিস্ময় যে নীরবতা তখন। আমরা বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছের কাণ্ড ছুঁয়ে ধীর প্রবহমান নদীর কাছে যাই, দেখি নদীর ভেতর সহস্র নৌকায় বয়ে চলেছে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপ।
গোলাপ যায় শহরে। আমাদের গ্রামের গোলাপ। প্রতিদিন। ভোর ভোর আঁধারে। যেন আমাদের গ্রাম যায় নৌকায়। শহরে। যেন আমাদের গৃহ মেঘ নদী গাছ পাখি প্রজাপতি শিশুকালের বই যায় শহরে। আমরা তখন ভাবছি, গ্রামে হয়তো কোনো নাগলিঙ্গম গাছের শুকনো শাখাপ্রাশাখার ছায়া পাওয়া যাবে। অথবা নদীতীরের ন্যাড়ামুড়ো প্রাচীন গাছটি গ্রামের জীবনী লিখতে পারে। গোলাপের মতো তারও কি আছে অখণ্ড অবসর? ন্যাড়ামুড়ো গাছটি কি পর্যাপ্ত সূর্যালোক, জল আর হাওয়া পাচ্ছে। গ্রামের জীবনী লিখতে গিয়ে তারও হয়তো আঙুল বিবশ হয়ে অনন্ত আঁধারে ঘুমিয়ে পড়তে পারে। ন্যাড়ামুড়ো গাছটির বিষাদ অনুভবের চেষ্টা হয়। হয়তো কোথাও কোনো ছায়াচক্র থেকে হাওয়াঘোড়ার হ্রেষা ভেসে আসে। আমরা গাছকে বলি আমাদের আশ্রয় দাও। নদীকে বলি আমাদের আড়াল দাও। বইকে বলি আমাদের অন্ধকার দাও।
গ্রামের লোকেরা দেখে, আমাদের গ্রামের বিকেল বসে আছে নদীর ঢেউ ছুঁয়ে। বিকেলের ভেতর প্রতিদিন আমাদের গৃহ গাছ পাখি প্রজাপতি ফিরে আসে নদীতে, নৌকায়। নদীর উপকণ্ঠে গোধূলিমেঘের ভেতর আমরা বর্ণনা করি গোলাপের জীবন; যেন গ্রামের লোকেরা, সকলেই, আরিস্ততল; আর পৃথিবীর বিবিধ প্রান্তের আগন্তুক যারা আসে গোলাপপদচিহ্ন চিনে চিনে, এইমাত্র যে, বলে গোলাপ আন্দোলন, তারা মুগ্ধ থিওফ্রেস্টাস। কিন্তু আমরা এদের চিনতে পারি না। জানি না তাদের নাম। আমাদের না চেনার ভেতর, না জানার ভেতর, তখন, গ্রামের আকাশে ভেসে বেড়ায় কয়লার গনগনে আগুনে পোড়ানো গোলাপপাপড়ির ধোঁয়া। গোলাপধোঁয়াগন্ধ মেঘের পানে উড়ে গেলে সুগন্ধি ভোরকুয়াশা নামে গ্রামে। আমাদের গ্রামের ভোরে। গ্রামের বাতাসে। বাতাস গ্রামের লোকদের বলে, গ্রামের সকল সুগন্ধের ভেতর গোলাপ ফুটে আছে; সকল মেঘের ভেতর গোলাপের নির্যাস বয়ে চলে। বলে, বইয়ের প্রাচীন ভাষা লেখা আছে গোলাপঅক্ষরে। বলে, গাছের সজীবতা, পতঙ্গের শূককীট আর হাজার হাজার শস্যের ভেতর সে সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে। সকল গোলাপবই পড়ে গ্রামের লোকদের যকৃতে ব্যামো হলে, আমাদের গৃহের নারীরা চিনি মিশিয়ে গোলাপের চূর্ণপাপড়ি খেতে দেয়—সেসব গোলাপবই পড়ে গ্রামের লোকেরা বোঝে যে গোলাপ কত হাজার হাজার যকৃৎকে বাঁচায়, তখন, গ্রামের লোকেরা গোলাপজলে গোসল করে। আর, প্রতিদিন গোলাপজলে আমাদের শরীর রূপায়িত হলে, আমাদের শরীর যেন জ্যোৎস্নাধোয়া; যেন গ্রামের নারীদের মুখে চাঁদ, গ্রামের পুরুষদের মুখে চাঁদ, শিশুদের মুখে চাঁদ। এত চাঁদ আমাদের গ্রামে—মাটির লাবণ্য এবং আকাশের নীল অঞ্জলিবদ্ধ করেছিল। আর এত জ্যোৎস্না আমাদের বইয়ের ভেতর—প্রাচীন বাক্যের ঐশ্বর্যে স্তিমিত ছিল। তখন এক হিম হিম জ্যোৎস্নার বিস্ময় আমাদের স্মৃতির ভেতর অস্থিমজ্জা ভেদ করে চলে যায়। হিম হিম জ্যোৎস্না আমাদের শরীরের দিকে দেখে, হিম হিম জ্যোৎস্না মেঘের আড়াল থেকে আমাদের মাংসের ভেতর প্রবেশ করে। এবং আমরা এক জ্যোৎস্না থেকে আরেক জ্যোৎস্নার ভেতর যেতে যেতে অনেক অনেকদিন পর আমাদের পায়ের ভেতর চাঁদের মৃত্যুর স্মৃতি মনে করে বিহ্বল হয়ে পড়ি।
গ্রামের লোকেরা বলে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের মুখে চাঁদ ছিল, তাদের মুখে জ্যোৎস্না ছিল, তাদের চোখে প্রাচীন গোলাপবই ছিল। গ্রামের লোকেরা আরো বলে, তারা, চাঁদবালিকা এবং চাঁদবালক, হেঁটেছিল গ্রামের পথে পথে, বাগানে, বৃক্ষে, পাখির ভেতর, প্রজাপতির ভেতর, খড়ের হাওয়ায়; আর তাদের পায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল শিশিরজ্যোৎস্না। তাদের ভ্রমণ কী যে গোধূলি অলৌকিক হয়, বিকেল আশ্চর্য হয়; ধূলির ভেতর তাদের পায়ে কত আনন্দ, কত হাসি। আর বেদনারও আনন্দ সৌন্দর্য হয় যে গ্রামের ধূলি দুপুরের জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে। একদিন, কত কতদিন তারা ধূলিজ্যোৎস্নায় হেঁটেছিল যে তাদের নিঃশব্দ হাসির জ্যোৎস্না দুলছে এক টুকরো ভোর; গ্রামের লোকেরা তখন, অনেক অনেকদিন পর জানতে পারে, গ্রামে ভোর হারিয়ে গেলে শরৎ অথবা হেমন্তের রাতে শিশিরজ্যোৎস্নার ভেতর এই বালকবালিকার প্রণয়ের আশ্চর্য; তারা ঘাসলতায় অলঙ্কার বানায়—হাতে পরে, গলায় পরে। তারা বুনো ফুল শুকিয়ে গুঁড়ো রং তৈরি করে, লেখার খাতায় রঙিন ছবি আঁকে—ফুল, পাখি, চাঁদ, নদী, নীল মেঘ আর পাখির ডানায় উড়ে যাচ্ছে দুটি বালক-বালিকা। তারা দুজন একই অলঙ্কার বানায়, তারা দুজন একই ছবি আঁকে, প্রতিদিন একই ছবিতে তারা রং করে,—জিনিয়া আখতার ঘাসলতা তুলে আনলে আবু সাইদ গলার অলঙ্কার বানায়; অথবা আবু সাইদ ঘাসলতা খুঁজে আনলে জিনিয়া আখতার হাতের অলঙ্কার বানায়, তখন, আবু সাইদ হাতের ভেতর জোনাকির আলো জ্বেলে প্রতীক্ষা করে। অথবা জিনিয়া আখতার হাতের ভেতর চাঁদ জ্বেলে আলো ছড়ায়—ধরা যাক সেটি একটি গগনশিরীষ; সেখানে ফুটে আছে শান্ত নদীর মতো ছায়াফুল, সেখানে গৃহ বানিয়েছে অঝোর বৃষ্টি, পাতায় জড়িয়ে আছে ঘুম ঘুম ঘাসলতার ঘন সবুজ। এই তবে, ঘাসলতার অলঙ্কার তাদের দুজনের হাতে গলায় পরা হলে তাদের মুখ একই রকম হয়ে ওঠে, তাদের কণ্ঠস্বর একই, তাদের একই চোখের তারা, একই হাসির ধ্বনি, একই রঙের পোশাক—যেমন আমাদের গ্রামের আকাশে প্রতিদিন একই চাঁদ।
বিন্দু বিন্দু শিশিরচাঁদের ভেতর, গ্রামের লোকেরা তখন, এই বালকবালিকার প্রণয়ের আশ্চর্য দেখে বিস্মিত হয়, এবং গোলাপের চূর্ণপাপড়ির ভেতর জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের প্রণয় রূপায়িত হলে, শরীর আশ্চর্য হলে, আগন্তুকের দল আমাদের বর্ষার গল্প শোনে। আমরা বসন্তের ফুল ছড়িয়ে দিই; তারা আমাদের শীতের সংগীত শোনে, আমরা শরতের পাখির গান গোধূলিদিগন্তে উড়িয়ে দিই। তারা, তখন, আমাদের ঋতু বর্ণনার বিভ্রমের ভেতর। যদিও এমন যে, ঋতু মেঘ বা ফুল বা পাখি বা নদী বা খড় বা কুয়াশা বা নক্ষত্র বা ভোরের নয় যে তার স্বচ্ছতার ভেতর বিভ্রম বর্ণনার অযোগ্য, তখন আগন্তুকের দল ফুল পাখি এবং মেঘের ভেতর আমাদের ঋতুর সকল পরিচয় পেয়ে খুশি হয়। এবং তারা তখন, আমাদের মেঘের হৃদয় খোঁজে, আমাদের নদীর জীবন পাঠ করে, মাটির গন্ধ পাঠ করে, পাখি পতঙ্গ প্রজাপতি আর গাছের ভাষা পড়ে। অনেক অনেক কাল তারা আমাদের মাটি নদী মেঘ বৃক্ষ পাখি পতঙ্গ ফুলের দিকে দেখলে তাদের মনে আনন্দ হয়। হয়তো আলো এসেছিল। হয়তো যা গোলাপের মতো উজ্জ্বলতার যোগ্য; গ্রামের লোকেরা বলে, তখন, আগন্তুক দল বুঝতে পারে, আমাদের গ্রামের হৃদয় গোলাপের ঐশ্বর্যে আলোকিত, গ্রামের ভোর মাটি নদী পাখি গাছ ছায়া এবং চাঁদে জড়িয়ে আছে গোলাপের নীরব বিস্ময়।
আগন্তুকরা, যদি বা তারা, পৃথিবীর নানান দেশের, তারা বলে আমাদের গ্রাম দ্বীপের মতো মনোরম—সবুজ, শ্যামলিমা—বহুদূরের নক্ষত্রবীথির মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে আছে। তারা বিবিধ কোম্পানি এবং ফ্যাক্টরির মালিক, কেউ বা ম্যানেজার স্বয়ং। এবং তারা হয়তো কারো পাতালপুঞ্জে হিরার খনি, কারো বা পরমাণুবিদ্যা, কারো হয়তো যুদ্ধসরঞ্জাম, হয়তো বা সফটওয়ার বা গুগল অথবা ফেসবুক কিংবা ইন্সুরেন্স কোম্পানি; তাদের হাওয়াঘোড়া আমাদের গ্রাম দাবড়ে বেড়ায়। গ্রামের লোকেরা বলে, তারা, আগন্তুকরা, তারা নিজেরাই ঘোড়া। তারা লাল ঘোড়া। তারা কালো ঘোড়া। তারা সাদা ঘোড়া। তারা ধলা ঘোড়া। তারা কটা ঘোড়া। তারা ফটকা ঘোড়া। এইসব হাওয়াঘোড়ার চিঁহিঁ চিঁহিঁ চিঁহিঁচিঁহিঁচিঁহিঁ আমাদের গ্রামের বাতাস মেঘ মাঠ নদী ভরে গেলে আমরা তৃতীয় বা চতুর্থ বা পঞ্চম বা একাদশ বা দ্বাদশবার জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের স্মৃতির ভেতর প্রবেশ করি, তাদের বিলীয়মান কণ্ঠস্বর আর নির্বাক চিত্রকলার ভেতর প্রবেশ করি। তাদের চিত্রকলায় একটা মৃত বৃক্ষ কালো চন্দ্রালোকে কৃষ্ণময় হয়ে আছে, আর পাতাশূন্য ডালে অনৈসর্গিক দুটো ফুলের রক্ত পৌরাণিক নীল! গ্রামের লোকেরা বেদনায় আকুল হয়। ভাবে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ —তারা কি গিয়েছিল মৃত্যুর দিকে, অথবা তারা কি গিয়েছিল হত্যার দিকে? —গ্রামের লোকেরা বলে, তারা হেঁটেছিল ধানখেতের ভেতর, আলপথে; হেঁটেছিল বাঁশঝাড়ের ভেতর, ঝরা পাতার ছায়ায় ছায়ায়; শুকনো পাতার ছায়া তাদের পায়ের ভেতর দিয়ে মুখে ছড়িয়ে দিত অপরূপ বিকেল। তারা হেঁটেছিল বর্ষায় ফোটা বনতুলসীর জগতে, বিলে, জংলায়। তারা গোধূলির ভেতর ভেসে বেড়ানো জোনাকি ধরত মুঠোয়—আঁচলের ভেতর জোনাকিরা জ্যোৎস্না ছড়ায় আবু সাঈদের বাড়ির উঠানে, ঝোপে। মুঠোর ভেতর জোনাকিরা চাঁদ ঝরায় জিনিয়া আখতারের বাড়ির বাঁশঝাড়ে, ঝোপে। তারা আঁচল মেলে মুঠো খুলে জোনাকি উড়িয়ে দেয় রাতের ভেতর, আর জিনিয়া আখতারের জোনাকিরা যায় আবু সাইদের বাড়ির ঝোপে; আবু সাইদের জোনাকিরা যায় জিনিয়া আখতারের বাড়ির উঠানে। তখন শরতের জোনাকিচাঁদ ভাসে জিনিয়া আখতারের মুখে, তখন হেমন্তের জোনাকিচাঁদ ভাসে আবু সাইদের কপালে; গ্রামের লোকেরা বলে, পাগল দুইটা। তখন, তারা একদিন, অনেক অনেকদিন পর ধানখেতের আলপথে হেঁটে বেড়ালে গ্রামের লোকেরা বলে, পাগল দুইটা কী জানি করে বেড়ায়। এবং তাদের মৃত্যুর কথা মনে পড়লে, আমাদের বিষণ্ন হৃদয়ের দীর্ঘশ্বাস জ্যোৎস্নায় দ্রবীভূত হয়।
গ্রামের লোকেরা বলে, ভোর হারিয়ে বিহ্বলতার ভেতর তারা গ্রামের উঠানে আলপথে শস্যখেতে গিয়েছিল—রাতের শিশিরের ভেতর বিন্দু বিন্দু চাঁদের কাছে, তখন তাদের পায়ে শিশির জড়িয়ে গেলে চাঁদ হারায়। তখন জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ শিশিরচাঁদের আকুল জ্যোৎস্নায় দেখে গ্রামের লোকেরা রাতের স্তব্ধতা চুরমার করে উঠানে আলপথে নেমে এলে চাঁদের মৃত্যু হয় এবং ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া পাখিরা জেগে ওঠে; তখন, হাজার হাজার পাখি তাদের ছোট্ট ঠোঁটে ভোর চুরি করে উড়ে যায়। গ্রামের লোকের সেই কথা মনে পড়ে, তারা বলে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ ঘাসলতায় হাতের গলার অলঙ্কার বানালে তা যেন আশ্চর্য চাঁদের ফাঁদ।
ঘাসলতার চাঁদের ফাঁদ গ্রামের লোকদের সকল ভয়, সকল হত্যা, সকল ঘোড়া, সকল কথা বন্দি করলে তারা জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদকে ঘাসলতার আশ্চর্য চাঁদের ফাঁদ বানাতে বলে, এই কথা শুনে তারা বিহ্বল হয়ে পড়ে এবং জোনাকিজ্যোৎস্নার ভেতর উঠানে আলপথে কানামাছি ভুলে যায়। তখন, চাঁদবালিকা এবং চাঁদবালক, তারা দেখে তাদের অম্লান পায়ের ভেতর শিশির হারিয়ে যাচ্ছে, বিন্দু বিন্দু চাঁদ হারিয়ে যাচ্ছে; এবং গ্রামের লোকেরা বলে, বিলীয়মান জ্যোৎস্নায়, তবে কি, চাঁদবালিকা এবং চাঁদবালক হারিয়েছিল তাদের পা, হারিয়েছিল জোনাকিজ্যোৎস্না? অথবা, এমন কী যে, পা হারিয়ে চাঁদ হারিয়ে তারা হেঁটেছিল মৃত্যুর দিকে, হত্যার দিকে! —তাদের মৃত্যু অথবা হত্যা আমাদের স্মৃতির ভেতর নিদ্রায় ডুবে গেলে, একদিন, অনেক অনেকদিন কালো অন্ধকার সময়ের ভেতর এক কুয়াশাভোরে গোলাপের বিন্দু বিন্দু লাল পাপড়ি ঝরে পড়ে; তখন, আগন্তুক দল, অতঃপর, আমাদের গোলাপ বিনিময় করতে চায়। দারুণ চুক্তি তাদের। তারা বলে, কমিশন কোম্পানির, এমত যে তারা বলে, গোলাপ তাদের পরমাণুবিদ্যার গোপন জ্ঞান। বলে, তাদের আবিষ্কার এবং যুদ্ধের বাণিজ্যে গোলাপ নতুন এক দর্শনচর্চা। বলে, গোলাপই একমাত্র ফুল যে যার আছে কাঁটার সম্প্রসারণ; তার আছে সভ্যতা হত্যা, তার আছে স্বপ্ন হত্যা, জ্ঞান হত্যা, শস্য হত্যা, স্মৃতি হত্যার প্রতিভা।
তাদের এসব কথা শুনে গ্রামের লোকেরা দেখে, তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের নদী, সমুদ্র, বনস্পতির দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের মেঘ, বিদ্যুৎ, নক্ষত্রের দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের পাখি, পতঙ্গ, বৃক্ষের দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের মাটি, পাতাল, বৃষ্টি, বাতাসের দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের ঋতু, শস্য, ফুল, বীজের দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের নারী, শিশু, বিদ্যালয়, রাষ্ট্রের দিকে; তাদের একটি ঘোড়া গেছে আমাদের আলো, স্মৃতি, শিশুকালের বই, জানলা আর ফুলের দিকে। তাদের কত ঘোড়া। তাদের এত ঘোড়া যে, আগন্তুকের দল এসব বিবিধ ইচ্ছার অনুবাদ, তাদের দারুণ চুক্তির অভিলাষ ক্রমাগত বাজতে থাকলে আমাদের আনন্দ, আমাদের ব্যামো নিরাময়, আমাদের আহার, গৃহসজ্জা, আমাদের চিত্রকলা, আমাদের অলঙ্কার শিল্প, আমাদের বৃক্ষশিল্প, আমাদের ভোর এবং গোলাপ নিয়ে শহরের দিকে নৌকাযাত্রা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি; তখন, একটা আনন্দ কীভাবে হত্যা হয়, একটা ভোর কীভাবে হত্যা হয়, একটা চাঁদ কীভাবে হত্যা হয়, একটা বিকেল কীভাবে হত্যা হয়—কী আশ্চর্য, আমরা তখন হত্যার ভয়ে ভয়ে পৃথিবীর সকল সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমরা তখন নির্বাক। আমাদের ওষ্ঠপুট একটা মৃত নদী। আমাদের পাঠ্যপুস্তকের সকল গোলাপঅক্ষর ঘসে ঘসে পৃষ্ঠা সাদা করে ফেলি, আর মৃত ঠোঁটের ভেতর গোলাপের জীবনবৃত্তান্ত, গোলাপের হাজার ব্যঞ্জনা গোপন করে রাখি—আমাদের মুখে তালাচাবি। আমাদের পায়ে তালাচাবি। আমাদের হাতে তালাচাবি। আমাদের চাঁদে তালাচাবি।
তখন আগন্তুকের দল বৃক্ষ ও বৃষ্টি নিয়ে, শস্য ও পতঙ্গ নিয়ে, নদী ও পাখি নিয়ে, ফুল ও পরাগায়ন নিয়ে আমাদের অজ্ঞতার কথা বলে। তারা বলে, এসব বিষয়ে অজ্ঞানতা থাকলে আমাদের প্রেম নেই। জ্ঞান নেই। দর্শন নেই। গণিত নেই। পুরাণ নেই। প্রাচীন নেই। মেঘ নেই। ভোর নেই। চাঁদ নেই। শিশুকাল নেই। চিত্রকলা নেই। বৃক্ষশিল্প নেই। তারা বলে, আমরা একটা আঁস্তাকুড়। একটা ভাগাড়। তাদের এই কথায় আমাদের রাগ হয়, ভয় হয়; দেখি তাদের হাওয়াঘোড়া আমাদের ভোর খেয়ে ফেলে, বিকেল খেয়ে ফেলে; বৃক্ষ, নদী, পাখি, চাঁদ খেয়ে ফেলে; তখন, গ্রামের লোকের মনে হয়, গোলাপ না থাকলে শরীর থাকে না, আমাদের ছায়ার ভেতর বাস করে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ। গোলাপ না থাকলে শরীরের আকাঙ্ক্ষা থাকে না, আমাদের শরীরে বাস করে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ; গোলাপ না থাকলে শরীরের গ্রীষ্ম, শীত, শরৎ থাকে না, আমাদের ঋতুরহস্যের ভেতর স্মৃতি হয়ে আছে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ; তখন আমরা এইসব ঋতুরহস্যের ভেতর ভোরের কুয়াশা দেখি। চাঁদ নেই, তারকারাজি নেই; শুধু ছায়া ছায়া ঘুম ঘুম রক্তের নিবিড় অলৌকিক কুয়াশা। স্তিমিত অথবা বিষাদময়, এমনকি ছাইরঙা কালোর বদলে দেখি লালাভ কুয়াশার ভেতর নদীর ধারে বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছের ডালে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের শরীর। দুলছে। মন্থর বাতাসে।
তালাচাবির ভেতর গ্রামের লোকেরা জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের স্মৃতি নিয়ে দুলতে থাকে। কোথাও তাদের আঁকাজোকা কণ্ঠস্বরহীন চিত্রকলার ছেঁড়া টুকরো উড়ছে। ছেঁড়া টুকরো শিশু মাটির ঘোড়া নেবার জন্য কান্না করছে। ছেঁড়া টুকরো জোনাকি ঘুম ঘুম গান গাইছে—যদি বা ফুল ফোটে। ছেঁড়া টুকরো গৃহছায়ায় পিঁপড়ার দল আলো খুঁজছে। ছেঁড়া টুকরো মেঘ গড়িয়ে গড়িয়ে গোপন ক্লান্তিতে ডানা ভেঙে ঘুম ঘুম। ছেঁড়া টুকরো কণ্ঠস্বর ঘুম ঘুম। ছেঁড়া টুকরো জোনাকি ঘুম ঘুম। মাটির ঘোড়ার ঘুম ঘুম হ্রেষা ভেসে আসে আর আমাদের গ্রামের উঠানে আলপথে আগন্তুকরা ছোটাছুটি করে। এসব তাদের কানামাছি খেলা, এমনই হয়তো বা, এবং গ্রামের লোকেরা দেখে, আগন্তুকরা উঠানে আলপথে নদী বা শস্যখেতে আমাদের গৃহের পশু বা গাছপালা, চাঁদ বা নদী যা দেখে তাকেই ভেঙে টুকরো করে। কেটে ছড়িয়ে দেয়। তারা আমাদের ঘরের চালে লাফিয়ে ওঠে, দেয়ালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, নদীতে নেমে পানি ঘোলা করে; তারা বিকট আওয়াজ তুলে গান করে, যেন শেষকৃত্যের কোনো অশুভ আত্মার কান্না ভেসে আসছে। দলকে দল আগন্তুকের শরীর খড়িমাটি আর কালো কালির উল্কি দাগানো, তাদের ঘাড়ে হাতের অনাবৃত অংশে এসব উল্কির ভেতর বন্দুক গর্জে ওঠে—যেন খেলা। তাদের শরীর থেকে ভনভনে দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে গেলে আমাদের গ্রামে মাছির উৎপাত বেড়ে যায়। আগন্তুকেরা তিড়িংবিড়িং ঘোড়ার মতো নাচে, লাফায়। তাদের লাল ঘোড়া সাদা ঘোড়া কটা ঘোড়া ধলা ঘোড়া ফটকা ঘোড়া আমাদের উঠান আলপথের সকল ঘাস খেয়ে ফেলে, সকল ঝোপজঙ্গল খেয়ে ফেলে। তখন, শূন্য মাঠ পড়ে থাকে, এবং ঘোড়ার দল মেঘকুয়াশাবৃত বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছটা খেতে গেলে গ্রামের লোকেরা দেখে, ন্যাড়ামুড়ো গাছের শুকনো গায়ে গজিয়ে উঠছে গোলাপকাঁটা। তার পাতাশূন্য ডালে গোলাপকাঁটা। ঘোড়ার দল পাতাশূন্য গাছটা খেতে গেলে সে শূন্যে উঠে যায়। মেঘে চলে যায়। তখন, গোপন রাগে ক্ষোভে চিঁহিঁ চিঁহিঁ চিঁহিচিঁহিঁচিঁহিঁ হাওয়াঘোড়ার দল চোয়াল রক্তাক্ত করে তুললে, গ্রামের লোকের কাছে ঘোড়ারা গোলাপ বিক্রির কথা বলে। ঘোড়ারা বলে, চুক্তি বাতিল। গোলাপ বিক্রি করো। ঘোড়াদের মুখে এসব কথা শুনে ভোরের কুয়াশার ভেতর আমাদের শরীরের অস্পষ্ট ছায়া দুলতে থাকে; এবং সূর্য প্রতিফলিত হলে আমরা হারাই। মেঘের ভেতর।
তখন ঘোড়ার দল দেখে, মাঠের পর মাঠ গোলাপবাগান টুকরো টুকরো—দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে একটি বিকট কালো গহ্বরের অধঃক্ষেপ। তারা দেখে, গোলাপসূর্য মানুষের জাগতিক স্মৃতি এবং ভবিষ্যৎ থেকে সকল মাঠ এবং গোলাপবাগানের চিহ্ন বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। দেখে ধুধু কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে আছে ভোরের করোটি, একটি উজ্জ্বল আলোর অস্থি, এক মুঠো দোঁআঁশ মাটি আর এক ফোঁটা শুকনো রক্ত।
অতঃপর আগন্তুকেরা গ্রামের পথের ভেতর প্রবেশ করে, গ্রামের ছায়ার ভেতর প্রবেশ করে; কিন্তু পথই তাদের বিস্ময়—পথের ভেতর ছায়ার বিভ্রম, মেঘের বিভ্রম। তখন, আগন্তুকেরা দেখে, সকল গোলাপবাগান সারি সারি বৃক্ষের আড়ালে, গৃহের আড়ালে, অনুরণিত বাতাসের আড়ালে; সকল আড়াল তাদের বিস্ময়, সকল আড়াল তাদের প্রবেশ বাধা দেয়। সকল আড়াল মেঘের ক্ষুদ্র কালো রঙের আকৃতি যা সমস্ত গ্রামের উপর পাখা বিস্তার করে যা ন্যাড়ামুড়ো গাছটিকে মেঘের ভেতর নিয়ে যায়। আগন্তুকেরা দেখে, গ্রামের সকল আলপথ একই রকম প্রশস্ত, সেখানে একই বৃক্ষেশোভা; সকল পাখির একই পালক, তাদের একই উড়াল, একই বাতাসের দীর্ঘশ্বাস; সকল পথে একই গৃহশৈলী, গৃহের একই দরজা-জানলা। তারা বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো প্রাচীন গাছ খোঁজে, কিন্তু বাতাস নিস্তব্ধ; তারা দেখে পথের অনতিক্রম্য চক্রব্যুহ, দেখে গ্রামের লোকদের গল্পের টুকরো টুকরো বাক্য, চাপা হাসির ধ্বনি; দেখে একই রঙের পোশাক, একই রঙের সুতাশিল্প, একই চিত্রকলা, একই পাতার অলঙ্কার, একই রঙের শব্দ; দেখে প্রতিটি মানুষ সমান বয়সি, সকলেই যৌবনের আশ্চর্যে, প্রতিটি মানুষ একই চোখমুখচুলের নকশা নিয়ে একই কাজে ব্যস্ত। তখন, আগন্তুকেরা ভুল কোনো গ্রামে পৌঁছেছে—এই বিভ্রম অতিক্রম করতে তারা গ্রামের লোকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তারা আরো আশ্চর্য যে, এখানে গ্রামের নাম, এখানে মানুষের নাম, এখানে পাখির নাম, এখানে বৃক্ষের নাম, এখানে নদীর নাম, বিকেলের নাম, মেঘের নাম, ছায়ার নাম একই শব্দে উচ্চারিত। সে নাম গোলাপ হলে তারা দেখে গ্রামের সকল পরিচয়, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ প্রকাশিত সুরের ধ্রুপদে; রং এবং ঘ্রাণের ভেতর দাড়ি কমা সেমিকোলন বিস্ময়চিহ্নে ঘাসলতার অলঙ্কার প্রচ্ছন্ন ছায়া হয়ে আছে। তাদের মনে হয়, তবে কি গোলাপগ্রাম বলে কিছুই ছিল না? হয়তো ছিল, এখন নেই? তারা তখন আশ্চর্য এক শূন্যতা অনুভব করে, ভয় পায়। তাদের শূন্যতা এবং ভয়ের ভেতর কণ্ঠস্বরের অস্ফুট গুঞ্জন বাতাসের ধীর মন্থর সংগীতের মতো গ্রামের আত্মার ভেতর নড়েচড়ে ওঠে। আগন্তুকেরা তখন ধন্দে পড়ে, ভয় পায়; সূর্য জ্বলছে, তবু তাদের মনে হয় সন্ধ্যা ঘনিয়ে আছে বাতাসে। বাতাসে গোলাপবাগান নিকটে চলে আসে। পুনরায় দূরে। তারা বাতাসে গোলাপের নিঃশ্বাস পায়। নিঃশব্দ পায়। তারা গোলাপের ঘুম পায়। ভয় পায়। এভাবে নিকট ও দূর, নিঃশ্বাস ও নিঃশব্দ, ঘুম ও ভয়ের ভেতর তারা গোলাপের রাষ্ট্রতন্ত্রে প্রবেশ করতে চায়। গোলাপযুদ্ধের উত্তেজনায় তারা কাঁপে। তখন তারা দেখে, গ্রামে কোনো পথ নেই, অথবা কখনো কোনো পথ ছিল না। না প্রবেশের। না বাইরের। অথবা পথশূন্য কোনো গোলাপগ্রাম ছিল না। তখন দিগন্ত পরিব্যাপ্ত কুয়াশার অস্ফুট ধ্বনির ভেতর তারা গোলাপবাগানে পৌঁছানোর ইচ্ছায় মরিয়া, এবং তারা পথের একটি বিন্দুতে গোপন পাতাল খুঁড়তে থাকে।
তখন আমাদের মনে পড়ে, ১৩২৬ অথবা ১২২৬ বঙ্গাব্দের শরৎকালের একটি দিন, গ্রামের ভোরের ভেতর চাঁদবালিকা-চাঁদবালক জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের প্রণয়ের অনিবার্য পরিণাম; তারা কি গিয়েছিল মৃত্যুর দিকে? অথবা তারা কি গিয়েছিল হত্যার দিকে? তাদের মৃত্যু অথবা হত্যা আমাদের স্মৃতির ভেতর জমা থাকলে গ্রামের লোকেরা বলে, নদীর ধারে বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছের ডালে ভোরের মেঘকুয়াশার ভেতর তারা জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের জড়াজড়ি মৃতদেহ ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে; তাদের কান এবং নাকের ছিদ্র গলে বেরিয়ে এসেছিল চিকন রক্তের ধারা, এবং সেই রক্তধারা তাদের জড়াজড়ি মৃতদেহের বুকের মাঝখানে কালচে লাল শুকনো গোলাপের মতো জমাট বেঁধে ছিল। গ্রামের লোকেরা আরো বলে, ভোর হারিয়ে বিহ্বলতার ভেতর হাজার হাজার উড়ন্ত পাখির ডানার ধ্বনি ও ছায়ায় তাদের তন্দ্রা ছুটে গেলে তারা উঠানে আলপথে নামে। তখন, আমাদের পায়ের ভেতর বিন্দু বিন্দু শিশিরচাঁদ উড়ন্ত পাখিদের বিলীয়মান ধ্বনি ও ছায়ায় হারিয়ে গেলে আমরা জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদকে কানামাছি খেলতে দেখি। গ্রামের লোকেরা বলে, জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ পাখির ডানার আওয়াজে ঘাসলতায় বাঁধা চোখের বাঁধন খুলে ফেলে, এবং তারা তখন বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো গাছের মগডালে একটা পাখির বাসা দেখতে পায়। জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদ কানামাছি খেলা ফেলে প্রাচীন ন্যাড়ামুড়ো গাছের মগডালে ওঠে, তারা পাখির বাসায় উঁকি দেয়, দেখে, সেখানে কোনো পাখি নেই; পরিত্যক্ত খড়ের বাসার ফোকর থেকে উড়ে আসছে হাজার হাজার ধলা কটা লাল কালো সাদা ফটকাঘোড়া। তারা দেখে, হাজার হাজার হাওয়াঘোড়া ঠোঁটে ভোর নিয়ে খড়ের বাসার ভেতর বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে, ঘোড়াদের পা মেঘের গায়ে আর মাথা নিচের দিকে শূন্যের ভেতর ঝুলছিল। তখন, হয়তো, হাজার হাজার ঘোড়ার উড়ালে বাতাসের ঝড় ওঠে, এবং গ্রামের লোকেরা বলে, ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে দ্রবীভূত ঘোড়ার চিঁহিঁচিঁহিঁ চিঁহিঁচিঁহিঁ হ্রেষা পাখির ডানার বিলীয়মান ধ্বনি বলে ভুল করে তারা।
তারা বলে, হাজার হাজার হাওয়াঘোড়ার উড়ালে বাতাসের প্রবল ধাক্কায় ঘাসলতার অলঙ্কার জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের গলায় একটা নিশ্ছিদ্র চাঁদের ফাঁদের মতো আটকে যায়। অথবা তারা বলে, হাজার হাজার ঘোড়ার খুরে ক্ষতবিক্ষত চাঁদের ফাঁদ জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের গলায় চেপে বসে। তখন, গ্রামের লোকেরা বলে, তারা বিষণ্ন ন্যাড়ামুড়ো প্রাচীন গাছের ডালে জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের জড়াজড়ি মৃতদেহ থেকে ভোরের মন্থর বাতাসে ঝড়ে পড়া এক ফোঁটা রক্ত ঘনায়মান মেঘকুয়াশার ভেতর উড়ে যেতে দেখেছিল। অনেক অনেকদিন পর তারা ১৩২৬ বঙ্গাব্দে, অথবা কেউ বলে ১২২৬, এক আঁধার-আঁধার ভোরে বিলীয়মান জ্যোৎস্না ও মেঘকুয়াশার ভেতর জিনিয়া আখতার এবং আবু সাইদের শরীর নিঃসৃত কুয়াশার ভেতর উড়ে যাওয়া রক্তফোঁটা গোলাপের পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়তে দেখে। গ্রামের লোকেরা তিন সপ্তাহ ধরে ভোরের কুয়াশার ভেতর আমাদের গৃহ মাঠ শস্য নদী খামার আর আলপথের উপর গোলাপের লাল পাপড়ি ঝরে পড়তে দেখলে, তখন, আমাদের গ্রামের পথে পথে বাতাসে ভেসে থাকে আশ্চর্য সুর ও সংগীতের নীরব মন্থর আলোর মতো নরম তরঙ্গ; তখন, কোথাও এইসব ফুল আমাদের কথা ও গৃহ নির্মাণের সংকল্প নদীর দিকে উড়ে যেতে থাকে।
আবু হেনা মোস্তফা এনাম
২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২-এ জন্ম। মেহেরপুর শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করেছেন।
গল্পগ্রন্থ : ক্রুশকাঠের খণ্ডচিত্র অথবা অভাবিত শিল্পপ্রণালী [২০০৫], নির্জন প্রতিধ্বনিগণ [২০১০], প্রাণেশ্বরের নিরুদ্দেশ ও কতিপয় গল্প [২০১০], জোনাকিবাবুই [২০১৮], গোলাপ নির্মাণের গণিত [২০২৪]
উপন্যাস : ক্রনিক আঁধারের দিনগুলো [২০১৪]
প্রবন্ধগ্রন্থ : মোহাম্মদ সাদিকের কবিতা : নিরন্তর নিজেকে খোঁজা [২০২০], মাহমুদুল হক : সৃষ্টি ও শিল্প [২০২১]।
জীবনীগ্রন্থ : কথাশিল্পী মাহমুদুল হক [২০১৬]
সম্পাদনা : মাহমুদুল হকের অগ্রন্থিত গল্প [২০১০], মাহমুদুল হক রচনাবলি [৪ খ-, ২০২০-২০২২]