তখন খুব ঘন করে চলে আসতো শীত। ভোর হতো অনেক ভোরে। আমরা ছেলেপুলেরা ঘাসের ওপর সূর্য দেখার অপেক্ষায় থাকতাম। কেননা রোদ পড়লেই শিশির শুকিয়ে যাবে, আর আমরা সরষে ক্ষেতের আলে কড়ি খেলবো। খেলার অপেক্ষা-আনন্দের পাশাপাশি এই সময়টাতে আমাদের ভেতর কাজ করতো একটা ভয় ও বিরক্তি। কারণ খেলার জায়গা আগে থেকেই কয়েকটা কুকুর দখলে নিয়ে রাখতো। তবু আমাদের খেলা কিন্তু চলতো। যে কারণে রোজ কড়িখেলায় স্বপনকে নিতাম আমরা। বয়সে আমাদের বড়, আর কুকুরগুলো ওদের বাড়ির হওয়ায় ও আগে ভাগে গিয়ে কুকুর তাড়াতো। আমরা একটু দূরে দূরে থাকতাম। কুকুরগুলো চলে গেলে খেলা শুরু হতো।
স্বপনকে সমীহ করার মূল কারণ কুকুরগুলোর কয়েকটি ওদের গৃহপালিত। ছেলেবেলার এই ভীতি এখন আর স্বপনকে লাভবান করে না জানি, তবে অন্যরা কিন্তু থেমে নেই। সবাই যার যার মতো এই ভয়ের’ই ব্যবসা করছে। সে আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আমাদের সমাজ ও ক্ষমতা কাঠামো। আইন আদালত (এমনকি প্রতিটি মানুষের কথা, লেখা, আচরণ, অঙ্গভঙ্গি নিয়ন্ত্রণের জন্যও আলাদা আলাদা কানুন আছে এই স্বাধীন দেশে!) থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল থেকে ধর্মশালা বা ব্যাংক সবাই এই ভয়ের ব্যবসায়ী। মাঝেমাঝে এই আইন-কানুন নিয়ম নীতিকেই স্বপনদের বাড়ির সেই পালিত কুকুর মনে হয়। যাকে নিয়ন্ত্রণ করেই কেউ কেউ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে রাখছে। আর আমরা একটু একটু ভয় পেয়ে নিজের ভেতরের আরো গভীর কোনও ভেতরে গুটিয়ে বসে আছি।
পাপ, বেআইনি, রাষ্ট্রবিরোধী, অপসংস্কৃতি, অনুভূতিতে আঘাতসহ বিভিন্ন ভয়ের টোটকা নিয়ে বহাল তবিয়তে আছি আমরা। বিদ্রোহ আজ কোটি আলোকবর্ষের দূর প্রতিবেশী আমাদের।
ক্ষ্যাপা কুকুরের রাগী চোখের নজরদারী পেরিয়ে যাওয়াটা একটা ভাল রকমের অ্যাডভেঞ্চার বটে। এই শিহরণ ভয়ের। এই ভয়ের সম্মুক্ষীণ আমরা আবার হয়ে যাই, যখন কোন কিছু ভাঙে। ভাঙন হতে পারে প্রাচীনের, নিয়মের, কানুন কিংবা নৈতিকতার। নিরন্তর ভয়ের মধ্যে থেকে যাচ্ছি আমরা। মানবিক গান কি সত্যি আটকে দিতে পারবে পারমাণবিক? কবিতা কি পেরেছে ভয় তাড়ানিয়া উপায় হতে? তবু কবিতা লেখা হয়-
নিরন্তর এক ভয়ের মধ্যে আছি
আঁধার করা কালো আর তীব্র আলোর সুতীক্ষ্ণ তলোয়ারে
ঘোর সন্ধ্যাতেও নিরুত্তাপ ঝিঁঝির মাথা নাই
আর গ্যালাক্সির ওপারে ঘূর্ণায়মান গ্যালাক্সি
মহাবৈশ্বিক ভয়বার্তা ওয়েবে-ওয়েবে, হোমপেজে ভেড়ে
মাঠের সবুজে অচেনা হাজার কীট
অবিরাম কাঁটে কৃষকের বুক, আঁচল কৃষাণীর
তবু অনিবার্য হয়ে ওঠে পারমাণবিক চাষ
সভ্যরা পাশ করে কালা কানুন
অনিঃশেষ এক ভয়ের ভেতর আছি
আগুনের মতোই জলের ভয়
জলনিবাসী কুমিরের মতো সাবমেরিনের ভয়
ঘরের ভেতর খুন হয়ে যাবার ভয়
পথে নামলে গুম হয়ে যাবার ভয়।
অন্তিম ঘেউ শোনার প্রত্যাশা কিন্তু মরে না। হয়তো এই ভয়ের ভেতর’ই আপাত অস্থির, বিশৃঙ্খল, অসাম্যের সমাজে এমনকি আদিম সমাজেও কেউ কেউ ঘেউ করে উঠেছিলো। মানুষের ইতিহাস যদি বলি তবে তা বিরুদ্ধবাদের ইতিহাস। সব সমাজ এবং সময়ই বিরুদ্ধবাদীদের, দ্রোহীদের, অবিশ্বাসী-সমাজবহির্ভূত-হীন আর ক্ষ্যাপাকুকুর জ্ঞান করেছেন। সে গ্যালিলিও কিংবা আব্বাস কিয়ারোস্তামি।
কর্পোরেশন যতই শহরের সব ক্ষ্যাপা কুকুরকে দিনে দুপুরে হত্যা করে ফেলুক না কেন, যতই ঘোষণা দিয়ে দিক রাষ্ট্রীয় প্রচারকবৃন্দ বা ধর্মশালা জিকিরে বসুক, ঘেউ কিন্তু কখনো রহিত হয় নি। এই ঘেউ আছে বলেই, ঘেউ করে কেউ উঠবে বলেই সমাজের গতি আছে। মার্কস সাহেবের দ্বন্দ্ব আছে। তাই মনে হয় সমস্ত নিপীড়ন-নিয়ম, বিশ্বাস-ঈশ্বর, মানচিত্র-কাঁটাতার, বিধান-প্রবিধান বলবৎ থাকুক আর না থাকুক অন্তহীন ঘেউ আমরা শুনবোই, না চাইলেও শুনবো, প্রতীক্ষায় থেকে থেকেও শুনবো।