আর তাই, তরুণ লিঙ্গারাম কদপী কেন এতোটা হুমকিস্বরূপ তা বুঝতে কোন বেগ পেতে হয় না। সাংবাদিক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেবার আগে সে দান্তেওয়াদার একজন ড্রাইভার ছিল। ২০০৯ সালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে, সেই সাথে তার জিপটিও জব্দ করা হয়। সেইসময় তাকে ছোট্ট একটি শৌচাগারে ৪০ দিন আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে তাকে সালওয়া জুদুমের স্পেশাল পুলিশ অফিসার (এস.পি.ও) হবার জন্য চাপ দেয়া হতো। সালওয়া জুদুম হলো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত পাহারাদার বাহিনী যারা ঐ সময় গ্রামবাসীকে ঘরবাড়ি থেকে তাড়ানোর কাজে নিযুক্ত ছিল। (তখন থেকেই সুপ্রিম কোর্ট সালওয়া জুদুমকে অসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।) গান্ধীবাদী কর্মী হিমেশ কুমার আদালতে হেবিয়াস কর্পাস পিটিশন দাখিল করার পর পুলিশ লিঙ্গারামকে মুক্তি দেয়। কিন্তু তারপর, পুলিশ লিঙ্গারামের বৃদ্ধ পিতা এবং পরিবারের অন্য পাঁচজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। তারা তার গ্রাম আক্রমণ করে, সেইসাথে লিঙ্গারামকে আশ্রয় না দেয়ার জন্য গ্রামবাসীকে সতর্ক করে দেয়। অতঃপর লিঙ্গারাম দিল্লীতে পালিয়ে যায়। সেখানে তার বন্ধু, শুভাকাঙ্খীরা তাকে একটি সাংবাদিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়। ২০১০ সালের এপ্রিলে সে দান্তেওয়াদায় যায়। সালওয়া জুদুমের নৃশংসতার শিকার হয়েছে এমন মানুষ এবং সাক্ষীদের সেখান থেকে সে দিল্লীতে নিয়ে আসে। লিঙ্গারামের সাক্ষীরা, দিল্লী পুলিশ এবং সংসদীয় শক্তির সাহায্যে স্বাধীন গণ আদালতে তাদের সাক্ষ্য দেয়। (লিঙ্গারাম তার নিজের বিবৃতিতে মাওবাদীদেরও কঠোর সমালোচনা করে।)
কিন্তু তা ছত্রিশগড়ের পুলিশের মনোভাব পাল্টাতে পারেনি। ২০১০ সালের ২ জুলাই, মাওবাদীদের উচ্চ পর্যায়ের নেতা ও মাওবাদী দলের অফিসিয়াল মুখপাত্র কমরেড আজাদকে অন্ধ্র প্রদেশের পুলিশ আটক করে এবং মৃতুদণ্ডে দণ্ডিত করে। ছত্রিশগড় পুলিশ বাহিনীর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল কাল্লুরি এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন যে মাওবাদীরা কমরেড আজাদের পদে লিঙ্গারামকে নির্বাচিত করেছে। (ব্যাপারটা যেন ১৯৩৬ সালের ইয়েনানের কোন স্কুল বালককে ঝাউ এন লাই হবার দোষে অভিযুক্ত করা।) অভিযোগটি এতোটাই হাস্যকর ছিল যে পুলিশ তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
পুলিশ দান্তেওয়াদার এক কংগ্রেস বিধায়কের ওপর মাওবাদী আক্রমণের পরিকল্পনাকারী হিসেবেও লিঙ্গারামকে দায়ী করে। কিন্তু একের পর এক অভিযোগ মিথ্যা প্রামাণিত হওয়ায় হয়তো জনসমাজের কাছে ছত্রিশগড়ের পুলিশ বোকা আর প্রতিশোধপরায়ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠেছিল। আর তাই, সঠিক সুযোগের সন্ধানে থাকার জন্য সেবারের মতো তারা থেমে যায়।
লিঙ্গারামও দিল্লীতে রয়ে যায়। পড়াশোনা শেষে সে সাংবাদিকতার ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে। ২০১১ সালের মার্চে আধা সামরিক বাহিনী দান্তেওয়াদার তিনটি গ্রাম পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ণ করে দেয়। এই গ্রাম তিনটি হলো- টাডমেটলা, টিম্মাপুরাম, এবং মোরাপাল্লি। ছত্রিশগড় সরকার এই অপরাধের জন্য মাওবাদীদের দায়ী করে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে তদন্তের ভার দেয়া হয়। লিঙ্গারাম একটি ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে দান্তেওয়াদায় ফিরে যায়। সে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে ঘুরে ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী গ্রামবাসীদের বক্তব্য রেকর্ড করে। ভিডিওগুলোতে গ্রামবাসীরা পুলিশকেই এই ঘটনার জন্য দায়ী করে। (ভিডিওগুলো আপনি নিজেই ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন।) এই কাজটি লিঙ্গারামকে দান্তেওয়াদার সবচেয়ে কুখ্যাত পলাতক ব্যক্তিতে পরিণত করে। অবশেষে ৯ সেপ্টেম্বর পুলিশ তাকে ধরে ফেলে।
ছত্রিশগড়ে, লিঙ্গারাম সরকারের জন্য অস্বস্তিকর সব খবর সংগ্রহ ও প্রচার করে এমন একদল চিত্তাকর্ষক মানুষের সাথে যোগ দিয়েছিল। এই দলের মধ্যে সবার আগে যার মুখ বন্ধ করা দরকার হয়ে পড়েছিল, তিনি হলেন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ডক্টর বিনায়ক সেন; সেই ২০০৫ সালেই তিনি সালওয়া জুদুমের অপরাধ সম্পর্কে সবাইকে সাবধান করেছিলেন। মাওবাদী হবার অভিযোগে ২০০৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাদণ্ড দেয়া হয়। জেলখানায় কয়েক বছর কাটানোর পরে তিনি এখন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বিনায়ক সেনের পথে অনেকেই জেলে গেছেন- তাদের মধ্যে আছেন পিযুশ গুহ এবং চলচ্চিত্রকার অজয় টি.জি। উভয়কেই মাওবাদী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এইসব ঘটনা ছত্রিশগড়ের কর্মী সমাজে ভীতি তৈরি করেছে বটে কিন্তু এরপরও কিছু মানুষ নিজেদের কাজ বন্ধ করেনি। এইসব মানুষদের একজন হলেন- কোপা কুনজাম। সে হিমাংশু কুমারের ভানসাভাসি চেতনা আশ্রমে কাজ করতো। লিঙ্গারাম যে কাজ আরো কয়েক বছর পরে করতে চেষ্টা করেছে, কোপা কুনজাম ঠিক সেই কাজটিই করতো। সুদূর গ্রামেগঞ্জে গিয়ে সে খবর সংগ্রহ করে আনতো, এবং ভয়ঙ্কর সব তথ্য নথিবদ্ধ করতো। (সে-ই দান্তেওয়াদার জঙ্গলের ভেতরের গ্রামগুলিতে আমার প্রথম গাইড ছিল।) এইসব নথিপত্রের অনেকগুলোই আইনি বিচারের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে এগুলো ছত্রিশগড় সরকারের দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তির উৎস হয়ে উঠেছিল। ২০০৯ সালের মে মাসে ছত্রিশগড়ের সরকার দান্তেওয়াদায় ঘুরতে যাওয়া সাংবাদিক, লেখক, এবং অ্যাকাডেমিকদের সর্বশেষ নিরপেক্ষ আশ্রয় ভানসাভাসি চেতনা আশ্রম গুঁড়িয়ে দেয়।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার দিবসে কোপাকে আটক করা হয়। মাওবাদীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে একজনকে হত্যা এবং আরেকজনকে অপহরণের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে দায়ী করা হয়।
যখন পুলিশের সমস্ত স্বাক্ষী, এমনকী অপহৃত ব্যক্তিও পুলিশের কাছে দেয়া তথাকথিত জবানবন্দী অস্বীকার করে বসলো তখন কোপার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ধ্বস নামে। ভারতে আসামীরা যে প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায় সেটাই তাদের শাস্তি, আর তাই মামলা দূর্বল হলেও আসামীর মুক্তি নেই। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে কোপার নিশ্চিতভাবে আরো কয়েক বছর লেগে যাবে। আর ততোদিনে তাকে আটক করার পেছনে প্রশাসনের যে উদ্দেশ্য তা সফল হতে বাধ্য। কোপার কথায় সাহস পেয়ে যেসব গ্রামবাসী পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিল তাদের অনেককেই গেপ্তার করা হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন কারাগারে বন্দি আছে, বাকিদেরকে স্পেশাল পুলিশ অফিসার বা এসপিওদের দ্বারা পরিচালিত রাস্তার ধারের ক্যাম্পগুলোতে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে কিছু মহিলা আবার নিজে থেকে ধর্ষিত হবার মতো অপরাধও করেছে! কোপাকে গ্রেপ্তারে পরপরই হিমাংশু কুমারকে তাড়া করে দান্তেওয়াদা থেকে ধরা হয়। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কার্তাম যোগা নামের আরেকজন আদিবাসী কর্মীকেও আটক করা হয়। ২০০৭ সালে সালওয়া জুদুমের নির্বিচার মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করাটাই ছিল তার প্রধান অপরাধ। যোগার বিরুদ্ধে ২০১০ সালের এপ্রিলে মাওবাদীদের যোগশাজশে টাডমেটলাতে ৭৬ জন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশের সদস্যকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়। অথচ কার্তাম যোগা ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) একজন সদস্য আর সিপিআই এর সাথে মাওবাদীদের সম্পর্ক শত্রুতামূলক না হলেও বেশ উত্তেজনাপূর্ণ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যোগাকে বিবেকের বন্দী হিসেবে অভিহিত করেছে।
ইতিমধ্যে গ্রেপ্তারের কাজ বেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে। পুলিশের পেশকৃত প্রথম ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) এর দিকে একটু তাকালেই পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে দান্তেওয়াদাতে যথাযথ ব্যবস্থা কেমন মারাত্মকভাবে সম্পন্ন হয়। প্রায় সব এফআইআর এর ভাষাই মোটামুটি একইরকম। অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম, তারিখ, অপরাধের ধরণ, এবং স্বাক্ষীদের নামগুলোকে শুধুমাত্র বিস্কুটের ছাঁচে ঢেলে দেবার মতো করে এফআইআর-এ ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এইসব নথিপত্র পরীক্ষা করার জন্য কেউ নেই; অভিযোগের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষেরা বন্দি হয়ে আছে এবং স্বাক্ষীদের কেউই লিখতে বা পড়তে পারে না।
একদিন দান্তেওয়াদাতেও মৃতরা কথা বলে উঠবে। আর সেটা কেবল মৃত মানুষ নয়, মৃত ভূমি, মৃত নদী, মৃত পাহাড়, এবং মৃত বনের মৃত প্রাণীরা সবাই মিলেই একদিন ঠিকঠিক বিচার দাবী করে বসবে।
অন্যদিকে, জীবন বহমান।
একদিকে অনধিকারমূলক নজরদারি, ইন্টারনেটের ওপর শাসন, ফোনে আড়িপাতা আর নিপীড়িতের উপর দমন ক্রমশ বাড়ছে। ফলে মানুষের পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরও ভয়ানক নাজুক হয়ে উঠছে। অন্যদিকে, এটা খুব অদ্ভূত ব্যাপার যে ভারত ধীরে ধীরে সাহিত্য উৎসবের স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে উঠছে। পরবর্তী কয়েক মাসে অন্তত দশটি সাহিত্য উৎসব অনুষ্ঠিত হবার জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি সাহিত্য উৎসবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে থাকা কর্পোরেশনগুলোর সাথে পুলিশি বর্বরতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। মূলত এসব কর্পোরেশনের মুনাফার স্বার্থেই পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় নৃশংসতার রাজত্ব কায়েম করেছে।
এসব সাহিত্য উৎসবের মধ্যে শ্রীনগরের হারুদ সাহিত্য উৎসব (বর্তমানে স্থগিত) কে সবচেয়ে নতুন, সবচেয়ে আকর্ষণীয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে – শরতের পত্র-পল্লব রঙ বদলানোর সাথে সাথে কাশ্মীরের উপত্যকা কবিতা, সাহিত্যের সংলাপ, বিতর্ক, আর আলোচনার শব্দে অনুরণিত হয়ে উঠবে…। সংগঠকেরা বিজ্ঞাপনে বলেছে যে এটি একটি অরাজনৈতিক অনুষ্ঠান। কিন্তু একটি বর্বর সামরিক দখলদারীত্বের ভেতরে থাকা জনগণ এবং তাদের শাসকেরা কীভাবে নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবী করতে পারে – আয়োজকেরা তা খোলাসা করেনি। যে শাসকেরা হাজার জনের প্রাণ নিয়েছে, হাজার হাজার মহিলা ও শিশুকে প্রিয়জনের কাছ থেকে বিচ্ছিণ্ন করেছে এবং নির্যাতন কক্ষে লাখো মানুষকে পঙ্গু করে দিয়েছে, সেই শাসক কিংবা তার প্রজারা কি কখনো অরাজনৈতিক হতে পারে? আমি ভাবছি – সাহিত্যের আলোচক অতিথিরা কি পর্যটক ভিসা নিয়ে কাশ্মীরে আসবেন? দিল্লী এবং শ্রীনগরের জন্য কি আলাদা ভিসা দেয়া হবে? তাদের কি নিরাপত্তার ছাড়পত্র লাগবে? একজন কাশ্মিরী যদি মুখ খোলে তবে কি তাকে উৎসবের জায়গা থেকে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে? নাকি তাকে বাড়ি ফিরে পোশাক পাল্টে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে আনার সুযোগ দেয়া হবে? (আমি একটু স্থুল ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছি কিন্তু আমি জানি যে ব্যাপারটা এর চেয়েও বেশি সূক্ষ।)
আসলে – এই উৎসব কেন্দ্রিক কৃত্রিম স্বাধীনতার উল্লসিত ধ্বনির সাহায্যে বিমানবন্দরের ভেতরের অলিগলি দিয়ে পুলিশি পাহারায় বিতাড়িত মানুষকে ফেরত প্লেনে উঠানোর পদশব্দ ঢেকে দেয়া যাবে, শক্তিশালী উষ্ণ হাতের কব্জিতে হাতকড়া লাগানোর মৃদু ক্লিক শব্দটি বোবা করে দেয়া যাবে, এবং জেলখানার ভারী গরাদ বন্ধ করার ধাতব শব্দকে সহজেই নীরব করে ফেলা হবে।
আমাদের ফুসফুসে অক্সিজেনের মাত্রা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হচ্ছে। হয়তো আমাদের শরীরের অবশিষ্ট শ্বাসটুকু দিয়ে এখনই বলার সময় এসেছে যে- অনেক হয়েছে, এই রক্তাক্ত দরজা এবার খুলে দাও। (চলবে)
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল
[বইটি বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকবে; প্রতি শুক্রবার।]