তৃতীয় পর্ব , দ্বিতীয় পর্ব , প্রথম পর্ব
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়নে কম-বেশি নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকায় আছে বিশ্বব্যাংক। ফলে বিশ্ব পুঁজি বাজারে যোগ দিতে দেশের পর দেশকে তাদের বাজার খুলে দিতে সে বাধ্য করে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে, আপনি বলতে পারেন যে, কর্পোরেট সমাজসেবা সর্বকালের সবচেয়ে দূরদৃষ্টিসম্পণ্ন একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
কর্পোরেট অনুদানে সমৃদ্ধ ফাউন্ডেশনগুলো তাদের ক্ষমতাকে পরিচালনা, কেনা-বেচা, এবং প্রবাহিত করার মাধ্যমে তাদের পছন্দের দাবাড়ুকে দাবার ছকে বসায়। অভিজাত ক্লাব এবং থিঙ্ক ট্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত একটি সিস্টেমের মাধ্যমে তারা এই দাবাড়ু বসানোর কাজটা করে। এই সিস্টেমের সদস্যরা আবার অংশত একইরকম হয় এবং একই রিভলভিং দরজার ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসা করে। প্রচলিত বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক নীতি, বিশেষ করে বামপন্থী গ্রুপগুলোর ভেতর প্রচলিত গোপন, শয়তানসুলভ, বা গুপ্ত ভাতৃত্বসুলভ কোন কিছু এই সিস্টেমে নেই। বরঞ্চ, কর্পোরেশনগুলো যেভাবে খোলসে ঢাকা কোম্পানি এবং বৈদেশিক অ্যাকাউন্টগুলোকে তাদের অর্থ সরানো ও পরিচালনায় ব্যবহার করে, তা থেকে এটা খুব বেশি ভিন্ন কোন ব্যবস্থা নয়। দুটোর ভেতর পার্থক্য শুধু এই যে, মুদ্রা মানে এক্ষেত্রে টাকা-পয়সা নয় বরং ক্ষমতা।
সিএফআর-এর সমমর্যাদার বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হলো ট্রাইলেটারাল কমিশন। ডেভিড রকফেলার, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জিগনিয়েভ ব্রিজিনস্কি (তালেবানের পূর্বসূরি আফগান মুজাহিদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য), চেস-ম্যানহাটন ব্যাংক, ও আরো কয়েকজন বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তি মিলে ১৯৭৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকা, ইউরোপ, ও জাপানের এলিটদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার টেকসই বন্ধন প্রতিষ্ঠা করাই ছিল এর উদ্দেশ্য । চীন ও ভারতকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার পর এটি এখন পঞ্চপক্ষীয় কমিশনে পরিণত হয়েছে। (সিআইআইয়ের তরুণ দাস, ইনফোসিসের সাবেক সিইও নারায়ণমূর্তি, গোদরেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জামশেদ এন. গোদরেজ, টাটা সন্সের পরিচালক জামশেদ এন. ইরানি, এবং অ্যাভান্ত গ্রুপের সিইও গৌতম থাপর।)
এমনই আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো অ্যাসপেন ইনস্টিটিউট। এটি স্থানীয় এলিট, ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদদের নিয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ক্লাব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ফ্রাঞ্চাইজ রয়েছে। ভারতে অ্যাসপেন ইনস্টিটিউট সভাপতি হলেন তরুণ দাস। আর চেয়ারম্যান হলো গৌতম থাপর। ম্যাকিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউট এর (দিল্লিমুম্বাই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল করিডোরের প্রস্তাবক) বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সিএফআর, ট্রাইলেটারাল কমিশন ও অ্যাসপেন ইনস্টিটিউটের সদস্য।
ফোর্ড ফাউন্ডেশন (রকফেলার ফাউন্ডেশনের অধিকতর রক্ষণশীলতার উপর লাগানো উদারতার প্রলেপ, যদিও সব সময়েই প্রতিষ্ঠান দুটি একসঙ্গে কাজ করে) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৬ সালে। ফোর্ড ফাউন্ডেশনকে প্রায়ই খাটো করে দেখা হয়। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির অত্যন্ত স্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ রয়েছে এবং এটি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা ও ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠার জন্য এই ফাউন্ডেশনের যে প্রকল্প রয়েছে তাকে আদর্শ ব্যবসায়িক ব্যবস্থা এবং অবাধ বাজারের কার্যকারিতা বিকাশে ব্রেটন উডসের পরিকল্পনারই বিশেষ অংশ বলা চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন ফ্যাসিবাদীদের বদলে কমিউনিস্টরা মার্কিন সরকারের পয়লা শত্রুতে পরিণত হলো, তখন স্নায়ুযুদ্ধ মোকাবিলার জন্য নতুন নতুন ধরণের প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফোর্ড প্রতিষ্ঠা করে র্যান্ড (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)। সামরিক থিঙ্ক ট্যাংক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সার্ভিসের জন্য অস্ত্র নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরুর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। “মুক্ত দেশগুলোতে কমিউনিস্টদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে এবং গোলযোগ সৃষ্টির তৎপরতা বন্ধ করতে” ১৯৫২ সালে এরা প্রতিষ্ঠা করে “ফান্ড ফর দ্য রিপাবলিক”। পরিবর্তীতে যা সূক্ষভাবে পাল্টে গিয়ে “সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেমোক্রাটিক ইনস্টিটিউশন” এ রূপ নেয়। কমিউনিস্ট দমনে ম্যাকার্থাইটের বাড়াবাড়ি পদ্ধতি বাদ দিয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াই ছিল এই ইনস্টিটিউশনের মূল কাজ।
ভারতে এই ফোর্ড ফাউন্ডেশন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে; শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, ও সমাজকর্মীদের তহবিল জোগাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্স ও স্কলারশিপে উদার হাতে অনুদান দিচ্ছে। ফাউন্ডেশন সম্পর্কে একটু আগে আমরা যা জানলাম তার আলোকেই ভারতে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের এইসব অর্থায়নকে আমাদের মূল্যায়ন করা উচিত।
‘মানবজাতির ভবিষ্যত লক্ষ্যগুলো’- ফোর্ড ফাউন্ডেশন ঘোষিত একটি এজেন্ডা। এই এজেন্ডার ভেতর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক আন্দোলনগুলোয় হস্তক্ষেপের কথা রয়েছে। ১৯১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রেডিট ইউনিয়ন মুভমেন্টকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার মঞ্জুরি ও ঋণ দেয়। ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মালিক অ্যাডওয়ার্ড ফিলেন ছিলেন এই মুভমেন্টের পথিকৃৎ। ফিলেন ভোগ্যপণ্য কেনার জন্য শ্রমিকদের ঋণ লাভের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে একটি গণভোগকারী সমাজ সৃষ্টিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ওই সময়ের আলোকে এই ভাবনাটি ছিল দুর্দান্ত। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটি ছিল আধা প্রগতিশীল ধারণা। কারণ, ভাবনার অন্য অংশে ফিলেন জাতীয় আয়ের সুষম বণ্টনের ধারণাতেও বিশ্বাস করতেন। পুঁজিবাদীরা ফিলেনের চিন্তার প্রথম অর্ধেক লুফে নিয়ে কর্মজীবী মানুষকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ‘সহনীয়’ ঋণ দিতে লাগল। এই ঋণের মাধ্যমে তারা মার্কিন শ্রমজীবী শ্রেণীকে স্থায়ীভাবে ঋণের জালে আটকে ফেলে তাদের জীবনযাত্রার রাশ টেনে ধরতে সমর্থ হয়।
অনেক বছর পর যখন মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুধার্ত কৃষকদেরকে ভয়াবহ পরিণতি-সম্বলিত ক্ষুদ্রঋণের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় তখন এই ধারণাটিই ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের হতদরিদ্র পল্লীতে এসে পৌঁছায়। ভারতীয় উপমহাদেশের গরীবেরা সবসময়ই গ্রামের দয়ামায়াহীন শোষক তথা বেনিয়াদের ঋণের ভেতর বসবাস করতো। কিন্তু ক্ষুদ্রঋণ এই ব্যাপারটিকে কর্পোরেটের আওতার ভেতর নিয়ে আসে। ভারতে শত শত আত্মহত্যার জন্য এই ক্ষুদ্রঋণের কারবারীরাই দায়ী। ক্ষুদ্রঋণের কারণে কেবল ২০১০ সালেই অন্ধ্রপ্রদেশে ২০০ লোক এভাবে জীবন দিয়েছেন। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে ১৮ বছরের এক বালিকার আত্মহত্যার চিরকুট প্রকাশিত হয়েছে। মেয়েটি তার শেষ সম্বল স্কুলের বেতনের ১৫০ রুপি ক্ষুদ্রঋণ কোম্পানির নাছোড়বান্দা কর্মীদের কাছে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। চিরকুটটিতে লেখা ছিল : “কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করো। তবু ঋণ নিয়ো না।”
দারিদ্র্যে অনেক টাকা আছে, এবং এতে কিছু নোবেল পুরস্কারও থাকে।
১৯৫০-এর দশকে রকফেলার ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন বেশ কয়েকটি এনজিও ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তহবিল দেয়া শুরু করে। এসব প্রতিষ্ঠান দৃশ্যত ল্যাটিন আমেরিকা, ইরান, ও ইন্দোনেশিয়ায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার উৎখাতে তৎপর মার্কিন সরকারের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে কাজ করতো। (প্রায় একই সময়ে তারা ভারতেও প্রবেশ করে। ভারত তখন জোট নিরপেক্ষ শিবিরে অবস্থান করলেও স্পষ্টভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে ছিল।) ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইন্দোনেশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কিন ধাঁচের অর্থনীতি কোর্স চালু করে। ১৯৬৫ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সিআইএ সমর্থিত অভ্যূত্থান হয়। মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের হাতে বিদ্রোহ দমন প্রশিক্ষণ পাওয়া এলিট ইন্দোনেশীয় ছাত্ররা এই অভ্যূত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং এর মাধ্যমে জেনারেল সুহার্তোকে ক্ষমতায় বসানো হয়। জেনারেল সুহার্তো হাজার হাজার কমিউনিস্ট বিদ্রোহীকে হত্যার মধ্য দিয়ে তার পরামর্শদাতাদের ঋণ শোধ করেন।
তহবিল দেয়া শুরু করার বিশ বছর পর, শিকাগো বয়েজ নামে পরিচিত চিলির তরুণ ছাত্রদের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে (জে. ডি. রকফেলারের দানে পরিচালিত) নিয়ে যাওয়া হয়। তারা সেখানে মিল্টন ফ্রিডম্যানের কাছ থেকে নব্য-উদার অর্থনীতি বিষয়ে শিক্ষা নেয়। এই শিক্ষা কার্যক্রম মূলত ছিল ১৯৭৩ সালের সিআইএ-সমর্থিত অভ্যূত্থানের প্রস্তুতি, যার পরিণতিতে সালভাদর আয়েন্দে নিহত হন এবং জেনারেল পিনোশে ক্ষমতায় আসেন। পিনোশে’র ডেথ স্কোয়াড চিলিতে ১৭ বছর ধরে গুম আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। আয়েন্দে ছিলেন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সোশ্যালিস্ট এবং তিনি চিলির খনিগুলো জাতীয়করণ করেছিলেন- এটাই তার অপরাধ।
১৯৫৭ সালে এশিয়ার সামাজিক আন্দোলনের নেতাদের জন্য রকফেলার ফাউন্ডেশন র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার চালু করে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট র্যামন ম্যাগসেসের নামে এ পুরস্কারের নামকরণ করা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মার্কিন অভিযানের সময় যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত আস্থাভাজন মিত্র ছিলেন এই র্যামন । ২০০০ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন র্যামন ম্যাগসেসে ইমারজেন্ট লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড চালু করে। ভারতের শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী, সামাজিক আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। এমএস শুভলক্ষ্মী, সত্যজিৎ রায়, জয়প্রকাশ নারায়ণ, এবং ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক পি. শ্রীনাথ এই পুরস্কার পেয়েছেন। তবে ম্যাগসেসে পুরস্কার তাদের যতোটা মর্যাদা দিয়েছে, তার চেয়ে তারা ম্যাগসেসেকে দিয়েছেন আরো বেশি। সাধারণভাবে বলতে গেলে, এই পুরস্কারের মাধ্যমে কোন কাজ “গ্রহণযোগ্য” এবং কোনগুলো তা নয়, সেটা ভদ্রস্থভাবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
মজার ব্যাপার হলো, তিন ম্যাগসেসে পুরস্কারজয়ী ব্যক্তি- আন্না হাজারে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ও কিরণ বেদি গত গ্রীষ্মে আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অনেকগুলো এনজিও’র একটিকে দুই হাতে তহবিল যোগান দেয় ফোর্ড ফাউন্ডেশন। আর কোকাকোলা ও লেহমান ব্রাদার্সের টাকায় চলে কিরণ বেদির এনজিও।
আন্না হাজারে নিজেকে গান্ধীবাদী হিসেবে প্রচার করেন। কিন্তু তিনি যে আইনটিকে “জন লোকপাল বিল” অভিহিত করছেন, সেটি অ-গান্ধীবাদী, অভিজাত শ্রেণীবান্ধব, ও বিপজ্জনক। কর্পোরেট মিডিয়ার প্রচার প্রচারণায় তিনি সবসময় ‘জনগণ’-এর কণ্ঠস্বর হিসেবে মর্যাদা পেয়ে আসছেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের “অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট”-এর বিপরীতে হাজারের আন্দোলন একবারও বেসরকারিকরণ, কর্পোরেট শক্তি, বা অর্থনৈতিক “সংস্কার”-এর বিরুদ্ধে কথা বলেনি। বরং তার সমর্থক প্রধান প্রধান মিডিয়াগুলো এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে সফলভাবে ব্যাপক কর্পোরেট দুর্নীতি, কেলেঙ্কারি (যাতে বড় বড় সাংবাদিকদের জড়িত থাকার বিষয়ও প্রকাশিত হয়েছিল) আড়াল করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে তারা রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, আরো সংস্কার, আরো বেসরকারিকরণের প্রচারণা জোরদার করে। ২০০৭-এ ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত এক পর্যালোচনা পত্রে বিশ্বব্যাংক আন্নার আন্দোলনকে তাদের “গুড গভর্ননেন্স” নীতির সাথে “সামঞ্জস্যপূর্ণ” বলে মন্তব্য করে। (২০০৮ সালে অনবদ্য জনসেবার জন্য আন্না হাজারে বিশ্বব্যাংক পুরস্কার লাভ করেন।)
সব ভালো সাম্রাজ্যবাদীর মতো সমাজসেবকেরাও নিজের স্বার্থ সুরক্ষায়, নিজেদের দায়িত্ব হিসেবে, পুঁজিবাদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য বিস্তারে বিশ্বাসী একটি আন্তর্জাতিক ক্যাডার গঠন ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। স্থানীয় অভিজাতেরা যেভাবে ঔপনিবেশিকতাবাদের সেবা করত তারা সেভাবেই ‘‘গ্লোবাল কর্পোরেট গভর্নমেন্ট’’ পরিচালনা করে চলেছে। আর এ কারণেই ফাউন্ডেশনগুলো শিক্ষা ও শিল্পকলায় হানা দিতে শুরু করেছে। বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতির পর এটি তাদের প্রভাব বিস্তারের তৃতীয় প্রভাবশালী ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাদান খাতে তাই তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে (এবং এখনো করে যাচ্ছে)।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষার পুরনো ধ্যান-ধারণাগুলোকে ফাউন্ডেশনগুলো কীভাবে নতুন বিন্যাসে পাল্টে দেয়, কীভাবে “আন্তর্জাতিক’’ ও ‘‘এলাকাভিত্তিক” স্টাডিজ বিষয়গুলো হালনাগাদ করে, জোয়ান রোল্ফস তার চমৎকার গ্রন্থ ফাউন্ডেশনস অ্যান্ড পাবলিক পলিসি : দ্য মাস্ক অব প্লুরালিজম-এ তা তুলে ধরেছেন। ফাউন্ডেশনগুলোর এই কাজের মাধ্যমে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের নিজেদের সুরক্ষায় নিয়োজিত করার জন্য বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত এক দল বিশেষজ্ঞ পেয়ে যায়; সিআইএ ও মার্কিন স্বরাষ্ট্র দফতর যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে তাদের কার্যক্রম চালায়, ফলে তাদের দেয়া স্কলারশিপের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করা যে কোনো ক্ষমতাসীন শক্তির জন্য একটি মৌলিক ব্যাপার। ভারত জুড়ে ভূমি অধিগ্রহণ ও নতুন অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠার, বিশেষ করে মধ্য ভারতে পুরোদস্তুর যুদ্ধের ছায়ায় গড়ে ওঠা প্রতিরোধের প্রেক্ষাপটে, প্রতিবাদের প্রভাব হ্রাসের পদ্ধতি হিসেবে সরকার “ইউনিক আইডেনটিফিকেশন নাম্বার” (ইউআইডি) নামের একটি ব্যাপক বায়োমেট্রিক্স কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এটি বিশ্বের অন্যতম উচ্চাভিলাষী ও ব্যয়বহুল তথ্য-সংগ্রহ প্রকল্প। মানুষের খাবারপানি, কিংবা টয়লেট বা খাবার বা টাকা-পয়সা না থাকতে পারে, কিন্তু তাদের ভোটার কার্ড ও ইউআইডি নম্বর থাকবে। চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো, ইউআইডি প্রকল্পটি পরিচালনা করছেন নন্দন নিলেকানি। তিনি ইনফোসির সাবেক সিইও। ফলে, “দরিদ্র মানুষের সেবা করা”র এই প্রকল্প কি আসলে বেকায়দায় পড়া আইটি শিল্পকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদানের কর্মসূচি নয়?- সে প্রশ্ন করাই যায়। বস্তিবাসী, হকার, ভূমি রেকর্ডবিহীন আদিবাসীদের মতো বিপুলসংখ্যক অবৈধ ও ‘‘অস্পষ্ট’’ মানুষে ভরা একটি দেশকে ‘‘ডিজিটালকরণ’’ করা হলে তা ওইসব লোককে অবৈধ থেকে আইনগতভাগে অগ্রাহ্য মানুষে পরিণত করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘‘সাধারণ মানুষকে ঘিরে ফেলা’’ এবং ক্রমবর্ধমান কঠোরতর পুলিশি রাষ্ট্রের হাতে বিপুল ক্ষমতা ন্যস্ত করাই এই ডিজিটাল সংস্কার কাজের উদ্দেশ্য। প্রযুক্তিগতভাবে উপাত্ত সংগ্রহের যে ধ্যানধারণায় নিলেকানি আসক্ত, তার সাথে ডিজিটাল ডাটাবেইজ, সংখ্যাগত লক্ষ্য, ও “অগ্রগতির স্কোরকার্ডের” ব্যাপারে বিল গেটসের বদ্ধমূল ধারণার কোন তফাত নেই। তাদের ধারণাটি এমন যেন ঔপনিবেশিকতাবাদ, ঋণ, ও চক্রবৃদ্ধি মুনাফামুখী কর্পোরেট নীতি নয়, বরং বিশ্বে ক্ষুধার মূল কারণ হলো তথ্যের অভাব।
কর্পোরেট অর্থ-সমৃদ্ধ ফাউন্ডেশনগুলো সমাজবিজ্ঞান ও শিল্পকলার বৃহত্তম তহবিল জোগানদাতা। সেইসাথে এরা ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কমিউনিটি স্টাডিজ, কালচারাল স্টাডিজ, বিহাভিয়ারাল সায়েন্স, এবং হিউম্যান রাইটস বিষয়ক কোর্সে অনুদান ও বৃত্তি দিয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজের দরজা খুলে দেয়ার পর লাখ লাখ ছাত্র, তৃতীয় বিশ্বের অভিজাতদের সন্তানেরা, বন্যার বেগে সেখানে প্রবেশ করেছে। যারা পড়ালেখার ফি জোগাড় করতে পারে না, তাদের জন্য আছে স্কলারশিপ। বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে- সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে পাঠায়নি- উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এমন একটি পরিবারও সম্ভবত খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখান থেকে কেবল ভালো বিদ্বান ও শিক্ষাবিদেরাই উঠে আসবে না, বলা যায়- প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, অর্থনীতিবিদ, কর্পোরেট আইনজীবী, ব্যাংকার, আমলাও এখান থেকে তৈরি হবে। এবং তারাই তাদের দেশের অর্থনীতিকে বৈশ্বিক কর্পোরেশনগুলোর জন্য খুলে দেবে।
ফাউন্ডেশনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তৈরি করা অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিতদের ফেলোশিপ, গবেষণা তহবিল, মঞ্জুরি, ভাতা, ও চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। যারা ফাউন্ডেশন-বান্ধব নন, তারা তহবিল পান না, কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকেন, তাদের স্থান হয় আমেরিকার ঘেট্টোতে, আর তাদের কোর্সগুলো অসমাপ্তই থেকে যায়। এভাবে ক্রমান্বয়ে, একটি নির্দিষ্ট কল্পনা- একটি ভঙ্গুর, কৃত্রিম সহিষ্ণুতার ভন্ডামি এবং বহুসংস্কৃতিবাদ (যা গাছের মূলের মতো বর্ণবাদে, উন্মাদ জাতীয়তাবাদে, জাতিগত উগ্র স্বদেশিকতায়, অথবা এক মুহূর্তের নোটিশে আসা ইসলামোফোবিয়ার যুদ্ধাতঙ্কে রূপ নেয়) শুধু একটিই ব্যাপক ও বিশাল অবহুত্ববাদী অর্থনৈতিক আদর্শের ছাদের নিচে থেকে- সুসংবদ্ধ চিন্তা বা ডিসকোর্সের ভেতর নিজের প্রাধান্য বজায় রাখে। বিষয়টিকে এতোটাই জোরদার করে করা হয়েছে যে, এটাকে এখন আর আদর্শ হিসেবে বোঝা যায় না। এটি এখন অন্য আদর্শের অনুপস্থিতিতে একা একাই জয়লাভ করার মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে নয় বরং স্বাভাবিকতার সাথে নিজের অবস্থানে সুদৃঢ় আছে। বলা যায়, এটি স্বাভাবিকতাতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং এই আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করাটা এখন বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতোই অবাস্তব ও দুর্বোধ্য মনে হয়।
ইদানীং ‘‘ওকুপাই মুভমেন্ট’’ এর কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথেঘাটে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে অন্য ভাষাটি আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছে; ছাত্রদের ‘‘শ্রেণীযুদ্ধ’’ বা ‘‘তুমি ধনী হলে আমাদের আপত্তি নেই, তবে সরকারকে কিনে নিলে অমাদের আপত্তি আছে”-এর মতো ব্যানারগুলো এই মুহূর্তে আশা জাগানিয়া, প্রায় বিপ্লবের মতোই শোনায়।
কর্পোরেট সমাজসেবা শুরুর পর একশ বছর পার হয়ে গেছে। এটা এখন কোকাকোলার মতোই আমাদের জীবনযাত্রার অংশে পরিণত হয়েছে।ফলে বর্তমানকালে লাখ লাখ দাতব্য সংস্থা গড়ে উঠেছে।
এগুলোর অনেকেই বাইজেন্টিয়ান সাম্রাজ্যবাদের বাণিজ্যময় গোলকধাঁধার মাধ্যমে বড় বড় ফাউন্ডেশনের সাথে জড়িত। এই ‘‘স্বাধীন’’ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলার। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল বিল গেটস ফাউন্ডেশন (২১ বিলিয়ন ডলার) এরপর রয়েছে লিলি এনডোমেন্ট (১৬ বিলিয়ন ডলার) ও ফোর্ড ফাউন্ডেশন (১৫ বিলিয়ন ডলার)।
আইএমএফ যেহেতু কাঠামোগত সমন্বয় এবং অন্যান্য নানা পন্থায় সরকারগুলোকে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু পরিচর্যা, ও উন্নয়ন প্রকল্পতে কাটছাঁট করতে বাধ্য করে, সেহেতু এনজিওগুলোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। সবকিছুর বেসরকারিকরণ-এর অর্থ সবকিছু এনজিওকরণও। এ পদ্ধতিতে কর্মসংস্থান ও জীবিকা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় এনজিওগুলো চাকরির মহাগুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠে। এমনকি যারা এনজিওগুলোর সত্যিকারের চেহারা দেখতে পায় তাদের জন্যও এটা সত্য। অবশ্য এগুলোর সবই যে খুব খারাপ, তা নয়। লাখ লাখ এনজিও’র মধ্যে কিছু কিছু দারুণ, অসাধারণ কাজ করছে; আর তাই, একই তুলি দিয়ে সব এনজিওকে কালিমাযুক্ত করাটা হবে হাস্যকর একটি কাজ।
তবে কর্পোরেট বা ফাউন্ডেশন-অনুদানে চালিত এনজিও হলো প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো কিনে নেয়ার বৈশ্বিক আর্থিক মাধ্যম। বলা যায়, যেভাবে শেয়ারহোল্ডারেরা কোম্পানির শেয়ার কিনে তারপর ভেতর থেকে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তেমন করাটাই তাদের কাজ। তারা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গ্রন্থির মতো বৈশ্বিক অর্থপ্রবাহের চলার পথে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। ট্রান্সমিটার, রিসিভার, তরঙ্গের ওঠানামার আত্মস্থকারীর মতোই তারা কাজ করে, প্রতিটি স্পন্দনে সতর্ক থাকে, এবং তাদের স্বাগতিক দেশকে কখনোই বিরক্ত না করার ব্যাপারে ভূমিকা পালন করে। (ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদান পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ সম্পর্কে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।)
অসতর্কতাবশত (এবং অনেক সময় সতর্কতার সঙ্গে) তারা শ্রবণযন্ত্র হিসেবেও কাজ করে। ক্রমশ কঠোর হয়ে ওঠা রাষ্ট্রের বর্ধিত নজরদারির আগ্রাসী ব্যবস্থায় এদের সংগৃহীত রিপোর্ট, কর্মশালা, এবং অন্যান্য সেবামূলক কার্যক্রম প্রয়োজনীয় তথ্য যুগিয়ে যায়। যে দেশে যতো বেশি সমস্যা সেই দেশে এনজিও’র সংখ্যাও ততো বেশি।
খারাপ ব্যাপার হলো, ভারত সরকার বা কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমের কোনো একটি অংশ যখন প্রকৃত কোন গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অপবাদ প্রচার করতে চায়- যেমন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন বা কুন্দনকুলাম পারমাণবিক চুল্লির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ- তখন তারা এসব আন্দোলনকে ‘বিদেশি অর্থ’ প্রাপ্ত এনজিও হিসেবে অভিহিত করে। তারা খুব ভালো করেই জানে, বেশির ভাগ এনজিও-ই; বিশেষ করে যেগুলো আর্থিকভাবে ভালো অবস্থায় রয়েছে- তাদের কাজ হলো কর্পোরেট বিশ্বায়নের প্রকল্পকে আরো জোরদার করা, একে ব্যর্থ করা নয়।
(চলবে)
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল
[বইটি বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকবে; প্রতি শুক্রবার।]