২০০৫ সালে চন্ডিগড়, উড়িষ্যা, এবং ঝাড়খণ্ডের রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্পোরেশনের সাথে কয়েকশ সমঝোতা স্মারক (মেমোরান্ডাম অব আন্ডারস্টান্ডিং বা এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির ফলে ঐসব প্রতিষ্ঠান কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বক্সাইট, লোহার আকরিকসহ অন্যান্য খনিজ সম্পদ নামমাত্র মূল্যে কিনে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে, এমনকি মুক্তবাজার বাণিজ্যের বিকৃত যুক্তিকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। (সরকারকে যে রয়্যালটি দেয়া হয় তার পরিমাণ মাত্র ০.৫ থেকে ৭ শতাংশ।)
ছত্রিশগড় সরকার বাস্তার বিভাগে টাটা স্টিলের সাথে একটি স্টিল কারখানা তৈরির সমোঝতা চুক্তি স্বাক্ষর করার মাত্র কয়েকদিন পরেই “সালওয়া জুদুম” নামক অতি সতর্ক এক সেনাবাহিনীর অভিষেক ঘটানো হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, জঙ্গলের মাওবাদী গেরিলাদের “অত্যাচারে” অতিষ্ঠ হয়ে এলাকাবাসী স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ করে এই বাহিনী গঠন করতে এগিয়ে এসেছে। পরে দেখা গেল যে এটি এক ধরণের শুদ্ধি অভিযান যাতে সরকার নিজেই অর্থ এবং অস্ত্রের যোগান দিয়েছে। তাছাড়া, খনির কর্পোরেশনগুলো এই বাহিনী গঠনের জন্য ভর্তুকিও দিয়েছিল। অন্যান্য রাজ্যেও এরকম আরও সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে, অবশ্য সেগুলোর নাম আলাদা। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঘোষণা দিয়েছেন যে মাওবাদীরাই “ভারতের একমাত্র ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা হুমকি।” প্রকৃতপক্ষে এই বক্তব্য ছিল একটি যুদ্ধের ঘোষণা।
২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি উড়িষ্যার প্রতিবেশী রাজ্য কালিঙ্গানগরে গ্রামবাসীরা টাটা স্টিলের নির্মাণাধীন একটি কারখানা এলাকায় জড়ো হয়। সরকারের কাছ থেকে নিজেদের জমির বিনিময়ে তারা যে টাকা পেয়েছিল তা বাজারদরের চেয়ে খুবই কম ছিল। এই অন্যায্যতার প্রতিবাদ জানানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। সম্ভবত সরকারি সিদ্ধান্তের গুরুত্ব বোঝাবার জন্যই ১০ প্লাটুন পুলিশ এসে, জড়ো হওয়া গ্রামবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঐ ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্যসহ ১৩ জন মানুষ প্রাণ হারায় এবং সাইত্রিশ জন আহত হয়। তারপর ছয় বছর পার হয়ে গেছে। ওই এলাকার গ্রামগুলো অস্ত্রধারী পুলিশ অবরোধ করে রেখেছে। কিন্তু জনগণের প্রতিবাদী মনোভাব এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
এদিকে ছত্রিশগড়ে সালওয়া জুদুম তাদের দমন, ধর্ষণ, হত্যা, আর অগ্নিসংযোগ চালিয়ে বনের ভেতরের কয়েকশ গ্রাম দখল করে নেয়। ছয়শো গ্রাম খালি করে ৫০,০০০ গ্রামবাসীকে নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে পুলিশের শিবিরে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। সেই সাথে এই ঘটনার ফলে ৩,৫০,০০০ মানুষকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, যারা জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে আসবে না তাদেরকে “মাওবাদী জঙ্গি” হিসেবে গণ্য করা হবে। এইভাবেই ভারতের ওই অংশের জমিতে চাষাবাদ আর ফসল ফলানোর যে কাজ, তার নাম দেয়া হয়েছে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। সালওয়া জুদুমের চালানো নৃশংসতার ফলে ওই এলাকায় মাওবাদী গেরিলাবাহিনীর প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে ২০০৯ সালে সরকারের পক্ষ থেকে তথাকথিত “অপারেশন গ্রিন হান্ট” এর ঘোষণা দেয়া হয়। এর আওতায় ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, এবং পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দুই লাখ সৈন্যের আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
তিন বছর ধরে “মৃদু সংঘাত” চলার পরেও সরকার যখন জঙ্গল থেকে বিদ্রোহীদের “বের” করে আনতে ব্যর্থ হলো, তখন কেন্দ্রীয় সরকার ওইসব এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনী মোতায়েনের ঘোষণা দেয়। ভারতে এই পরিস্থিতিকে আমরা যুদ্ধ বলি না। একে আমরা বলি “বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করা।” ইতোমধ্যেই ওই এলাকায় হাজার হাজার সৈন্য পাঠানো হয়েছে। ব্রিগেডের সদরদপ্তর এবং বিমানঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনীগুলোর একটি এখন নিজেদের “রক্ষা” করার জন্য কলাকৌশল তৈরি করছে। সেনাবাহিনীর এইসব কার্যকলাপ যাদের বিরুদ্ধে তারা হল পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের দল। এখন আমরা কেবল “সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ( এএফএসপিএ) এর জন্যই অপেক্ষা করছি, যে আইন সেনাবাহিনীকে “সন্দেহভাজন” ব্যক্তিদের হত্যা করার অধিকার এবং তা থেকে বৈধ উপায়ে দায়মুক্তির ক্ষমতা দেবে। অবশ্য কাশ্মীর, মনিপুর, নাগাল্যান্ডের কয়েক হাজার বেনামী কবর এবং শবদাহের চিতা দেখলে এই সেনাবাহিনীকে বেশ সন্দেহপ্রবণ বলেই মনে হয়।
সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি যখন চলছিল তখন ভারতের মূল ভূখণ্ডের বনভূমিতে অবরোধ বজায় ছিল। ফলে, গ্রামবাসীরা ভয়ে জঙ্গল থেকে বের হতে পারছিল না। এমনকী খাবার বা ওষুধ কেনার জন্যও তারা বাজারে যেতে পারছিল না। সেসময়, মাওবাদী হওয়ার অভিযোগে শত শত মানুষকে কঠোর অগণতান্ত্রিক আইনের আওতায় জেলে আটকে রাখা হয়। আদিবাসী মানুষ, যাদের অনেকেই তাদের অপরাধটা কি তা জানে না, তাদের দিয়ে জেলখানাগুলো ভর্তি করে ফেলা হয়। সম্প্রতি বাস্তার এলাকায় সোনি সোরি নামের একজন আদিবাসী স্কুল শিক্ষিকা গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিত হয়েছেন। মেয়েটি যাতে মাওবাদীদের বার্তাবাহক হিসেবে নিজেকে “স্বীকার” করতে বাধ্য হয় সেজন্য তার যোনিপথে পাথর ঢুকানো হয়। জনগণের তীব্র দাবীর মুখে মেয়েটিকে কলকাতার এক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হলে রোগিনীর শরীর থেকে ঐ পাথরগুলো বের করা হয়। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের শুনানীর সময়, মানবাধিকার কর্মীরা একটি প্লাস্টিক ব্যাগ ভর্তি করে পাথরগুলো বিচারকদের সামনে উপস্থিত করে। পাথরগুলোকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের ফলাফল এটুকুই হয়েছে যে, সোনি সোরি এখনও জেলেই আটক আছেন। আর এদিকে আঙ্কিত র্গাগ- সোনি সোরিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা সেই পুলিশ সুপারিটেন্ডেন্ট, বীরত্বের জন্য প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে পুলিশ পদক পেয়েছে।
কেবল গণঅভ্যুত্থান আর যুদ্ধের কারণেই আমরা কেন্দ্রীয় ভারতের সামাজিক ও পরিবেশগত পুণঃস্থাপনার কথা শুনি। সরকারের পক্ষ থেকে নিজে যেচে কোন তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সকল সমঝোতা চুক্তিই গোপনে স্বাক্ষরিত হয়। কেবল গণমাধ্যমের কয়েকটি অংশই কেন্দ্রীয় ভারতে কি ঘটছে সে ব্যাপারে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যথাসাধ্য করে থাকে। যাই হোক, ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর বেশিরভাগই খুব সহজে ক্ষতিগ্রস্থ হবার আশঙ্কায় থাকে, কারণ তাদের আয়ের সিংহভাগই আসে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন থেকে। শুধু তাই নয়, আরো বড় দুঃসংবাদ হলো, গণমাধ্যম আর বৃহৎ বাণিজ্যের মধ্যকার তফাতটুকু আশঙ্কাজনকভাবে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আরআইএল সাতাশটি টিভি চ্যানেলের মালিক। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, এর উল্টোটাও ঘটছে। কিছু কিছু গণমাধ্যমের নিজেদেরই বাণিজ্য আছে বা কর্পোরেট বাণিজ্যের সাথে তাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা আছে। যেমন, “দৈনিক ভাস্কর” নামের একটি প্রধান জাতীয় পত্রিকার প্রায় ১৭.৫ মিলিয়ন পাঠক রয়েছে। এই দৈনিক পত্রিকাটি তেরোটি রাজ্যে ইংরেজি এবং হিন্দিসহ চারটি ভাষায় প্রকাশিত হয়। এছাড়াও পত্রিকাটি ঊনসত্তরটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আছে খনি, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, রিয়েল এস্টেট, ও বস্ত্রশিল্প যেখান থেকে মালিকপক্ষ লাভবান হয়। “দৈনিক ভাস্কর” এর মতো আরো উদাহরণ দেয়া যায়।
সম্প্রতি ছত্রিশগড়ের উচ্চ আদালতে দায়েরকৃত একটি রিট পিটিশনে অভিযোগ করা হয় যে, ডিবি পাওয়ার লিমিটেড (ঐ গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান) ইচ্ছাকৃতভাবে অবৈধ এবং অসৎ উপায় ব্যবহার করে নিজেদের পত্রিকার মাধ্যমে একটি উন্মুক্ত-ঢালাই পদ্ধতির কয়লাখনি’র প্রকাশ্য শুনানির ফলাফলকে প্রভাবিত করছে। পত্রিকাটি শুনানির ফলাফলকে সত্যি সত্যিই প্রভাবিত করেছে কিনা তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, এমন কাজ করার মতো সুযোগ গণমাধ্যমগুলোর আছে। এবং সে সুযোগ ব্যবহার করার ক্ষমতাও তাদের রয়েছে; এই দেশের আইন তাদেরকে এমন এক অবস্থানে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে যেখান থেকে তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় আইনের সাথেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে।
এই দেশের আরো বিভিন্ন অঞ্চল আছে যেখান থেকে কোন খবরই আমরা পাই না। অরুণাচল প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনবিরল অথচ সেনাবেষ্টিত রাজ্যে ১৬৮ টি বড় বাঁধ তৈরি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই ব্যক্তি মালিকানাধীন। মনিপুর এবং কাশ্মীরের মতো ব্যাপক সেনাবেষ্টিত রাজ্যে এতো বড় বাঁধ তৈরি করা হয়েছে যা খুলে দিলে পুরো জেলাই ডুবে যাবে। অথচ এসব রাজ্যে বিদ্যুতের অভাবে প্রতিবাদ জনাতে গিয়েও মানুষ প্রাণ হারায় (মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই কাশ্মীরে এমনটি ঘটেছে)। এসব এলাকার সাধারণ মানুষ যারা একটু প্রতিবাদেই প্রাণ হারায়, তারা তাহলে কীভাবে বাঁধের মতো বড় স্থাপনা তৈরিতে বাধা দেবে?
গুজরাটের কল্পাসার বাঁধটি সবচেয়ে হঠকারি। খাম্বাট উপসাগর জুড়ে ৩৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বাঁধটি এমনভাবে তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে যাতে এর উপর দিয়ে রেলপথসহ ১০ লেনের একটি রাস্তা বানানো যায়। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য হল সমুদ্রের লোনা পানি আটকে রেখে গুজরাটের নদীগুলোর জন্য একটি মিষ্টি পানির জলাধার তৈরি করা (যদিও এই নদীগুলো ইতোমধ্যেই ধাপ্পাবাজদের খপ্পরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং কলকারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক প্রবাহে দূষিত হয়ে গেছে)। ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে বিজ্ঞানীরা কল্পাসার বাঁধ নিয়ে আপত্তি তুলেছেন কারণ এ বাঁধটি সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বাড়িয়ে দেবে এবং উপকূলের কয়েকশ কিলোমিটারব্যাপী এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ পাল্টে দেবে। আর এখন, যাতে করে ধোলেরার বিশেষ বিনিয়োগ অঞ্চলে (এসআইআর) পানি সরবরাহ করা যায় সেজন্য হঠাৎ করেই এই পরিকল্পনা প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এই এসআইআর শুধু ভারতে নয় বরং সমগ্র পৃথিবীর সবচেয়ে পানি বঞ্চিত এলাকাগুলোর একটি। এসআইআর এর অপর নাম এসইজি যা কীনা শিল্প এলাকা, শহরতলী, আর মেগাসিটির সমন্বয়ে গঠিত এক সায়ত্ত্বশাসিত কর্পোরেট-কষ্টের কল্পনগরী। দশ লেনের কয়েকটি সড়কের সমন্বয়ে তৈরি একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ধোলেরা এসআইআ- কে গুজরাটের অন্যান্য শহরের সাথে যুক্ত করা হবে। এখন প্রশ্ন হল, এই সব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা কোথা থেকে আসবে?
২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে মহাত্মা (গান্ধী) মন্দিরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সভাপতিত্ব করেন। ঐ সভায় একশটি দেশ থেকে আগত দশ হাজার আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী ঐ সব ব্যবসায়ী গুজরাটে ৪৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেন। যে দিনটিতে গুজরাটের মুসলিম গণহত্যার দশ বছর পূর্তি হয়েছিল, ইচ্ছাকৃতভাবে সেই দিনটিতেই ওই সভার আয়োজন করা হয়। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ওই দিনটিতে দুই হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকাণ্ডের জন্য মোদীকে দায়ী করে এই অভিযোগ তোলা হয় যে, তিনি গণহত্যা সম্পর্কে জেনেও সেদিন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি বরং হত্যাযজ্ঞে সহায়তা করেছেন। যারা চোখের সামনে প্রিয়জনদের ধর্ষিত হতে দেখেছে, দেখেছে তাদের আপনজনদের পেটের নাড়িভূড়ি বের করে ফেলা হচ্ছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, এবং যে দশ হাজার মানুষকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে তারা সকলেই ন্যায়বিচারের অন্তত সামান্য কোন ইঙ্গিত পাওয়ার অপেক্ষায় দিনের পর দিন বসে আছে। কিন্তু ওই সভা থেকে মোদী তার নিজের জাফরান রঙা শাল ও সিঁদুর মাখা কপালের বাণিজ্য বিনিময়ে পেলেন একটি চকচকে বিজনেস স্যুট- যা পরে তিনি আশা করলেন যে তার বিরুদ্ধে ওঠা গণহত্যার সব অভিযোগ ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের এই বিনিয়োগ দিয়ে কাটাকাটি হয়ে যাবে। সেইসাথে সব হিসাব নিকাশও চুকে যাবে। হয়তো আসলেই তাই ঘটবে। বড় বড় বাণিজ্য তার পেছনে হাঁটছে; ন্যায়বিচারের এই বীজগাণিতিক অঙ্ক পুরোটাই রহস্যময়।
মাত্রিউশকা নামের পুতুলগুলো যেমন একটার ভেতরে আরেকটা ঢোকানো থাকে তেমনি ধোলেরা এসআইআর হচ্ছে মাত্রিউশকার ভেতরের ছোট পুতুলগুলোর একটি; যা এক কষ্টময় কল্পনগরী তৈরির জন্য ব্যবহৃত হবে। এই এসআইআরকে দিল্লী-মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল করিডোরের (ডিএমআইসি) সাথে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ডিএমআইসি হচ্ছে ১৫০০ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩০০ কিলোমিটার প্রশ্বস্ত করিডোর যাতে থাকবে নয়টি মেগা ইন্ড্রাসট্রিয়াল অঞ্চল, উচ্চগতিসম্পন্ন মালবাহী রেলগাড়ির জন্য একটি রেলপথ, তিনটি সমুদ্র বন্দর, ছয়টি বিমানবন্দর, ইন্টারসেকশনবিহীন ছয় লেনের একটি সড়ক, এবং ৪০০০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ডিএমআইসি হল ভারত ও জাপান সরকার এবং তাদের কর্পোরেট অংশীদারদের সম্মিলিত একটি উদ্যোগ। ম্যাককিনজি গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগটি প্রস্তাবিত হয়েছে।
ডিএমআইসির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এই প্রজেক্টের ফলে প্রায় ১৮০ মিলিয়ন মানুষ “প্রভাবিত” হবে। প্রভাবটা ঠিক কেমন সে ব্যাপারে অবশ্য কিছু বলা হয়নি। এই প্রকল্প বেশ কয়েকটি নতুন শহর গড়ে তুলবে এবং আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী ঐ অঞ্চলের জনসংখ্যা ২০১৯ সাল নাগাদ ২৩১ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩১৪ মিলিয়নে এসে দাঁড়াবে। জনসংখ্যার এই পরিবর্তনের জন্য সময় লাগবে সাত বছর । কথা হল, শেষ কবে, কোন দেশ, কোন স্বৈরশাসক বা একনায়ক এইরকম লক্ষ লক্ষ মানুষকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরাতে সমর্থ হয়েছিল? শান্তিপূর্ণ কোন উপায়ে কি এই প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন সম্ভব?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচিত এখন থেকেই সেনা নিয়োগ শুরু করা যাতে করে সমগ্র ভারতে সেনা মোতায়নের নির্দেশ দেয়া হলে তা অপ্রত্যাশিত বলে মনে না হয়। কেন্দ্রীয় ভারতে সেনাবাহিনী যে ভূমিকা রাখবে তার প্রস্তুতি হিসাবে সেনাবাহিনীর সামরিক মনস্তাত্বিক অপারেশনের সর্বশেষ মতবাদ জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “বিশেষ একটি বিষয়বস্তু প্রচলনের জন্য নির্দিষ্ট একটি নির্বাচিত জনগোষ্ঠীর কাছে পরিকল্পিত উপায়ে একটি বার্তা পৌঁছে দিতে হবে, যার প্রভাবে ঐ জনগোষ্ঠীর আচার-ব্যবহারে একটি আশানুরূপ পরিবর্তন সাধিত হবে। এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য সাধনের পথ সুগম হয়ে উঠবে।” এই মতবাদে আরো বলা হয়েছে যে, নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর এই “উপলব্ধির ব্যবস্থাপনা” পরিচালনায় জনসেবার কাজে নিয়োজিত গণমাধ্যমকে ব্যবহার করা হবে।”
ভারতের ভবিষ্যত পরিকল্পনাকারীদের ইচ্ছানুযায়ী প্রয়োজনীয় সামাজিক বিনির্মানের জন্য শুধু দমনমূলক শক্তি যথেষ্ট নয়, এটুকু বোঝার মতো অভিজ্ঞতা সেনাবাহিনীর আছে। গরিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এক জিনিস। কিন্তু বাকি সবার জন্য- অর্থাৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণী, কেতাদুরস্ত কর্মী সমাজ, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, “মতামত সৃষ্টিকারী”- তাদের ক্ষেত্রে এই যুদ্ধকে হতে হবে “ উপলব্ধির ব্যবস্থাপনা।” আর এই কলাকৌশল বুঝতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই কর্পোরেট সমাজসেবার সূক্ষ শিল্পের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
[চলবে]
প্রথম পর্বের লিংক: http://wp.me/p7QKgr-69
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল
[বইটি বাংলা ভাষায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকবে; প্রতি শুক্রবার।]