কাশ্মীরী বিবাদের ফল
২০০৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হবার এক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছিলেন, কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের কারণে যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধান বের করাটা তার “জটিল কাজগুলোর” মধ্যে একটি। এটি জটিল কারণ এই বিরোধের ফলে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৯৪৭ সালের পর থেকে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে। তার এই মন্তব্য ভারতে ব্যাপক হতাশা সৃষ্টি করেছিল এবং সেই থেকে তিনি কাশ্মীরের ব্যাপারে তেমন কিছুই আর বলেননি।
কিন্তু ২০১০ সালের ৮ নভেম্বর সোমবার, ভারত সফরকালে তিনি তার মেজবানদের এই কথা বলে সন্তুষ্ট করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরের ব্যাপারে নাক গলাবে না। এছাড়াও তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে ভারতের আসনের ব্যাপারে তার সমর্থন ঘোষণা করেন। এই সফরকালে ওবামা সন্ত্রাসের ভীতির ব্যাপারে গলা খুলে কথা বললেও, কাশ্মীরের মানবাধিকার সম্পর্কে একেবারে মুখ বন্ধ রেখেছিলেন।
কাশ্মীরের ব্যাপারে ওবামা তার সিদ্ধান্ত আবারও পাল্টাবেন কীনা তা নির্ভর করছে বেশ কিছু বিষয়ের উপর : আফগানস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেমন যাবে, পাকিস্তানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কতোটা সাহায্য দরকার হবে এবং এই শীতের মৌসুমে ভারতীয় সরকার বিমান কিনতে রাজি হবে কীনা। (পাইপলাইনের অন্যান্য বড় আকারের বাণিজ্য চুক্তি ছাড়াও, ভারত যদি ৫.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দশটি বোয়িং সি-১৭ গ্লোবমাস্টার থ্রি বিমান কেনার অর্ডার দেয়, হয়তো তাহলেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এই নিরব থাকাটা নিশ্চিত হবে।) কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, ওবামার নীরবতা বা হস্তক্ষেপের কোনটাই কাশ্মীরের জনতার হাতের পাথর সরাতে পারবে না।
দশ দিন আগে আমি কাশ্মীরে ছিলাম। কাশ্মীর হলো পাকিস্তান সীমান্তের সেই অপূর্ব উপত্যকা যা- ইসলাম, হিন্দু, এবং বৌদ্ধ – এই তিনটি মহান সভ্যতার বাসভূমি; এ হলো কল্পকাহিনী আর ইতিহাসের উপত্যকা। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে যীশু এই স্থানে মারা গিয়েছেন, অন্যরা মনে করে মুসা নবী এখানে তাঁর হারানো গোত্র খুঁজতে এসেছিলেন। এই কাশ্মীরেই আছে হযরতাবালের উপসনালয়- যেখানে লাখ লাখ মানুষ প্রার্থনা করে এবং বছরের কয়েকটি দিন এখানে নবী মুহাম্মদের (সঃ) একটি কেশ বিশ্ববাসীদের জন্য প্রদর্শিত হয়।
বর্তমানের কাশ্মীর- পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের জিহাদী ইসলামের প্রভাবের মাঝখানে গিয়ে পড়েছে; এর ভৌগোলিক অবস্থানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ দেখা দিয়েছে এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদ (যা ক্রমশই আগ্রাসী এবং “হিন্দুবাদী” হয়ে উঠছে) এখানে প্রভাব বিস্তার করছে। এসব কিছুর মাঝখানে পড়ে কাশ্মীর একটি নিউক্লিয়ার বোমা ফাটার কেন্দ্রের মতো হয়ে উঠছে। বর্তমানে এই অঞ্চলে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক সৈন্য মোতায়েন আছে এবং এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সামরিকীকরণ এলাকা।
আমি দেখলাম, কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর এবং দক্ষিণের শোপিয়ান নামক ছোট্ট আপেলের শহরটির মধ্যবর্তী পথের পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল। রাজপথ, আঙুর বাগান, মাঠ, বাড়ির ছাদ, আর বাজারের দোকানগুলোর সামনে সৈন্যদের ছোট ছোট দলকে মোতায়েন করা হয়েছে। কয়েক মাসের কারফিউ চলার পরেও প্যালেস্টাইনি ইন্তিফিদার দ্বারা অনুপ্রাণিত “পাথর নিক্ষেপকারীরা”রা “আজাদী” (স্বাধীনতা) হাঁক ছেড়ে আবার বের হয়ে এসেছে। রাজপথের কিছু কিছু অংশ পাথর দিয়ে এমনভাবে ঢেকে গেছে যে, ওগুলোর ওপর দিয়ে চলার জন্য একটি এসইউভি গাড়ির দরকার হবে।
সৌভাগ্যবশত আমি যে বন্ধুদের সাথে ছিলাম তারা এলাকার গলিপথ এবং গ্রামের ভেতর দিয়ে বিকল্প রাস্তা চিনতো। ঘুরপথে যেতে যেতে ওদের কাছ থেকে এই বছরের বিপ্লবের কাহিনী শোনার সুযোগ পেয়ে গেলাম। সবচেয়ে ছোটজন, যে এখনো বালক, বললো যে- তার তিনজন বন্ধুকে পাথর ছোড়ার অপরাধে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ তাদের দু’ হাতের সবকটা আঙ্গুলের নখ উঠিয়ে নিয়েছে।
কাশ্মীরীরা যেটাকে ভারতের হিংস্র দখলদারিত্ব বলে মনে করে, পরপর তিন বছর ধরে রাস্তায় নেমে তারা সেই দখলের প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু বিশ বছর আগে পাকিস্তানের সহায়তায় ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে যে সামরিক অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল তা এখন স্থগিত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব মতে কাশ্মীরের উপত্যকায় বর্তমানে পাঁচশরও কম জিহাদী আছে। যুদ্ধের কারণে প্রায় সত্তর হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং কয়েক হাজার মানুষ নির্যাতনে নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ “অদৃশ্য” হয়ে গেছে। প্রায় দুই লক্ষ কাশ্মিরী হিন্দু উপত্যকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। যদিও জিহাদীদের সংখ্যা কমে গেছে, কিন্তু মোতায়েনকৃত ভারতীয় সৈন্য সংখ্যা এখনও অটুট আছে।
কিন্তু ভারতীয় সামরিক কর্তৃত্বকে ভারতের রাজনৈতিক বিজয় ভাবাটা ভুল হবে। সাধারণ জনতা যাদের অস্ত্র বলতে নিজেদের ক্রোধ ছাড়া আর কিছুই নেই তারাও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। পুরো কাশ্মীর জুড়ে এখন সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজন্ম এসেছে। এই প্রজন্মটি চেকপয়েন্ট, বাঙ্কার, সেনাশিবির, এবং জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছে; এদের শৈশব কেটেছে “ধর আর মার” অপারেশনের চাক্ষুস স্বাক্ষী হিসেবে; এদের কল্পনা জুড়ে আছে চর, ইনফরমার, “বেনামী বন্দুকবাজ”, গোয়েন্দা কার্যকলাপ, আর প্রতারণার নির্বাচন। এই প্রজন্মের সন্তানেরা কেবল ধৈর্য নয় বরং নিজেদের ভয় ভীতিও হারিয়ে ফেলেছে। বলা যায়, নতুন প্রজন্মের এই কাশ্মীরী যুবারা উন্মাদীয় এক সাহস বুকে নিয়ে প্রতিনিয়ত সশস্ত্র সৈন্যদের মুখোমুখি হচ্ছে আর নিজেদের রাস্তাগুলোর অধিকার বুঝে নিচ্ছে।
গত এপ্রিল মাসে সেনাবাহিনী এখানে তিনজন বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে তাদের মুখোশধারী পাথর নিক্ষেপকারী “সন্ত্রাসী” হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু ঐ মৃত মানুষদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ ছাত্র। এ ঘটনার পর থেকেই কাশ্মীরের জনজীবন ধীরে ধীরে থেমে গেছে। ভারতীয় সরকার কারফিউ, বুলেট, এবং নিষেধাজ্ঞার সাহায্যে পাল্টা জবাব দিয়েছে। মাত্র গত কয়েক মাসেই ১১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে যাদের অধিকাংশই বয়সে কিশোর; এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত এখানে তিন হাজারের বেশি মানুষ আহত এবং এক হাজার জন আটক হয়েছে। কিন্তু তারপরও ওরা- কিশোর, তরুণেরা- বের হয়ে আসে আর পাথর ছুড়ে মারে। দেখে মনে হয় না যে ওদের কোন নেতা আছে বা ওরা কোন রাজনৈতিক দলের অন্তর্ভূক্ত। ওরা নিজেরোই নিজেদের নেতৃত্ব দেয়। এবং হঠাৎ করেই যেন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ সামরিক শক্তি বুঝে উঠতে পারছে না যে তারা ঠিক কী করবে। মনে হচ্ছে, কার সাথে আলোচনায় বসলে সমস্যার সমাধান মিলবে ভারত সরকার তা ঠাওর করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ভারতীয়ই এখন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে যে তাদেরকে কয়েক যুগ ধরে মিথ্যে বলা হয়েছে। এসব কারণে এক সময়ের সুদৃঢ় ঐক্যের কাশ্মীরকে হঠাৎ করেই একটু নড়বড়ে বলে মনে হচ্ছে।
শোপিয়ানের পথে রওনা দেবার দিন সকাল বেলায় আমার একটু ঝামেলা হয়েছিল। কয়েক দিন আগে দিল্লীর একটি জনসভায় আমি কাশ্মীর নিয়ে ভারত সরকারের চিরন্তন দাবীর বিপরীতে গিয়ে বলেছিলাম যে, কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল। আর তাই, একে ভারতের “অবিচ্ছেদ্য অংশ” বলে দাবী করা যায় না। এরপর ক্রোধোন্মত্ত রাজনীতিবিদ এবং সংবাদ সমন্বয়কারীরা জনতাকে খেপিয়ে তোলার অপরাধে আমাকে গ্রেপ্তার করার দাবী জানায়। নিজেকে যেন “নমনীয়” না মনে হয় সেই ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে হুমকিমূলক বক্তব্য দেয়। ফলে পরিস্থিতি আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। দিনের পর দিন মূল সংবাদে আমাকে বিশ্বাসঘাতক, সুশীল সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করা হয়। অবাধ্য মহিলাদেরকে অন্যান্য যেসব নামে ডাকার জন্য কিছু শব্দ মজুদ আছে সেগুলোও আমার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু শোপিয়ানের পথে যেতে যেতে, গাড়িতে বসে আমার বন্ধুদের কথা শুনতে শুনতে, দিল্লীতে আমার দেয়া বক্তব্যের জন্য আমি কোন অনুতাপ বোধ করলাম না।
আমরা শাকিল আহমেদ আহঙ্গার নামের এক লোকের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলাম। এর আগের দিন, এই মানুষটি শুধু আমাকে শোপিয়ানে নেবার জন্য রাজি করাতে শ্রীনগরে আমি যেখানে উঠেছিলাম সেখানে এসেছিলেন। তার অনুরোধের ভেতর এমন এক অত্যাবশ্যকীয়তা ছিল যা উপেক্ষা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
শাকিলের সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৯ সালের জুন মাসে। তার কয়েক সপ্তাহ আগে শাকিলের বাইশ বছর বয়সী স্ত্রী নিলুফার এবং সতের বছরের বোন আছিয়ার মৃতদেহ একটি উচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তামূলক এলাকার অগভীর নদীর তীরে খুঁজে পাওয়া যায়। দুটি দেহ পরস্পর থেকে হাজার ফুট দূরে পড়েছিল। জায়গাটি সেনাবাহিনী এবং রাজ্য পুলিশের শিবিরে গিজগিজ করে। প্রাথমিক পোস্ট মর্টেমের ফলাফলে ধর্ষণ এবং হত্যা নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু তারপরেই সিস্টেম এখানে হস্তক্ষেপ করে। নতুন ময়নাতদন্তের রিপোর্টে প্রাথমিক ফলাফলকে খারিজ করে দেয়া হয় এবং কবর খুঁড়ে দেহ তুলে আনার বীভৎস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পরে ধর্ষণের ঘটনাকেও বাতিল ঘোষণা করা হয়। তার বদলে ঘোষণা দেয়া হয় যে, উভয়েই পানিতে ডুবে মারা গেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ টানা সাতচল্লিশ দিন ধরে শোপিয়ানে ধর্মঘট চলে। অবশেষে, ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হলো যে ভারতীয় সরকার এই সঙ্কট সামাল দিতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের ফলে সৃষ্ট জনরোষ এ বছরের বিদ্রোহের তীব্রতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
শাকিল পুলিশের হুমকির ভেতর ছিল। পুলিশ তাকে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখতে বারবার হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। তাই সে চাইছিল যে, আমরা যেন তার সাথে শোপিয়ানে গিয়ে দেখা করি। তার আশা ছিল, আমরা যদি তার বাড়ি গিয়ে তার সাথে দেখা করি তাহলে এ কথা প্রমাণ হবে যে, কাশ্মীরের বাইরের মানুষও তার উপর খেয়াল রাখছে। তখন হুমকিদাতারা বুঝতে পারবে, সে একা নয়।
কাশ্মীরে তখন আপেলের মৌসুম চলছিল। শোপিয়ানের পথে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম পড়ন্ত বিকেলের তেরছা আলোয় এলাকার পরিবারগুলো ব্যস্তভাবে তাদের ফলের বাগানে তড়িঘড়ি করে কাঠের বাক্সে আপেল ভরছে। লাল গালের আপেলের মতো দেখতে কিছু বাচ্চাকাচ্চা দেখে আমার ভয় হলো যে ওদেরকেও না আবার আপেল ভেবে বাক্সবন্দী করে ফেলা হয়। আমাদের আগমণের খবর আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে রাস্তায় বেশ কিছু মানুষের ভীড় দেখতে পেলাম। শাকিলের বাড়ি গোরস্তানের শেষ প্রান্তে, ওখানেই তার স্ত্রী এবং বোনকে সমাহিত করা হয়েছে।
আমরা যখন পৌঁছালাম তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে আর ওখানে লোডশেডিং চলছিল। আমরা একটি লণ্ঠনের সামনে অর্ধবৃত্তাকারে বসে শাকিলের কাছ থেকে তার কাহিনী শুনলাম যার প্রতিটা ঘটনা আমরা সবাই খুব ভালভাবেই জানি। আরো কিছু মানুষও ভেতরে ঢুকলো। আরো কিছু ভয়ানক কাহিনীও শোনা হলো। এমন সব কাহিনী যা মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে লেখা হয়নি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলোতে যেখানে সাধারণ জনগণের চেয়ে সৈন্যের সংখ্যা বেশি, সেখানকার মহিলাদের কপালে কি ঘটেছে তার কাহিনী। শাকিলের ছোট্ট ছেলেটি অন্ধকারে সবার কোলে কোলে ঘুরতে লগলো। শাকিল বেশ কয়েকবার বলে উঠল, “খুব তাড়াতাড়িই আমার ছেলে বড় হয়ে যাবে। তখন ও বুঝতে পারবে যে ওর মায়ের সাথে আসলে কী ঘটেছিল।”
বিদায় নেবার জন্য আমরা উঠে দাঁড়াতেই একজন খবর দিল যে, শাকিলের শ্বশুর – নিলুফারের বাবা আমাদের জন্য তার বাড়িতে অপেক্ষা করছে। আমরা দুঃখ প্রকাশ করে জানালাম যে রাত হয়ে গেছে, আরো দেরী করলে ফেরার পথে বিপদ হতে পারে।
বিদায় জানিয়ে গাড়িতে ওঠার পরপরই আমাদের এক বন্ধুর ফোন বেজে উঠলো। ঐ বন্ধুর এক সাংবাদিক সহকর্মীর ফোন। আমার জন্য একটি খবর আছে: “পুলিশ ওয়ারেন্ট টাইপ করছে। লেখিকাকে আজ রাতেই গ্রেপ্তার করা হবে।”
আমরা কিছুক্ষণ নীরবে এগিয়ে চললাম। পাশ দিয়ে একটার পর একটা আপেলের ট্রাক চলে গেল। অবশেষে আমার বন্ধু বলে উঠল, “ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। এটা শুধুই একটা সাই-অপস”**।
** জনগণের মনোভাব প্রভাবিত করার জন্য লোক দেখানো সামরিক অভিযান- অনুবাদক।
তারপর যখন আমরা হাইওয়েতে দ্রুত চলতে শুরু করলাম তখন মানুষ ভর্তি একটা গাড়ি আমাদের সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত নাড়তে লাগলো। মোটর সাইকেলে চড়া দুজন আরোহী আমাদের ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললো। যা ঘটতে যাচ্ছে তার জন্য আমি নিজেকে শক্ত করে ফেললাম। গাড়ির জনালায় একজন লোককে দেখা গেল। তার সবুজ চোখ জোড়া আধবোজা এবং সাদাকালো দাড়ি বুকের অর্ধেক পর্যন্ত নেমে এসেছে। নিজেকে তিনি আব্দুল হাই বলে পরিচয় দিলেন, তিনি মৃত নীলুফারের বাবা।
“আপনাকে আমি আপনার আপেলগুলো না দিয়ে কীভাবে যেতে দেই?”, ভদ্রলোক বললেন। মোটর সাইকেল চালকেরা আমাদের গাড়িতে দুই বাক্স আপেল উঠিয়ে দিল। আব্দুল হাই তার বহু ব্যবহারে জীর্ণ খয়েরি জামার পকেট হাতড়ে একটি ডিম বের করলেন। ডিমটি তিনি আমার হাতের তালুতে রেখে আমার হাতের মুঠি বন্ধ করে দিলেন। তারপর আমার অন্য হাতেও আরেকটি ডিম দিলেন। ডিম দুটো তখনও গরম ছিল। “খোদা আপনাকে রহম করুন এবং আপনার সাথে থাকুন।”, কথাগুলো বলেই তিনি অন্ধকারে হেঁটে চলে গেলেন। একজন লেখক এর চাইতে বড় পুরস্কার আর কি চাইতে পারে?
সে রাতে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তার পরিবর্তে, বহু ব্যবহৃত রাজনৈতিক কৌশলে যা করা হয় তেমন করেই প্রশাসন তাদের সমস্ত অসন্তুষ্টি জনতার মাধ্যমে প্রকাশ করল। আমাকে যাতে আটক করা হয় সেই দাবীতে আমি বাড়ি ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় জনতা পার্টির (ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিরোধী দল) মহিলা শাখা আমার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করল । ঘটনাটি যাতে সরাসরি সম্প্রচার করা যায় সেজন্য আগেভাগেই টিভির ভ্যানগুলো হাজির হয়ে যায়। এদিকে খুনি বজরং দল নামের হিন্দু জঙ্গী গ্রুপ যাদের নেতৃত্বে ২০০২ সালে গুজরাটের মুসলিমদের আক্রমণ করে হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছিল, তারা আমাকে একটি “উচিৎ শিক্ষা” দেয়ার ঘোষণা দিল। এরপর তারা সমগ্র দেশের কয়েকটি কোর্টে আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
ভারতীয় সরকার এবং জাতীয়তাবাদীরা বিশ্বাস করে যে, তারা ভারতের পুনরুত্থান সম্পর্কে তাদের ধারণাকে তর্জন-গর্জন আর বোয়িং এরোপ্লেনের সমন্বয়েই জোরদার করে তুলতে পারবে। কিন্তু তারা আসলে সেদ্ধ গরম ডিমের বিধ্বংসী শক্তি সম্পর্কে কিছুই জানে না।
গ্রন্থ: ক্যাপিটালিজম অ্যা গোস্ট স্টোরি
লেখক: অরুন্ধতী রায়
অনুবাদক: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল