ক্যাটসলাফ | প্রিয়ম

এক

 

জুন ফাইনাল। অনেক চাপ। কাজগুলো শেষ করে বিড়িতে টান পড়বে কখন জাহেদ চিন্তা করে প্রতিদিন। রাত হয় অনেক বাড়ি ফিরতে এখন।

(গাড়ির ভিতর থেকে সে দেখে পতিতাদের, ভিখারিদের, সিকিউরিটি গার্ডদের, কুকুরদের। আগেও দেখত। আসলে গিলত। হেঁটে বাড়ি ফিরত। একসময় এই রাস্তাই তার কাছে বাস্তব ছিল। যা দিনদিন অবাস্তব হয়ে পড়েছে। আর এখন বাস্তব হলো জুন ফাইনাল। বাস্তবতা হলো সবকিছু ক্লায়েন্ট। ছুটির দিনে চেরাগির বিড়ির দোকানের পাশে আশ্রয় নেয়া কুত্তাকেও ক্লায়েন্ট মনে হয় আজকাল। কারো সাথে দেখা হয় না আজকাল বা জাহেদ ইচ্ছা করেই মুখ লুকিয়ে বাঁচে। আসলে এইসব মাদারচোদ কবিদের বকবক শোনার চেয়ে বাসায় গিয়ে হাত মারা ভাল।

 

এক রাতে লিখতে বসে জাহেদ। টেবিলে উঠতে অনেক কষ্ট হয় তার। অথচ এই টেবিলেই অনায়াসে পাছা রাখত ঘন্টার পর ঘন্টা। চেয়ারে ওঠার সময় মনে হয় সে কোনো পাহাড়ে উঠছে বান্দরবান বা রাঙামাটির। অনেক কষ্টে উঠে বসে সে। এরপর কলম টেনে নেয়। কলম হাত থেকে পড়ে যায় বারবার। যেন প্যারালাইজড রোগী সে। হাত কাঁপতে থাকে ঘনঘন। অনেক কষ্টে একটা কি দুইটা শব্দ লিখে কোনোরকম- যা অদৃশ্য হয়ে যায় নিমেষেই। পিছনে ফিরে দেখে পা পিছলে যাচ্ছে একটু একটু করে। সব অন্ধকার হতে থাকে। অন্ধকার!

চেয়ার থেকে পড়ে যায় সে। হারিয়ে যেতে থাকে অতল গহ্বরে। ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে থাকে জাহেদ। প্যান্ট বেল্ট শার্ট টাই ঘড়ি কোর্ট এসব তার শরীরের অংশ বলে মনে হয় এখন। অফিস শেষে এসব খুলে রাখার পরও মনে হয় এই কাপড়গুলো গায়ের সাথে লেগে আছে। রাতের ঘটনা মনে পড়ে না তার। আসলে স্বপ্ন নিয়ে সে ভাবে না অথবা ভাবার সময় নেই।

ব্যাংকের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের স্বপ্নই দেখে সে পথে যেতে যেতে বা যতক্ষণ জেগে থাকে। তার এই ডেডিকেশনের জন্য প্রমোশন হলো কিছুদিন আগে।

এভাবে দিনযাপন করতে করতে কিছু মাস গড়ালে একদিন তার দেখা হয়ে যাবে ফরহাদের সাথে। এরা দুজন ছিল এদেশীয় গঁগা, ভিনসেন্ট অথবা রেঁবো, পল ভার্লেন। দুজনই বেঁচে আছেন। গুলি না খেয়ে।

 

 

দুই

 

এইবার শেষ ওয়ার্নিং দেয়া হচ্ছে আপনাকে। সবসময় কলিগদের সাথে গণ্ডগোল লাগে আপনার। ঠিক সময়ে অফিসে আসবেন না। নাইট ডিউটিতে এসে ঘুমিয়ে পড়বেন। এবার শেষ সুযোগ দিচ্ছি আপনাকে।

ফরহাদ সব কথা শুনে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসে। গিয়ে আবার কাজ শুরু করে। এসব ওয়ার্নিং-টোয়ার্নিং আজকাল গায়ে লাগে না তার। গণ্ডার প্রকৃতির মানুষ হয়ে গেছে দিনদিন সে। আসলে সবাই তাই হয়ে গেছে। এই দশ হাজার টাকার জন্য সে যেকোন প্রাণী হতে পারে।

শুরুতে যখন সে ঢাকা আসে অন্য এক অফিসে ছিল কিছুদিন গরু হয়ে। কিন্তু ওখানে ঘাস দিত কম দুধ দিতে বলত বেশি। পরে সে গণ্ডার হবার সিদ্ধান্ত নেয়।

এ অফিসে আসার পর প্রথমদিকে ভালই লাগত। খুব সুন্দর অফিস। সবচেয়ে বেস্ট পার্ট হলো সারাদিন কফি খেতে পারে ফ্রি। বিড়িটা অবশ্য নিচে নেমে খেয়ে আসতে হয়। তা কোনো সমস্যা না। সমস্যা হলো চারকাপ কফি খাওয়ার পরও সে কীভাবে ঘুমিয়ে গেল সেদিন!

এই পত্রিকা অফিসে কাজ করার আরেকটা কারণ ছিল সে লেখালেখি চালিয়ে যেতে পারবে। তা সে কোনো না কোনোভাবে লিখে গেছে। বইও বের করেছে তিনটা। যা দিয়ে পরিচিতি বেড়েছে ঠিকই কিন্তু মালকড়ি কিছু পকেটে আসেনি। উল্টো তার দশ হাজার টাকা থেকেই টাকাগুলো দিতে হয়েছে। আর তার উপর ধার দেনাও বেড়েছে কিছু।

সকালের ডিউটি সেরে অফিসের গাড়িতে ফরহাদ পৌঁছে যাবে তার মেসে। মেসে বুয়া আসছে না এক সপ্তাহ। বুয়ার বিলও বাকি। দোকানে গিয়ে ডিম আর নুডুলস কিনে পাঁচতলায় উঠবে ফরহাদ। পাঁচতলায় উঠতে উঠতে আর প্রতি সিঁড়িতে পা রাখতে রাখতে সে জেমসের গান গাইবে অবচেতন মনে। রুমের দরজা খোলার সাথে-সাথে তার ইনটেলেকচুয়াল পার্ট সব অফ হয়ে যাবে।

নুডুলস সিদ্ধ করতে দিয়ে গোসল সেরে নেয় ফরহাদ। বাথরুম থেকে বের হয়ে ডিম ছেড়ে দেয় সিদ্ধ নুডুলসে। নুডুলস শেষ করতেই ঘুম চলে আসে। ঘুমে তলিয়ে গেলে ছারপোকা কামড়াতে থাকে আর কারেন্ট চলে যাওয়াতে মশাও এসে যোগদান করে মহাভোজে। মহমান্য ছারপোকা আর মশারা জানেন না ইনি চার কাপ কফি খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া গণ্ডারশ্রেণির লোক।

মোট পাঁচ প্রজাতির গণ্ডার রয়েছে। ভারতীয় গণ্ডার, জাভাদেশীয় গণ্ডার, সুমাত্রার গণ্ডার, সাদা গণ্ডার, কালো গণ্ডার। এদের মধ্যে চার প্রজাতির গণ্ডারই বিলুপ্তির পথে আছে এখন।

ফরহাদ ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে থাকে অফিসে যাবার জন্যে। দরজা বন্ধ করেই নিচে নামতে থাকে ফরহাদ। নিচে নামতে নামতে একটা কবিতার দুইটা লাইন মাথায় আসে তার। সে ভাবতে থাকে। পরের লাইন হবে অন্য ছন্দে। এদিকে তৃতীয় লাইনও ধরা দেয় তাকে কিন্তু সে এখন পাঁচতলার সব সিঁড়ি অতিক্রম করতে পারেনি। তার মজ্জার ভিতরে ঢুকে গেছে এই সিঁড়িগুলো। কিন্তু আজ কী হচ্ছে! সে মাথা ঠান্ডা করে। কবিতার চতুর্থ লাইন নিয়ে আর ভাবে না। নিচে নামতে থাকে। আরো নিচে। আরো নিচে। আরো নিচে। কিন্তু অন্ধকার সিড়ি শেষ হয় না। সে হাঁপিয়ে ওঠে। শ্বাস নেয়। সিঁড়িতে বসে। নিচে নামতে না পেরে উপরে উঠতে থাকে ফরহাদ। আর তখনই চতুর্থ লাইন ধরা দেয়। আর তখনই পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম এবং আরো অনেক কবিতা ভিড় করতে থাকে তার মাথায়। না! এসব মাথা থেকে বাদ দেয় সে। এসব ভুলে গিয়ে নিচে নামতে থাকে আবারও। একসময় সে দেখতে পায় রাস্তার আলো। দৌড়াতে থাকে ফরহাদ। অফিসের গাড়ি মিস করা যাবে না কোনোভাবেই। পা পিছলে পড়ে গিয়েই ঘুম ভাঙে ফরহাদের। গোসল, নাস্তা, প্যান্ট, শার্ট, চাবি, তালা। পাঁচতলা সে আজকে খুব তাড়াতাড়ি অতিক্রম করে।

 

 

তিন

 

জাহেদকে অফিসের কাজে ঢাকা পাঠানো হয়। ঢাকায় এসে হোটেলে উঠে সে। হোটেলেই প্রতিদিন মিটিং হতো। অফিসের লোকদের সাথে বসে আছে জাহেদ। হুইসকি হাতে সবার। তো যেমন হয় আর কি। গেলাসে বর্গাকার বরফের টুকরা সহযোগে খাওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে তারা সবাই দেশ, সমাজ, রাজনীতি সব বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। এমনকি কবিতা নামক তুচ্ছ বিষয় নিয়েও।

তারা ফকনার, রেঁবো, শহীদুল জহির সবাইকে নিয়ে কথা বলে। জাহেদ শুনতে থাকে। আর গেলাসে চুমু দিতে থাকে। ছয় সাত পেগের পর জাহেদ দেখে ফরহাদকে। ফরহাদ বসে আছে।

দূরে। এক কোণে। তার সাথে একজন লোক। দেখে মনে হচ্ছে কোনো বড় অফিসার হতে পারে কোনো সরকারি বা বেসরকারি অফিসের। ফরহাদ শুধু হাসছে ওই লোকের কথা শুনে। সে নিজে কোনো কথা বলছে না। শুধু মাথা নেড়ে যাচ্ছে ওই লোকের সব কথায়।

জাহেদের কলিগরা এবার ধর্ম নিয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। জাহেদ প্রস্রাব করতে যাবে বলে অনুমতি নেয় তাদের কাছ থেকে। জাহেদ দেখে সে অনেকক্ষণ ধরে প্রস্রাব করছে। মনে হচ্ছে প্রস্রাব শেষ হবে না। অনন্তকাল এভাবে চলতে থাকবে। জাহেদ প্রস্রাব করে আসার পরও দেখে তারা একই বিষয়ে আলোচনা করছে।

ওদিকে ফরহাদও ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে যায়। মনে হচ্ছে ওই মোটা লোকের একটানা কথা শুনতে সে ক্লান্ত। সেও প্রস্রাব করতে যায়। কিন্তু মোটা লোকটি ফরহাদের অবর্তমানেও কথা বলতে থাকে। ফরহাদ আবার এসে, হাসতে হাসতে গ্লাস হাতে নিয়ে বসে পড়ে। আর শুনতে থাকে ওই লোকের কথা যেন সে একদমই শুনছে না।

জাহেদ তার এগারতম পেগ শেষ করে মাথা তুলে তাকায় ফরহাদের দিকে। মনে হয় যেন অনন্তকাল ধরে ফরহাদ তাকিয়ে ছিল জাহেদের দিকে। ফরহাদ আর তার সাথের লোকটিকে জাহেদের মনে হয় অবাস্তব বা তাদের অস্তিত্ব নেই বা যেন ওরা এখনই বুদবুদ হয়ে হাওয়ায় মিশে যাবে।

কিন্তু এবার সে দেখে ফরহাদ তার গ্লাস হাতে নিয়ে জাহেদের দিকে তাকিয়ে আছে

এবং হাসছে।

এবার জাহেদও গ্লাসে চুমুক দিয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।

 

বিড়ালের হাসি। যা শুধু কবিরাই দিতে পারে।  

শেয়ার