কৃষ্ণ জলেশ্বর’র কবিতা

নক্ষত্র খসে পড়তে পড়তে

 

নক্ষত্রফুলের বাগান 

ডাকপিয়নের ঝোলার ভেতর গল্পের রঙ 

চিঠি পাতা হয়ে খসে খসে পড়ে গহীন শীতের মৌসুমে।

 

এই স্মৃতি থেকে যায়—  মরে গেলে মানুষ তারা হয়ে রয়? নাকি তারা মরে গিয়ে মানুষ হয়ে জন্মায়? একটা গোপন ডায়রী জুড়ে কারো ঠোঁট আর চোখ এঁকে এঁকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি স্মৃতির ভেতর। শ্যাওলার ইস্টিশন। ট্রেন আসে না কতো কাল! পর্নোমুভির পোস্টার সাঁটা এমন একটা ট্রেনের বগিতে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছি। নিশ্চল। অথচ ভেতরে ভেতরে ফুটছে অবীশগ শরীর, ছুঁয়ে থাকে অক্ষম দাভিদ। শূনেম শহরের তরুণেরা রেখে গেছে ক্ষীরের নদী কোথাও। ফুল পাপড়ি ঝরিয়ে দেয়ার আগে কাঁদে নিশ্চয়ই গাছ। গাছেরা পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করে। মাছেরা নদী। মানুষ ক্রমশ ফুল আর নক্ষত্র হয়ে জন্মে। তারপর বসে বসে ভাবে তারা খসে পড়ে। খসে খসে পড়ে। খসে পড়ার শব্দ শুনে শুনে গান গায়। মানুষেরা গাছ নয়, নদী নয়, ফুল নয়, পাখির ঠোঁটে অজানা বৃক্ষের বীজ হয়ে বেঁচে থাকে চিরকাল। 

 

 

পৃথিবী কমলালেবু হয়ে শুয়ে থাকে

 

রোদশহরের পাখি এঁকেছে চোখ

ঘূর্ণিতোলা নাদে ভেঙ্গেছে নিনাদ প্রহর

একটা নীল ঘুড়ি ম্লান হয়ে আছে— স্মৃতির।

 

কমলা লেবু দেখলেই পৃথিবীর কথা মনে হয়। শীত এলে কমলার খোসা খুলে খুলে পৃথিবী খাই— ভাবলে বিষয়টা বড় অশ্লীল লাগে। জীবনের কমলা শুয়ে থাকে রোগীর বিছানার পাশে। এমন একটা কমলা গর্ভবতী বন্ধুপত্নীর— যে কিনা বছরের পর বছর ধরে গর্ভবতী। হয়তো তার গর্ভে বেড়ে উঠছে গভীর পৃথিবী এক— পৃথিবী ছড়িয়েছে বাতাসে কমলার ঘ্রাণ! প্রেমিকার স্তনও গহীন পৃথিবী— ভেবে ভেবে উড়িয়ে দেই নারঙ্গি মেঘের জীবন। দরিদ্র বলে তার গর্ভে কখনো পৃথিবী  ঠেলে দিতে সাহস করিনি।

 

ভেতরে ভেতরে একটা পৃথিবী ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ে। ভেঙ্গেপড়া পৃথিবীর পাশে পা ঝুলিয়ে বসে থাকি চুপচাপ।

 

 

অন্ধপাখির ঘুমপাড়ানি গান

 

ভেতরে এলাচ পোড়া ঘ্রাণ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে অন্ধ যত পাখি___

 

বুনো চন্দ্রিমা ভেঙ্গে পড়ে

আলতো পায়ের স্পর্শ আঁকে শিরীষ কাঠের জমিন— খর পাতা ঘ্রাণে জড়ায় নগ্ন গোড়ালি— ভেষজ ওষুধের শীতলতায় খুঁজে গোপন বর্ণ— পাখিদের ঘুম

 

যে পাখি লুকিয়ে গেছে

ধ্যানমগ্ন আফিমের ডালে

তার গান কে লেখে?

 

বাতাসের সরু পিঠ জুড়ে লেখা থাকে অন্ধপাখির গান, কাঠকাটা অক্ষরে

 

 

 

স্মৃত সমুদ্রস্মৃতি

 

চোখের গভীরে সমুদ্রবন, পেছনে জলরাশিস্রোত

অথচ সমুদ্র দেখিনি কখনো

তাই মনে মনে সমুদ্র বানাই

 

ঠাকুরদার হাত ধরে বহুবিকেল হাঁটতে বেরিয়েছি। এক বর্ষায় বৃষ্টি শেষে রোদ উজ্জ্বল হয়ে উঠলে নদীর তীরে আমি আর ঠাকুরদা দাঁড়িয়েছিলাম। ঠাকুরদা সমুদ্রের গল্প বলছিলেন। তিনি তখন সমুদ্র দেখে বাড়ি ফিরেছিলেন। বলেছিলেন— মানুষের বুকের ভেতর সমুদ্রের শব্দ আছে। তারপর একদিন তাঁর শীতল শরীরে কান পেতে শুনি সেখানে কোন শব্দ নেই—

 

গহিন সমুদ্রে কি নৈঃশব্দ্যের বাস?

 

 

 

পরম্পরা

 

সকল সত্যকে ঈশ্বর জেনে ধ্রুপদী ধনুকে বসিয়েছি কাষ্ঠল তীর

আঙুলে জলরেখায় বার বার আঁকি পৃথিবীর গোল

তারপর অন্ধপাখির সুরে বিদ্যুতে ছুড়ে ফেলি পারদ নহর

 

ভেঙ্গে পড়ছে বালির পাহাড়— আমি আর পিতা সম্মুখে দুধের পেয়ালা নিয়ে বসে আছি বৃষ্টির অপেক্ষায়— চোখের গহীনে শুকিয়ে যাওয়া দৃশ্যগুলো বৃষ্টির ছোঁয়ায় কিছুটা সতেজ হয়ে দুধ পান করবে আর আমরা তলিয়ে যাব ভাঙ্গনে— আমি ধরে রেখেছি পিতার বামহাতের তর্জনী—

 

পিতার আঙুলে ঝুলে থাকে শৈশব

 

 

পাখিরা মরে গিয়ে হাওয়া হয়ে যায়

 

প্রলেপে মসৃণ কাঠপাখির চোখ 

ভেঙ্গে ভেঙ্গে নাদের শহর

আড়াল মাপে শেখে দীঘল মানচিত্র

 

পাখিদের গ্রাম ও শহর থাকে, থাকে দেশ— দেশ ভ্রমণ। সমুদ্রচারী পাখিরা বুকে হাহাকার বয়ে বেড়ায় — তাদের স্বরে থাকে কান্না। যে পাখি ভুলে গেছে জীবনস্মৃতি— সে-ই কেবল গান জানে। মানুষের শরীর মূলত পাখির গান। গানে গানে বিচ্ছুরিত অনুভূতি ও জীবন; জীবন শেষে পাখিরা হাওয়া হয়ে যায়— তাই হাওয়ায় ওঠে সুর।

 

সে হাওয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে মানুষের শরীরে বাজে গোপন এস্রাজ

 

 

হিরামন পাখির শহরে

 

এসো, লাল দলাবাঁধা পিণ্ড থেকে

এই হিরামন পাখির শহরে

এইখানে দিনভর কাকাতোয়া

রাতভর সন্ন্যাসী চাঁদ

 

মথুরায় ননীর নদীতে মুছে গেছে রাধা শরীরের ঘ্রাণ। এইখানে হিরামন পাখির শহরে পুঁথিতে সঁপে প্রাণ স্মৃতি নিয়ে- জীবন নিয়ে লাল লাল ঠোঁট ট্রেনলাইন ছোটে। ট্রেন পড়ে থাকে সিগনালে বাঁকা হয়ে, প্রতি বাঁকে জমে থাকে শিশির চুম্বন। জলে আঁকা মধুর জীবন। আর দিন এই হিরামন পাখির শহরে লীলা হয়, লিলিথের পাখায় চিহ্ন মুছে ফেলে ঈশ্বর একটা দীর্ঘ-ই এঁকে। চুপচাপ কাটে সময় ভুলে সব অতীত প্রণয়।

 

পাখিদের শরীরে জমা থাকে জননের ঘ্রাণ।

 

 

বাণিজ্য

 

প্রপিতামহের পিতা নাকি শুনিয়েছিলেন আমার পিতামহকে দারুচিনি, এলাচবনের গল্প। ভিন দেশি বণিকেরা ঝোলা ভর্তি করে সেই সব গল্প সওদা করতেন তাঁদের কাছে। সেই ঘ্রাণ ছড়ানো গল্পের মোহে কতজন বিকিয়েছে দুধেল গাই, স্ত্রীর কোমড়ের বিছা, মায়ের কাকন— বিনিময়ে তারা সম্মোহিত করে ফেলছিলো শুনিয়ে এলাচ ও দারুচিনি ঘ্রাণে মাখা সরেস অথচ কূট গল্পগুলো;

 

প্রপিতামহের প্রপিতামহ টের পেয়ে নাকি গর্জে উঠেছিলেন কপালে গামছা বেঁধে নিজের লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে; এতোটাই সহজ ছিলো তারা লাঠি ছাড়া আর কোন জটিল অস্ত্রের কথা চিন্তাও করতে পারে নি। তারপরের কথা সবাই জানে— ভিনদেশীদের হাত থেকে একদিন নিজের কাছে ফেরা; নিজের মতো বাঁচার স্বপ্ন দেখা, বেঁচে থাকা। 

 

হঠাৎ মনে হলো— ভিনদেশীরা এখন ফেরি করে কথার বুদবুদ। আমরা দুধেল গাই, স্ত্রীর কোমড়ের বিছা, মায়ের কাকনের বিনিময়ে উড়িয়ে দিচ্ছি কথার বুদ্বুদ।

 

 

মুছে ফেলে মুখোশের দাগ

 

ভেতরে বাঘ পুষে বেঁচে থাকি হরিণ জীবনে— ঘাস, লতা-গুল্মের আড়ালে ভেতরে ভেতরে ভেতরের বাঘ নিজেকে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে নিয়ে শিকার শিকার খেলি;

 


জ্বরের ঘোরে প্রজাপতির ডানায় খোঁদাই করি কাঠশালিকের চোখ
বরফকলের ঝাড়  
হরিতকি পাহাড়ের মিশকালি পাখি 
আর নিমুরার বাণিজ্য জাহাজ;
মাস্তুলে আঁকি তার মুখ; যাযাবর পাখির ঠোঁটে নীল বাতাসের সুর শুনে ভাসিয়ে দেই সেই বাণিজ্য জাহাজ—

জাহাজে ফেরি করে কমলার বীজ
তুলোবন রোদ
স্নেহের রুমাল
সমুদ্র শাদা বুকে
জল ভেবে ডুবে ডুবে
লাল সুরায়
তলিয়ে দিয়ে মূক ময়ূর, বর্ণিল পেখম।
তারপর ঘরে ফিরে আসি—

ফিরে এসে শুয়ে থাকি বিছানায় আমার শরীরের গন্ধের সাথে। 
সন্ধ্যা নেমে এসেছে বোধ হয়— আমি জানি না, আমার জ্বর। 

 


পুড়ে গেছে রাত্রির নখে আঁকা মাছের পুরাণ, উড়ে গেছে বাতাসে চিহ্ন। পাখির ঠোঁটে লেগা থাকা চুম্বনের রঙ ছুড়ে দিচ্ছে বিদ্যুতে বিদ্যুতে। ফুরিয়ে যাওয়া ব্রহ্ম-নহরে একটা ঢেউ আসবে বলে বসে আছে বৃদ্ধ হরিহর পঁচাত্তর বছর।

সে মাছদের মরণ লিখে ঢেউয়ের আঘাত সয়ে সয়ে।

শেয়ার