গ্রাফিতি এখন এমন একটা মাধ্যম যা দ্বারা সামগ্রিক আন্দোলনের চিত্র আপনি আর্টের মধ্যে দিয়া প্রকাশ করতে পারেন। শুরুতে গ্রাফিতি আর্টিস্ট যখন গ্রাফিতি করতো, তারা কোন দাবী আদায় না, বরং সেন্স অব ওনারশিপ থেকে ট্রেন, সাবওয়ে, দেয়ালে লিখতো। আপনার আশেপাশে দেয়ালে লোকাল গ্যাংয়ের দেয়াল লেখাও অনেকটা তাই। প্যালেস্টাইন, কাশ্মীরের মত জায়গাতে গিয়ে গ্রাফিতি এই দুই কাজই একসাথে করে যাইতেছে। নিজের ভূখণ্ড মার্ক করতে, আর দাবী আদায়। দুটো জায়গায় চরম মাত্রায় নিপীড়িন আর সংঘাতের মধ্যে দিয়ে যায় প্রতিদিন। সরাসরি যুদ্ধ নাম দিয়া না হইলেও যা হইতেছে তা কোন যুদ্ধের চেয়ে কম না। সংঘাত বা দ্বন্দ্ব বললে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনরে বরং খর্ব করাই হবে।
যদি কাশ্মীরে গিয়ে থাকেন তাইলে ভূস্বর্গের যে তকমা তার গায়ে লেগে আছে তারে সত্যি বলেই মাইনা নিবেন। তবে এই ভূস্বর্গ ভারত পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই একটা বড় বিবাদের বিষয় যা কাশ্মীরের শান্তির অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেছে প্রতিদিন।
ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরে অবস্থিত ৮৬,০০০ বর্গমাইল বিস্তৃত এই অঞ্চল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে দ্বিতীয়টি নেই পৃথিবীতে। কিন্তু এর দখলকে কেন্দ্র করে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ। ১৯৮৯ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪৭,০০০ মানুষ। আর ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রাণ হারায় আরো ৪,৪২৭ জন। যদিও ভারতীয় সরকারের এই হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি মারা গেছেন বলে দাবি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সৈন্য আরোপিত এই অঞ্চলের মানুষ যতই যুদ্ধ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ততই তাদেরকে আটকায়ে ফেলা হচ্ছে কলোনিয়ালিজমের নতুন এক রূপে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলাও এই শোষণ, শাসনের বিপক্ষে যে বিশেষ কথা বলতেছে, তাও না। কিন্তু এসবের প্রতিবাদে কাশ্মীরবাসীদের প্রতিবাদও থাইমা নাই। তারা তাদের এই প্রতিবাদ জারি রাখতে, তাদের স্বাধীনতার আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গ্রাফিতি।
কাশ্মীরের গ্রাফিতি নতুন কিছু নয়, প্রতিবাদের এই শক্তিশালী মাধ্যম অনেক আগে থেকে থাকলেও, গ্রাফিতির ব্যবহার ছিলো সীমিত। কিন্তু সময়ের সাথে সারভেইলেন্স বাড়তে থাকে, মানুষের চলাচলের অধিকারও সীমিত হয়ে আসে আর বাড়তে থাকে গ্রাফিতির গেরিলাগিরি। এ গেরিলাগিরিতে কাশ্মীরের গ্রাফিতি প্যালেস্টাইনে আঁকা গ্রাফিতি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে। এমনকি কাশ্মীরে প্যালেস্টাইনের পক্ষে গ্রাফিতি আঁকতে গিয়ে গ্রেফতারও হয়েছেন কাশ্মীরেরই কয়েকজন শিল্পী। এ যেন একই লড়াইয়ের দুইটা ক্ষেত্র।
কাশ্মীরের সৌন্দর্যের সাথে পরিচয় থাকলেও দেশ হিসেবে কাশ্মীর আমাদের তেমন পরিচিত নয়। পুরো ভারতবর্ষে যখন ইংরেজদের শাসন পুরোদমে চলতেছে, তখনও স্বাধীন ছিলো কাশ্মীর। ইংরেজরা চলে যাবার পর সে স্বাধীনতা কেড়ে নেয় ভারত। কাশ্মীরী নাগরিকেরা প্রতিবাদ করে ভারতের দখলদারিত্বের। ১৯৫৩ সালে কাশ্মীরি নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করা হলে, তখনও সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। তাদের লাঠিচার্জ করা হয় এবং অনেকেই মারা যায় সেই আন্দোলনে। মানুষ দমে না গিয়ে আন্দোলন করতে থাকে আর দেয়ালে দেখা মেলে “গো ইন্ডিয়া গো” । কাশ্মীরের স্বাধীনতার সংগ্রামে প্রথম চিহ্ন এই দেয়ালিকা। যদিও দেয়ালিকাটি পুলিশ খুব তাড়াতাড়িই মুছে ফেলে।
ইদ্রিস কান্ত, একজন ইতিহাস গবেষক বলেন, “পোস্টার, দেয়ালিকা, ব্যানার এসব খুবই নিত্যনৈমিত্তিক ছিল ১৯৪৭ এর আগে ও পরে। ১৯৪৫ সালের জন্মাষ্টমীর সময়, কাশ্মীরে অবস্থিত পণ্ডিতরা র্যালির ডাক দেন যার উদ্দেশ্য ছিলো তাদের সাংস্কৃতিক প্রতীক রক্ষা করা। একইভাবে ৪৫-এর ঈদে মীরওয়াইজ গ্রুপের নেতৃবৃন্দ মিছিল করতে চাইলেও, দাঙ্গার ভয়ে পুলিশ তা করতে দেয়নি। কিন্তু দু’দলের সদস্যরাই একে অপরকে নিয়ে দেয়ালিকা কিংবা প্ল্যাকার্ড ইত্যাদি ব্যবহার করতেছিল। আর প্রশাসন তা জনসাধারণ দেখার আগেই মুছে ফেলার চেষ্টা করতো। এখনো মুছে ফেলে। যত দ্রুত পারে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, এই যে একদলের বিরুদ্ধে আরেকদলের নানাবিধ কর্মসূচী, এও এক প্রকার গ্রাফিতিই। আর এই যে গ্রাফিতির মধ্যে ব্যঙ্গ করা, বিদ্রুপ করা, তার সাথে আমরা মোটা দাগে ব্যাঙ্কসির সাথেই মিল পাই। আর এও বোঝা যায় কাশ্মীরের এই গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিবাদ, রুখে দাঁড়ানো তা হুট করে না। অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। প্রতিবাদের সংস্কৃতি হিসাবে। আমেরিকাতে বা আরো কোথাও কোথাও আমরা গ্রাফিতির বেড়ে ওঠা দেখছি হিপহপকে সঙ্গে নিয়ে; অনেকটা সমান্তরাল রেখার মতো। কিন্তু উপমহাদেশে এই মাধ্যম শুরু থেকেই বেশ রাজনৈতিক, অবশ্য ‘৯০-এর পরে এইখানেও তরুণদের র্যাপ-কালচারের প্রচলন শুরু হয়ে যায় আস্তে আস্তে। আর এই র্যাপ-কালচারের সাথে গ্রাফিতির সম্পর্ক বরাবরই অতি পুরান। এইখানেও এর ব্যতিক্রম না।
শ্রীনগরের বারজুল্লায় অবস্থানরত গ্রাফিতি আর্টিস্ট (নাম জানাতে অনিচ্ছুক) মাত্র ২৩ বছর বয়সেই শুরু করেন তার যাত্রা। ভোর হবার আগে বাড়ি থেকে বের হন কিংবা মাঝরাতে; তাও আবার পরিবারকে না জানিয়ে। স্বল্প সময়ে তার সাথে যোগ দেয় আরো তিনজন সমমনা আর্টিস্ট। তাদের প্রথম পছন্দ ছিলো শ্রীনগর বিমানবন্দর সংলগ্ন রাস্তা। তারা খুব জলদি স্প্রে ব্যবহার করে কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে (যা ভারত সরকারের কাছে রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণ) গ্রাফিতি করেন এবং দ্রুত পালিয়ে যান। তারা আরো বলেন যে, “এই রাস্তাটা আমাদের জন্য উত্তম, বাইরের মানুষের জানা উচিত কাশ্মীর কি চায় এবং কাশ্মীর কিসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।” এই গ্রাফিতিগুলোর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তারা প্যালেস্টাইনের গাজা শহরের গ্রাফিতির ভিডিও দেখে।
“গ্রাফিতি আঁকি নিজের রাগ, মানসিক আঘাত দ্বারা তাড়িত হয়ে” বলেন ২০ বছর বয়সী কাশ্মীরের একজন নারী আর্টিস্ট। “লিভিং ইন কাশ্মীর ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট” গ্রাফিতিটি তিনি করেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই আর্টিস্ট বলেন , “ভারত বেআইনিভাবে কাশ্মীর দখল করে আছে কিন্তু তাদের সরকার সবসময় এটা অস্বীকার করে।” সে আরো বলে কিভাবে সৈন্যরা নারীদের ধর্ষণ ও পুরুষদের বিনা কারণে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে। আর যুগ যুগ ধরে এইটাই চলে আসছে।
পৃথিবীর সর্বাধিক সেনা পাহারারত অঞ্চলে গ্রাফিতি আঁকা সহজ না। আঁকার জায়গা ও ডিজাইন আগে থেকে তৈরি রাখতে হয় এবং আঁকার সময় দু’জন আঁকেন আর একজন পাহারা দেন। তারা লাল ও কালো রং বেশি ব্যবহার করে থাকেন; শহীদ ও প্রতিবাদের প্রতীক হিসাবে। তাদের বক্তব্য থাকে খুবই সোজাসাপ্টা, সরাসরি; যাতে সবাই বুঝতে পারে। তাই গ্রাফিতিগুলোর টেক্সট হয় এমন: “ওয়ান স্লোগান, ওয়ান ট্র্যাক; গো ইন্ডিয়া গো ব্যাক”, “আই প্রোটেস্ট”, “দিস ইজ অ্যা পুলিশ স্টেট”, ” দ্যা রেভুলেশন ইজ লোডিং “, ” ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ইত্যাদি।
পুলিশ-আর্মি না শুধু, অনেক সময় ভারতের সর্মথক গোষ্ঠীরাও গ্রাফিতি দেখলেই মুছে দেয়। অনেক সময় নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন নিজেরাই স্প্রে নিয়ে চলাফেরা করেন। গ্রাফিতি দেখলে যেখানে সম্ভব, গ্রাফিতির অর্থ পাল্টে দেন স্প্রে করে। মুছার চেয়ে অনেক সময় এটা সহজ। কর্মরত এক সিআরপিএফ অফিসার বলেন যে,”আমরা ‘বুরহান, দ্য লায়ন অফ কাশ্মীর’ এই গ্রাফিতিকে ‘ডগ অফ কাশ্মীর’ করেছি। আবার ‘গো ইন্ডিয়া গো’ কে পাল্টে করেছি গুড ইন্ডিয়া। আমরা নিজেদের পক্ষেও অনেক গ্রাফিতি করে থাকি।” এতে বোঝা যায় গ্রাফিতির ভাষাকে তারা জোরপূর্বক হলেও ভারতীয় সরকারের পক্ষে মতান্তরিত করবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে কাশ্মীরী আর্টিস্টরাও এতে অভ্যস্ত; আজ তারা যে গ্রাফিতি করছে, কাল তা মুছে দেবে অথবা অর্থ পাল্টে দিয়ে নষ্ট করবে কিন্তু এই পাল্টা আক্রমণে অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যায় যেমন কীভাবে অক্ষরগুলো পরির্বতন হয়ে নতুন শিল্পের রূপ নেয়। যদিও পুলিশি তৎপরতায় গ্রাফিতিগুলো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু সামাজিক ও বিশ্ব গণমাধ্যমে ঠিকই জায়গা করে নেয়।
শুধু দেয়ালে লেখা বা কিছু আঁকা বা পোস্টার সাঁটা না, অন্যান্য নানান এক্টিভিটিও গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে। ব্যাঙ্কসি যেরকম খুব পরিচিত অন্য শিল্পীর কোন ভাস্কর্যে কিছু এড করে দিয়েও আর্ট করা সম্ভব বলেছিলেন, তেমন এক্টিভিটি দেখা যায় কাশ্মীরের লাল চকে। দেখা যায় একবার এক লোক বাধাকপিতে শেকল পরিয়ে হাঁটতে বের হয়েছেন। এই কাজটি করেছেন তিনি মূলত যুদ্ধের যুক্তিহীনতার প্রতিবাদে। প্রথম যিনি
এই আন্দোলনটা করেন, হ্যান বিইং, তিনি তার পরিচয় গোপন রাখেননি, কিন্তু কাশ্মীরে যিনি এই কাজটা করেছেন, তাকে পরিচয় গোপন রাখতে হয়েছে। এভাবে কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে এমনকি বাধাকপিরও একটি রাজনৈতিক পরিচয় সৃষ্টি হয়েছে। আর এটা তো জানা কথাই যে কাশ্মীরের দেয়ালে লেখা ‘স্বাধীনতা’ আর অন্য কোন শহরে লেখা ‘স্বাধীনতা’ এক নয়। কারণ কাশ্মীরের স্বাধীনতা চেয়ে বাঙ্গালুরু, কলকাতাসহ আরো অনেক শহরেই গ্রাফিতি দেখা যায়। আবার ইন্ডিয়ান অনেক গ্রাফিতি আর্টিস্ট যেমন গেস হু, টাইলর, ওনারা স্টেনসিল বা ইমেজ দিয়েও গ্রাফিতি করতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এইটা এক প্রকার লাক্সারি। এখানে সেই সময়-সুযোগ দেয়া হবে না। আর সে কারণেই হয়তো অন্য শহরে কোন গ্রাফিতি আপনার চিন্তাটাকে অতোটা নাড়াইতে পারবে না, যতোটা কাশ্মীরে সম্ভব। তাই কাশ্মীরে গ্রাফিতি সৌখিন কিছু না। এটা আর যে কোন রাজনৈতিক এক্টিভিটির মতোনই কিছু বা তার অংশ। তাই এর রিয়েকশনও অইরকমই কিছু হবে। এই হওয়াটা বজায় থাকুক।