কবি কামরুজ্জামান কামুর জন্ম ১৯৭১ সালের ৩১ জানুয়ারি গাইবান্ধার বামনডাঙা ইউনিয়নের রামধন গ্রামে, নানাবাড়িতে। ৯ বছর বয়স পর্যন্ত একই গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়ে ওঠেন মায়ের সঙ্গে। এরপর পিতার চাকরিস্থলে গমন এবং স্থানান্তরিত হতে হতে উত্তরবঙ্গের সমতলের জীবনের কলতানে বেড়ে ওঠেন। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় আসেন জীবিকার প্রয়োজনে। পেশা হিসেবে প্রথমে সাংবাদিকতায়, পরে নানা প্রতিষ্ঠানের অডিও-ভিজুয়াল নির্মাণে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশের একটি লিডিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগে কাজ করছেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ :
কবি মুখপত্রহীন, অহেতু গুঞ্জনমালা, মামুজির নৌকায়, তুনির কবিতা, নিগার সুলতানা, চেয়ে আছো, আমি রোহিঙ্গা, আমাকে এবার পিছমোড়া করো ও কবিতা সংগ্রহ।
ফড়িং দিন এবং দৃশ্যাবলি
ফড়িং-এর পিছনে ছিলো খড়কুটা এবং দুপুর। তাহাদের ঘিরে বৃক্ষগুলি চক্রাকারে ঘুরিতেছে। ভূমির পিছনে দৃশ্য। খড়ের পিছনে দৃশ্য। গরুর পিছনে দৃশ্য। দৃশ্যের পিছনে এই সর্বময় দৃশ্য সমাহার। মাইল ফলকে গেঁথে ছিলো এক ব্রহ্মচারী দাঁড়কাক। মহিষের পিঠে অলস সঙ্গীত রচে সোনালি ফড়িং। তাহাদের দিনগুলি দ্রষ্টব্যে চক্রাকারে ঘুরিতেছে। ব্রহ্মচারী। অদ্ভুত স্বর-বিন্যাস। আমারও অনেকগুলো দিন ফড়িং এবং খড়ের পিছনে প্রতিধ্বনিময় মুহূর্ত উদ্ভিদ।
ধান
ধানের সাফল্যে দেখি
সকলেই হাসিখুশি হলো
আমাদের ব্যবসা-সংক্রান্ত মন
হায় হায়
আমাদেরও বাণিজ্য প্রতিভা আহা
বিরহ দিবসে এলে ধান
গরিবের ঘরে
শল্যরোগীর মেটাফিজিক্স
(ডা. হাবীবকে)
শল্য বিশারদ
এস এন আদিত্যের
হস্তময় মহা—
পেন্ডুলাম
দুলছো দোলো ভাই
শঙ্কা জাগো কেন
হঠাৎ বন্ধের
সঙ্কেতের
রতন, আপনার
ছুরিটা দিন দেখি
কাব্য ঘষে তুলি
ছন্দ তার
বাছা এ বিধাতার
তুচ্ছ প্রশ্নটা
বলছি ধীরে কাটো
অস্ত্রধার
শল্যবিদ ওরে
অ্যাবস্ট্রাকশন
আমি তো শিশু পাবো
আশমানের?
দূরের বেলাভূমে
এতো যে শিশুরূপ
আমার সন্তান
দৃষ্ট হও
আমাকে শুশ্রুষা
দিচ্ছো লো সেবিকা
পূর্বজন্মের
ধাত্রী নও?
আসছে ডাক্তার
আমাকে সিস্টার
ক্ষণিক নিচে রাখো
শ্বেতডানার
নিচে কি বেলাভূমি
মহিলা ডাক্তার
নিচে কি বহু শিশু
অ্যাপ্রোনের
উঠছো জেগে আজ
শল্যচিৎকার
জাগছো নিখিলের
হাসপাতাল
মফস্বলে রচিত কবিতা
এই বীতনাথ
কবির জীবন,
ধরিত্রী ও ধুলা, তুমি কতভাবে
ধন্য করে যাও।
মফস্বলে রচিত কবিতা তুমি অতি মনোযোগে
বিদ্যুতের নিচে বসে ছাপা করো—
আর সেই ছাপযন্ত্রের রোলারের চাপে
চ্যাপ্টা হয়ে বেরিয়ে আসছে
কবির অস্বচ্ছ মুখ,
হস্তলিপি, বাঁকাচোরা হাসি।
চারিদিকে ধানের ব্যঞ্জনা
সারাংশ
লোহা-লক্করের নিচে পাওয়া যাচ্ছে
মাটির পেয়ালা
এ সংবাদ প্রাসঙ্গিক বটে, তবু
ঘটনা ঘটেছে যাহা সারাংশটুকুই তার শ্রেয়
যুবার হারিয়ে গেছে ধান
দু হাতে সোনার বালা নিয়ে
বউ ছুটছে থানা সাঘাটায়।
ডাকু
ডাকু আসে মধ্যরাতে। তুমি যেন
বস্ত্র খুলে রেখে কভু ঘুমাতে যেয়ো না।
স্বর্ণহরণের কালে মানুষের মতিভ্রম ঘটে।
সেটা খুবই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু যদি
ধানচোরা অন্যকিছু দাবি করে বসে
তখন কী হবে?
প্রেমিক
গ্রামসালিশির রাতে, পুনরায় প্রকৃত সিঁদেল
ঘরে ঢুকে, অন্ধকারে তোমাকেই ধান ভেবে
জড়িয়ে ধরেছে।
তুমিও নিথর ছিলে, ধান ছিল
আশেপাশে ছড়ানো-ছিটানো।
পরকীয়া
সেদিনই বুঝেছি আমি, আহতের চেয়ে বেশি
টান ছিল নিহতের প্রতি।
তথাপি তোমাকে এই পদ রচনার কালে বলে রাখি,
ভেবে দেখো, বিবাহের বহুদিন পরে
ক্লিশে জীবনের ফাঁকে, মাঝে মাঝে
অন্য কোনো ধানের লাবণ্য দেখে টলে যাওয়া
কত সাবলীল।
ধান ও ঘটনা
বাড়ির মালিক গেছে, অন্য গৃহে, ধানের সন্ধানে;
হেন অবসরে
ঘটনা ও ধান, শব্দ দুটিকেই আমি
বহুব্যবহারে আজ
ক্লিশে করে ফেলি।
কোনো যথারীতি নাই
কোনো যথারীতি নাই দেহখানা অযথা জটিল
কী বলি দেহের কথা বলো দেহ কিবা পরিচিতি?
বলো বলো কী কারণে মণি দিলা নয়নে আমার
কী কারণে বেন্ধে দিলা দুই অঙ্গে দ্বিপ্রকার গীতি!
কত কত লোহা দেই, আগুনও তো দিয়েছি অনেক
তবু কামারের বাঁকা হাসি আমি না বুঝি রসিক
না বুঝি লোহার প্যাঁচ কত প্যাঁচে নাটবল্টু হয়
না বুঝি রসের টান কোন রসে ভাসে নাগরিক
রাজা দিয়া রাজা মারি তীর দিয়া মারি রে শালিখ
কোন অস্ত্র দিয়া মারি কালা আমি ঠারে চাওয়া পাখি
মোচড় দিয়েছো বুকে ভাবসম্প্রসারণের ছলে
ফুলভাবে পাখিভাবে সখা তব হাতে হাত রাখি
আমার দেহের তাল, হাড়গোড় খুলে যাচ্ছে হায়
না বুঝি সুতার গেরো, তবু সুতা বাঁধে রে আমায়।
শীতকালীন কবিতা
আমার নামের শেষে পরিচিত কাম
দিয়া আমি কামিনীরে আহ্বানিলাম
তবু তো না সে কেন হাসে
ঠান্ডা লাগে নভেম্বর মাসে
তবে লাগুক না হাড়ে হাড্ডি ঠকাঠক
আমার বান্ধবী যদি খাইতে চায় বক
তাতে করে মিল দেওয়া হয়ে যায় সোজা
যত গো কামনা তত চোখ লাগে বোজা
বুজে থাকব চোখ তোমার বাড়িতে গিয়া
যা করার করবা তুমি আমার সঙ্গে প্রিয়া
আমি কত ভালো তত লাগতে পারব না
কামকাতর নভেম্বর জাগতে হয় সোনা
হেমন্তের গ্রামান্তরে
হেমন্তে যে কী কী সব কলরব আমি
গ্রামে থাকতে টের পাইছি ওগো অন্তর্যামী
তা আজ স্মরণে আর নাই নাই তো রে
ধানের পরশে ধান পেকে পেকে
উঠেছিল ভোরে
সম্ভবত সেই ধান গোলায় হেলান
দিয়া তুলতেছিলা হায় রে সেই প্রাণ
রসে রসে বিরসিত বাহিরিয়া মৌ
ধান লয়ে বসে আছে মাভগ্নিবউ
আমি সে ধানের গান মনে রাখতে চাই
হেমন্ত রে আলাভোলা আমরা দুই ভাই
হঠাৎ নগরে আসি নাগর নাগর করি
চাইরবেলা মালামাল
তালবেতাল
যাই যাই চলে
গিয়া
বসে থাকি চুপচাপ ডাকাডাকিহীন
খাইতে দেয় সে নবান্ন, এ নবীণ
তাইতো তাইতো খায়া
যাই তো যাই তো করে
নব নব পাকা ধান
হেলাফেলা ফাঁকা ঘরে
সারাবেলা যে-বা করে
তার নাম, তাহারো নামটা
স্মরণে আসতেছে নাকো কিন্তু একটা
কথা আমি বলতে চাই এহ মনোবলে
হেমন্তে ধান পাকে পরস্পরের দেহ
তল্লাশির ছলে
সম্ভবত সেই ধান, গোলায় হেলান
দিয়া তুলতাছিলা হায় রে মোর প্রাণ
হায় রে মোর বিরচিত প্রাণ
তোমার সংসারে
বসে থাকব অর্থহীন, ঠ্যাং মেলে
চাব না তোমারে
তবু চক্রবর্তীর হাসি মেটাফিজিক্যাল
এক.
হাসি ব্যাপারটা কবিতায় বহু প্রচারিত, তবু
বিশ্বে আপনি যতবার হাসেন ততবার
মেটাফিজিক্যাল শব্দটা আমাকে ব্যবহার করতে হয়
এখানে মেটাফিজিক্যাল অর্থ অনির্বচনীয়
মানে যাহা অধিজগতের, যাহা বচনে অতীত, তবু
বচন ব্যতীত আমি কথা বলি কীভাবে হে বালা?
দুই.
তা কথা বলার জন্যে এ নিখিলে হাসপাতালে
একজন নারী-চিকিৎসক
একজন সাগরিকা চক্রবর্তী রয়
গাইনি বিভাগে গিয়া আমি তার সাথে কথা-বার্তা বলে আসি
তিনি আমার চুলে বিলি কেটে দেন, আর বলেন,
এটা কেমন কথা বলো তো কামু আসে না কেন
এত এত করে করে তার কথা বলি বলি রে
তার তো একবার আসা উচিত
এরপর আমাকে তিনি প্রেসক্রিপশন দেন
ঘুমাবার আগে কাশিয়াম খেয়ো
টেনশন কমে তাতে ঘুম হয় ভালো
তার তো এটা খাওয়া উচিত
ছেলেমেয়েরা তো সব এসব-টেসব খায় চিরকাল
ঘুমের ব্যাঘাত হলে ধরণীতে বসে বসে
বড়িটড়ি নেশা-ভাং ইত্যাদি ইত্যাদি
তিন.
কিন্তু এই সাগরের কথা আর বলা যাবে না
সকালবেলায় আমি তার কাছে গিয়া
ক্ষমা চাই, আমার যে ভয় লাগে, তার
বর যদি আমাকে শাসন করে
যদি বলে, এই ছেলে দুপুরবেলা
শ্মশানে শ্মশানে ঘুরছো কেন?
পড়াশোনা নাই?
চার.
পাঁজির হাড় কোথাকার
বাউণ্ডুলে কোথাকার বোহেমিয়ান কোথাকার
ট্রামের তলে পড়ে তোমার মরা উচিত
জীবনানন্দ দাশ কোথাকার!
মাতৃভূমি
কে তুমি নিশুতি বাংলাদেশের পাখির সুরে গো ডাকো
চিঁ-আও! চিঁ-আও! ধ্বনির আবেগে রাত জেগে বসে থাকো
না না পাখি নয় তারা নয় সে তো দুর্বিনীত নিগার
আমার হাড্ডি খুলে বাঁকা করে গড়ে সে নিজের হাড়
আমার শিশুরা দোলে তার কোলে যেন প্রকৃতির বুকে
বাদুড়-ছানারা ঝুলে আছে কালো মাই চুষবার সুখে
যেন বকসারি আকাশের গায়ে রেখা টেনে চলে যায়
পূর্ণিমারাতে সে যেন আমার মায়ের মাদুলি চায়
আমি খরগোশ কালো দাঁড়কাক সবুজ পাখির ডানা
ঝাপটাই যেন আকাশের মত নীলরঙ শামিয়ানা
ফুলে উঠে ফের খুলে পড়ে যায় চৌচির বৈশাখে
আমি শুয়ে আছি কান খাড়া করে ঠান্ডা মাটির ডাকে
শুয়ে আছি ওগো পুকুরপাড়ের গাবের গাছের তলে
ধানের ক্ষেতের পুবালি বাতাসে মহামিলনের ছলে
আমাদের দেহে পরাগের মত লুটোপুটি খায় হেসে
তুমি গো আমারে জন্ম দিয়েছো তোমার বাংলাদেশে
তোমার বিলের বুকের শাপলা ফোটার বর্ষাকালে
দল হয়ে আমি দু’পায়ে জড়াই বামনডাঙার খালে
গলগল করে বয়ে চলে যাই চিতল-চিত্তসম
বুকে চেপে ধ’রে দেখো তো জীবন কাঁপে কেন প্রিয়তম!
মুখে চেপে ধ’রে রাখো তো আমারে মুখ চেপে ধ’রে রাখো
পলে ও বিপলে আতায় কাঁঠালে ঘনীভূত হয়ে থাকো
দেখো আমবনে বটনির্জনে নিখিলনদীর কূলে
কামু ফিরে যায় ভ্রুণ হয়ে তার মায়ের নাভির ফুলে
এ কার হৃদয়ের কাজল গ’লে যায়
আমাকে হত্যার তিমির আয়োজন চলছে। উন্মাদ
কাতেল তলোয়ার উঁচিয়ে হুংকার দিচ্ছে। রক্তের
কণিকা-পানকারী পশুরা উল্লাসে চাটছে ব্যক্তিকে
ব্যক্তি-নির্যাস, ব্যক্তি-কল্পনা, ব্যক্তি-ছন্দের
প্রস্ফুটন। যেন ফুলের বিকাশের মুহূর্তকে আজ
শোণিতে ভরে দিতে সীমার প্রস্তুত। ধারালো তলোয়ারে
ঝিলিক-মারা রোদ ঠিকরে পড়ে ওই। এখানে এই নিচে
কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।
ছোরায় শান দেওয়ার শব্দে সচকিত বল্গা হরিণেরা
ছুটছে। যেন এই ত্রস্ত বনতল ডাকাত-কবলিত
রাতের বুক থেকে আমাকে লুকাইতে চাইছে প্রাণপণে।
হত্যা-হাহাকার-হর্ষ-উৎসব! ঝালর-ঝাড়বাড়ি
শোভিত পৃথিবীতে সবুজ ধানক্ষেত, কবি ও কাকাতুয়া
এ বুকে দোল খায়! হাত দে ধরে দেখি পিণ্ড কাঁপছে!
এ কার হৃদয়ের কাজল গ’লে যায় অন্ধ আর্তির
মতন। লাশকাটা ঘরের দরজায় আব্বা বসে আছে
আমার বয়সের চাইতে দীর্ঘ এ দুপুরে। শব্দের
ভিতরে শূন্যতা নীরব। নিরবধি নদীর কান্নার
শব্দ নাই যেন শঙ্খ বাজে নাই আযান শোনে নাই
মানুষ কোনোদিন আবেগে আপ্লুত হইতে পারে নাই
রক্ত খায় নাই নিজের শরীরের বীর্য অন্যকে
প্রদান করে নাই ঝাপটে ধরে। এই শাণিত তলোয়ার
আমাকে ফালি ফালি করবে কেটে কেটে এখানে এই নিচে
কণ্ঠনালীটার পাশে চুমার দাগ রয়েছে জননীর।
এই যে গোধূলির মোষের পাল যায় লালচে সূর্যের
সামনে দিয়ে আজ হত্যাকাণ্ডের প্রাগমুহূর্তের
যেনবা একবার একটু-জ্বলে-ওঠা ছোট্ট আর্তির
মত। কে যেন হুঙ্কারের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে যাওয়া
দুমড়ে দেশকাল মুচড়ে ফেলে দেওয়া মানব কঙ্কাল
দু’হাতে বুকে নিয়ে কাঁদছে। হৃদয়ের কাজল গ’লে যায়
বঙ্গপোসাগরে লবণ-ঢেউ উঠে আস্তে নেমে যায়
নিজেরই গহ্বরে। টিনের কৌটার মতন ভেসে থাকে
আমারই কল্পনা-প্রসূত আবেগের তীব্র ঘূর্ণিতে
জন্ম নেওয়া ওই মুক্তা। ঝিনুকের উষ্ণ গহ্বরে
জন্ম নিতে নিতে গলিত মরে-যাওয়া মুক্তা। উজ্জ্বল
পারদ-বিগলিত-রাতের কিনারায় বেহালা বাজানোর
করুণ প্রস্তাবে তুমি কি জাগো নাই, বলো তো, অব্যয়?
তোমাকে শেষবার দেখেই মরে যাব। গলায় তলোয়ার
বসাবে জল্লাদ, আখেরি ইচ্ছার অপারগতা হয়ে
মৌন লতাগুলি গড়িয়ে পড়ে যাবে মাটিতে। জামপাতা
নীরবে ঝরে যাবে। আর্ত কলরব থামিয়ে ভোরবেলা
বাঁশের বাগানের পাখি ও গুঁইসাপ তাকাবে বিস্ময়ে
হত্যাদৃশ্যের বরফ-হিম-ছায়া সরিয়ে রক্তের
ধারায় মিশে যাবে অর্ধবাক হয়ে অন্ধ জন্মের
আর্তনাদ। তবু আমাকে মনে রেখো। দু’চোখে কাজলের
আবার টান দিও। আবারও গলে যাবে। আবেগে থরথর
মদিরা-বিজড়িত নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের তারাগুলি
অধীর পৃথিবীকে আলিঙ্গন দিতে নামবে ধীরে ধীরে।
আদরে ভরে দিয়ো কাজল-কালো রাত। দূরের যাত্রীকে
বাহুর বাহানায় দু’দিন ধরে রেখো। বসন্তের গান
ক্ষণিক ভুলে যাওয়া কোকিল পাখিটাকে কেউ তো দেখে নাই
পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যরশ্মির মাটিতে তির্যক
নামার দৃশ্য তো মানুষ দেখে নাই হত্যা-উত্তর
জৈব-ধর্মের উত্তেজনাগুলি মলিন হয়ে যেতে
কেউ কি দেখে নাই লোহা ও মানুষের যুদ্ধে পরাজিত
লাশের পাহাড়ের উপরে শেয়ালের খিদায় কাতরানো
করুণ চোখ দুটি! তবুও হত্যার তিমির আয়োজন
তবুও রক্তের পিপাসা-জাগ্রত-শাণিত-লোহা দিয়ে
তৈরি তলোয়ার আমাকে কোরবানি করবে উল্লাসে
হঠাৎ থমকানো ঘূর্ণি-বাতাসের বুকের ধূলিকণা
পড়বে ঝরে। এই সুরত মুছে দিয়ে সূর্য ডুবে যাবে
তুলসিতলে জ্বেলে নীরব মোমবাতি আম্মা কোরানের
আয়াত তেলাওয়াত করবে। মর্মের অশ্রুবিন্দুর
মতন টুপটাপ ঝরবে দুনিয়ায় বেহেস্তের ফুল
দেবতা দরবেশ করবে কোলাকুলি। কণ্ঠনালীটায়
আম্মা চুমা খাবে। আমার দুই চোখে কাজল টেনে দিয়ে
নিজের আয়নায় নিজেরই মুখ দেখে পারদে গলে যাবে
মানবজন্মের দীর্ণ দুই পার। একটু পরে তার
কোলের শিশুটিকে জবাই করা হবে। মাংস রান্নার
মশলা বাতাসের লুব্ধকারী ঘ্রাণ জাগাবে মানুষের
ভিতরে মানুষের হত্যাকারী প্রাণ, হিংসা, রৌরব
রক্ত-কণিকার গন্ধে মানুষের মাতাল তলোয়ার
তুলবে ঝঙ্কার। পথের মাঝখানে হারানো সন্তান
আবার তুলে নিতে মায়ের বুকটান ছিটকে পড়ে যাবে
মানুষ দৌড়াবে নিহত মানুষের চামড়া ছেদ করে
মাংস ভেদ করে রক্ত পান করে অশ্বারোহীদের
চাবুকে চিৎকার করতে করতেই পাহাড়চূড়া থেকে
ধাবিত পাথরের ধাক্কা খেয়ে তবু মানুষ দৌড়াবে
প্রেমের পেয়ালায় চুমুক দিতে গিয়ে তপ্ত পৃথিবীর
আগুনে পোড়া হৃৎপিণ্ড ছুঁড়ে ফেলে ধ্বস্ত মানুষেরা
তবুও দৌড়াবে। সকালে সূর্যের সামনে ফেলে দিয়ে
কাতেল তলোয়ার আমাকে কোরবানী করবে। রক্তের
ফিনকি-লাগা-মেঘ কিছুটা উড়ে গিয়ে ঈষৎ থমকাবে
শুভ্র শরীরের রক্ত ফেলে দিয়ে আবারও উড়ে যাবে
আকাশে আপনার আকার বদলাতে। মাটির পৃথিবীতে
মহিষ ভেড়া আর গরুর পাল যায় লম্বা সার বেঁধে
রক্তমাখা ঘাস তারা তো খায় নাই। বুলেট বিঁধে যাওয়া
বাঘের গোঙানির মতন মিনতির সামনে শিকারীর
চোখের দুই কোলে রক্ত লাল হয়ে কখনো ওঠে নাই
পাতা ও বাতাসের নিবিড় সংলাপ সীমার শোনে নাই
গলায় তলোয়ার চালানোর উল্লাসে রজনী চৌচির
ব্যথায় ফেটে গেছে। গড়িয়ে পড়ে গিয়ে কে যেন মরে গেছে
সুরত মুছে দিয়ে কে যেন চলে গেল কী যেন চলে গেল
কখনো আসে নাই তবু সে মরীচিকা সুদূরে চলে গেল
দিগন্তের কালো গ্রামের ওইপারে দিনের অন্তিম
আলোর রেশটুকু ডানায় তুলে নিয়ে যে পাখি উড়ে যায়
তার এই চরাচরে কখনো খুলে-পড়া ছোট্ট পালকের
স্মৃতি কি মনে থাকে! গোপন হত্যার ছোরায় হাতছাপ
নিজেরই অগোচরে কেউ কি রেখে যায় একটু কেঁপে-ওঠা
আবেগে থরথর নিনাদে ফেটে-যাওয়া রাতের কিনারায়!
রক্তবসন্তবনে
বসন্তের দিনে ভালোই লাগে না তো! কোকিল কেন ডাকে
ঘরের জানালার পাশে বেল গাছে! সময়-জ্ঞান নাই
বেহায়া পাখিটার লজ্জা-শরমের বালাই নাই কোনো
আমি কি কেনা তার? যখনই ডাক দেবে তখনই ছুটে যাবো?
ও ঘরে আব্বার কণ্ঠ শোনা যায়। আনাজ-তরকারি
কাটার উসিলায় আম্মা বসে আছে ঘরের চৌকাঠে
কীভাবে যাই আমি? একটু তর কেন সয় না পাখিটার!
আমি কি কচি খুকি? সবার চোখভরা পাহারা সন্দেহ
ভ্রুকুটি ভেদ করে সকালে-সন্ধ্যায় কীভাবে ডেট করি!
বসন্তের দিনে বাতাসও বেপরোয়া উড়িয়ে নিয়ে যায়
কী জানি কোন বনে! লালচে প্রিন্টের আঁচল খসে পড়ে!
একি এ হায় হায়! শরীর হৃদয়ের ভিতরে ঢুকে যায়!
পলাশ ও শিমুলের ফুলের ফাঁক দিয়ে বসন্তের কালো
কোকিল উড়ে আসে আমার জানালার পাশের বেলগাছে।
দুপুরে ও কোকিল, ডাকিস না তো আর! শাড়ির ভিতরে যে
ঈষৎ লালরঙ আলতো রক্তিম ফুলের কলিগুলি
ফুটছে, সেই ফুলবনের সীমানায় ডাকিস না তো আর!
আমার ভয় লাগে! আব্বা ও ঘরের দুয়ারে গর্জায়
এ ঘরে আমি একা। বারান্দায় বসে আম্মা পান খায়
দু’হাতে তীর নিয়ে বাইরে পাহারায় আমার বড় ভাই
আমি কী করে যাই? কোকিল, ও কোকিল, আমাকে নিয়ে যাও
ডানার ঝাপটায় আমাকে রক্তিম বনের ওইপাড়ে
আছড়ে ফেলে দিয়ে কানের কাছে এসে বলো তো, কুহু কুহু…
তবে
এই ভবে কেন তবে
তবের ভিতর থেকে
আরেকজন মুখ চেয়ে রবে
রোহিঙ্গা
আয় রে আমার নিখিল-নিরাশ্রয়
আমার বুকের দুধের ধারার তলে
আমার দেহের রক্তনদীর ধারে
কিসের বাঙালি কিসের রোহিঙ্গা রে…
রণরক্তমাতম
এ কি সন্ধ্যাতারা নাকি বাংলাদেশের বুকে যুদ্ধবিমান
ধেয়ে নামছে আকাশ তবু সঙ্গতিহীন হাহা হাসছে কেন
খাটো কালচে মানুষ? দিকশুন্যবুকের নিচে অন্ধপাথর
ফেটে চূর্ণ হয়ে দূরে ছিটকে পড়ে। রণরক্তমাতম!
কামে জর্জরিতের বুকে বীর্যপতনধ্বনি আছড়ে পড়ার
মত শব্দ হলো এই দীনদুনিয়ার মধুচন্দ্রিমাতে।
যেন ক্ষিপ্ত ঘোড়ার ক্ষুরে অশ্বারোহীর নাভিচিহ্ন ছিঁড়ে
দূরে ছিটকেপড়া কোনো রক্তজবা নাকি সন্ধ্যাতারা?
নাকি বাংলাদেশের বুকে যুদ্ধবিমান এসে হামলা করে?
নাকি শেলক্ষেপনের ধোঁয়াধ্বস্ত হৃদয় ফাটে আর্তনাদে?
নাকি বংশপরম্পরাছিন্ন মাতাল হাসে মধ্যরাতের
ঘন অন্ধকারের দিনে সন্ততিদের কথা চিন্তা করে?
ভুলে জাপটে ধরেই দূরে ছিটকে পড়ি। গাইবান্ধা থেকে
এই পাংশু সিটির বুকে মাংস কাটার মত ঐতিহাসিক
ঘোড়া দাবড়ে বেড়াই। কোনো চঞ্চলতার মদে মাতোয়ারা খুন
রগে রক্তমশাল হয়ে উঠছে জ্বলে। লোহা চাটছে আগুন।
লোহা তপ্ত করার কাজে ব্যাপ্ত কামারশালা গনগনে লাল
জাগো সন্দেহাতীতভাবে সর্বহারার বুকে ঢাল-তরোয়াল
রণরক্তমাতম! এই বাংলাদেশের বুকে যুদ্ধবিমান
আমি তৈরি করি। আমি বিশ্বজিতের বুকে রামদা কোপাই!
আসাদ
মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে
এসো রূপকুমার ফরহাদ
— কাজী নজরুল ইসলাম
আসাদ, আমার নাম মনে নাই তোর?
বুকের ভিতরে ঝাপটে ধ’রে রাখা সেই
বুকের উষ্ণতা হয়ে আরেকবার ডাক
আমার সমস্ত কিছু যা আছে আমার
আমার গলার মালা যা আছে আমার
যা আমার নাই তা না থাকার ফাগ
সবকিছু ফেলে দিয়ে তোর কাছে যাব
বুকের-বিলয়-তলে বিজয়-বেদনা
রে আসাদ, বন্ধু মোর, শিশিরের কণা,
ঝাঁপ দে রে আমার বুকে, জন্মের শূন্যতা
চুমায় ভরিয়ে দে রে! আঁকড়ে ধর, যাদু!
এত আলো এত আলো কেন রে ভুবন!
আসাদ! আসাদ! আমি মরে যাচ্ছি রে!
আসাদ-২
আমি খিলি পানের মতন ক’রে হাসি
কেন হাসি লাগে রে আমার তনু
জাগে রে আমার কেন আগে রে আমার
তুই পাবি? কেন এই হাড্ডির চিৎকার তুই
পান ক’রে যাবি? কেন আমার বিকার
রে আসাদ! কালো ঘোড়া! গত জনমের
পহেলা বৈশাখ তুই, আমি তোকে চাই
রগের ভিতরে রক্ত হয়ে তুই থাক রে আমার
ছিটকে পড়া বীর্যের বিরহ হয়ে থাক রে আমার!
খাঁ খাঁ এই বুকে আয়, ঝাঁপ দে রে আসাদ
দুপুরের পুকুরে আমার! আমার শূন্যের বুকে
আমার দিগন্তে তুই নেমে আয়! খোকা!
সোনার ধানক্ষেত দিয়ে দৌড়ে ছুটে আসি
এই নে হাড্ডির রক্ত, পান কর, হাসি…
আসাদ-৩
আসাদ আমার বন্ধু, ভগ্নাংশ আমার
আমার জলার মাছ, লালপুঁটি, তার
বুকের ঢিপঢিপ ধ্বনি বাজে রে আমার
বুকের তলের জলে! দুধের বোঁটায়,
তলপেটে সে আমার থেঁতলে যাওয়া ছেলে!
সে আমার ঠোঁট থেকে আস্তে খুলে যাওয়া
ঠোঁটের অনুরাগ হয়ে সুদূরে মিলায়!
রে আসাদ! ভাই আমার! সোহাগের ধন!
ফিরে আয় ফিরে আয় ফিরে আয় বুকে
আমার আতার ফুল ছিঁড়ে আয় বুকে
আমার নাড়ির টান আমার পাতাল
আমার দাফন শেষে ছিটানো আতর
গন্ধের মতন তুই উড়ে যাবি, সোনা!
তোকে আর এই দেশে জীবনে পাব না…
আমার বাংলাদেশ! আমার বিফল
তনু! ভীরু ধানক্ষেত! মায়ের পেটের
ভিতরের দুই ভাই আমি ও আসাদ…
আসাদ-৪
আমি তোকে আর রক্ত দেখাবো না রে
আমি তোকে আর গলাবো না এই ক্ষার-এ
আমি শুধু এই এপারে আমার শুয়ে
রবো রে আসাদ, পারানির সিঁকি খু’য়ে
তুই তো আমার পাঁজরে পা রাখবি না
জানবি না কেন কাঁপে এই ছোট সিনা
মানবি না তোর পেড়ে আনা সেই মুখ
লুকায়ে রাখুক এই চির-উজবুক
আসাদ-৫
আসাদ! আসাদ! চল আমরা খলখল ক’রে
দৌড়াই পাকা ধানের শীষের উপর দিয়ে
চল আমরা মেঘ খাই
চল দামামা বাজাই, চল রে আসাদ
আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই
উপরের দিকে, উপরের সীমাহীনতার
ওপারের সাদাকালো গ্রাম
পার হয়ে আরও এক দূর…
গ্রামের ভেতর দিয়ে নূর
হয়ে মোরা বয়ে যাই চল…
আসাদ-৬
চল আমরা কাঠবিড়ালির সাথে
লাফ দিয়া গাছে উঠি
গাছের ডালের ফাঁকের আলোছায়ায়
এ-ডাল ও-ডাল করার মতো খেলি
আমাদের হিরন্ময় আমগাছগুলি
আমাদের আমের তলের ছোটঘর
আমরাই তো বাঁধিয়াছি হেসে
দুজনে দোঁহারে ভালোবেসে
সে-ভালোবাসার দিন আদিঅন্তহীন
গোলাপের বাগানের মত ফুটে রবে
এপারের এ-ঘরের
চালার উপর দিয়ে
উড়ে চলে যেতে গিয়ে থমকায়
যে-বাতাস, তার
হৃদয়ের গান আমি গাহিয়াছি
আমি তারে ডাকি রে আসাদ!
আসাদ-৭
আমার বাঁশের তলে পড়ে আছে বাঁশপাতা
রে আসাদ, তুই আমার
কবিতার খাতা রে! আসাদ!
তুই আমার ব্রহ্মপুত্রের পারে
ঝাউবন, বিবাহ-মন্দির…
তুই আমার স্বপ্নে-পাওয়া
সোনালি ধারের তলোয়ার…
তুই আমার আত্মারই আলয়
আদিকালে বৃষ্টির আঘাতে
ধ্বসে-পড়া জীবন্ত নগর
ভূ-পাতন, ইন্দ্রিয়ের শৈথিল্যের
নিচের শহর দিয়ে বয়ে যাওয়া চন্দ্রমুখী-নাও…
শৈবালে ঠোকর দেওয়া রাজহাঁস
উড়ে যাওয়া পাখিদের
উন্মুল ছায়ার নিচে
মম ভগবান!
নাসিমা খালা
তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি।
আব্বা আমাদের রামধন থেকে
নিয়ে গেলেন তার চাকরিস্থল
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে।
সেইখানের স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
নাসিমা খালার সাথে স্কুলে যাই।
বাসা থেকে খুব দূরে নয়।
ফেরার পরে তাদের বাসার সামনের
ফুলবাগানের বাঁশের ঘেরার উপরে
ফড়িঙ ধরি।
আমি তো ফড়িঙ ধরি যেভাবে,
সেইরকম গুপ্তপায়ে একদিন
পিছন থেকে এসে নাসিমা খালা
দুই হাতে আমার চোখ চেপে ধরল।
সেই হাত কেন রে মলিন হয় না, মন?
তার ঘরে গিয়া দেখি,
গান বাজে কিন্তু যন্ত্র নাই!
আমি নাসিমা খালাকে বলি,
গান কোত্থেকে বাজে?
সে বলে, বলো দেখি কোত্থেকে বাজে?
আমি খুঁজে পাই না।
গানের ক্যাসেট কোথায় যেন
গোপন করে রাখা!
এরপর নাসিমা খালা আমাকে দুধ খাইতে দেয়।
তাদের গ্রামের বাড়িতে দুধের খামার আছে।
সেখান থেকে প্রতিদিন
তাদের বাসায় দুধ আসে।
বসন্ত
তোমার বিবাহ ভেঙে যায়
আমার বিবাহ ভেঙে যায়
এমনই বসন্ত আজ
হায় রে
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
চোখ বেঁধে ফেলো প্রভু
আমি কোনোখানে কোনো মানুষের
হৃদয় দেখিনি কভু
আমি শুনি নাই কম্পিত রাতে
কোনো প্রহরীর হাঁক
আজি বসন্তে কালো কোকিলের
তীক্ষ্ণ মধুর ডাক
অন্ধকারের বুক থেকে এনে
চয়িত শব্দমালা
বসিয়েছি শুধু কবিতার দেহে
উদগিরণের জ্বালা
আমাকে এবার গুলি করো প্রভু
পাহাড়ে ও সমতলে
আমার শরীর লুটায়ে পড়ুক
কালো যমুনার জলে
আমিই সালাম আমি বরকত
আমি রফিকের ভাই
লেখামাত্রই আমার কবিতা
লাল হয়ে গেল তাই
এই মাঠঘাট এই বন্দর
এই মানুষের সারি
হে অবদমিত পৃথিবীর বুকে
উন্মুল নরনারী
এই বুকফাটা কান্নার রোল
আকাশ-পাতাল ধ্বনি
নিজ হাতে আমি খুবলে তুলছি
নিজের চোখের মণি
শত গোয়েন্দা-দৃষ্টির ফাঁদ
সহস্র বন্দুক
নস্যাৎ করে সম্মুখে এসে
পেতে দিয়েছি এ বুক
আমিই সালাম আমি বরকত
আমি রফিকের ভাই
লেখামাত্রই আমার কবিতা
লাল হয়ে গেল তাই
পৃথিবীর বুকে আমি সেই কবি
আমি সেই চণ্ডাল
আমি সেই লোক কালো ও বধির
আমার রক্ত লাল
আমি সন্ত্রাসী আমি ধর্ষক
আমি ধর্ষিত নারী
আমি তোরই ছেলে বুকে তুলে নে মা
ফিরেছি নিজের বাড়ি
হৃৎপিণ্ডের ঢিপঢিপ ধ্বনি
চঞ্চল রক্তের
ফিনকির মতো ছিটকে বেরিয়ে
দেহে ফিরে আসি ফের
করি লেফট-রাইট গুম করি আর
গুম হয়ে যাই নিজে
শুষ্ক রজনী কাষ্ঠ দিবস
ঘেমে উঠে যায় ভিজে
নিজের রক্ত নিজে পান করি
নিজ দংশনে নীল
নেশায় মত্ত মদের পাত্র
হয়েছে আমার দিল
আমাকে তোমার মনোরঞ্জনে
রঞ্জিত রাত্রির
কিনারায় নিয়ে ধর্ষণ করো
ধ্বস্ত করো হে নীড়
তনুর মায়ের শূন্য বুকের
মহাশূন্যতা হয়ে
বোবা পৃথিবীর বায়ুসম আমি
চিরকাল যাব বয়ে
কালোত্তীর্ণ কালের কান্না
হে মহাকালের মাটি
আমি রবীন্দ্র আমি নজরুল
ধরণির বুকে হাঁটি
কেঁপে কেঁপে উঠি শিহরিত হই
পায়ের তলার ঘাসে
মরা কোষগুলি জৈবপ্রেষণে
চিৎকার করে হাসে
সংক্ষুব্ধের সংহারসম
শঙ্কিত এই রাতে
জন্ম দিয়েছি কোরবানি তোকে
করব রে নিজ হাতে
আজানের ধ্বনি ভেসে এল ওই
পাখিদের কলরবে
একটিমাত্র গুলির আঘাতে
আমার মৃত্যু হবে
একটিমাত্র চিৎকার আজ
করব ভূমণ্ডলে
আমি বরকত সালাম রফিক
মরব মায়ের কোলে
আমাকে এবার পিছমোড়া করো
চোখ বেঁধে ফেলো প্রভু
আমি কোনোখানে কোনো মানুষের
হৃদয় দেখিনি কভু
শুধু যুদ্ধের গোলা-বারুদের
শুধু হিংসার বাণী
প্রলয়ঙ্করী পৃথিবীতে কাঁপে
বেদনা-লতিকাখানি
শেষ নিশ্বাস এত ভারী কেন
অসহ জগদ্দল
চারিদিকে মম ঘোরাফেরা করে
নায়কের মতো খল
চারদিক কেন চেপে আসে আরও
চারিদিকে বন্দুক
গুলির শব্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে
বাংলাদেশের বুক