দশকের হিসাবে জহির হাসান নব্বইয়ের কবি। প্রথম বই প্রকাশ হয় দুই হাজার তিন সালে। এবার প্রকাশিত হলো এগারো নম্বর কবিতার বই। তার আছে নিজস্ব কাব্যভাষা। নম্র ও নিচু সে স্বর। কথ্য ক্রিয়ার সাথে প্রচল শব্দের মিশ্রণে তিনি মানুষের ভিতরের শিশুপনাকে ধরতে চান। দেহ ও চিন্তার অভেদ তার কাব্যভাষার এক বড় বৈশিষ্ট্য। জহির হাসানের গদ্যভাষাও বেশ নরম। হাইকু, উর্দু কবি ইলিয়াস, রবীন্দ্রনাথের নিসর্গচিন্তা, উৎপলকুমার বসুর সাথে সাক্ষাতের স্মৃতি, কবিতা চিন্তা ইত্যাদি বিষয়ে তার আলাপ বেশ চিত্তাকর্ষী। সাম্প্রতিক সময়ে তার আঁকা ছবিও লোকের মনোযোগ পাচ্ছে। এই সব নিয়েই এক দুপুরে শিরিষের ডালপালার জন্যে অনলাইনে কথা হয় জহির হাসানের সাথে।
— মোস্তফা হামেদী
কবিদের উচিত নতুন ছন্দপথ তৈয়ার করা নীরবে। তাতে ভাষার ঘর শক্ত হয়।
মোস্তফা হামেদী
এগারোটা কাব্য হই যাইতেছে আপনার। শুভেচ্ছা জানাইতেছি আপনারে জহির ভাই। এখন আলাপের বিষয় হইলো, বই থেকে বইয়ে আপনি কীভাবে ছড়াই পড়তেছেন, আলাদা হইতেছেন?
জহির হাসান
কবিতা শুধুই চিন্তাজাত জিনিস ন। নানা সময়ে কবিতা নানা অর্থ নিয়া হাজির হইছে আমার নিকটে। সেই পথ ধরি হাঁটছি। পরে দেখি যে আলেয়ার পিছে পিছে হাঁটছি এতদিন। এই হাঁটার পিছু ফিরা নাই। কবিতা নতুন ইনসাইটের প্রতীতি দেয়।
ভাষা মেটাফরের জগৎ সেইখানে বাস্তবতা ও কল্পনা সীমারেখা আদান প্রদান করে সতত। কবিতা যত না জগতের চিন্তা-চেতনার ঘটনা তার চাইতে ভাষার যাতনা। সেই যাতনা সত্যের প্রসববেদনার মতো। কবি তাই মা হওনের বাসনা পূরণ করে কবিতা লিখি।
ফলে এক বই থাকি আরেক বইয়ে নতুন কবিতা লিখতে অসুবিধা হয় নাই। নতুন কবিতার সন্ধানে, নতুনবোধ-সংবিৎ তাড়িত হই লিখছি। আসলে কবিতা জিনিসটার অন্তরাাল বিষয়ে কথা বলা মুশকিল।
একটা বই হয়ত অসচেতনভাবেই কোনো একটা ঘোরের অধীন চলি আসে। কবিতা ভিতরে ভিতরে সেই ঘোরের লগে খাতির পাতায়ে আগাইতে থাকে। এইভাবে একটা নির্জন পথ আগাইছি কবিতায়। একটা বই আরেকটা বইয়ের থাকি স্বতন্ত্র। একটা বই আরেকটা বইয়ের লগে প্রতিযোগিতা করে না। তবে কেন জানি কিছু অচিন সীমারে অতিক্রম করে এই বোধ কাজ করে আমার ভিতর!
হামেদী
এইটা তো ঠিকই জীবন আমাদের কবিতারে নানা অভিজ্ঞতা ও চিন্তায় ভিজায় রাখে। নানা সময় নানা অর্থ নিয়া হাজির হয়। সাধারণ একটা প্রবণতা হইলো, একটা নির্দিষ্ট সময়ে লেখা কবিতারে কেউ মলাটবদ্ধ করে বইয়ে রূপ দেন। কেউ হয়তো একটা বিশেষ ভাষাভঙ্গি বা ফর্মকে গুরুত্ব দেন। কেউ হয়তো বিষয় বা প্রজেক্টরে। আপনি কখন মনে করেন বইয়ে যাওয়া দরকার? মূলত আপনার বই করার প্রসেসটা জানতে চাইতেছি।
জহির
ভাল বলছেন। ‘পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে’ আমার প্রথম কবিতার বই। আসলে এইটা আমার তৃতীয় বই। আগের দুইটা আমি ছাপি নাই। কারণ আমার মনে হয় নাই ঐ কবিতাগুলা ছাপার মতো। ঐ কবিতাগুলার ভিতর আমি বলতে যা বুঝি তা ছিল না। ঐ কবিতায় আমার শারীরিক উপস্থিতি ছিল না হয়ত। পরে ‘পাখিগুলো মারো নিজ হৃদয়ের টানে’ বইয়ে যে ফর্ম তৈয়ার হইলো দেখা দিল ঐটা আমার একান্ত নিজের মনে হইল। তখন আমি বইটা প্রকাশ করলাম। আসলে কবিতার ফর্ম কবিতার কন্টেন্টই তৈয়ার করে। আধার-আধেয় একে অপরের পরিণতি। এ বিষয়ে মতান্তর থাকতে পারে।
হামেদী
নানান প্রচলিত ছন্দ ও আঙ্গিকে কবিতা লেখার চল আছে আমাদের এখানে। আখ্যান, টানাগদ্য, সনেট ইত্যাদি নানা ধরন। যেটা ধরেন বাইরে থাকি পষ্ট বোঝা যায়। আপনার কবিতায় একটা জিনিস খেয়াল করি যে, আপনি ফর্মের এই ধরন নিয়া ঐভাবে আগান নাই। নিজের লেখার স্টাইলটাকেই কনটেন্টের মধ্যে একাকার করে নতুন নতুন সময়ে গড়ে পিটে নিয়েছেন। যেটা হয়তো সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম পার্থক্য তৈয়ার করে আগের লেখা থেকে পরের লেখার, কিন্তু ব্যাপকভাবে ভিজিবল না। এতে স্টাইলের পুনরুৎপাদন হয়ে যায় কি না কখনো কখনো? এই ব্যাপারগুলো কীভাবে দেখেন?
জহির
যা হোক প্রথম বই নিয়া আমার তত আফসোস নাই। অনেকেই আফসোস করে। ছন্দের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ দুইটা মজার কথা কইছিলেন। তিনি বলছেন, ‘ছন্দে-লেখা রচনা কাব্য হয়নি, তার হাজার প্রমাণ আছে’। আবার এইটাও বলছেন, ‘ছন্দের একটা সুবিধা এই যে, ছন্দের স্বতঃই একটা মাধুর্য আছে; আর কিছু না হয়তো সেটাই একটা লাভ। সস্তা সন্দেশে ছানার অংশ নগণ্য হতে পারে কিন্তু অন্তত চিনিটা পাওয়া যায়।’ তার মানে কী দাঁড়াইলো, ছন্দে অন্ধ না হওয়ার একটা পরোক্ষ উপদেশ এইখানে উনি দিছেন। কবিতারে কবিতা হউনের লাগি যা দরকার তার দিকে ঘোড়া ছুটানিই কবির উচিত। মানিকবাবুর ‘ঝড়ের পরে’ যে গল্পখানি উনি লিখছেন তা তো ছন্দেই। ছন্দে, অন্তমিলে কবিতা লিখলে যে আনপ্রিডিক্ট্যাবিলিটির মুখামুখি হওয়া লাগে পরে কভু এমন অজান বাক্যবোধের হাজির হয় তা এক অপারলীলের আনন্দ দেয় বটে! আহারে, নজরুল বিদ্রোহী কবিতা ছন্দে না লিখিতেন, যদি রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ ছন্দে না লিখিতেন, যদি গোবিন্দদাস কবিরাজ ছন্দে না লিখিতেন- তাইলে আমরা কী কিছু হারাইতাম!
আজ যারে আমরা কবিতা কইতেছি তা একদিন গান আছিল। কবিতা সুরারোপ করি গাওয়া হইত। পরে কবিতায় ছন্দ জিনিসটা আসে। কবিতা ও গান আলাদা হই গেল। বাংলা কবিতার ইতিহাসে বিচিত্র ছন্দের সমাগম হইছে দিনে দিনে। ছন্দ জিনিসটা কবিতায় রক্ত-মাংসের মতো ব্যবহার হইলে সমস্যা নাই। যদি ছন্দের মুন্সীয়ানা দেখানো বা অমুক ছন্দের প্রয়োগ করলাম বা ছন্দের কেদরানি দেখানোই কবিতার উদ্দেশ্য হয় তাইলে তা আর কবিতা না রয়। জীবনানন্দ দাশ পড়লে আপনি ছন্দের লয় টের পাবেন, ছন্দের নাচন-কুদন চোখে লাগে না, কানেও লাগে না, তা অন্তরে লাগে শুধু। ছন্দকে কবিতায় অন্তর্মুখী হইতে হবে। কবিতায় ছন্দ ভাইসা উঠলে তা আর রক্তের মতো কাজ করলো না!
আবার দেখেন গদ্যেরও একটা ছন্দ আছে যদি আপনি কমলকুমার মজুমদার পড়েন। দেখবেন সেইখানে গদ্যের প্রাণটা কবিতার দিকে যাত্রা করতেছে সদা। আসলে ছন্দ-লয় যুক্তভাষা ছাড়া কবিতা সম্ভবই না। ছন্দের মারফত যেন কবিতায় অলৌকিকতা জারি হয়। যেন ঈশ্বর ছন্দ তৈয়ার করছেন, আর মানুষ গদ্য তৈয়ার করছে!
ভাল করি পড়লে দেখবেন আমার কবিতায়ও তলে তলে একটা নিজত্ব অর্জনের ছন্দ কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ বন্ধনরে উতরানোর চেষ্টাও আছে। কবিদের উচিত নতুন ছন্দপথ তৈয়ার করা নীরবে। তাতে ভাষার ঘর শক্ত হয়। হয়ত আমি ভাষার ঘর রচনায় বেশি মনোযোগী। ভাল করি আমার কবিতা পাঠ না করলে, তা ধরা সম্ভব না। কবিতার মনোযোগী ডুবুরির অভাবেই আমার কবিতার অনেক পাঠকের চোখে তা ভাসা ভাসাই রই গেছে। আমার পাঠকভাগ্য খারাপ আর কি!
হামেদী
কিন্তু দেখেন, জহির ভাই, কবিতা ও গান আলাদা হইছে কিন্তু মর্ডানিটির প্রভাবে। এবং এইটাতে আমার মনে হয়, কবিতার আবেদন কিছুটা কমছে আমাদের এইখানে। সুর লালিত্য আমাদের কবিতাতেও দীর্ঘসময় একটা শক্তি যোগান কিন্তু দিয়া আসছিল। বিশেষ করে, প্রাকঔপনিবেশিক আমলে। রবীন্দ্রনাথ ছন্দের ব্যাপারে সতর্ক করছেন ঠিক আছে। কিন্তু তিনি নিজে প্রাকঔপনিবেশিক ছন্দ ও ফর্মের বড় কারবারি। আবার মডার্ন ফ্রি ভার্স তথা মুক্তছন্দ কিংবা গদ্য ছন্দেও কবিতা লিখছেন। দুই কালরে যেন তিনি মিলাইছেন এইভাবে। ফলে প্রাক-ঔনিবেশিক ফর্ম বা ছন্দরে নতুন করে বাজাই দেখাটা কি মডার্নিটির চাপ কমানোর কিংবা কবিতারে ছড়াই দেওয়ার পথ হইতে পারে না?
জহির
ভাল বলছেন। প্রাকঔপনিবেশিক আমলে পয়ার ছিল ভাবপ্রকাশের, কাহিনি কওয়ার মাধ্যম। দেখেন, পয়ারের দ্বি-পদী, ত্রি-পদী প্রকাশ হইতে বার হই আজ বাংলা কবিতায় কত বিচিত্র ছন্দের প্রচার! মাইকেল একটা ছন্দ আনলেন যা তার আগে কেহই আনেন নাই। উনি একটা মহাকাব্য রচলেন সেই ছন্দে। দেখেন, তা আমাদের প্রচলিত পয়ার হইতে একদমই আলাদা। একটা উদাহরণ দিলে দেওয়া যায় এইখানে। যেমন-
‘সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি? কি কৌশলে, রাক্ষসভরসা
ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদে —অজেয় জগতে
ঊর্মিলাবিলাসী নাশি, ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা?
বন্দি চরণারবিন্দ, অতি মন্দমতি’
খেয়াল করেন, এইখানে ৮+৬ মাত্রায় গিয়া প্রতি লাইনেই কিন্তু পয়ারের মতো ভাবের সমাপ্তি ঘটে নাই। লাইন চলতেই আছে। কোনো দাঁড়ি নাই। কমা, ড্যাশ দিয়া লাইন চলতেই আছে। প্রতিটি চারণে ৮+৬ মাত্রার রক্ষা করি পয়ার প্রবহমান রইছে। ইহা মহাপয়ার। এইটা ছিল যুগে একটা বিপ্লব ভাষার ভিতর একটা মহানিনাদ! একটা মহাভাবের উচ্ছ্বাস কেমনে কবিতায় একটা ছন্দধারণ করি আছে। বিস্ময়কর বটে! রবীন্দ্রনাথ মাইকেলের এই ছন্দরে নিছেন কিন্তু। এইটা আমাদের ছন্দ ঐতিহ্য। মেঘনাদবধ কাব্যরে উনি যৌবনে নেন নাই। মেঘনাদবধ কাব্যে রাবণের নায়ক বনে যাইবার ফলে মহাভারতীয় ধর্মীয় ভাবগন্ধ নষ্ট করার যোগাড় হইছে বিধায় ঠাকুর এইটারে নেন নাই।
মাইকেলের ছন্দের বিরোধিতা রবীন্দ্রনাথ করেন নাই। তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের ‘মেঘদূত’ কবিতাখানার শুরুটা পড়েন।
‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে
কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে।’
দেখেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ছন্দের জাদুকর ও যাদুঘর। উনি নিজে অনেক ছন্দ বানাইছেন। বাংলা ছন্দের বিকাশ ঘটছে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। আধুনিকতার আহবানরে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেন নাই। উনি মুক্তছন্দে কবিতা লিখছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘লিপিকা’ পড়েন, দেখবেন, সেইখানেও কাব্যের বিস্তার । কবিতা আকারেই আপনি নিশ্চয় পাঠ করবেন ‘লিপিকা’। রবীন্দ্রনাথ ছন্দের মুক্তি চাইছিলেন ছন্দের বন্ধনের মধ্যেই।
আমি আমার কবিতায় যে ভাষা আনি তা আমার দেহেরই কণা, আমার দেহেরই বিকল্প উপস্থাপনা। ভাষা কিছুমাত্রায় অনুবাদ।
হামেদী
রবীন্দ্রনাথ কীভাবে কাজ করছেন, তা তো বললেনই। আর তার কাজ নিয়ে আরও গভীরভাবে দেখার দরকার আছে বইলাও মনে হয়। এখন আমাদের সময়ে কবিতার ভাষা ও আঙ্গিক নিয়া কী ধরনের চেষ্টা চরিত্র করা যায়?
যেমন, আপনার কবিতায় নিজস্ব ছন্দপথ তৈয়ার করার ক্ষেত্রে মর্ডানিটিকে মোকাবেলা করার একটা চেষ্টা আমি দেখি। মরমিপনার ভাব ধরার চেষ্টা আছে। যেটাকে আমি আপনার ওপর লেখা একটা গদ্যে, ‘পাগলপনা’ বলতে চাইছি। আর কিছুটা প্রচলিত বিশেষ করে মুসলমান সমাজের আচার, বিচার, বিশ্বাস বা মিথের টুকরাটাকরা কবিতার মধ্যে চারিয়ে দেওয়ার ব্যাপার আছে। আমাদের ‘ফোক’ ঐতিহ্যের মধ্যে এমন চর্চা ছিল বা আছে। আপনার প্রেরণার উৎস কী? মর্ডানিটিকে কীভাবে দেখেন?
জহির
কোনো কিছু আধুনিক মানে তাতে ভাঙনের শব্দ লাগি আছে। ঐতিহ্যের অপর পিঠই আধুনিকতা। এই দৃষ্টির বিরোধিতা করি আমি। আমার নিজের একটা আধুনিকতা প্রতিষ্ঠা করাই আমার কবিতার অন্যতম একটা লক্ষ্য। আমার আধুনিকতা কিন্তু উত্তর-আধুনিকতা ন। আমার আধুনিকতা হইল আমার ঐতিহ্য, কওম, সমাজ, ধর্ম এইসবরে সঙ্গে থাকা, তাদেরে নানা পদে ধর্মসাহিত্য বা কওমসাহিত্য না বানাইয়া সাহিত্য করা যায় কি না সেই সম্ভবনারে বাজাই তোলা। ফলে ঐসবই আমার বিশেষ, তাদেরে চিপাই চিপাই আমার সামান্য বার করি আনার শপথ থাকে আমার কবিতায়। এই আমার বুঝ। আমার দেহচিন্তা। এইখানে আমার যে ’আমি’ সে অনেক বড় দেহধারী। সে কেবলি ঘুরি ঘুরি একা হই যায় না। এবং জলের মতো কথা কয় না! কারণ আমার আমি একা নয়। কারণ আমার ‘আমি’ তেমন আধুনিক ‘আমি’ ন। আমার যে ‘আমি’ সে যেন বড় একটা ‘আমি’রই অংশ। কোন ফাঁকে কোন খেয়ালের বশে যে সেই ‘বড় আমি’ হইতে জুদা হই গেছে। হয়ত এইটাই আমার ‘আমি’র নিয়তি। এখন সেই আমির সহিত মিলনের তাগিদ আমার শরীরের ভিতর কাজ করে। কে কানতেই আছে আমার ভিতর! বড় আমির অনুপস্থিতি আমার শরীরের ভিতর। এই যে বিচ্ছেদ আমার ‘আমি’র সহিত ‘বড় আমি’র। সেইটা বেদনাময়। এই বেদনা একাকিত্বের বেদনা ন। এই জিনিসটা বুঝতে হবে। আধুনিকতার ভিতর যে বিষণ্ণতা তা এক দিকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কড়াকড়ি উদ্যাপন। আর অপরদিকে আধ্যাত্মিক প্রশ্নে বড় আমির অনুপস্থিতি হইতে সৃষ্ট আধুনিকতার বিষণ্ণতারে ‘হুজুন’ বলা যায় না। কারণ আধুনিক মানুষ মর্মমুখীন ন। বরং তিনি মর্মশূন্যতার কথা বলেন। তার মর্মশূন্যতার উৎস অজ্ঞাত। সত্তার গভীরে শূন্যতায় ভরা। ঈশ্বরকে উচ্ছেদ করি তার অন্তরেকে শূন্য দিয়া ভরানো হইছে। এই বুদ্ধিগত শূন্যতাই তার বিষণ্ণতার উৎস। যাই হোক আধুনিকতারে এই বুঝ হইতেই আমি দেখি প্রথমত। তাই আধুনিকতা মূলত বড় আমিরে হারানোর একটা ন্যারেটিভ। মহব্বতশূন্য জগতের ভিতর নিঃস্বতার হাহাকার গান।
আমার কবিতায় ভাষার একটা প্রজেক্ট তো আছেই। কোনো ভাষা আমার শত্রু ন। বরং বন্ধু। বাংলাভাষার শত্রু নাই। বরং বাংলা ভাষার বন্ধু আর সবভাষা। বাংলা ভাষার ভিতর একটা নারীভাব কাজ করে। সে আহ্বান করে কমলমতি নারীর মতো। তাই দেখবেন বাংলা ভাষা সব ভাষারেই নেয়। ফলে এর ভিতর আরবি, ফারসি, পশতু, হিন্দি, উর্দু সবই চলে। এই ভাষার শোষণক্ষমতা বহুত। তাই এত এত অপর ভাষারে সে অ-পর করি আগলায় রাখছে নিজ আঁচলের তলে। তাই আমার কবিতায় ভাষা-সাম্প্রদায়িকতা নাই। বাংলা ভাষারে একটা বড় চেহারা দাঁড় করাইতে হইবে। ভাষারে বড় পরিপ্রেক্ষিত হইতে দেখতে হবে। কবিতায় আরবি, ফারসি দেখলে ভয় পাইলে চলবে না, সংস্কৃত দেখলেও ভয় পাইলে চলবে না। আমাদের আত্তীকরণক্ষমতা বাড়াইতে হইবে। আমাদের দিল ও দৃষ্টিভঙ্গি সহনশীলতার সহিত বড় করিতে হবে। ভাষার হরাইজন বিশাল আকাশের মতো। বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের ভাষার সংকোচনবাদী নীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। ভূখন্ড, ভাষা ও ক্ষমতা বিষয়ে ভাবনার সময় আসছে। আপনি মুসলমান হইয়া নামাজ, রোজা, পানি, ওজু, লহু শব্দ ব্যবহার করতে পারবেন না আপনার কবিতায়, এইটাই বরং ভাষাসাম্প্রদায়িকতামূলক উদ্যোগ। আপনি হিন্দুধর্মের হইলে আপনি সংস্কৃতমিশ্রিত বাংলা লিখেন তাতে আমি আপত্তি করব না। বরং আমি খুশি। কারণ সংস্কৃত ভাষার শব্দ আমার মা বাংলা ভাষা বহুত নিছে, আরও নিতে রাজি আছে। আমার মা নিতাই-এরও মা! নিতাই কাউরে ফেলে যাবে না! ভাষাসহিষ্ণুতা বাড়াইতে হবে আমাদের এই ইশারা আছে আমার কবিতায়। কবিতার ভিতরই ভাষা দিগন্তের প্রথম বিস্তার করে। একটি জাতিগোষ্ঠী তাই কবিতার দিকে তাকাই রয় নতুন একটি শব্দের লাগি।
‘আমাদের স্নেহের এ জগৎ নশ্বর, তথা চৈত্ররুক্ষ অগণন অন্ধকার সকলই, মৃন্ময় এবং অনিত্য’। গুনি দেখেন কয়টা বাংলাজাত কয়টা সংস্কৃতজাত শব্দ এইখানে! তাই বলে কী আমরা কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলীযাত্রা’র ভাষারে নিই নাই? নিছি। বরং বেশি বেশি নিছি। এই রকম সংস্কৃত প্রবাহিত বাংলা নিব, অন্তরেই রাখিব।অধম আরবি ফারসি শব্দরে আমার মা বাংলা ভাষা তার আঁচলের নিচে জায়গা দিবে বটে! এই ভরসা কবিরা করেন। কারণ কবিরই দাবি বেশি মায়ের কাছে।
হামেদী
ভাষা নিয়া আপনার এই প্রস্তাব বা চিন্তা কবিতায় টের পাওন যায়। এর সাথে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি, আপনি ক্রিয়াপদেও কথ্য বা আঞ্চলিক রূপ ব্যবহার করেন। আপনাদের সময়ে অনেকের মধ্যে এমন প্রচেষ্টা ছিল বা আছে। যখন এটা শুরু করছিলেন, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈয়ার হইছিল? ষাট দশকীয় প্রমিত বাংলার প্রবাহের মধ্যে আপনাদের এই ভাষাভঙ্গিকে কীভাবে নিতে ছিল ক’জন?
জহির
ভাষারে আমি সত্যি কথা বলতে কি একটা ভালোবাসার জায়গা থাকি দেখি। ভেদ রচি না! তখনই ফুকারিয়া উঠি যবে দেখি মানভাষা দিয়া কেহ দমন করতে চায়, মানভাষারে দমনের হাতিয়ার বানায়। তখনই মনে ক্ষণে ক্ষণে ভাষাআন্দোলন হয়। মানভাষা বিদ্বেষ আমার নাই। কোনো ভাষাবিদ্বেষই নাই। আমার আগের অনেক কবিতা মানভাষায় রচিত। আমি দেহ ও ভাষা নিয়া ভাবিত। আমি আমার কবিতায় যে ভাষা আনি তা আমার দেহেরই কণা, আমার দেহেরই বিকল্প উপস্থাপনা। ভাষা কিছুমাত্রায় অনুবাদ। মানভাষা ডাবল অনুবাদ। এখন অনুবাদে তো ভাব নিঃস্ব হই পড়ে। ফলে কবিতায় ভাব-নিঃস্বতা কাটানোর একটা উপাই হইলো আপনি শরীরে যে ভাবটা যেইভাবে আসে তারে তার নিকটতম ভাষার পথ দেখাই দেয়া। আমার মা-বাপ-পাড়াপড়শির ভাষা আমার জন্য একটা বিরাট ভাব-ভাষাসম্পদ। তাদের জবানে কথাটা কওয়াই দেহবাদীতার লক্ষণ। আমি আমার কবিতায় এইভাবে আমার দেহরক্ষা করি। আমার কওমরে চাগায়ে তুলি ভাষায়। ভাষা একটা বিশাল ব্যাপার। নানা মতের নানা পথও ভাষার ক্ষেত্রে খোলা। খেয়াল রাখতে হবে রস-ভাব-ভাষার পিরিতি যেন রহে। আমার কবিতা লই পাঠকের প্রতিক্রিয়া কম পাই। অল্পকিছু ভক্ত টাইপের কাছে জানতে পারছি আমার কবিতা তাদেরে গভীরবোধের ভিতর নিয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই যথেষ্ট! ধরেন, এই দেশের বড় বড় দৈনিক আমার কাছে লেখা চায় না, আমার ভাষার ভিতর তারা গ্রাম্যতার গন্ধ পায় বলে। আমার এখন উপাই কী! আমার বইও কোনো প্রকাশক বার করতে রাজি নয়! এখন আমি নিজেই নিজের বইগুলা বার করছি। নিজেই দোকানে দোকানে দিছি যাতে কিছু লোক যদি পড়ে এই ভরসায়। এখন তো অনেকেই লিখতেছেন। কিন্তু তা প্রায় মানভাষারই যেন অনুবাদ সেইগুলি। এ লিখার কোনো মানে নাই।
যেইখানে রস নাই, ভাষার ভিতর ভাব মরা, সে যতই আঞ্চলিকে টান মরুক ফুল ফুটিবে না, পাখি তাতে তত গাহিবে না!
হামেদী
কিন্তু, কিছু পাঠক আছে আপনার যারা আপনার কবিতারে সমাজে জিয়াই রাখতেছে। আপনার ভাষারসের আবেদন তাদের থেকে দিন দিন আরও ছড়াবে বলেই মনে হয়। যাই হোক, আপনার এই স্বতন্ত্র ভাষাচর্চার কারণেই কি আপনারে অনেক সময় লোকমুখে ‘যশোরের জীবনানন্দ’ বলতে শুনি? এই ধরনের ট্যাগের রাজনীতি কী আসলে?
জহির
জীবনানন্দ বাংলার প্রকৃতি প্রেম মৃত্যু ও জীবন ছানি ছানি লিখি গেছেন আধুনিকতার ইশারায়। উনার কবিতায় যে ইউরো-কেন্দ্রিকতা আছে সে বিষয়ে আমি সচেতন। আমি বাংলার ভাবরসের ছহি ইশারার দিকে ছুটতে চাই। সো, আমার কবিতা আর জীবনানন্দের কবিতা এক না। প্রকৃতি জীবনের পরিপূরক না আমার কবিতায়, তা জীবনের অংশ। এখন লোকজন এভারেজ চিন্তা করে। প্রকৃতির শিশির, হোগলার বন, বেতফল, অন্ধকার, হেমন্ত এইসব শব্দ আমার কবিতাতেও দেখলে ভাবে এই লোক আরেক মাত্রার যশোরের জীবননান্দ! প্রকৃতি আর জীবনানন্দ একাকার করি দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এইসব। জীবনানন্দ কবিতায় অনেক জায়গায় আসি ছাড়ি গেছেন। এখন উনি আর আগান নাই। আপনি যদি এইটা বুঝতে পারেন তাই সেই অনাবাদি জমিচাষ করতে পারেন তাতে বাংলাভাষার লাভ হইবে। তাতে আপনারে যদি আমারে জীবনানন্দ বোলায় তাতে তাদের সমস্যা। কবিতায় সূক্ষ্মরসের পার্থক্য যারা ধরতে জানে না, তারা কোনো প্রকৃত রসিক না। জানবেন, এরা কবিতার রাস্তায় কোলাহল করতে আসছে বেহুদা!
ছোটকালে আমি ক্লাসের লিখাপড়ায় ভাল ছিলাম। পড়াশোনা নিয়া থাকতাম। আর্থিক বহুত দৈন্যদশা নিয়া শৈশবে সেরকম কষ্টের ভিতরদি দিন গুজার করছি। যাই হোক, জীবিকার তাগিদে দাদা-বাপের লগে আমি কৃষিকাজ করছি বহুত। ফলে ধানের খেত, পাটের খেত, বিশাল বিশাল মাঠ আর আকাশ, গ্রামের গাছপালা, নদী, ঋতুমণ্ডলি আমার ভিতর চাষাবাদ করছে উল্টা। তো প্রকৃতির সহিত আমার যে বিশাল লেনদেন ঘটি গেছে তা আমার জীবনবোধের ভিতর ফেলনা ন! প্রকৃতি বাদ দিয়া কবিতা লিখা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। জীবনানন্দ আমাদের কবিতার ভাষারে যে উচ্চতায় নিছেন তা তো কম কবিই পারছেন। আমি মনে করি কবিতায় জীবননান্দের পথ একটা আইল পথ আজও।
হামেদী
আপনারে নিয়া লেখা একটা গদ্যে তপোধীর ভট্টাচার্য আপনার কবিতাকে কবি জসীমউদদীনের ‘আধুনিক সম্প্রসারিত উপস্থিতি’ বলতে চাইছেন। বলতে চান মুখ্য প্রেরণা। আপনার পূর্বসুরি কারা আসলে ঐভাবে? গ্রাম্য প্রকৃতির কথা বলতেছিলেন আপনি। তো আল মাহমুদেও তো এইরকম ব্যাপার আছে। আপনার কাব্য ভাষা তৈয়ারে এরা কোনোভাবে প্রভাব রাখছিলেন কী?
জহির
জসীমউদদীন ও আল মাহমুদ বাংলা কবিতার দুই দিকপাল। আমার দৃষ্টিতে এরা ইয়েটস-ফ্রস্ট এর চাইতে বড় কবি। তাদের সাথে আমারে তুলনা করলে আমার গৌরব বাড়ে বটে তাতে কমে না! আমার গুরুত্বও তাতে কমে না।
আসলে একাডেমির মানুষরা সহজ রাজপথই চোখে দেখেন বেশি। গলিপথগুলা তাদের অচিনা রই যায়।
প্রকৃতি নিয়া কিছু লিখলে তারা এর ভিতর পান জীবনানন্দ। কবিতায় পরিবার, সমাজ ও প্রকৃতির উপস্থিতি দেখলে আল মাহমুদ। পাড়াগাঁর কথা কিছু পাইলে জসীম। তো, এইসব মোটাদাগের আলোচকদের দাগানো কথাবার্তা। ঠিকাছে, প্রকৃতি কমন একটা জায়গা বটে। বাট কোনদৃষ্টিতে প্রকৃতিরে আপনি আপনার কবিতায় ছেনতেছেন তা আর চোখের ভিতর আনেন না। তো এইসব শোনা কথা মানুষ কয় আরকি! এরা ফাঁকিবাজ টাইপের পাঠক, একাডেমিশিয়ান। চোখ দিয়া ভালো করি দেখি পাঠ করেন না। পার্থক্যগুলা বুঝার চেষ্টা করতে হইবে। তাইলে নতুন সৃষ্টিরে ধরতে সহজ হইবে। আপনার শক্তির জায়গাটা কোথায় লোকেট করতে হবে। এখন আপনি যদি আমার একটা দুইটা কবিতা চাইখাই কই দেন যে উনি জীবনানন্দীয়, জসীমীয়, আল মাহমুদীয়, তাইলেই বলবো আপনার চাখারোগ আছে। শিল্পসাহিত্যকে এত হালকা করি দেখার কু-অভ্যাস আমাদের ত্যাগ করতে হবে। কোনো কবিকে জানতে হইলে তারে ভাল মতো স্টাডি করা উচিত।
আমার কাব্যভাষা তৈয়ারিতে তাদের কোনো প্রভাব নাই। তবে তাদের কবিতা আমার ভীষণ প্রিয়। তারা আমার কিছু মাত্রায় প্রেরণা তো বটেই, সাহসও।
বাংলা কবিতায় মধ্যযুগের কবিতা, আধুনিক এইসব দিকপাল কবিদের কবিতার কাছে নানাভাবে ঋণী আমি। কারণ এদের একেকজনের কাছ থাকি একেকটা জিনিস আপনি পাইবেন। ধরেন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস এদের কবিতার দিকে তাকান। বাঙলার ভাবরস কেমনে যে অকৃত্রিমভাবে ধরছেন, অবাক আর বিস্ময়কর প্রতিভা ছিল তারা। এককভাবে কারও কাছেই আমি ঋণীবোধ করি না।
হামেদী
আপনাদের সময়ে, মানে নব্বই দশকে অনেকের লেখায়ই মরমিপনা, পল্লীর বিষয়-আশয়, কথ্য ভঙ্গির ব্যবহার হয়ে আসছে। সেইখানে আপনি আপনার পথটাকে কীভাবে আলাদা করছেন? ঐ ঘরানাগুলি থেকে আপনার স্বাতন্ত্র্যকে কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
জহির
ধরা যাক, আমাদের কবিবন্ধু মুজিব ইরমের যে ভাবরসে মরমি বিষয়টা (নাও আনতে পারেন, ধরি নিলাম) তার কবিতায় আনেন। কবিতায় সে তার গ্রাম-জীবন শৈশব যেইভাবে আনে আমি কি সেইভাবে আনি? না। পড়েন । পড়লেই বুঝতে পারবেন। আমার আর মুজিব ইরমের কবিতা তো এক না। শুধু বিষয়-আশয়ই কবিতা ন। কবি-কবিতে পার্থক্য তাদের ফর্মের মধ্যকার পার্থক্যই চোখে পড়ে আগে।
যাই হোক, কবিতায় আমি প্রায় সবসময় একটা ভাবদর্শন তাড়িত। অনেকের কবিতারে শুধু ভাবতাড়িত বলেই মনে হইছে। আমার এ-বছর একটা বই বার হইছে। নাম ‘আমি ও জহির’। বইটা পড়েন। অন্তত বইটার ফ্লাপ পড়েন। রকমারিতে পাওয়া যায়। দেখবেন যে আমি এইসব কবিতায় শুধু অনুভব ভাবের কবি না। আমার ভিতর ভাবদর্শন কাজ করে। এই ভাবদর্শনমূলক কবিতার একটি শক্তিশালী ধারা। কোনো জিনিসরে দেখাই দিই আফসোস প্রকাশ করিই আমি থামি না। কবিতার ভিতর একজন নারী রয় যে জগৎ পুরুষরে খোঁজে । তার নানারূপ লীলা নিয়া সে প্রশ্নও করে। যাই হোক কবিতা তো একরৈখিক কিছু না। এইখানে নানা মালমশলার কারখানা নানা মাজেজায় কাজ করে!
হামেদী
ব্রাত্য রাইসুর কবিতাতেও কথ্যভঙ্গির ব্যবহার আছে। মাতিয়ার রাফায়েলও করছেন। কাছাকাছি সময়ে ইমরুল হাসানে কথ্য ক্রিয়াপদ ও ভাবভঙ্গিরে কবিতায় ধরার চর্চা দেখি।
জহির
উনাদের সবার কবিতাতেই কথ্যবাক্ আছে। এইগুলা লক্ষণ। মনে রাখবেন, জ্বর কোনো রোগ নায়, উহা রোগের লক্ষণ। রোগটা কী সেইটা নির্ণয় করাই ভাল বুঝমান পাঠকের কাজ। তো দেখবেন যে রাইসু , মাতিয়ার, ইমরুলের কারণগুলি আলাদা। তাদেরে এই একই প্রশ্ন করেন। দেখবেন উত্তর আলাদা। আসলে লক্ষণ দিয়া কবিতারে ধরা যায় না। কবিতার ভিতর প্রত্যেক কবির দেখবেন আলাদা সিগনেচার রয়। কন্ঠস্বর, ডিকশন, ভিন্ন ভিন্ন আগ্রহ রয়।
কবিতায় লক্ষণের সাধারণীকরণের মধ্যে হারাই ফেললে আপনি বিরাট লস গুনবেন!
হামেদী
কবি উৎপলকুমার বসুর ব্যাপারে আপনার বেশ উচ্ছ্বাস আছে। তার লগে দেখা হওয়ার স্মৃতি আপনি বেশ আনন্দের সঙ্গে প্রচার করতে পছন্দ করেন। গদ্যও লিখছেন দেখলাম। আপনার কাব্যের ঘরানা আর তার ঘরানা তো বেশ ভিন্নই মনে হয়। তার প্রতি আপনার এই টানের রহস্য কী? কোন রসে তিনি আপনারে পূর্ণ করেন, আনন্দ দেন?
জহির
সুন্দর প্রশ্ন। আসলে উৎপলের কবিতা ধরার চেষ্টা আমি নব্বই দশকে করি। বারবার পড়ি তার গদ্য, কবিতা, ছবি, গল্প ইত্যাদি। উনি তো একটা মিথ ছিলেন আমাদের কাছে। তার বাচন-ভঙিমা একদমই আলাদা। কবিতায় উনি ইন্টারটেক্সুয়াল জিনিসটা চরমভাবে আনছেন। তার কবিতায় বুদ্ধির সূক্ষ্ম ব্যবহার, উইট, হাস্যরস, বক্রোক্তি, পান, ব্যাপকভাবে আনছেন। বাংলা কবিতার ফরমের দিক হইতে উনি কবিতারে দেখতেন। উনি কমলকুমার মজুমদারের শিল্পধারা নিয়া আক্রান্ত। বাংলার ভাবরস শ্রুতিরে নিপুণ নতুনভাবে ধরছেন। উনার ভিতর ইউরোপ যেরকম ছিল বাংলাভাবও ছিল । উনার ভিতর যে কমলকুমারীয় ঐতিহ্য-ভাবচিন্তা সেইটা আমার কাছে আগ্রহের বিষয় ছিল। কমলকুমারের পরমহংসদেবপ্রীতি উৎপল নেন নাই। এইটুক বাদে কমলকুমারের সবকিছুতে উৎপলের ভীষণ আগ্রহ ছিল।
পুরানা জিনিসের প্রতি উনার ছিল ভীষণ মায়া। উনার এই মায়াবোধ দিয়া প্রভাবিত আমি তলে-তলে।
আসলে যার ভিতর মায়া ও বিস্ময় নাই তারে কবি বলি মানতেই আমার কষ্ট হয়।
হামেদী
এই মায়া ও বিস্ময় এখনকার কবিতায় খুঁইজা পান, মানে আপনার পরের কবিদের কবিতায়? এই সময়ের কবিতা নিয়া আপনার অবজারভেশন কী, জহির ভাই? কাউকে পছন্দ হয় আলাদা করে?
জহির
আছে অনেকের কবিতায়। মায়া আছে, মমতা নাই আবার এদের কবিতায়। নিজের শরীর দিয়া লিখতে পারে নাই। তবে কেউ কেউ বেশ চেষ্টা করতেছে। আমার বিশ্বাস এরা একদিন একটা উচ্চতায় পৌঁছায় যাবে। এখনও বিশাল কোনো বিষ্ফোরণ আকারে কাউকে দেখি না। তবে আমি আশাবাদী বাংলা কবিতার রংধনুতে রং যোগ তারা করতে পারবে।
আমার পছন্দের বড় বড় কবিদের সব কবিতাই আমার ভাল লাগে না। তবে এইখানে আমি নাম উল্লেখ করতে চাইতেছি না।
হামেদী
উর্দু কবিতা নিয়ে আপনার আগ্রহ/পঠন-পাঠনের কথা জানি। উর্দু কবিতা পাঠ আপনার কবিতাকে কোনোভাবে আক্রান্ত করে কি? ইউরোপীয় কবিতার লগে আমাদের যে চলমিল, এই দেশে/উপমহাদেশে চর্চা হইলেও উর্দু কবিতার লগে চলমিল মোটাদাগে খুব বেশি নাই বইলা মনে হয়। এটা কেন হইছে বইলা মনে করেন?
জহির
এইটা একটা ভাবনার বিষয়। ইউরোপ যেইরূপে আমাদেরকে তাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিমুখীন বা প্রভাবিত করতে পারছে প্রতিবেশি উর্দু ফারসি হিন্দি মালয়লাম করতে পারে নাই। এইটার কারণ আমার মতে আমাদের ভিতর একটা উৎকেন্দ্রিকতার ইমেজ বাসা বানছে। বিদেশি জিনিসে আস্থা বেশি আমাদের। দেখেন ইংরাজি কত শব্দ আমাদের বাংলার ভিতর ঢুকি বসি আছে তাতে কোনো আপত্তি নাই এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের। অথচ হালের ‘জান ও জবান’ তথা আরবি ফারসি শব্দ বাংলায় প্রবেশাধিকার নিয়া কতই না প্রতিরোধ। ইংরেজি শব্দ বাংলায় ঢুকান সমস্যা নাই। আমার আপত্তি নাই। বাংলাভাষার সেই ব্যাপ্তি আছে, সম্প্রসারণশীলতা আছে। তাইলে সমস্যা কোথায় ? এক সম্প্রদায় আরেক সম্প্রদায়রে ভালোবাসার বাহুডোরে বাঁধিতে পারে নাই যেন। হাজার বছর পাশাপাশি বসবাস করার ফলে তাদের অন্তত তো কিছু অর্জন আছে!
অতীতে এখনও দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ভিতর মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো বোনের মতো স্মৃতি আছে। কেন সেই মিলনের স্মৃতি আমাদের উদাহরণ হয় না। সদা বিচ্ছেদ ব্যবধানের স্মৃতি কোলাহলের দাঙ্গার স্মৃতি আমাদেরে গাইড করে কেন? এইটার ভিতর রাজনৈতিক বিষ আছে। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ভেদচিহ্ণগুলা সামনে না আনার রাজনৈতিক চৈতন্য আমাদের দরকার। এমন একটা পরিস্থিতি এখন এইসব নিয়া কথা বলতেই সবাই ভয় পায়। আমরা সবাই এক আত্মার দিকে ধাবিত হইতেছি- এই অমৃত ভাবকথা ভুলিয়া গেছি।
যা হোক আমি আগেও বলছি বাংলাভাষায় সবই চলে। এই ভাষা মাতৃভাবাক্রান্ত। সে সবাইরে বুকে টানে। কী সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি, হিন্দি …।
আমি মূলত উর্দু-হিন্দি জানি না। অনুবাদ মারফত পড়ি। তাতে যতটুকু পাই। মীর, গালিব, ইকবাল, ফয়েজ, ফারাজ, ইলিয়াস এরকমের অজস্র কবি আছেন উর্দু ভাষায়। প্রতিবেশি ও দেশি এইসব উর্দু কবি অনেক সিরিয়াস জিনিস নিয়া ডিল করছেন। ভাবেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ নোবেল প্রাইজ শর্টলিস্টে কয়েকবার নাম আসছে। নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে তাদের কবিতায়। আমি উর্দু গজল নজম শেরের রুবাই এর মধ্যে অনেক দুর্দান্ত ভাবরসের বস্তু পাই । অনেক বাহাস, প্রশ্ন, বিস্ময়, বিরহ, প্রেম, ঐন্দ্রজালিক জিনিসের ভিন্ন উপস্থাপনায় সন্ধান পাই যা বাংলা কবিতায়ও আছে। উর্দু কবিতার মধ্যে এইসব জিনিসের ঝাঁঝটা আলাদা। আরও অনেক বাহানার মতো জিনিস আছে। মোট কথা উর্দু কবিতার বিউটিই আলাদা। এক গালিব পড়লেই বুঝা যায় ঐসব কবিতার হাইট কী!
আমাদের উচিত প্রতিবেশি সংস্কৃতিকে জানা ও বুঝা- তা হিন্দি বা উর্দুই হোক।
বাংলার ভাবসম্পদে এইগুলা যোগ হইলে আমাদের ব্যাপ্তি আরও বাড়িবে নচেৎ কমিবে না!
হামেদী
এই আলাপ হাইকু নিয়াও করা যায়। আমাদের খুব কাছের এই কাব্য-আঙ্গিক নিয়া আলাপ মাঝেমধ্যে উঁকি দেয়। কিন্তু চর্চা ঐভাবে হয় নাই বলেই মনে হয়। পাশাপাশি দেখলে, সনেটে আমরা বহুত শক্তি অর্জন করতে পারছি।
জহির
সেই। দেখেন সনেট মালটা ইতালি আগত। বাট দেখেন বাংলা ভাষায় কতনা সুন্দর সুন্দর সনেট লিখছেন। প্রাণের থেকে কিছু নিলে তা আর বিদেশি মনে হয় না। এইভাবে হাইকু ফর্মটাও আমরা প্রতিবেশির জিনিস হিসাবেই অ-পর করি নিতি পারি।
হামেদী
আপনার আঁকাআঁকির গল্প শুনতে চাই, জহির ভাই। আগে আপনার কিছু স্কেচধর্মী কাজ নজরে আসছিল। সেটা আরও বছর দশেক আগে। বেশ কিছুদিন হইলো আপনাকে আঁকাআঁকিতে বেশ সরব দেখতেছি। এই যে কবিতা-গদ্যের পাশাপাশি শিল্পের আরেকটা মাধ্যমে ঢুকতেছেন, এইটারে আপনার অনুভবের নতুন কোনো ডাইমেনশন দেয় কী? ব্যাপারগুলা কীভাবে কাজ করে আসলে? আপনার ছবির জনপ্রিয়তা কবিতারে ছাড়াই যাইতেছে মনে হয়! লক্ষ্মণ হিসাবে এইটারে কেমনে বিচার করবেন?
জহির
ছবি তো ধরেন কবিতার পাশাপাশি আমি চর্চা করছি। ঠিকই ধরছেন। আগে ড্রয়িং করতাম। পরে পেইন্টিং এ আসছি। এখন ফাইন আর্টসে যারা পড়ে তাদের কাছে এগুলার তেমন মূল্য নাই। তারা এগুলারে আলাদা ক্যাটাগরি করে। তারা এ দেশের শিল্পচর্চার ইতিহাসের বাইরে রাখবে। কারণ ফাইন আর্টস জিনিসটাই এলিট শাসিত। এইখানে ছবির দামের চাইতে শিল্পীর দাম বেশি। বড় শিল্পীর খারাপ ছবির মূল্যও অনেক। যা হোক, আমার ছবি আঁকা খামখেয়ালির চর্চা। কিন্তু এই খামখেয়ালিটা আবার সিরিয়াস! হা, হা। একটা সাহস নিয়া ছবি আঁকতেছি আরকি! ঐ যে ভ্যান ঘগের একটা কথা আছে না- ‘তোমার ভিতর যে নিয়ত বলতেছে আমি ছবি আঁকতে পারিব না সে-ই মূলত শিল্পী। তারে চ্যালেঞ্জ নিতে বলো দেখবে সে পারবেই।’ এইটা আমার একটা ইন্সপিরেশন। ছবির ভিতর দিয়া একটা দ্রষ্টার অনুভূতি পাই আবার দর্শকের অনুভূতিও পাই। কবিতায় দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ কম। আর ধরেন একজন নামকরা আর্টিস্ট একবার কইছিলেন, যেইখানে ড্রয়িং-এর শেষ সেইখান থেকেই পেইন্টিং-এর শুরু।
আবার আরেকটা জিনিস ধরেন, শিশুরা শত চেষ্টাতেও খারাপ ছবি আঁকতে পারে না। তো এই ক্যানডিড বিষয়টা শিশুদের ছবি আঁকার প্রেরণা। শিশুদের মনটা একটা ব্লাঙ্ক পেইজ। সে তো আর আর্ট কলেজে পড়ে নাই। তারাও গভীরতা অনুসন্ধানী ছবি আঁকে আনমনে। এই জিনিসটাও আমারে সাহস দেয়। আসলে ছবির ভিতর একটা আধ্যাত্মিক প্রশান্তি পাই আমি। রঙ ও রঙহীনতার মাঝখানে কে যেন আসা-যাওয়া করে । উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির ভাবাবেশ তৈয়ার করে। আর সেই অধরার রঙ কি-বা!
হামেদী
আলাপে আলাপে অনেক সময় গড়াইলো। ধন্যবাদ আপনাকে, জহির ভাই।
জহির
কবি মোস্তফা হামেদী। আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।