কবির হোসেন’র কবিতা

শিকার ও শিকারি

নদীতে ছিপ ফেলে বহুবছর ধরে বসে আছি যে মাছটির জন্য— তার ছেলে বন্ধুদের নিয়ে এসে একদিন আমাকে দেখিয়ে বলে— ঐ দেখো, বাপের শিকার। ছিপটার ঠিক নিচেই একটি সাপ, ফণা তুলতে জানে না, ছিপের ভয়ে সেই যে মাথা পেতে রেখেছে উঁচিয়ে, আর যেতে পারেনি। কতো ঢেউ এলো গেলো, ধাক্কালো, জলের ওপর ছিপের ছায়াটিকে নিয়ে যেতে চাইলো, ছায়াটি আর গেলো না। নড়চড় নেই দেখে যে ফড়িংটি আমার ওপর বাসা বেঁধেছিল, তার ছেলে আমাকে পৈত্রিক ভিটা দাবি করেছে। এসব নিয়ে ভাবছি না অবশ্য। ভাবছি— তাকিয়ে আছি যে উড়ন্ত প্রজাপতিটির দিকে, সে কেনো যেতে পারেনি!

কাফনের রং সাদা কেন

দেয়ালের দুর্বল পলেস্তরা খ’সে মানুষের একটি সুন্দর অবয়ব ফুটে উঠেছে। অবয়বটা দেখতে ঠিক কার মত যেন মনে হয়। চেনা-চেনা লাগে। কোনো মুখোশ নেই, চামড়া খ’সে বেরিয়ে এসেছে চেহারার নির্যাস। বিমর্ষ, বিষণ্ণ এক চেহারা, আহতভঙি নিয়ে ছেপে আছে দেয়ালে। চলতি পথে হয়তো কোথাও এক পলক দেখে ত্বরিত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম— এমন দেখা-দেখা লাগছে। দেয়াল ঘড়িটা ঠিক বলতে পারবে কার হৃৎপিণ্ড নিয়ে যে সে চলছে। শুনেছি— শিকারি প্রাণির ছবি গুহার দেয়ালে চিত্রিত করে রাখতেন গুহামানবেরা। আমার দেয়ালে তবে এ কাকে শিকার করে ছেপে রেখেছি?

চেহারাটা সাদা রং দিয়ে মুছতে গেলে দেখি আমি মুছে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে!

কালো বক

কলসের পানি যতটা কম হলে একটি কাককে বক হয়ে যেতে হয়, তারচেয়েও কম পানি রেখে একটি কলস পেতে রাখি উঠানে। কণ্ঠে তীব্র তৃষ্ণা নিয়ে একটি কাক উড়ে এসে ধরা পড়ে, কলসে গলা বাড়িয়ে পানি খেতে গিয়ে বক হয়ে যায়; তারপর তৃষ্ণার কথা ভুলে হঠাৎ ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলে মাছ ধরতে নেমে পড়ে কলসে। আমরা কলসের ঢাকনা ফেলে বকটি ধরে ফেলি, এক টানে খুলে ফেলি তার উকিলের পোশাক।

বকের মাংশ খেয়ে বাবা রায় দেন— বিভিন্ন মাছের স্বাদ পাওয়া যায়।

উচ্চতর কৃষিবিজ্ঞান

ফসলি এক জমিতে ধানের গোছার মতো কতোগুলো বিল্ডিং রোপণ করা হয়েছিল। আশ্চর্য, মাটি এতোটাই উর্বর যে এক মৌসুমে সবকটা বিল্ডিংই তরতাজা হয়ে উঠলো। আবার বিল্ডিংগুলোতে ফলনও ফলেছে দারুণ— একেকটা বিল্ডিং-এ ফলেছে পঞ্চাশ কিংবা ষাট-সত্তর তলা। ফসল কাটার দিনে আরেক আশ্চর্য দেখতে পেলাম। ফসল না কেটে চাষি ক্ষেতে রেখেই ফসল বিক্রি করে দিতে লাগলো— আর লোকজন ফসল কিনে ফসলের ভেতর ঢুকে পড়তে লাগলো পরিবারসহ।

আশ্চর্য! নবান্নের উৎসব করে— ফসলগুলো মানুষ খেতে লাগলো!

নতুন জুতা

বিড়ালের লেজে পা পড়ায় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ভেবেছিলাম, চামড়ার জুতা পরলে চিৎকার করে উঠবে তেমনি কোনো গরু, ভেড়া কিংবা ছাগল। কিন্তু মনে হচ্ছে, এ যেন সাপের লেজের চামড়ায় বানানো জুতা— হাঁটতে গেলে পায়ে ছোবল মারে! বন্ধুরা বলে— নতুন জুতার এই এক বিষধর স্বভাব, দংশনের আঘাত বড়জোর ঠোসায় থাকে। তবুও হাঁটতে গেলে সাপের ভয়, চুপিচুপি যেন ছোবল মারে।

ছোবলের আরও বেশি ভয়, পথটা যদি সর্পিল হয়।

পারিবারিক পূর্ণিমা

এই গাঢ় অমাবস্যা রাতে, মা সুইচ টিপে টিপে আকাশে তারা জ্বালাতে চাচ্ছেন। চাচ্ছেন আমাদের অন্ধকার পৃথিবীতে কিছুটা আলো নিয়ে আসতে। কিন্তু সুইচ টিপে টিপে মা বুঝতে পারছেন অমাবস্যার আকাশে সবকটা তারাই ফিউজ! তবুও সবকটা সুইচই টিপে যাবেন মা। চেষ্টা করে যাবেন অগণিত তারার সর্বশেষটিও দেখে নিতে। প্রতিটা তারার বিপরীতে মা প্রতিটা সুইচ অন করে যাচ্ছেন কেবল…

একদিন নাকি আমাদের মেইন সুইচ অন হবে, আকাশেও জ্বলে উঠবে পূর্ণিমার চাঁদ!

পাল্কিতে চড়ছেন পথিকবর

কবরে গিয়ে তো আর মরেন না। ঘরে মরে থাকা আপনার শব, চার-দুগুণে আটপা ঘাড়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতটুকু পথ বাকি রেখেই কেন আপনাকে মরতে হয়? পৌনে-গন্তব্যে ঘুমিয়ে পড়া খরগোশকে ঘাড়ে তুলে দৌড়ে নিয়ে যাচ্ছে যেন একজোড়া কচ্ছপ। কচ্ছপের দৌড়কে আপনার হাঁটা বলে উপহাস, ভেঙে-ভেঙে পড়ছে আপনার পায়ে, অট্টহাসিতে। ঘর থেকে কবরের দূরত্বটুকুই আপনার না-মাড়ানো পথ, ঢুকে যাচ্ছে অন্যের হিসাবে।

বাকিতে কেটে যাচ্ছে আরেকজনের জীবন; যুদ্ধে হারিয়ে ফেলা যার এক পা এখনো অন্য পা’কে হাঁটা শেখাচ্ছে।

ডারউইনের বাসায় ডেভিড কপারফিল্ড

যতটুকু পেছনে এলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে ততটুকু পৌঁছে দেখি আমার দেয়ালটা নেই। দেয়ালের খোঁজে পেছন দিকে যেভাবে হাঁটছি, যে কেউ দেখে তার ভেতরে বিশ্বাস গড়ে নিতে পারে ভূতের অস্তিত্ব। হারিয়ে যাওয়া সেই দেয়াল, পিঠের কাঙ্ক্ষিত বিছানা যেন, যার ওপর বসে পা দুলিয়ে একজন ঘুড্ডিবালক সুতা গুটিয়ে নিচ্ছে আমাকে টেনে। সেই সুতার টানে, পেছন দিকে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে একদিন বেখেয়ালে এক বটির উপর ধপাস করে পড়ে যাই। দ্বিখন্ডিত আমি লক্ষ্য করি— আমার কোমর থেকে পা অব্ধি খণ্ডিত অংশ তড়পাচ্ছে রুইমাছের মত। কিঞ্চিৎ হেসে, দরোজায় বসে ঝিমানো এক মা’কে ডেকে বলি— মা গো… এভাবে যেখানে-সেখানে বটি দাঁড় করে রাখবেন না, বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।

জেগে ওঠা অপরিচিত প্রাচীন মা, মুখে ভার এনে বলেন— বড়শি কেনার টাকা নেই বাবা, তাই দীর্ঘদিন ঘরের কোণে পড়ে থাকা অব্যবহৃত বটিটা উঠানে পেতে রেখেছিলাম।

ব্যাপারটা বুঝি নাই

ভেবেছিলাম ব্যাপারটা হবে ঠান্ডা নেবেন নাকি গরম নেবেন অথবা কফি নেবেন নাকি চা নেবেনের মতো, কিন্তু ঘটলো সাদৃশ্য দেখিয়ে লবণের বদলে চিনি অথবা চিনির বদলে লবণ বেছে নিতে হবে। হিসাব করে দেখলাম— লবণে এসে স্বাদের সাদৃশ্য দেখিয়ে আমাকে তখন সমুদ্র বেছে নিতে হবে, সমুদ্র থেকে জলের সাদৃশ্য দেখিয়ে নদীতে, তারপর নদীর সাদৃশ্য দেখিয়ে নদীদের উঠোন হয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। বাড়িতে এসে আবার বরাবরের মতো দেখতে হবে— আমাদের চায়ের সংসারে চিনির সংকট লেগেই আছে।

অবশ্য ঘরে চিনি না থাকলে মা মাঝে মাঝে শরবতের গ্লাসে চা খাওয়ান।

কাঁটাতার

বৃষ্টির একটি ফোঁটা কাঁটাতারে কেটে দ্বি-খণ্ডিত হয়ে জল ও পানি হয়ে যায়।


কবির হোসেন

প্রকাশিত কবিতার বই:

ব্রেকিং নিউজ (২০১৮)
ভাড়ায় চালিত পা (২০১৯)
দেশলাই কাঠির অগ্নিপরীক্ষা(২০২১)
ক্ষুধার্ত মাছের স্বাদ (২০২২)

শেয়ার