কবিতা কি কেবলি ভাষা? ।। মোস্তফা হামেদী

প্রশ্ন উঠছে, কবিতা কি কেবলি ভাষা?

বছর আগে লিখেছিলাম,

“কী কথা বলে সে পাতা ও পথের সাথে
নাকি ভাষার বাইরে অজানা কোনো কারবার নিয়ে সে মেতে আছে”

এই তর্কমুখর দিনে মনে পড়ছে সেই বৃষ্টিঘন দুপুরের কথা, যখন বর্ষণের শব্দকে ভেবেছিলাম ‘বৃষ্টির মাতৃভাষা’। সেই ভাবাটা আরও ব্যাপ্ত হয় যখন কবি বিনয় মজুমদারও বলেন,

“সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা”

যেন তিনি শুনেছিলেন বৃক্ষের ভাষা। কুকুরির পিছে যে কুকুর ছোটে, গাভীর ‘হাম্বা’ শুনে যে বাছুর ছুটে আসে, তাতে কি নেই ভাষার কায়কারবার?

ফলে ভাষাকে এত ভয় কেন, হে বিহ্বল!

খাটে শুয়ে শুয়ে ভাবি, কত জরুরি এ আসবাব। কী দারুণ আবিষ্কার মানুষের। মাটি থেকে কিছুটা শূন্যে তুলে শরীরকে ধরে রেখে আরামের বন্দোবস্ত করেছে এ। ব্যবহারিক বস্তু হলেও এরও আছে কিছু ক্যারিশমা, বস্তুগুণ ও অভিনবত্ব। কত নকশা-ছুতারের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কত অভিনিবেশ জড়ো হয়ে সেটা দৃশ্যমান হয়, চোখের শান্তির কারণ হয়। আর আছে বাহারি কাঠের সমাহার। সেদিন এক কাঠমিস্তরির দোকানে বসলাম। দেখি আটটা বাটাল ছড়ানো-ছিটানো দুই ইঞ্চি পুরু এক তক্তার পাশে। রেডিওতে গান বাজছে। আর তিনি মন লাগিয়ে কাজ করছেন। জিজ্ঞাসা করি, এত বাটালের কাম কী? ‘আট রকমের কাজ এই আটটার’ বলেন তিনি। একেকটার ধরন একেকরকম, কাজও আলাদা আলাদা। প্রতিটাই অপরিহার্য। এই যে কত ধ্যান আর সৌন্দর্যবোধের মিলনে বনের বেয়াড়া কাণ্ডটি মসৃণ খাটে পরিণত হল, সেটা কি ভাবি? নাকি নিত্য দেখি বলেই সেটাকে শিল্পবস্তু বলে পাত্তা দিই না? অথবা এও এক ভ্রান্তি, নাকি অজ্ঞানতা? ফলে ব্যবহারিক ওরফে নিত্য প্রয়োজনীয় মানেই জলো বা হালকা ব্যাপার নয়। আবার শিল্পগুণ রহিত করে, তা বেমালুম (অ)পদার্থ হয়ে ওঠে না।

ভাষা সেও এক ব্যবহার্য জিনিস।খাটে শুয়ে ভয় পেয়ে প্রভুকে যে ডাকি কিংবা ভালোবেসে বঁধুটিকে, তাতে ভাষাই তো সহায়। খাইতে গেলেও ভাষা, নাইতে গেলেও। ফলে ভাষা দূর অন্তরীক্ষের কোনো প্রাণী বা নক্ষত্র নয়। আমারই প্রতিবেশী, প্রতিবেশীও নয় কেবল, যমজ ভাই। একসঙ্গে বাঁধা জীবন-মরণ। তার

” প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর”

সে যখন চুপ থাকে বা লুকিয়ে ফেলে শরীর তাকে বলি চিন্তা বা ভাব। কিন্তু যখন সরব হয়, আড়াল থেকে আলোয় আসে সাকার হয়, তখন তাকে আমি ‘ভাষা’ নামে ডাকি। আমার খেলা এই ‘ভাষা’ নিয়ে। কী লাভ এতে, কীইবা লস, সব প্রভুই জানে। আমিও জানি কিছুকিছু। কবির নিয়তিই এই। যেমন মেসির নিয়তি বাঁধা, গোল এক বস্তুর সঙ্গে, যাকে লোকে ‘ফুটবল’ নামে চেনে। ওর চোখ ধাঁধানো শটে, কী লাভ এই ভূ-বিশ্বের? এর ব্যবহারযোগ্যতাই বা কী? এই ধাঁধার মীমাংসা টানবে কে? সম্ভবত প্রভু নিরুত্তর। অথবা ফাঁস হবে না সেই উত্তরমালা।

তাহলে কবিতা কি ভাষার খেলা?

না। কবিতা ‘ভাষা’ নিয়ে খেলা। শব্দকে দাস বানানোই কবির প্রধানতম কাজ। শব্দকে খেয়ালখুশিমতো চাবকাতে পারার নামই কবিত্ব। আর এই শব্দ ব্যবহার্য বস্তু থেকে উঠে আসা একেকটি উজ্জ্বল মণি। বাক্যের ফ্রেমে কবি স্যাকরার দরদে সেগুলো বসান যথাযোগ্য লিপ্ততায়।

কবির শব্দ আসমান থেকে পড়ে না। কার্যকারণযোগে চারপাশে জন্ম নেয় তারা। চিন্তা ও বোধের সাথে মিলন ঘটে তাদের অদ্ভুত জৈবনিক প্রক্রিয়ায়। ফলে কবির কাজটা অন্য কাজ থেকে স্বতন্ত্র কিন্তু ব্যবহারিক-ই। একদম সাধারণ-ই। তাই বলে যা-তা হলেই তাকে কবিতা বলা যাবে, তা নয়। রান্নায় ঝাল-লবণ ঠিকঠাক না হলে তাতে যেমন জিভ ছোঁয়াতে আপত্তি। কবিতার বেলায়ও তাই। কী মাছ কিংবা কী বস্তু পরিবেশিত হলো, তাতে তখন কিছুই আসে যায় না। ফলে ‘বস্তুগুণ’ থাকাটা হলো সবচেয়ে জরুরি। কেননা রসনা একমাত্র ওতেই তৃপ্ত হয়।

কাব্যে ‘বস্তুগুণ’ সৃষ্টি করা বা সঞ্চার করার ভিতর দিয়েই কি কবিজন্মের সার্থকতা? নাকি আছে আরোধিক কোনো দায়?

কবিকে আমি তো ‘ভাষা সৈনিক’ বলি।কবির কাজটাই এমন, শুধু কবিতার দায় পূরণ করেই তিনি সৈনিক পদ লাভ করতে পারেন। কিন্তু পদোন্নতির জন্য তার আরেকটু লায়েক হয়ে ওঠা লাগে। জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস, কালের চলন, রাজনীতি এসবের সাথে তাকে মার্চ করতে হয়।এগুলোকে হাতের তালুতে নিয়ে খেলবেন তিনি। তাতে সহায়ক তার চিরাচরিত সেই ভাষাস্ত্র। কিন্তু সে ভাষা কলামের নয়, এনজিওর লিফলেটের নয়, বিজ্ঞাপনের নয়, অধ্যাপকের ক্লাস লেকচার নয়, বক্তৃতা বা শ্লোগানের নয়, গদ্যের নয়, সিনেমার নয়, এমনকী মানুষের কলকাকলিও নয়। সে ভাষা কবিতার। কবি এসব থেকেও রসদ নিতে পারেন। কিন্তু সেটাকে কবিতার বিশেষ ফর্ম ও প্রকাশভঙ্গির ছাঁচে ফেলে কাব্য করে তুলতে হয়। কেননা কবিতার ভাষা এক কৃত্রিমভাষা–কবির ঔরসজাত বা নাড়িছেঁড়া ধন। আর কবি শুধু ভাষা নয়, ভাষার বাইরে অজানা কোনো কারবার নিয়ে মেতে থাকেন। এই ‘অজানা কারবার’ বড় রহস্যময়-দুর্জ্ঞেয়। যেন কোনো মোহমাখা অঞ্চল মিহি পর্দায় ঢাকা। কবিতাকে পাইতে হলে এই পর্দা ভেদ করতে হয়। কিন্তু পর্দা ভেদে ব্যক্তিবিশেষের অক্ষমতা বা অনীহা থেকেই কবিতার কপালে জোটে দুর্বোধ্যতার তকমা। যদিও এতে কবির কিছু যায় আসে না।

যাবতীয় মূঢ়তা থেকে দূরে কবি তার খেলা খেলতে থাকেন।

শেয়ার