এইসব রাস্তা
যাওয়া আর আসার একই রাস্তা কিন্তু একই নয়-
এইখানে বিশাল ব্যবধানে উলটে যায়
রহস্যময় হাওয়া । ফুলতোলা জামার আস্তিনে
মুছে যায় দ্রুতগামী সকাল । বিকেলের কথা
আর কী-ই বা বলার আছে- কেবল কৌনিক দূরত্ব
বেড়ে চলে একই রাস্তার অচেনা মেরুকূলে !
আলাহিয়া
আলাহিয়া নিজেকে খুন করার পর পৃথিবীর সমস্ত আয়না
ভেঙে ফেলেছিলো-
তাকে আমি চিনি না, তবু তার কথা ভাবলে
দূরত্বকে বেশ সহজ মনে হয়। আলাহিয়া বলেছিলো-
পৃথিবীর চোখের রঙ লাল !
পতনমুখী পাহাড়ের যন্ত্রণায় খুলে যাচ্ছে মুঠিবদ্ধ হাত
তাই লাল পতাকায় চোখ বেঁধে
একদিন নিজেই সে খুন হয়ে যায়- নিজস্ব বোধের ফাঁদে !
আলাহিয়া, যাকে কখনো জানা হয়নি, তবু পুরনো চিঠির মতো
সে লুকিয়ে থাকে পলকের ভাঁজে। আর তার গল্প
বলতে গেলেই মনে পড়ে-
একটা নিশিক্ত ফুল কেমন কোরে ঝরে গিয়েছিলো,
যেভাবে একটা সবুজ বিকেলের আগে সন্ধ্যা ঘনায়
মটরশুটি
১।
স্ক্রিনে ভেসে ওঠে নাম
এইযে স্পর্শ, স্নায়ুর ভেতরে মরে যায় !
২।
পৃথিবীর সবচেয়ে তীব্র স্লোগান আমি ক্ষুদাকেই জেনেছি
ক্ষুদাই সবচেয়ে সুন্দর কবিতা !
৩।
ক্ষণিকারা চলে যাবে, এটাই নিয়ম
৪।
আমি চাইনি, তার চোখে আমার জন্য
মায়ার অনুবাদ হোক- তবু সে শাদা দেয়ালের প্রচ্ছদে
লিখে রেখেছিলো আমার নাম, ভূমিকাবিহীন !
৫।
বৃক্ষসারির মধ্যবর্তী আকাশে লিখে এসেছি-
“স্মৃতি এমন এক মোহময় সুর,
বারবার শুনেও যা অশ্রুত থেকে যায় !”
৬।
অধিকারছিন্ন রক্তজবা জানে-
বঞ্চণার বিপরীতে
কতটুকু আকাশ ঢেকে থাকে
অন্ধকার আগুনে !
৭।
একদিনে পৃথিবী কতটুকু ঘোরে
তারচেয়ে অধিক জীবন ঘুরে যায়
আহত-অশোক
গলার ভেতরে ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছে অলিভ অন্ধকার-
ভাষাহীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সম্মোহিত শোক !
আমি এখনো আছি, যেভাবে নীল হয়ে জেগে থাকে আহত-অশোক
আহত-অশোক ২
এসব দিন শ্রাবণের চোখ, সান্ধ্য আলো,
রোদ মুছে ফেলে মৃত্যুর ঘ্রাণ
সেই তো ভালো!
দূরত্বকে কাছে টানে
আহত অশোক-
থাকা না-থাকার মাঝখানে
থাকে ভুল বাস্তব !
শীত-পাখিদের আকাশ
শীতের পাখিরা আসতে চেয়েছে সন্ধ্যার বাস ধরে-
অস্ট্রিয়া, জুরিখ, সাইবেরিয়া, মিসিসিপির
এলানো পথে পথে টুকরো টুকরো স্মৃতি পালকে গুজে
পাখিরা জলের আয়নায় দেখে নেয় নিজস্ব মুখ ,
তারপর বালিয়ার চর, তুলসীপুর, সারিয়াকান্দি হয়ে তাদের কেউ কেউ
দুইদিনের পাখি-পর্যটকের চোখের আরাম হয় জাহাঙ্গীরনগরে !
অথচ আমি ওদের দিকে তাকালে আকাশকে মনে হয়
বিষণ্নতর চিঠি- তাই আমার উল্টো পা,
সন্ধ্যার বাস থেকে কুয়াশায় শীতের পাখির পতন
আমার ভাল লাগে না !
ক্যাকাফোনি
নিদ্রাচ্ছন্ন ঘোরে সে বসে থাকে, অথচ
ঘুমাতে পারে না, এরকম দ্বন্দ্বে
কেটে যাচ্ছে মুহূর্তরা- পরাজিত সৈনিকের মতো
হৃদয়ে বেদনার ফণা, অথচ বেদনার উৎস কোথায়
জানে না ! তাই অজস্র কথা বল্লেও,
তার চারপাশে ঘিরে থাকে মৌন আড়াল !
শ্যাওড়াপাড়া
আগারগাঁও পার হয়ে আরেকটু সামনে শ্যাওড়াপাড়া-
এইখানে একটি গলিতে , যেকোনো বাড়ি নয়, যে বাড়ির পাশ দিয়ে
উদ্বেল বাতাস আর রঙের মনোমালিন্যে ছায়া ঘিরে থাকে,
যে বাড়ির সম্মুখে ও ডানপাশে নতুন বাড়ি তৈরি হয় ,
যে বাড়িতে একজন থাকে অথচ বাড়িটা, তার নয় !
সে দেখে- কীভাবে সময় গলে যাচ্ছে, প্রতিবাদ প্রতিবাদ বলে,
প্রধান সড়ক ধরে মিছিল চলে যায়, সেই সাথে চলে যায় তরকারিওয়ালা,
আজ-কাল-পরশু করলা-আলু-পটল, সে কেনে অথবা কেনে না ,
তিন তলার জানালা দিয়ে দেখে- মিছিল চলে যায়, লোকেরা বাড়ি বানায়,
এবং বাচ্চাদের ‘খেলতে না-পাওয়া সময়‘ নিয়ে শৈশব চলে যায়-
মিরপুর দশ থেকে আরেকটু পেছনে শ্যাওড়াপাড়া,
শ্যাওড়াপাড়ায় বর্তমানে অসুখ বাস করে !
উপসংহারপূর্ব
তোমরা জানো সব ; জীবনের অত্যাশ্চর্য
প্রজ্ঞার আলোয় ভরে থাকে তোমাদের মুখ।
তাই কিছু বলবার নেই,
আর কিছু বোঝাবার নেই,
এখানে দাঁড়ি টেনে দেয়, সময়ের গতি থেকে বিচ্যুত,
পাথরের মতো দুটো চোখ।
মুখ
এরকম হোলো- মুখোশ থেকে বেরিয়ে এলো মুখ!
এ এক আশ্চর্য নদীময় বাঁক,
তবু কী সরল, জীবন বলতে আর
কিছুই বোঝালো না সে ;
যেসব বাঁকে হারিয়ে গিয়েছিলো
হীরা, নীলা, প্রবাল, তারা সব এখানেই আছে।
মুখোশের নীচে মুখ, বুকের গভীরে চোখ,
তাই দেখিয়েছে!
একদিন এভাবেই মুখোশের ভেতর থেকে
বেরিয়ে আসে মুখ !
শব্দের দাগ
১।
সেই বিকেলের নিরানন্দ বিদায়ের পর
পৃথিবীর সমস্ত পেয়ালার চা
ঠান্ডা হয়ে গেছে!
২।
তোমার কল্পনার ভূগোল ততদূর
বিস্তৃত কিনা জানি না,
আমার মাইলকে মাইল-
ক্লান্তি ছড়িয়ে আছে
৩।
বিবিধ অভাব আমাকে কেবল
স্মৃতিকাতর করে তুলে-
৪।
মুহূর্তের কাছ থেকে যা কিছু পেয়েছি
সেসবের খতিয়ান লেখা আছে
কালো পাথরটার ওপর, যা
একসময় আমার হৃদয় ছিলো!
৫।
স্মৃতি ও বেদনা বলে কিছু নেই,
যা আছে – অনন্তে অন্ধকার হাসি !
এই পথ, সূর্যে সূর্যে চলা, সমুদ্র
মুছে মুছে বেঁচে থাকা রক্তের স্রোত ভালোবাসি-
৬।
এভাবেই অবহেলিত প্রার্থনাগুলো আমাকে শেখালো-
‘উচ্চারণের থেকে উপলব্ধির মূল্য কত বেশি — !’
খেলা শেষ, শেষ দান
চল একদান দাবা খেলি।
– এখনো সাদা আর কালো, এখনো রাজা আর বোরে, অথচ, ঘোড়ার আড়াই চাল আমি সেই কবে ভুলে গেছি !
তাহলে তাস ?
– এখানেও সেই রাজা-রাণী-গোলাম, আচ্ছা তুমি কি জোকারকে চেন? তাসের পাতার দিকে একদিন চেয়ে চমকে উঠেছিলাম, জোকারটা হেসে হেসে বলে উঠেছিলো- সার্কাস, জীবনের সমার্থ! সেদিন থেকে আর তাস খেলি না—
সাপ-লুডু খেলবে তো নিশ্চই ?
-জন্ম থেকে একটা সাপ আমাকে তাড়া করে ফিরছে, এবারের মতো মাফ করে দাও, আমি উপরে উঠতে জানি না!
তবে এমন কোন খেলা আছে, যা তুমি আমার সাথে খেলতে পারো ?
– আমি যে খেলাই খেলতে গিয়েছি, অনিবার্য নিয়তিতে পেয়েছি ‘পরাজয়’। তবু তোমার সাথে আমি খেলবো শেষ-খেলা, চল, তার আগে করি রক্ত বিনিময়!
সন্ধ্যাশব
পরবর্তী মুহূর্তের কাছে সুখ জমাতে চেয়ে
কাটিয়ে দিচ্ছি বিষন্ন প্রহর । তবু
কিছু বিষাদের ভার হৃদয় বইতে না-পেরে
সময়ের বুকে জমে যায় ক্ষত । রক্তের ঋণ নিয়ে
তারপরও বেঁচে থাকতে হয় ! প্রতিদিন
পুরোনো চোখ যেন সদ্যোজাতের মতো দ্যাখে
পৃথিবীর নির্মোহ গতি, বদলে যাওয়া
আলো-অন্ধকারে
পরবর্তী মুহূর্তের কাছে সুখ জমাতে চেয়ে
সন্ধ্যার বিমর্ষ কিনারে ডুবে যাচ্ছে
একেকটি দিনের বেঁচে থাকা-
অলিখিত অন্ধকার
কোনো দূরবর্তী আকাশে এখনো শীতকাল-
আমি শীতের কথা ভাবতে ভাবতে আরো
হীম হয়ে আসি । নিদ্রায় নত হওয়া চোখ
ভুলে যায় ঘনিষ্ঠ স্বপ্নের পথ ।
শীতঘুম ।
ঘুমনদী ।
ক্লান্তির মুদ্রায় ঢেকে যায় সবুজ সময় ।
কোনো দূরবর্তী আকাশে এখনো একটা
মুখ জেগে থাকে ।
আমি শীতের কথা ভাবতে ভাবতে ক্রমশ
মৃত নক্ষত্র হয়ে যাই ।
পাথরের বন
তলিয়ে যাওয়া বলতে এখানে কিছু নেই,
এখানে সবটা অতল- আমি ডুবে থাকি
না-বলা কথার আঁড়ে। তিল তিল করে
সময় খাচ্ছে চোখ ; মেঘের শিশুরা এখনো
রঙধনুর সাতটি রঙ দেখেনি তবু তারা
বৃষ্টি হয়ে ঝরে। সময়ের শরীরে ক্ষত
এইভাবে মুছে যায়- তবু এখানে অতল
আর আমার ডুবে থাকার গভীরে
ভেসে উঠে মায়াফুল, পাথরের বন !
শ্বেতা শতাব্দী এষ। ২৫ বছর বয়সী এ কবির বাড়ি জামালপুর। বসবাস ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর এ কবি দীর্ঘদিন থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছেন। শ্বেতার প্রকাশিত কবিতার বই চারটি – অনুসূর্যের গান (২০১০, জলসিঁড়ি প্রকাশনী), রোদের পথে ফেরা (২০১৩, মুক্তচিন্তা), বিপরীত দূরবীনে (২০১৬, ঐতিহ্য) ও আলাহিয়ার আয়না (২০১৭, ফেস্টুন পাবলিশার্স)। বিপরীত দূরবীনে কাব্যগ্রন্থের জন্য আয়েশা ফয়েজ সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি।