কবিতাগুচ্ছ ।। উবাইদুল্লাহ রাফী

জঙ্গলে যেতে যেতে

বসে থাকি সুষম ঋতুর অপেক্ষায়, যখন মনে হলো, ওইদিকে ঘন জঙ্গলে ঘেরা শুকনা কূপ নিয়ে ধীর দুলতে রয়েছে মানুষ;— তারে নারী বলে চিনি; তারে পুরুষ বলে চিনি,— তার ভেতরে পানি সৃষ্টি করতে পারি।

মরুলোকালয়ে এতোকাল হিজড়া থাকার পর, মরুদ্যানে; জঙ্গলের নিকট, এসে শুনি হঠাৎ, ভেতরে আমাদের ফুটছে জলজ গন্ধ।

কাদার শরীর রেখেছে সুবাস গেঁথে,— আমাদের ভেতরে আমাদের পথিক পেয়ে অকস্মাৎ খোঁজ, দেহের এলাকায় প্রচার করেছে বাণী।

 

পানির প্রবাহ, ওই মরুদ্যানে, আমরা তো পারি দিতে,— করা যায় প্রাণের সঞ্চার পাইপ বসায়ে।

সুষম ঋতু আসলে সকল দিকে, আশা আমরা করবো জঙ্গলের কূপ; সেখানে আসবে পানি— বয়ে যাবে কূপ ভেঙে জঙ্গলের গায়ে, অদূরে মরুদ্যানে।

আমরা জলজ প্রাণী, আমরা মাটিভিত্তিক, আমরা থাকবো জল ও স্থলে, থাকবো প্রসারিত কূপে, দাবী করবো মরু ও জঙ্গল সকলই শুধু কূপের অধিকার— যেনো জমজম সেইদিন আর বন্ধ হয় নাই বাঁধে, যেনো জমজম প্রসারিত গোটা ধরণীমাতার দেহে।

 

 

তুমি প্রস্তাব দিলা

 

তুমি প্রস্তাব দিলা,

তীরে ঘর বাঁধার;

আমারে জেলে হবার, তুমি যার বউ।

বললাম, বাঁধি চলো।

এই চাকরী বাজারের সুদূরে, মাছ ধরে কিছু বাজারে নিতে হবে। বেচে কিনে আনবো চাল। তোমার রান্না দুইজন একই বাসনে খাবো। আমরা জানি, আমাদের বাসন হবে ভাঙা, তবু আমাদের কোনো দুঃখ থাকবে না।

আমাদের চায়ের বিলাস আমরা পূরণ করবো না, কেননা পৃথিবীতে আমরাই বিলাস; গরীব থেকেও থাকা ধনী; প্রত্যেকে প্রত্যেকের নেশা, সন্ধ্যার চায়ের অধিক।

 

আমাদের বসবাস হৃদয়ের গুহায় পরস্পরের।

মাছ সংক্রান্ত কাজে বেরোই আমি শুধু;

চুলার আগুন খুঁজতে বেরোও তুমি শুধু;

নিয়ে হৃদয়ে গোঁজা শুধু শরীরটুকু।

পরম আনন্দ নিয়ে, সাধারণ এই পৃথিবীরে আমরা পিছে হাঁকায়ে, আদিম মানুষের যুগে আমরা যেতে আছি ক্রমে—

যদিও প্রাণীর রেষ এই তল্লাটে নাই, তবু দখলের ভয়ে, জোরসে বাহুতে ধরে,

তোমারে,

আদিম করোটির কালে যেতে আছি ফিরে,

খাদ্য, প্রেম ও কামে।

 

 

রাতের কুকুর

 

ভোরবাহী এই বিদ্যুৎ; মেঘ-ঘর্ষণ, কুহকের মতো মৃদু এই ঝড়; নাই হয়ে এই থাকা ঝড়, তার তলে রাতের কুকুর তুমি, খোলাচোখ শয়নেই রহিয়াছো শুধু। ক্ষণের ভোরের তলে রাতের কুকুর, ঘেউ ঘেউ ঘেউ বলে, পুকুরের কাছেই মাছের, আরো কাছের ডেরায়, কীসের বিকর্ষণে যাও নাই ফিরে?

 

পানিতে মাছের হঠাৎ ঘাই মারা ডাক, শুনেছো প্রচুর তুলে সচকিত কান,

বালিপানিমাখা চিবুক লয়ে,

কঙ্কর ও কাদায় চিবুক গেঁথে তবু গেছে।

মীনের তরঙ্গ তো ক্ষীণ হয়ে গেলো, তুমি তো সেখানে যেনো কেন্দ্র; গুটানো।

 

গুটানো বিন্দু তুমি মিশিবে কবে, রেখা সব ক্ষীণ করে বৃত্ত হতে?

গুটায়ে নিজেরে ঝড়ে সব ঢেউ হতে, মিশিবে কেন্দ্রে কবে, আপন ডেরাতে?

 

ডেকে ডেকে দীর্ঘ ঘেউ সহসা রাতে,

না দেখে রাত্র-আকাশে মেঘভোর, কবে,

নিজের ব্যথা ও ঝড় পাথর হইতে,

আলগিয়ে ছুঁড়ে দেবে ইথার-পাথারে?

পাথারে তাদের শুধু ছুঁড়েই দেবে,

বেহালা বেহাগ নয়, তবু বেজে যাবে।

নিজপ্রাণে, নিজদেহে, কিন্তু দেহ নয়,

শোনাবে ভোরে ঢেউয়ে মাছেদের লয়।

 

 

চিরক্ষুধা

 

আমারে স্মরণে রাখো গো খেজুর কাঁটা, ভেতরে ক্রুদ্ধ থাকিয়ো শান্ত কাঁটা।

আমার কোষেতে ব্যথা গেঁথে দাও, দাগ দিয়ে দাও চির। অনুবাতে যেনো তোমারে স্মরি, হাওয়া লেগে আমি বেদনাপ্রোথিত; কেঁপে কেঁপে কেঁপে উঠি।

হাওয়াহেতু যাতে আরো গেঁথে যাই, সেরূপে করিয়ো বিদ্ধ। আমি যাতে থাকি বৃদ্ধ হলেও ব্যথার বোধেতে সিক্ত।

আমার রক্তে ঢেউ থেকে যাক, সাগর যখন ঘুম—

ব্যথার এ পথে হর্ষ যা কিছু ব্যথারই সুরতে থাম্।

আমি যেনো পাই হালকা হাওয়াও হাওয়ার মধ্যে টের, পাই যেনো টের খেচর-অহমও হাওয়ার মধ্যে ফের।

চিল উড়ে গেলো ডানার সাথে সুর ও শিকার নিয়ে,— হেঁটে যাই যেনো সেভাবে তখনো ধীর ও দ্রুতির লয়ে।

 

 

বিলুপ্ত কচ্ছপের তরে

 

কীসের ভার তার,— দৌড়কেও যার কেউ বলে নাই দৌড়!

জন্মের কালে আনীত প্যারাসুটে প্যাঁচ খেয়ে তারা আজো হয়ে আছে গ্রাস?—

নাকি ম্যামোথ-গোষ্ঠীর নতুন খলিফা কাছিম; মানুষের আদিম বোঝার শিকল দুনিয়া যাদের পায়ে কিছুটা পেরেছে পরাতে—

যে হেতু পদঢঙেই তার অঙ্কিত ক্লান্তির রূপ!

 

অজস্র বয়স তারা ধীরে হেঁটে গেছে,

পাহাড় পেরিয়ে, অগ্নিবাহী হাওয়াসহ সমুদ্রের পাড়ে—

গুঁজে থেকে মাথা, ক্লান্ত তাদের অনেকেই তথাপি উপায় পায় নাই মৃত্যুর—

মানুষের আদলে মুমূর্ষা নিয়ে তারা জাহেরে বাতেনে সুতরাং হেঁটে গেছে পথ;

চিৎ হয়ে থেকে সাগরসন্ধ্যায়, স্বঘরে জট করে দেহের, বিষাদের ভেতর কাছিম-হৃদয় ধীরতা করেছে খোদাই—

 

এইভাবে,

মানুষকালের জন্যই, এইসব মুসাফির-হৃদয়ের আশু ভার কিছু তারা করে গেছে হ্রাস। তারাই হাওয়ায় ভাসিয়েছে দোস্তির প্রাক-ইতিহাস।

তাই প্রাণ লকলকে ভাই; মানুষ ওহে, আসো, শুকরিয়া করি, কচ্ছপ আমাদের তরে মহা নেয়ামত।

 

ট্রপিক্যাল জঙ্গলে ক্রমান্বয়ে ঝড় ও রোদ তারা পেয়েছে নিয়মে

—ধ্বংসলিপ্সু; উভচর তারা, ভিজে পুড়েই মরেছে কেবল;—

অন্যোদ্ভূত বিষাদে, হয়েছে বিলোপ আধাআধিভাবে।

পাশাপাশি বহু শ’ বছর হেঁটে হেঁটে, মানুষের প্রতিবেশে ঢুকে আদিপুরুষের ক্রমে তারা খোলসের ভেতরও পেয়েছে খোলস।

ফলে তাদের ফসিল-লিখিত ইতিহাস খুবই ক্ষীণ।

 

বিষণ্ণ সংবিধানে লিখিত আমাদের অনেকটা ভাগ পায়ে, পিঠে, বুকে তারা করেছে আপন,

আর হৃদয়ের অধ্যায়ে লিখেছে,—

‘মানুষ; দুঃখের বিষ সংক্রামকারী এক গাছ; এহেন বিষে মরে যেতে পারে; নদভিত্তিক, তাদেরই অনেক শহর। উপচিকীর্ষাসমেত, বাড়িয়েছি তাই হাত’।

 

মানুষ ওহে; লকলকে প্রাণ, সুতরাং, কচ্ছপই আমাদের মরুতে মহিমান্বিত উট; আজো মানুষের আধ্যাত্মিক বাহন— প্রাণের পরম দোস্ত; ধীরতম; প্রশান্তি;— বহুকাল হৃত,

 

—চলো ভাই, মানুষ আমরা, দুনিয়া আখেরে তার দীর্ঘায়ু কামনায় তাই ফলাই নিজের অভ্যাস, পুণ্যার্জন করি এবং বেহুঁশ রাখি আমাদের আরো যতো তৃপ্ত ওজন।

শেয়ার