কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান ।। বাংলায়ন : নাঈম ফিরোজ ।। প্রথম অধ্যায়ঃ তৃতীয় পর্ব

                                            যাত্রাঃ পৃথিবীর পথে, এরপর আরো বহুদূর

 

আধুনিক চীনে মানুষের জীবন বাস্তবিক বা পার্থিব অর্থে  অগ্রসরমান। তাও অনেক মানুষ থেকে যাচ্ছে সন্তুষ্টিরহিত। এদেশে অনেকেই যেহেতু দৃশ্যমানভাবেই অজস্র ধন-সম্পত্তির মালিক বনে গিয়েছেন এখানে সাধারণ মানুষের মনে করাই সঙ্গত যে তাদের জীবনে আছে রাজ্যের অসঙ্গতি।

 

বস্তুত আমরা যাতে মন লাগাই তা দু তরিকায় এগিয়ে থাকেঃ একটা বাহ্যিকভাবে দৃশ্যমান যা অতিবড়, আমাদের চেনা জগতটাকে যা বাড়িয়ে চলে আর একটা  হচ্ছে অন্তর্গত দৃষ্টিমান বিষয় যা খুঁড়ে চলে আমাদের অতলতল হৃদয়ের গভীরের।

 

আমরা সর্বদা বাইরের দুনিয়াদারি দেখেই দিন গুজরান করি, খুব খুব কম কাটাই তাকিয়ে নিজের অন্তরপানে, নিজের আত্মার গহীনটায়।

 

কনফুসিয়াস আমাদের সুখের গোপন রহস্য যেন জানিয়ে দিচ্ছেন, মানে কী তরিকায় নিজের অন্তরেই পাবো শান্তির দেখা।

 

তার এক শিষ্য Zigong, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ “গরীব হয়েও অদীণ, ধনী হয়েও ঔদ্ধত্যবিহীন” এই কথায় কনফুসিয়াস কী মনে করেন ?‘ কারো কথা ভাবুন যিনি গরীব কিন্তু সম্পদলিপ্সু হবেন না, কিংবা এমন কেউ যে ধনী ও ক্ষমতাশালী কিন্তু চণ্ডাল বা উদ্ধত হবেন না। আপনি তা নিয়েই বা কী ভাবেন?

 

কনফুসিয়াস প্রত্যুত্তরে বলেন এটা তো খুবই ভালো, কিন্তু তাও এটা পর্যাপ্ত  নয়। আরো একটা উচ্চতর স্তর আছেঃ ‘গরীব কেউ কিন্তু সে নিজ বিশ্বাসে উজ্জীবিত, আবার ধনী হলেও ধর্মীয় আচারনিষ্ঠ’।

 

উচ্চতর স্তর দাবী করে যে একজন মানুষ কেবল দারিদ্র্যকে শান্তিময় করেই মেনে নেবেন না, উপযাচক হয়ে ক্ষুণ্ণ হয়ে সাহায্য ভিক্ষা  চাইবেন না শুধু, তার সৌম্য হতে হবে, থাকতে হবে ভেতরের সুখে সুখী, দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন যা ঘুণাক্ষরেও কেড়ে নিতে পারবে না।

 

আবার এও সত্য যে ধন-সম্পদ কখনো এই উচ্চস্তরের একজন মানুষকে অহংকারী ও আত্মগর্ববান করবে না, এতদসত্ত্বেও তিনি থাকবেন হর্ষমনে বিশুদ্ধ ও সন্তুষ্টচিত্তে বিনত। এমন জাতের মানুষ পারে সম্পদের উত্তাপে ভস্ম হওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে, পারে আত্মসম্মান ও অন্তরশান্তি ধ্রুব রাখতে। আর বস্তুত এ ধরণের কোনো মানুষকেই একজন junzi বলা চলে। এই junzi প্রপঞ্চটি অন্যান্য যেকোন শব্দের চাইতে বেশিবার দেখতে পাই The Analects of Confucius এ, যাকে কনফুসিয়াস অভিহিত করেন আদর্শ মানুষ হিসেবে, এটা হওয়ার গুণাবলি যার আছে সে-ই তা হতে পারে কেবল, তা সে গরীবই হোক আর ধনী। আজো চীনে এই শব্দ ব্যাবহার করা হয় ব্যক্তির শুদ্ধাচারের নির্ণায়ক হিসেবে এই অভিধা দিয়ে যে এই সেই আসল junzi ব্যক্তি। যেহেতু কনফুসিয়াসে দর্শনজাত শিক্ষা প্রবহমান হয়েছে তা  প্রজন্মান্তরে অনেক বিশাল অন্তরের junzi নির্মাণ করেছে যাদের কাছ থেকে শিখে আমরাও আমাদের জীবনে junzi হয়ে উঠতে চাইছি।

 

Tao Yuanming, প্রাচীর Jin Dynasty এর মহাকবি ছিলেন এই জাতীয় এক সত্তা। তিনি মাত্র তিরাশি দিনের জন্য Magistrate of Pengze এর দায়িত্বে ছিলেন, খুব ক্ষুদ্র এক বিষয়ে যিনি তার এই বড় পদবী ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। 

 

তাকে বলা হয়েছিলো তার ঊর্ধ্বতন মহল তার কাজের অনুবেদন এর জন্য একজনকে পাঠাচ্ছেন এবং ‘ tie your ribes with a belt to greet him’ ইংরেজিতে আমরা তা পড়লে দেখি এই নির্দেশ ছিলো। একদিনের জন্য হলেও তাকে স্যুট ও টাই পড়ে আগত নেতৃবৃন্দকে সম্মান জানাতে বলা হয়েছিলো। Tao Yuanming বলেছিলেন ‘I can’t bow low like a servant for the sake of five measures of rice’ ইংরেজিতে তা পড়লে দেখি এরকমই। অন্য ভাষ্যে তিনি সরকারি সামান্য বেতনের জন্য ন্যুব্জ হতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই অফিসের সীলমোহর পেছেনে ফেলে তিনি নিজবাড়ি ফিরে আসতে পেরেছিলেন। এরপর ফিরে তিনি লিখেছিলেন যা তিনি বধ করেছিলেন সেসময়। তিনি বলেছিলেনঃ “যেহেতু আমার অন্তর আমার শরীরের দাস হয়ে গেছে, আমি নিঃসঙ্গ ও আশাহত বোধ করছি।“ তিনি অনুভব করেন শুধু একটু ভালো খাওয়ার জন্য এবং ভালো কোথাও মাথা গোঁজার জন্য, নিজেকে অসম্মানিত করা, নতজানু হওয়া আর সুবিধা প্রাপ্তিতে নিজেকে বিকিয়ে মোসাহেবি করা ছাড়া তার আর কোনো গতি ছিলো না। তিনি সেই জীবন চাননি, “আমি জানি ফিরতে পারবো না আমার অতীতে, কিন্তু আমি আমার ভবিষ্যতকেও জানি  এবং তার অনুগামী হতে আমি পারবো ঠিকই” এই অনুভবে তিনি আবার তার প্রিয় গ্রামে ফিরে আসেন।

 

Zigong আবার কনফুসিয়াসকে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেনঃ “এমন  কোনো শব্দ আছে যা সকলকে সারাজীবনের জন্য পথ দেখাতে পারে?” আপনি কি আমাকে একটা সেরকম শব্দ দিতে পারেন, যেটা আমি মরে যাবার আগে অব্দি ব্যাবহার করে যেতে পারবো এবং দিক-নির্দেশনা পেতে থাকবো?

 

কনফুসিয়াস উত্তরে তার চিরচেনা স্বরে বললেনঃ “যদি সেরকম কোনো শব্দ থেকেই থাকে তবে তা সম্ভবত shu, বা ক্ষমাশীলতা।

 

কিন্তু এটা দিয়ে আমরা কী বুঝবো আদতে? কনফুসিয়াস বলে চলেনঃ “নিজে আশাও করি না এমন কিছু অন্যের উপর চাপিয়ে না দেয়া” মানে আপনি কাউকে এমন কিছু করতে বাধ্য করতে পারেন না যা আপনি নিজে হলে করতেন না। কেউ যদি সারাজীবন এই একটি কাজ করতে পারে তবে তাই যথেষ্ট। 

 

এবং একারণেই বলা হয় ‘With half a book of The Analects of Confucius’ I can govern the Empire’ কখনো-সখনো একটি শব্দ বা কিছু শব্দ সারাজীবন আমাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট।

 

কনফুসিয়াস একজন সত্যিকারের সন্ত। তিনি আপনাকে অনেক কিছু মনে রাখতে বলবেন না, মাঝেমাঝে তার একটি শব্দই আপনার মনে রাখার জন্য যথেষ্ট।

 

কনফুসিয়াসের শিষ্য Zengzi একবার বলেছিলেনঃ

“শিক্ষকের পথ হবে অন্যের সর্বমঙ্গলের জন্য উৎসর্গিত এবং অন্যকে পরিমাপের জন্য নিজেকে মাপকাঠিতে পরিণত করা। এই হলো সারকথা।“

 

কনফুসিয়াসের শিক্ষাকে দুটো শব্দেই করা যেতে পারে পরিস্রুতঃ ‘বিশ্বস্ততা’ এবং ‘ক্ষমাশীলতা’। সহজে বুঝালে, আপনাকে ‘আপনি’ হয়ে উঠতে হবে, কিন্তু একইসাথ আপনাকে অন্যদের ব্যাপারে আন্তরিক হতে হবে।

 

ক্ষমাশীলতা, এই শব্দটি দিয়ে কনফুসিয়াস বুঝিয়েছেন আপনি শক্তি দিয়ে লোককে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করাতে পারেন না, বা তাদের মনে আঘাত দিয়েও আপনি কিছু করবেন না। অধিকন্তু কনফুসিয়াস ক্ষমাশীলতা বলতে বুঝিয়েছেন যে অন্য কেউ যদি আপনাকে কষ্ট দিয়ে এমন কিছু করেও তবে আপনাকে খুব করে এমন কিছু করতে হবে যাতে আপনার ‘সহনশীলতা’ প্রকাশ পায়।

 

কিন্তু আমাদের নিকট এটা আসলে করার চেয়ে বলাই সহজ বলে প্রতিভাত হবে। যখন কোন অবৈধ বা অন্যায়কাজ ঘটে আমরা সেটাকে ধ্যানস্থ হয়ে উতরে যেতে সক্ষম হই না। এবং এই ব্যর্থতায় আমাদের বারবার হতে হয় আহত ও পরাহত।

 

বৌদ্ধ ধর্মে একটা মজার গল্প আছেঃ

দুজন বৌদ্ধভিক্ষু তাদের পাহাড়-টেম্পল থেকে নেমে এলেন মুষ্টি ভিক্ষা করতে সমতলে। যখন তারা নদীর পাড়ে পৌঁছালেন তারা এক বালিকাকে দেখতে পেলেন, যে ঐ নদী পাড় হতে না পারার দুঃখ নিয়ে ঠায় বসেছিলো ওখানটায়। বয়ঃভিক্ষু বললেনঃ “আমি তোমাকে আমার পিঠে চড়িয়ে ওপারে নিয়ে যেতে পারি”। এবং তিনি বালিকাটিকে তার পিঠে সওয়ার করে নদী পার করে দিলেন। এদিকে বিস্ময়বিমূঢ় তরুণ ভিক্ষু অবাক হয়ে এ ছবি প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আর কিছুই তেমন করতে পারলো না। সে কোনো প্রশ্ন অব্দি করবার সাহস করে উঠতে পারলো না আর। তারা আরো বিশ ক্রোশ হেঁটে গেলো সামনে। কিন্তু আর তো পারা যায় না কৌতূহল চেপে চলতে, তরুণ সে ভিক্ষু  জিজ্ঞাসা করেই ফেললো বয়ঃভিক্ষুকেঃ “গুরুজি আমরা ভিক্ষু, আমাদের তো নারীস্পর্শরহিত থাকার কথা, আপনি কিভাবে এক বালিকাকে পিঠে সওয়ার করে নদী পার করে দিতে পারেন?”

বয়ঃভিক্ষু সুস্থির কণ্ঠে বললেনঃ “তুমি দেখেছো আমি তাকে কী করে নদী পার করেছি এবং অবরোহণ করিয়েছি। কিন্তু তুমি কী করে এই চিন্তা এতদূর বহন করে আনলে কিন্তু এখনো মাথা থেকে নামাতে পারলে না?”

 

এই গল্পের মর্মকথা অবিকল কনফুসিয়াস আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন তাঃ যখন ঝেড়ে ফেলতে হবে কোনোকিছু কালক্ষয় না করে তা নিমিষেই ঝেড়ে ফেলুন। অন্যকে ক্ষমা করে বা অন্যের প্রতি সহনশীল হওয়ার মানে নিজে হালকা হওয়া ও নিজের মধ্যে ধনাত্মক বিষয়বস্তুর প্রবেশ সহজ ও সুপ্রশস্ত করে দেয়া, সহজ, সত্য!

(চলবে…)



আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার