কনফুসিয়াস ফ্রম দ্য হার্ট । ইউ ড্যান ।। বাংলায়নঃ নাঈম ফিরোজ ।। প্রথম অধ্যায়, দ্বিতীয় পর্ব

যাত্রাঃ পৃথিবীর পথে, এরপর আরো বহুদূর

 

The Analects of Confucius পড়তে পড়তে আমরা দেখবো যে কনফুসিয়াস ক্বচিৎই তাঁর শিষ্যদের সাথে রুক্ষভাষ হয়েছেন। সাধারণত তিনি তাদের সাথে শান্তভাবে সরল ভঙ্গিমায় সূত্র ধরিয়ে দিয়ে কথা বলতেন, যাতে তারা নিজেরাই সমস্যার সমাধান পেতে পারে। আমরা তো দেখি কোনো কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কড়া কথা শোনান এবং তাদেরকে এটা-সেটা করতে বা না করতে বলে থাকেন। এটা ঘটে যখন একজন শিক্ষক হয়েও তিনি প্রত্যাশিত ‘শিক্ষাগুরু’ হয়ে উঠতে পারেন না। একজন প্রকৃত যুৎসই শিক্ষক হবেন কনফুসিয়াস এর মতো, যিনি নম্ররূপে তার প্রজ্ঞা শিষ্যদের সাথে ভাগাভাগি করেন, যাতে গুরু-শিষ্য সবাই একযোগে চিত্তঙ্গম করতে পারবেন স্বর্গ, দুনিয়া আর মানবতা – ৩ টি জগতেই বিকাশ ও অগ্রায়ন এর জ্ঞান।

 

এই সৌম্য, শিষ্ট, ধীমতিবোধ ও বিনয়ী সাম্মানিক আচরণই আমাদের সবার অভীষ্ট হওয়া উচিত। The Analects of Confucius হচ্ছে এই আদর্শের প্রতীক। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে স্বর্গ , দুনিয়া ও মানবতাকে আমাদের অন্তরে যথার্থ প্রোথিত করে আমাদের অনন্ত হিম্মত প্রদানের জন্য কনফুসিয়াসের দর্শনকে আমাদের অন্তরে প্রবেশের জায়গা করে দেয়া। চীনে প্রায়শই বলা হয় যে, একটি জাতি টিকে থাকতে ও এগিয়ে যেতে তার উপর ঈশ্বরকে সুপ্রসন্ন থাকা চাই, অন্তে ইহার জনগণকেও শান্তিপ্রিয় থাকা চাই। এই কাজে সুস্পন্দ ভারসাম্য বিধানে কনফুসিয়ানিজমই আজ আমাদের দিশা হতে পারে। এ থেকে আমরা বিপুল শক্তি পেতে পারি যা কেবল মেলে কনফুসিয়াসের মতো মানুষের অন্তরাত্মা থেকেই। এই শক্তিকেই আরেক চৈনিক দার্শনিক Mencius, যিনি কনফুসিয়াসে পরবর্তীকালে জন্মেছেন এবং কনফুসিয়ানিজমের বিকাশে কাজ করেছেন, তিনি আখ্যা দিয়েছেন ‘the noble spirit’ বলে। মাত্র যখনই স্বর্গ, দুনিয়া ও আর মধ্যস্থিত সবটাই একজন মানুষের অন্তরে একীভূত হয়, তখনই সে এই শক্তিমত্তা অর্জন করতে পারে। মানবতা ও স্বর্গ একীভূত বলে আসলে এই বই কী বোঝাতে চায়? এই বইয়ে উহা এক বলতে বোঝানো হয়েছে মানবকল্যাণ ও প্রাকৃতিক জগতের লাগসই সমমেল।

 

একটা ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে আমরা খুবজোর কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যিকারের ‘ভারসাম্য’ কী? এটা কোনো ছোটো বাড়িতে ভারসাম্য থাকা না থাকার চেয়ে বেশি, আর এটা মানুষের নিজেদের মধ্যে সৌজন্যমূলক ব্যাবহারের চেয়েও বেশি। এটা অবশ্যই সামগ্রিক প্রাকৃতিক জগতকে অধিভুক্ত করে, ভারসাম্যপূর্ণভাবে এই পৃথিবীতে একত্রে বাঁচতে ও বেড়ে উঠতে। মানুষের প্রাকৃতিক জগতের প্রতি দরদ অনুভব করা উচিত এবং এর ছন্দ বুঝতে ইচ্ছুক থাকা উচিত।

 

এ এক প্রকার শক্তি। আমরা যদি এই শক্তিকে বশে আনতে এবং এটাতে নির্ভর করে চলতে জানি, তাহলে আমরা কনফুসিয়াসের মতো বিশালপ্রস্থ মনের অধিকারী হতে পারবো। কনফুসিয়াসের আচরণ ছিলো অতীব শিষ্ট, যদিও তার অন্তরাত্মা ছিলো প্রয়োজনে দুর্দান্ত কঠিন। এমনটা ছিলো কারণ তার সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিলো গভীর শক্তি । তার ছাত্র Zigong জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটি দেশের শান্তির জন্য ও  সুস্থির সরকার এর জন্য কী কী শর্ত? কনফুসিয়াসের উত্তর ছিলো খুব সাধারণ । সেগুলো হচ্ছে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ ও সাধারণ মানুষের বিশ্বাস।

 

প্রথমত, আভ্যন্তরীণ রাষ্ট্রযন্ত্র হতে হবে শক্তিশালী, এর পর্যাপ্ত সামরিক শক্তি থাকতে হবে আত্মরক্ষার জন্য।

দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্ত খাবার ও পোষাকের মজুদ থাকতে হবে, যাতে মানুষের অভাব না হয়।

তৃতীয়ত, সাধারণ্যের রাষ্ট্রের উপরে আস্থা থাকতে হবে।

 

এই ছাত্রটি সর্বদা অদ্ভুত প্রশ্নই করতো। সে বললো, তিনটা শর্ত অনেক বেশিঃ আমাকে বলুন যদি একটাকে ছাড়া কাজ চালাতে হয় কোনটা বাদ দেবেন?

কনফুসিয়াস বললেনঃ ‘অস্ত্রশস্ত্র বাদ দিতে পারো’। আমরা সামরিক নিরাপত্তা ছাড়াই চলবো।

 

Zigong আবার জানতে চাইলেনঃ যদি আপনাকে আরো একটা বাদ দিতে হয়, আপনি কোনটা দেবেন বাদ?

কনফুসিয়াস সমগ্র সতর্কতার সাথে বললেনঃ ‘খাবার বাদ দিতে পারো’ আমরা খাবার না খেতে রাজি আছি।

কনফুসিয়াস আরো বললেনঃ ‘সময়ের প্রারম্ভ হতেই মৃত্যু আমাদের সাথে সাথে রয়েছে । কিন্তু যখন কোনো প্রতীতি না থাকবে তখন সাধারণ মানুষের দাঁড়ানো জায়গামাত্র থাকেনা।‘

খাবার ছাড়া মৃত্যুই অনিবার্য কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে আজ অব্দি মৃত্যুকে কি কেউ ফাঁকি দিয়েছি? অতএব, মৃত্যুই একমাত্র খারাপ জিনিস নয় যা ঘটবে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে ধ্বস্ত ও ভেঙ্গে পড়া – যা ঘটে তখনি, যখন একটি দেশের জনগণ তার উপর থেকে আস্থা হারায়।

 

বৈষয়িক বিবেচনায়, সুখী জীবন একটানা কতগুলো উদ্দেশ্য অর্জন করা ছাড়া কিছুই না, কিন্তু সত্যিকারের শান্তি ও স্থায়িত্ব আসে মানুষের ভেতর থেকে, তা আসে যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে তাকে স্বীকার করা থেকে আর এই স্বীকার বিশ্বাসপ্রসূত।

 

এই হচ্ছে সরকার নিয়ে কনফুসিয়াসের ধারণা। তিনি বিশ্বাস করেন আস্থার শক্তিতেই একটি জাতি একতাবদ্ধ থাকতে পারে ।

 

একবিংশ শতাব্দীতে উপনীত হয়ে আমরা দেখি যে বিভিন্ন রাষ্ট্রে মানুষের জীবনমান নিরূপণে কেবল GNP(Gross National Product) এর সাধারণ মাপকাঠিই যথেষ্ট নয়।

 

এটা বুঝতে হলে আপনাকে তাকাতে হবে GNH(Gross National Happiness) এর দিকেও। অন্যকথায় একটি দেশ আসলেই শক্তিশালী ও ধনী কিনা তা বোঝার পরিক্রমায় শুধু এর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচক  বা দ্রুতিই না , আমাদের প্রত্যেক সাধারণ মানুষের কতিপয় প্রশ্নাকুল অনুভূতিকে পড়তে হবে- আমি কি নিরাপদ বোধ করছি ? আমি কি সুখী? যে জীবন যাপন করছি তা দিয়েই কি আমাকে চেনা যায়?

 

১৯৮০র শেষ দিকে চীন একটি আন্তর্জাতিক জরিপে অংশ নেয়, যা দেখায় যে সেসময় চীনের মাত্র ৬৪ শতাংশ মানুষ সুখী ছিলেন।

 

১৯৯১ সালে এরকম আরেকটা জরিপে চীন আবার অংশ নেয় এবং তা আগের চেয়ে সুখের সূচকে বেশি সংখ্যক অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ মানুষকে সুখী হিসেবে চিহ্নিত করে। এটা মানুষের জীবন যাপনের মানোন্নয়ন এবং সেসময় জুড়ে রাষ্ট্রে নানামুখী সংস্কার সাধনের প্রতিফল হিসেবে আসে। কিন্তু কালক্রমে আবার তা ৬৪ শতাংশে পড়ে যায় ১৯৯৬ সালের এক জরিপে।

 

তাই ইহা এক ধাঁধাঁটে ব্যাপার। এতে প্রতিভাত হয় যে, সমাজ যখন বৈষয়িকভাবে ও সাংস্কৃতিকভাবে অগ্রসরমান, সে সময়কালেও সমাজের এইসব উন্নতির সুবিধাভোগী মানুষেরা অদ্ভুতভাবে এক আত্মিক বিপন্নতায় দিনাতিপাত করতে পারেন।

 

এখন চলুন আড়াই হাজার বছর আগ থেকে একটু ঘুরে আসা যাক, এবং দেখা যাক সেই অনুন্নয়নকালেও কেমন ছিলেন সন্ত মানবেরা আর বিজ্ঞজনেরা।

 

কনফুসিয়াস তাঁর এক ছাত্র Yan Hui এর উপর সুপ্রসন্ন থাকতেন। তিনি তাঁর এই শিষ্যকে এভাবে তুলে ধরেন আমাদের সামনে-

“কী অম্লান Hui! সামান্য কুটিরে থেকে, একবাটি ভাত আর একঘট পানি নিয়ে যে সাধারণ দিনযাপন তাকে অনেকেই দুর্বহ ভাববে, কিন্তু Hui এগুলোকে তার জীবনের অপার আনন্দকে ম্লান করতে দেয়নি। কী অম্লান এই Hui!” (Analects VI)

 

Yan Hui এর পরিবার ছিলো ভীষণ দরিদ্র। ক্ষুধা মেটানোর যথেষ্ট খাবার আর পরিধানের পর্যাপ্ত বস্ত্র তাদের সংস্থানে ছিলো না, বসবাস করতো তারা অপরিষ্কার ও ক্লিন্ন এঁদোগলিতে। অনেকের জন্য এ ক্ষতক্লিষ্ট জীবন হবে গলগ্রহ, তথাপি সেই Yan Hui এসবের নিচেও অসুখী হয়নি মোটেও।

 

হয়তো অনেকেই বলবেঃ “এই তো জীবনের নিয়ম, আমাদের এ জীবনই বয়ে যাওয়া নিয়তি, অন্নহীন হই আর প্রাচুর্যশালী, এ জীবনকে নিয়ে আর কীইবা গতি?”

Yan Hui এর যে দিকটা বাস্তবিকই প্রশংসার তা এই নয় যে সে অসহ্য কষ্টের জীবন মেনে নিতে পেরেছিলো, কিন্তু আসল ব্যাপারটি যা, তা হচ্ছে তার সেই দুঃসহ পরিস্থিতিতে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটি। যখন সবে জীবনের নারকীয়তা নিয়ে অনাবশ্যক অনুযোগে মেতেছিলো, তখন Yan Hui এর আশাবাদ ছিলো অনড় ও অফুরান।

 

আমরা প্রত্যক্ষ করলাম যে, আদতে আলোকিত মানুষেরাই বৈষয়িক বস্তুদাস না হয়ে জীবন রাখতে পারে নির্বাধ এবং শান্ত, তারাই মোহমুক্ত থাকে প্রথম থেকে শেষাব্দি জীবনে, উদাসীন থেকে যায় সুনাম-বিকার ও ব্যক্তিক প্রাপ্তির দুর্মর বাসনা থেকে।

 

নির্দ্বিধায় তাদের দিকেই তাকিয়ে বলে দিবেন আপনি, সত্য তাই তো, কেউই তো চায় না জীবন বহন-অযোগ্য হয়ে পড়ুক এবং সাথে সাথে এও উচ্চারিত হবে আপনারই কন্ঠে, শুধু বিষয়-সম্পত্তি জড়ো করে করেই আমাদের ভেতরটা নস্যাৎ করতে থাকা আত্মিক ক্ষত আমরা সারাতে পারছি না তো।

(চলবে)



আগের পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার