ঠিক বই করবো এমনটা ভেবে যে লেখাগুলোর শুরু হয়েছিলো, তা নয়। বিভিন্ন সময়, নানান উছিলায়, অকারণেই কখনও-বা, এদের জন্ম। কী নাম দেবো এদের? কবিতা? গদ্য? গল্প? …জানি না। এ এক পদের রচনা। কারো কাছে কবিতা হয়তো-বা, কারো কাছে গল্প, কারো কাছে হয়তো ব্যক্তিগত গদ্য। আমি কেবল জানি এসবের ভেতর দিয়ে আমি আমাকেই প্রকাশ করেছি। একটু একটু করে, দিনে দিনে এ লেখাগুলো জমেছে। ঘুরে-ফিরে পাঠ করবার সময় প্রায়ই মনে হতো এগুলোরও গ্রন্থভূক্ত হওয়া প্রয়োজন। এ বছর বই করার সম্ভাবনা প্রায় ছিলোই না বলা যায়। মায়ের মৃত্যু-প্রেমিকার রহস্যময় নীরবতা-নিজেকে হারিয়ে খোঁজা, নিঃসঙ্গতা… এগুলোই হয়তো লেখাগুলোর প্রাণ। ভীষণ রোদের দুপুর যেন মাথার উপর।
এই বটগাছ কি আমার মা? আমার প্রেমিকা? আমার হারিয়ে যাওয়া আমি? জানি না। শুধু জানি ভীষণ এই দুর্বিপাকে মাথার উপর একটু স্নেহের, একটু প্রেমের, একটু ভালোবাসার আন্তরিক ছায়া খুব প্রয়োজন।
তুমি যে কে জানি না। আজ, ছায়া হয়ে এসো বটগাছ!
-বিধান সাহা
কবি, চিত্রকর বিধান সাহার প্রথম কবিতার বই ‘অব্যক্ত সন্ধির দিকে’ প্রকাশ হয় ২০১৫ সালে; চৈতন্য থেকে। বিধানের দ্বিতীয় বই প্রকাশ হচ্ছে এবারের মেলায়। নাম ‘এসো বটগাছ’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন রাজীব দত্ত। এই বইয়ের রচনাগুলো কোন শ্রেণিভুক্ত – তা তিনি পরিস্কার করেননি। কবিতা? গদ্য? না কবিতা আর গদ্যের মাঝামাঝি কিছু? সেসব অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিধান কি লিখেছেন অর্থাৎ টেক্সটাই ধর্তব্য। লেখাগুলো কোন শ্রেণির, তা পাঠকই ঠিক করে নিক।
০১.
কিছু কিছু ঘটনা থাকে, ঘটমান-বর্তমানে সে বিষয়ে কিছুই অনুভব করা না গেলেও পরবর্তিতে স্মৃতিতে সেই ঘটনাটা ফিরে ফিরে আসে আর নানান আতঙ্ক ও শিহরণ ঘিরে ধরে। এই যেমন, রাজু’দার বৌ-ভাতের দিন, মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসা হলো। হাই-ওয়েটের কারণে চারতলা থেকে লিফট ছিঁড়ে পড়ে যাওয়া। বেঁচে আছি তবু। একেবারে অক্ষত। ঘটনা ঘটার সময় তেমন কিছুই মনে হয়নি। একেবারেই না। তারপর, যত সময় গেছে, সেই অনুভূতিটা, ভয়ংকরভাবে ফিরে ফিরে এসেছে। কীভাবে মানুষ বোঝাই একটা স্টিলের বাক্স সাঁই করে নিচের ভূমিতে গিয়ে আঘাত করলো – মগজের কোষে কোষে এখনও সেই রোমহর্ষক অনুভূতিটা ফিরে ফিরে আসে আর হৃদস্পন্দন আরো শীতল থেকে শীতল হয়ে যায়।
মৃত্যু আসলে এক-পংক্তির এক সলিড কবিতা।
০২.
ওসব কালিপূজো-টুজো নয়, সেদিন একটা উৎসব দেখতে গিয়েছিলাম রমনায়। গিয়েছিলাম একটা উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষের সমাগম, তাদের সংস্কার আর আনন্দ দেখতে। আমার এসব দেখতেই ভালো লাগে। যখন দেখি অথর্ব এক পিতাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসছে তার ছেলে আর ছোট্ট নাতি, তখন আনন্দে মনটা নেচে ওঠে। দেখি আর ভাবি – কে বলে নষ্ট হয়ে গেছে সব? এই ঘনআঁধার রাতেও শ্রদ্ধা আর আন্তরিকতার এই যে দৈবআলো, ওই তো দেখা যাচ্ছে, খুব নিভৃতে তা ছড়িয়ে পড়ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
অর্ন্তজগতের নীরব প্রদীপে কারো আজ আগুন জ্বলুক।
০৩.
ফেরার পথে, কারওয়ান বাজারে, বসুন্ধরার সামনে, এক বেঢপ মহিলা সেলফি তুললো। যেন মহাকালের গহ্বরে এ-ই একমাত্র বিজ্ঞাপন তার। ভ্লুম ভ্লুম করে সিএনজি স্টার্ট নিচ্ছে, আর আমার মনে পড়ছে, সময় শেষ; যেতে হবে। কন্ট্রিবিউটর ছেলেটা ঘুরে বেড়াচ্ছে হারমোনিকা হাতে। পকেটে কে যেন হাত দিয়েছিলো, তাই নিয়ে একটা জটলা। মনে হলো, একটা মৃত মানুষ ঘিরে অজস্র কৌতুহলী চোখ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একটু উঁকি দিতেই একটা হলুদ হেলিকাপ্টার সাঁই করে উড়ে গেলো। নির্গত ধোঁয়ার রেখায় যে পথ রচিত হলো, তা সোজা চলে গেছে অনন্যাদের বাড়ি। মনে পড়ে, বহুদিন প্রাণভরে তাকে অনু অনু বলে ডাকা হয় নি। সেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নিরুপায়। একটা গোপন পাতায় মিছেমিছি কতিপয় অভিমান নিঃসঙ্গ পড়ে আছে।
জাদুকর, সে কি তোমার অভিমানের ভাষা বোঝে?
০৪.
বুদ্ধিস্থবির অবস্থায় মানুষ বুঝি দর্শক হয়ে ওঠে? এই যেমন টের পাচ্ছি লুজট্যাপ থেকে অনবরত টপটপ টপটপ করে জল পড়ছে। মাথার উপরে সিলিং ফ্যান ঘোরার শো শো আওয়াজ একটানা চলছেই। পাশেই, ফেসবুকে চ্যাট করছে কেউ। কী-বোর্ডের খট খট শব্দগুলো আলাদা আলাদা রিদমে কানে এসে পড়ছে। পাশের ইউনিটে, মিড-সাউণ্ডে কেউ একজন ক’দিন আগের বাংলা সিনেমা দেখছে। স্বপ্নের ঠিকানা। সালমান শাহ্, শাবনুরের। তার একটা পরিচিত গানের কথা সুরসহ ভেসে আসছে – ও সাথীরে, যেও না কখনও দূরে…
বহুদূরে, আগামীতে, ভবিষ্যতের এক ডার্ক আওয়ারে একটা ট্রান্সফর্মেশন ঘটবে এখানে। বুদ্ধিস্থবির অবস্থায় একজন মানুষ অজস্র মানুষের ভেতরে প্রবেশ করবে অথবা কোনো এক কবির হাতে তৈরী হবে ভূপেন দারোগার মতো ক্যারেক্টার। যিনি কবির কল্পনার ভেতর দিয়ে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানাবে সবাইকে। আর বলবে – জীবন এক আশ্চর্য নাইটকুইন, সূর্যের আলো তার সয় না!
০৫.
এ-ই যখন ভবিতব্য, তবে এসো আরো অবুঝ জোনাকি। আমি পেয়ে গেছি স্বর্ণডানা, এবার নির্দ্বিধায় হারিয়ে যেতে হবে। ঘুমের ভেতরে এতো এতো আর্তনাদ যে, আমিও কেঁদে উঠে নিজের দিকেই ভয়াবহ তাকিয়ে আছি! এই যে অজস্র পথ, অথচ গন্তব্যহীন! নিজের স্বপ্নের ভেতর আজও কোনো ছায়া নেই! জল্লাদ, তুমি কী সজাগ আছো? ও দরবেশ, আমার মাকে ভালো রেখো। পথ হারানো একটি মায়া-হরিণ নিরুদ্দেশ হেঁটে যাচ্ছে একা। আমি ঘুমোতে পারছি না! দৃশ্যে দৃশ্যে নেমে আসছে অসংখ্য আততায়ীমুখ আর সুবেহ সাদিক। তুমি ঘুমাচ্ছো এখনও?
বিগত দু’দিন অন্ধকারে কেটে গেলো। চলে যেতে হবে; কই যাবো?
ছায়া হয়ে এসো বটগাছ!
লেখক পরিচিতি:
বিধান সাহা
জন্ম ২১ মার্চ ১৯৮৪; টাঙ্গাইলের ভূয়াপুরে, মামাবাড়িতে। পৈতৃক নিবাস বগুড়ার ধুনটে। চারুকলা বিষয়ে স্নাতকোত্তর। একটি স্বনামধন্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
প্রকাশিত বই : অব্যক্ত সন্ধির দিকে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৫]
ই-মেইল : bidhan213@gmail.com