এমন দিনে তারে বলা যায় | সানিয়া রুশদী

আমার মনে আইজকা বৃষ্টি ঝরতেছে। মনে হইতেছে, এমন দিনে তারে বলা যায়।

আমার এক্সের সাথে আমার কথা হইত না খুব একটা। যেমন আমার কারো সাথেই হয় না। ও কথা বলতো আর আমি মনে মনে আমার দুনিয়ায় ঘুইরা বেড়াইতাম। ওর কথা হয়তো অর্ধেক শুনতাম আর মাঝে-মধ্যে হুঁ হাঁ করতাম। ও জানতো সেইটা, কিন্তু কিছু মনে করতো না। মাঝে মাঝে আমার ফ্যামিলির সবাই একত্রিত হইলে অভিনয় কইরা দেখাইত আমি কেমনে পড়াশোনা করি। ও বলতো, সবাই বইয়ের দিকে তাকাইয়া বা কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকাইয়া পড়ে, আর আমি নাকি পড়ি আকাশ-পাতাল দেখতে দেখতে, বা ঘরের চার দেয়াল আর সিলিং দেখতে দেখতে। ও আর আমি একদম ভিন্ন ধরনের মানুষ। অথচ আমাদের বিবাহিত জীবন খুবই সুখের ছিল। এবং সেইটা আমার কারণে যতটুকু, তার চেয়ে বেশি হয়তো ছিল ওর কারণে। ওর নাম এব্র্যাহ্যাম।

যেদিন আমাদের বিয়ে হইলো, সেদিনই ও ওর বাপ-মায়ের দেওয়া নাম বদলাইয়া একটা বাঙ্গালী মুসলমান নাম নিছিল। পরে সেই নাম বদলাইয়া এব্র্যাহ্যাম রাখছিল নিজেই, এব্র্যাহ্যাম লিংকনের অনুসরণে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের বিয়ে হইছিল ০২/০২/২০০২ তারিখে, বুধবারে। খুব তাড়াহুড়ার বিয়ে ছিল, কারণ বিয়ের একদিন পরেই আমার বাবা-মা বাংলাদেশের দিকে রওনা হবেন। এব্র্যাহ্যামের মা-বাবা তখন সেপারেটেড, তাই মোটেলে ওনারা আলাদা ঘরেই থাকতেছিলেন। এব্র্যাহ্যামের বোনও উপস্থিত ছিল বিয়েতে ক্যামেরা নিয়া। ও প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। নানানভাবে আমাদের ছবি তুলতেছিল। আমাদের বিয়ের ছবি দেখলে মনে হয়, কত আনন্দে ছিল সবাই! আংটি পর্বও বাঙ্গালি কায়দায়ই হইলো। এব্র্যাহ্যামের মা আমারে আংটি পরাইলেন, আমার মা এব্র্যাহ্যামরে। আমার আঙ্গুলে এঙ্গেইজমেন্টের আংটি অলরেডি ছিল। সেই আংটিটা ডায়মন্ডের। এব্র্যাহ্যামের হবু বৌয়ের জন্যে রাইখা গেছিলেন ওর বাবার নানী, যার সাথে আমার দেখা হইছিল সিডনী থাকাকালীন, বেশ কয়েকবার। তখনও উনি শক্ত-সামর্থই ছিলেন, নিজেই কেক বানাইতেন। ঘটনাক্রমে, আমার মতন ওনারও ২৭শে ডিসেম্বরে জন্মদিন।

তো এই সমস্ত কাকতালীয় ঘটনা অনেক ঘটছে আমার সাথে। আমি তাই অ্যাস্ট্রলজি, নিউমারলজি, ইত্যাদিতে বিশ্বাস করা শুরু করছিলাম। মানে শুধু এই বিশ্বাসই না যে এইসব প্যাগান চর্চা দিয়া কিছু রহস্য ভেদ করা সম্ভব, বরং, কিছুটা আস্থাও আসছিল এই সমস্ত চর্চার ওপর। আমার মনে আছে, সেই সময় কেউ ধর্মের কথা বললেই আমার রাগ লাগতো, গা জ্বালা করতো। আমি ব্যস্ত হইয়া পড়তাম তারে ভুল প্রমাণ করতে। মুখে না, মনে মনে নিজের সাথে তর্ক চালাইয়া যাইতাম। অহংকারও ছিল আমার খুব। ভাবতাম, “এত ভালো ভালো লজিক, এইগুলা তো আমি দিতে পারতেছি জীবনে অনেক ঝড় পার হইছি একা একা সেই কারণে।” এই ভাইবা নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াইতাম মনে মনে।

তো এমনই একদিন এব্র্যাহ্যামের বোন ভ্যানেসা মেলবোর্নে আসলো বেড়াইতে। কিভাবে যানি অ্যাস্ট্রলজির প্রসঙ্গ আসলো। আমি আর ভ্যানেসা অনেক গল্প করলাম। মানে ভ্যানেসাই বেশি, আমি মুগ্ধ শ্রোতা হইয়া শুনতেছিলাম। এক সময় জানতে পারলাম যে ওদের বাসায় ওদের ছোটবেলা থিকাই একটা বই আছে, যেইটার নাম “সেলেস্টাইন প্রফেসি” এবং যেইটা এই সমস্ত অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলারে বুঝতে সাহায্য করে। এত ইন্টারেস্টিং একটা বইয়ের কথা জাইনাও বইটা পড়া হইয়া ওঠে নাই আমার। তবে সেই রাতে বা তার পরের রাতে ভ্যানেসার জোরাজোরিতে সারা ফ্রেডার নামের একজনের ইন্টারনেট পেইজে গিয়া আমার নাম, জন্ম তারিখ ইত্যাদি সাবমিট কইরা আমার ভবিষ্যৎবাণী পাইলাম। তার পর থিকা রোজ সারা ফ্রেডারের ঘোরানো-প্যাঁচানো ইমেইলও পাইতে থাকলাম। সারা ফ্রেডাররে নিয়া ভয়ংকর সব স্বপ্নও দেখতে লাগলাম আমি। তারপরে তো ডাক্তাররা আমার সাইকোসিস ডায়াগ্নোস করলেন।

সাইকোসিসের গল্প আমি অন্যখানে করছি। এইখানে শুধু এইটুকু বইলা রাখা যে নানাভাবে, নানান কাকতালীয় ব্যাপার ঘটছে আমার জীবনে, যেই কারণে এইগুলা ঘটাই অনেক সময় স্বাভাবিক মনে হয়।  

সাইকোসিসের পরে আমি প্রায় পাঁচ বছর ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে ভুগছি। কিছুই ভালো লাগতো না তখন। সময়ও কাটতো না। তাই সবার পরামর্শ মতো শুধু একটা রুটিন ফলো করছি। আমি তখন হাত-পায়ের নখ কাটতে কাটতে ভাবতাম, “এমন দিন কি কখনও আবার আসবে, যখন আমি খুশির স্রোতে ভুইলাই যাব যে হাত-পায়ের নখ বড় হইছে এইগুলারে কাটা দরকার? এমন দিন কি আবার আসবে, যেদিন আমারও সবার মতন সময় থাকবে না?” রুটিন মানতে মানতে, সময় কাটানোর জন্যেই আমি সেই সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করলাম। নামাজ পড়তে আমার ভালো লাগতো না। প্রথমত, তখনও বিশ্বাস ছিল না আল্লাহ্‌তে, আর দ্বিতীয়ত, নামাজরে যাঁরা মেডিটেশনরূপে পান, তাঁরা চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন, এবং নিজেদের পারিপার্শ্বিকতা অনুভব করতে পারেন, আমি যেইটা পারতাম না। কিছু ভাবতে না পারা, দিবাস্বপ্ন দেখতে না পারা, কোন কিছু অনুভব করতে না পারা যে কত বড় শাস্তি কাউরে বুঝাইতে না পাইরা আমি শুধু কানতাম। সেই কান্নাও কেমন উপরে উপরে ছিল! যাই হোক, ঐরকম অবস্থাতেই আমার দ্বিতীয়বার সাইকোসিস হইল। সাথে, এব্র্যাহ্যামের সাথে আমার সেপারেশনও। যথা সময় ডিভোর্সও হইল। এত কিছুর পরেও আমার মনের অবশ ভাব রইয়াই গেল। নাকি একটু আলগা হইলো? আমি যানি কিছুটা ফিল করতে পারতাম রোজ সন্ধ্যার লাল আকাশ। হঠাৎ হঠাৎ কিছুটা ছুইয়া যাইতো আমারে একেকটা ঘটনা।

এইরকম অবস্থাতেই আমরা নতুন বাড়িতে উঠলাম। আম্মা তখনও কেমোথেরাপি নিতেছে। তাই আম্মার অবস্থা খুবই খারাপ। আগের বাড়ির গ্যারেজ ভর্তি জিনিস সব আব্বা প্যাক করছে, আর আমার বড় বোন লুনা আর আমি ঘরের ভিতরের জিনিস। আমরা তখন আম্মারে খুব মিস করছি। এই সমস্ত গোছানি গাছানি সব সময় আম্মাই কইরা আসছে। তো নতুন বাড়ি পঞ্চাশ স্কয়ার মিটারে দোতলা। এই বাড়ি পরিষ্কার করতে করতেই সারাদিন লাইগা যায়। প্রথম দিকে লুনা আপা আর আমি মিলা বাসা গোছানো, রান্নাবান্না, বাজার করা ইত্যাদি সাংসারিক কাজগুলা করছি। পরে, লুনা আপা যখন চাকরী শুরু করল, তখন সব কিছু আমিই করছি। সেই কাজগুলা আমারে ডিপ্রেশনের মধ্যেও বাঁচাইয়া রাখছিল। দেখতে দেখতে রমজান মাস আইসা আবার প্রায় চইলাও গেলো। তখন আমি রোজ ইফতার বানাই, রান্না করি, ঘরের কাজ করি। তো এমনই এক ঘরের কাজে ব্যস্ত দিনে এব্র্যাহ্যাম আসলো, দেয়ালে লাগানোর জন্যে কিছু ছবি দিয়া যাইতে। সেইটাই ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আম্মারে আর আমারে ওর ফোনের থিকা ওর স্ত্রীর আর নবজাতক বাচ্চার ছবি দেখাইলো। নবজাতক বাচ্চারও যে এত সুন্দর চেহারা হয়, সেইটা আমি ঐ প্রথম জানলাম। জিজ্ঞেস করলাম কবে জন্মাইছে, ও বলল, পঁচিশে জুলাই, শুক্রবার। হিসাব কইরা দেখলাম, ঐদিন শবে-কদর ছিল। আমি ঐদিন কোরআন শরীফ পড়তেছিলাম আর আমার খুব ভাল লাগতেছিল পড়তে কেন যানি। ওর মেয়ের নাম জিজ্ঞেস করতেই ও হাইসা দিয়া বলল, মেয়ের নাম রাখছে আনিয়া। আমিও হাইসা ফেললাম। আনিয়া মানে গ্রেইস। এব্র্যাহ্যাম চইলা যাওয়ার পরে, আমি আবারও কোরআন শরীফ নিয়া বসলাম। আমার আবারও খুব ভাল লাগলো পড়তে। সন্ধ্যায় ইফতার কইরা, মাগরিবের নামাজ পইড়া নীচে গিয়া প্যান্ট্রির জানালা দিয়া বাইরে তাকাইতেই মনে হইলো পূর্ণিমার চাঁদটা আমার দিকেই তাকাইয়া হাসতেছে। হঠাৎ আনিয়ার চেহারাটা ভাইসা উঠলো আমার মনে। আমার বুকটা হুহু কইরা উঠলো, যানি ও আমারই মেয়ে! মনে মনে গাইয়া উঠলাম আমি:

“তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে,

মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে,

যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে।”


সানিয়া রুশদী

জন্ম: ১৯৭৭, বাংলাদেশ।

লেখাপড়া ও কাজকর্ম: প্রাথমিক শিক্ষা ঢাকায় উদয়ন স্কুলে। ১৯৮৭ সাল (স্কুলের ৪র্থ শ্রেণী) নাইজেরিয়াতে কেটেছে। ৫ম শ্রেণী উদয়ন স্কুলে শেষ করে, ১৯৮৯ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়াতে আছেন। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে আছেন। মোনাশ ইউনিভার্সিটি, সিডনি ইউনিভার্সিটি ও ডিকিন ইউনিভার্সিটিতে জৈব বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান পড়েছেন। সানিয়ার প্রথম উপন্যাস ‘হসপিটাল’ ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে। বর্তমানে তিনি ইংরেজিতে তার দ্বিতীয় উপন্যাস লিখছেন ও বাংলায় ছোটদের জন্য লিখছেন। নিকট ভবিষ্যতে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি অ্যাকাডেমিয়াতে ফিরে যেতে ইচ্ছুক।

শেয়ার