সাহিত্যাঙ্গনে কান পাতলে শোনা যায়, মানুষ কবিতা পড়ে না। কবিতার বই নিয়ে কথা হয় না, কবির কাছের মানুষ এবং অনুরোধ ছাড়া বই নিয়ে আলোচনা লেখা হয় না। ব্যাপারটা পুরোপুরি সত্য নয়। টেক্সট ভাল হলে এখনও পাঠক কবিতার বই নিয়ে কথা বলেন, পাঠ-প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ করেন। ঢাকাপ্রকাশ প্রকাশিত হাসান রোবায়েতের কাব্য ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ পাঠকের কাছে এসেছে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ। দেড় মাসে ফেসবুকে বইটির ১২টি পাঠ-প্রতিক্রিয়া আমাদের চোখে পড়েছে। নিশ্চয় এর বাইরেও কেউ কেউ বইটি নিয়ে লিখেছেন। ওই অচেনা-অলৌকিক পাঠকের প্রতি সালাম। আমাদের গোচরে আসা ১২টি পাঠ-প্রতিক্রিয়ার নির্বাচিত ক’টি শিরিষের ডালপালার পাঠকদের নিবেদন করলাম।
— রুহুল মাহফুজ জয়
‘প্রণয়ের মতো যা দেখতে ছিল ব্যক্তির গত সব আলাপ-বিলাপ
যেন হতে হবে তোমাকেও কূট সামাজিক
তবু ফুল ফোটারও অধিক ঝরে যায়—কী যে শ্লেষ!
সেই যে কুসুম, না ফোটাও ফুল!’—হাসান রোবায়েত
আজ পয়লা ফাল্গুনে শরীর মন দুটোই বিকল। বিকল শহরের বাতাস। তবু ফুল ফুটে আছে, ‘মাদারচোতের’ মতো। আমরা কি যেন করতে চেয়েছি, আর কি করছি এর মাঝে এসে দাঁড়ায় উপলক্ষ। আর দশটা দিনের সঙ্গে আমি তো পার্থক্য করতে পারি না। বুঝতে পারি না তাৎপর্য, মেকি মনে হয় আজকাল। মৃত্যুর মত ধূসর মনে হয়। মনে হয় রোবায়েতই ঠিক বলেছেন। ফুলগুলো কদর্য হয়ে উঠেছে।
হাসান রোবায়েতের ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ পড়ে অস্বস্তি হয়। আজ বসন্ত দিনে বইটার কথা আবার মনে পড়ল। একটা সময়কে প্রতিনিধিত্ব করে নাকি এই বই? কোন দেশের কোন সময়কে? আমার তো মনে হয় এই ভূখণ্ড কেবল নয়, বিশ্বজুড়েই যেন কমে আসছে ভালোবাসার তাপ। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে অসহিষ্ণুতা। কে তুমি, কি তোমার মত, তুমি কোন দলে? এই প্রশ্ন ধ্বনিত হচ্ছে সব দেশে।
রবীন্দ্রনাথ আশা করেছিলেন এক মহামানবের উত্থান ঘটবে। তার পদধ্বনিও নাকি শোনা গেছে। আসলে সেই মহামানবের জন্ম তো শুভবোধ আর আশার ভেতরে। যে আশাবাদ প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বাহিত হয়। সেই আশাবাদই তো মরে গেছে। এখন কেবল বর্তমানকে খেয়ে ফেলার উন্মাদনা।
মাঝে মাঝে কালিমাখা ছবি ভালো। তমসা আলোর অনুপস্থিতির কথা বলে। তাই তমসা আলোর ইশারাও। বিজ্ঞাপন নয়, তবু বিজ্ঞাপনই। তমাসার বিজ্ঞাপন। পিকাসোকে গের্নিকা দেখিয়ে এক সৈনিক প্রশ্ন করেছিল, এটা কে করেছে, পিকাসো উত্তর দিয়েছিলেন, তোমরা।
—আহমেদ মুনির
এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে—একটি অসমাপ্ত পাঠ-অনুভূতি
‘এতকাল ধরে সৌন্দর্যের যা কিছু সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তা প্রকৃতির অনুকৃতিই হোক কিংবা বিষয়ের বিশ্বস্ত অনুগামিতাই হোক, অথবা বস্তুর অর্থগত সুমিতি-পরিমিতি-ঐক্য-সামঞ্জস্য সুষমাই হোক; হয় তারা শিল্পের যথার্থ সংজ্ঞা দিতে ব্যর্থ হয়েছে নয়তো বড় জোর শিল্পের দু-একটি লক্ষণ তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছে মাত্র, তার বেশি কিছু নয়।’
‘দূরে শাদা ফুল ধীরে কালো হয়
চাঁদে মুখ দেয় কত শেয়ালে—’
*
‘ধনধান্য ভেসে অস্থির—!
ক্রমসংকোচে তুমি গুটে যাও
আসে মাৎস্যন্যায়ে ভরা দিন
দূরে বুলবুল কাঁপে সন্ধ্যায়
মার ঠোঁটজুড়ে সুরা ইয়াসিন—’
*
‘ফ্যাসিবাদের এসব ক্রূর স্বর্ণযুগে, তুমি জানতে পাবে
কেউ, কারোর পাশেই, দেখা বৃষ্টিভিজে পারছে না দাঁড়াতে—
রু, বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে,
তুমি পুলিশভ্যানের পাশে এসে দাঁড়িয়ো না—
দেখো, কামরাঙাটির ফুল ভেসে যাচ্ছে,
অজস্র মৃত্যু চোখ চুয়ে তার—’
রোবায়েতের কাব্যভূবনে এসে দেখা যায় সৌন্দর্যের যাবতীয় সূত্রাবলী এইখানে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। বোধের প্রতিমাটি এক তলহারা অতলের দিকে যেতে যেতে রেখে যাচ্ছে তার উলঙ্গ শোভা, একটা পূরবীর সুর অমার্জিত শব্দসজ্জায় কাঁপছে।
জীবন আর শিল্প রোবায়েতে এসে একাকার হয়ে গেছে, যা কিছু শুভ ও প্রাণস্ফুর্ত রোবায়েত তারই অক্লান্ত কীর্তন করে গেছেন তার কবিতায়। জীবনকে ভেঙে-ভেঙে এক অনুপম শিল্প গড়তে চেয়েছেন তিনি।
‘যেখানে তোমার নদী জলমিতা, আর
মাধুডাঙালীন
ঝরে গেছে কণ্ঠিফুলে বিষাদে হাওয়ার
পরাঙ্মুখ দিন’
বা
‘রক্তের পরও কিছুটা হাঁস থেকে যায়
বিসমিল্লার ভেতর—
তার তড়পানো উল্লম্ফনের মধ্যে
অসহ্য কাঁপছে স্মৃতি’
জীবন যেখানে ক্ষণভঙ্গুর একটি ফুলের মতো, সন্ধ্যার অস্তগামী আলোর মতো বা কখনও পদ্মের পাতার উপর টলটলে এক বিন্দু জলের মতো, বুঝি বা একটু টোকা দিলে, একটু হাওয়া লাগলেই ঝরে যাবে; রোবায়েত প্রসাধন-বর্জিত এই জীবনটাকে তুলে এনেছেন বুঝি বহুকৌণিক কোনো সুইসাইডের ভেতর থেকে।
রোবায়েতের কবিতা কখনোই আমাদের ভাবনার সমান্তরালে হাঁটে নি। জীবনানুভূতির এক প্রগাঢ় প্রসারতা আমরা তার কবিতায় টের পাই—
‘মেয়েদের বিয়ে হলে পাড়ায় ওই নামে আর কেউ থাকে না—’
‘মানুষের দেখার থেকেও পাখিরা অন্য রকম—’
‘ফুলেরা ফুটবে ভেবে রেওয়াজ করছে বাগান’
এই জীবনবোধ আমাদের চমকে দেয়। আধার ও আধেয়ের এই সুষম সম্মিলনের সম্মুখে আমরা নতজানু হতে শিখি। এক অপার জিজ্ঞাসাবোধ নিয়ে তাকিয়ে থাকি—’যেন সবকিছু রেলব্রিজ, বাঁশি, গরুর দুচোখ, চিন্তা-বেদনা, গ্রন্থে রচিত/ কূট বিবমিষা সবটা বৃথাই—’
রোবায়েতের কবিতা আমাদের কাছে কোনো মধ্যাহ্নদিনের অলস সঙ্গীত নয়। এ বুঝি এক শব্দের তীব্র, তীক্ষ্ন কাকলি—এখানে কেউ ডেটলের শিশিতে রাতের লাল মাপে, প্রেমিকার চিঠিগুলো পিয়নের তালপাতা-জানালায় আপার পুরনো কথার মতোই লুকিয়ে আসে।
‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ মূলত প্রেমে-পঙ্কিলতায় ভরা এই অস্থির সময়েরই দিনলিপি। সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে এ বুঝি এক খণ্ড আলোর আভা। অভিজ্ঞতা আর শব্দের শাসন এখানে এক আশ্চর্য শোভা ফলিয়েছে। এ কথা সত্যি যে আমি রোবায়েতের অনেক কবিতাই বুঝে উঠতে পারি না। কবি নিজেও হয়তো চান নি এই যোগাযোগ—দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে যেতে যেতে তিনি সচেতনভাবেই পূর্বের ধারাটাকে চুরমার করে দিয়ে গেছেন—লোহার ফসল কবিতায়—
‘রক্তের পরও কিছুটা হাঁস থেকে যায়
বিসমিল্লার ভেতর—
তার তড়পানো উল্লম্ফনের মধ্যে
অসহ্য কাঁপছে স্মৃতি’
এটুকু বলার পর যে কাটা মুণ্ডু হাঁসটির মূর্তি চোখের সামনে তার রক্তাক্ত দেহসমেত ভেসে ওঠে পরের দৃশ্যে তার অস্তিত্ব উধাও—
গমের বাতাস, এমন প্যানোরামা-খুনে
তুমি বর্তুল
তুমি শ্রোণীদেশ হয়ে
শরীরী-গর্ভের দিকে যাও
তারপর একটা বিসর্পিল ফুটা নির্জনে হাওয়ার মর্মর গড়ে তুলছে লেবুগাছটির নিচে। তারপরেও ধুলা, ঘূর্ণমান কপিকল, সমুদ্রদণ্ডিত কারো পা।
রোবায়েতের কবিতায় একটা সোজাসাপ্টা রূপ বার বার সামনে আসতে চায়। সমগ্র রোবায়েত-পাঠের পর আমার মনে হয়েছে—ঐ রূপটাকে পাশ না কাটাতে পারলে তার কবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য বোঝা কখনও সম্ভব না। রোবায়েত একটা ফাঁদ মাত্র—
এই তো আমার যত্নে পোষা রেখা
হারিয়ে যাওয়া হাতের করতল
*
ফলের দিকেই তাকিয়ে পাকে পথ
চোখের দূরে কে আর ছিল কবে
*
ভাষাবিজ্ঞানের ছাত্র, এসো ধইঞ্চা কুড়াতে যাই
অবশ্য, সেখানেও পেয়ে যাবে তুমি
পাণিনি, পতঞ্জলি
*
আম্মা চোখের দূরে
অজস্র দেখতে পায় নোনা জুঁই ফুল—
এইসব খণ্ডদৃশ্যের অন্তরালে বয়ে চলছে জীবনের অন্য এক নিবিড় উপলব্ধি। যেখানে হাওয়ার দিন শেষে ফলে উঠছে অন্য এক জীবন। যেখানে লোহার দিনের স্বেদ আনমনে ঝরে গেছে। যেখানে ঠাট্টার পাশে একটি পাতা তিরতির করে কাঁপছে।
যে সুরটি এই কবিতার বইয়ে একটু একটু করে গড়ে উঠেছে তা কখনও একতালে বাজে নি ঘনরাত্রির কোন একটি শোলোক একটু একটু করে তার শেকড় মেলে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে সেই হাওয়ায় যা কিনা শিকারির দিকে এক নৈঃশব্দ্যের প্রাচীর তুলেছে। কোথাও সোনার হৃদয় খুঁজে না পেয়ে মেলেছে ডানা সোনালী রোদের উপর।
—অনুপম মণ্ডল
এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে: পাঠপ্রতিক্রিয়া
অভিযোগ তুলে দিলে, শব্দের আভিজাত্যে কিংবা রচনাশৈলীতে আদ্যোপান্ত এক সুদূরপ্রসারিত ভাণ্ডার। মেলে ধরলেই, হাজার বছর অতিক্রম হয়ে যায়। চোখ জ্বলে, খচখচ করে। ঘুম আসে। বাহির হতে হয় তবুও।
‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে”, কবি হাসান রোবায়েতের চতুর্থ প্রকাশিত সুখপাঠ্য কবিতার বই।
আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে অনেকটা অবুঝের মতো পাঠক দৃষ্টির বোঝাই থেকে হালকাকরণ প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া জানালাম।
শুরুতেই দুর্বিষহ অথচ অতিক্রান্ত যে ফসলে সবুজ খুঁজে চলেছেন বাস্তুসংস্থানের এই পৃথিবীতে। অদূর ভবিষ্যতে এড়িয়ে চলে যেতে চাইলে হয় বধির, নয়তো মিশে যেতে হবে কোন গহ্বর তলদেশে। আমি সে অধিক আশার জীবনকে উতরে যেতে পারিনি জানা-অজানা বোধে।
ভোরের আজানে সমর্পিত দেহকে বুঝ মানিয়ে যে উদ্যানে তিনি খুঁজে ফিরিয়েছেন নিজেকে। ক্ষত মুছবার মতো স্বস্তি আরও বেশি উত্তাল প্রতিচ্ছবির পাশে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই হয়তো তিনি লিখেছেন-
‘যখন আমার
চোখের পাশে
বাড়ছে ক্ষত
ফুল তখনো
ফুটছে মাদারচোদের মতো—‘
একইসাথে তিনি ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতেই পারেননি কিংবা চাননি। প্রেম, বিদ্রোহ কিংবা কবরে শুকোনো মাটির পরের কদম থেকে। যা পুষে চলি আমরাও। বলতে পারি না, জানি না প্রতিরোধ কৌশল। অনাবিষ্কৃত চেয়ে থাকা পাখিদের পথ ধরে বিশ্লেষণ ঢঙে। যাতে ভেদ করা বৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কবি। যেমনটা বলছেন—
‘খালি সে-ই একা—
পুরোটা না লেখা,
উপন্যাসের কেউ—‘
আমি ভাবনায় আড়ম্বরপূর্ণ সাধন খুজি কিংবা নৈপুণ্য। এমনটা ভাবতে চেয়েছি বলে-শান্ত, চিন্তাশীল স্বভাবের তাড়নায় প্রশংসার সাগরে ডুবে থাকা থেকে অস্তমিত অস্তিত্বের স্বীকারে স্বজাতির গুণ, বন্দনায় সৃষ্টির অনর্থক যাতনাকে আড়াল করতে না পারার প্রয়াসে দোদুল্যমান সময়কে বাছবিচার সমেত কাগজে-কলমে ভরানোকে দেখছি- এক আফসোসে, রাগে,ক্ষোভে কিংবা মুক্তিতে।যেখানে সংবরণের বালাই হতে বেড়িয়ে শিখিয়ে দিতে চাইছেন-
‘ভেবো না অন্য করে—’বাক্য অবিভাজ্য —’ভতৃহরির এই মত—‘
এই রিলেট করার জায়গায়, কবি অবিচল ভূমিকার পাশাপাশি মুছে দিতে চেয়েছেন বিরক্তিকর ক্ষত; নতুন কুঁড়ির সন্ধানে গিয়ে শেষ দেখবার আশায়। যাতে তিনি টেনেছেন মধুমাখা সুর হৃদয়ে বর্ষিয়ে স্বদেশ হতে দূরের ছটফট অথবা উচ্ছ্বাস। দৃষ্টি তুলেছেন পাখিদের চোখ হতে গড়া জ্বলজ্যান্ত পোট্রের্টে। যেভাবে-
‘শিশুদের হাইতোলা মুখের ওপর
হো হো করছে ট্রাক
অনন্ত গের্নিকা—
ফুলের নরম লেবু ভেঙে যায়
ফোটা ফোটা স্বেদ
হাসপাতালের পলেস্তারায়’
আমি নিশ্চিত, নই। এমন ধারণায় থেকে হয়তো পরিবর্তন দেখা নাও যেতে পারে। তবে সান্ত্বনা নাকি অস্থিরতা; জানবার, জানাবার সন্নিকটে বসে কবিতায় দেখাতে চেয়েছেন- পৃথিবীসহ গলিত পরাক্রমশালী ছিন্নভিন্ন দোসরদের অলংকারহীন প্রস্ফুটিত কসরতের। দূরত্ব বোঝাতে যেমন করে উনি বুঝালেন-
‘মানুষের দেখার থেকেও পাখিরা অন্য রকম—‘
যা শুকায় না, শুকোবে না প্রতিবিম্বে।
মুখের আদলে, অনুভবে-
এমন ঘনঘোরে, ফ্যাসিবাদে।
[যেখানে পুরোটাই আত্মজৈবনিক ঘোর। বিগলিত অথচ মালাকুল মাউত অবধি ফ্যাসিস্ট আচরণের বহিঃপ্রকাশ। একটা কথা না বললেই নয়- মোহাম্মদ, সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম; অন্যতম কারুকার্য। আমার পড়া অন্যতম সেরা কবিতা। কবির জন্য ভালোবাসা। সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।]
—ইমরান আহমেদ ডিউক
আপনার কবিতা সম্পর্কে যে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, এই বইটা পড়লে তা অনেকাংশেই কেটে যাবে। যেহেতু বইটা দৈনন্দিন জীবনের পরিচিত অনেক বিষয়াবলি তুলে ধরেছে, বিশেষত মিডলক্লাস সম্পর্কিত। যেমন, বাবা রিটায়ার্ড বাবা ক্লান্ত, সুরা ইয়াসিন দুলে দেয়ালে। আবার, আম্মা চোখের দূরে অজস্র দেখতে পায় জুঁইফুল। তবে সবচে বড় কথা সমাজবাস্তবতা, অথবা ভঙ্গুর, কাদালিপ্ত রাজনৈতিক অনুষঙ্গ তুলে ধরে বইটা সময়ের দাবি পূরণ করেছে। এতোটা উচ্চকিতভাবে রাজনৈতিক টানাপোড়েন নিয়ে কেউ বলতে সাহস পাচ্ছে না যখন পাঠ করি, যদি তোমাদের ফ্যাসিস্ট সন্ধ্যায় কখনো সকালের রোদ এসে হামলে পড়ে (বিরোধার্থক ইমেজারি ), অথবা ফ্যাসিস্টের ভেতর অজস্র ট্রেন হো হো করে ঢুকে যাচ্ছে হিংসায় (পরাবাস্তবতা) এমনি আরো লাইন এবং লাইনের ভেতর দৃশ্যভিলেনের সমারোহ।
কোথাও আধুনিক কবিতার শক্তিশালী প্রাসঙ্গিক অলংকার বিরোধাভাস। যেমন- কেউ আসে আলোর অন্ধকারে এলাচফুলের রাতে। জীবনানন্দের যেমন সাতটি তারার তিমির….
শুধু বিষয় এবং ফর্ম, ছন্দ নিয়ে নয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঘুমন্ত মার্কারি ফুলের মতো এই কাব্যগ্রন্থের ভাষাবিজ্ঞান কবিতায় আপনার ভাষা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা টের পাই।
—খান আলাউদ্দিন
পাঠপরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কবিতা সম্পর্কে সমসাময়িক একজন কবির মূল্যায়ন ছিল এ রকম—
‘জীবনোৎপলের ফ্রিকোয়েন্সির সাথে কয়েকখান সিমেটিক শব্দ লাগানোটাই বুঝি কবিতা!’
রোবায়েতের কবিতা প্রথম চোখে পড়ে একটা ওয়েবজিনে, খুব সম্ভবত সেটা কোন একটা দীর্ঘ কবিতা ছিলো। দীর্ঘ কবিতা এমনিতেই আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লাগে। তার উপর সমসাময়িক একজন কবির কবিতা নিয়ে প্রো-লগে অতখানি গুরুত্ব দিয়ে কথা বলা — স্বভাবতই কবিত্বজনিত অহমে সুরসুরি লাগে। অহমের সেই সুরসুরি ও বিরক্তি নিয়ে সেই কবিতায় ঢুকতে গিয়ে প্রচণ্ড হোঁচট খাই। কেন না, শব্দের এমন সব ব্যবহার আমার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিলো। শব্দার্থবিদ্যার খোল এভাবে নলচে কেউ পালটে দিয়ে কবিতা করতে পারে এই ধারণাই আমার মাথায় ছিল না। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ফুলের কোন মানে নেই, শুধু ঘ্রাণ আছে। সেই আপ্তবাক্য মাথায় রেখেও রোবায়েতের কবিতাকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
এরপর বছরখানেক, এরকমই হবে হয়তো, সময় কেটে গেছে। আমি তার কবিতাকে পর্যবেক্ষণ করে গেছি। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, রোবায়েত শব্দ নিয়ে, বাক্যগঠনের রীতি নিয়ে আসলে একটা সাধনায় রত। আমি তার এই সাধনার ঘোৎঘাত যে এখনও ঠিকঠাক ধরতে পেরেছি তা বলবো না, কিন্তু আমি তার কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হতে থাকি। আগের মতো ধাক্কা খাই না। বরং এক ধরণের ভালো লাগা কাজ করতে থাকে। আমি তার কবিতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। সে নতুন কী কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে কবিতায় তা দেখার জন্য কৌতুহল জন্মাতে থাকে।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। রোবায়েত যে কেবলই যাপিত জীবনের সাথে সাযুজ্য কতেক শব্দ লাগিয়েই কবির দায় এড়িয়ে যায় না, সমকালীন রাজনীতি, সমাজ, পারিপার্শ্বিকতা নিয়েও যে তার কাব্যভাবনা রয়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ কাব্যে (যারা তার কবিতা নিয়ে এ হেন অভিযোগ উত্থাপন করে থাকেন তারা পড়ে দেখতে পারেন)।
যখন একটা অবরূদ্ধ সময়ের আবদ্ধ বাতাসে বাংলাদেশের কবিসমাজের প্রায় সকলেরই দমবন্ধ হয়ে আসে (আমি দুঃখিত যে এই কবিসমাজের ক্ষেত্রেও প্রায় শব্দটি ব্যবহার করতে হচ্ছে), তখন রোবায়েত কতটা সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন —
‘দেখার কিছু ছিলই না তো /গুজব ছিল ঘাঁ/ রক্তঘুমে জিভ দেখালো/ মুসোলিনির মা…… যখন আমার /চোখের পাশে/ বাড়ছে ক্ষত/ ফুল তখনো/ ফুটছে মাদার/ চোদের মতো—’
পুলিশের গুলিতে সিদ্দিকুর নামের এক শিক্ষার্থীর অন্ধ হয়ে যাওয়া শিমুল ফুলের মতো রক্তাক্ত চোখ আমাদের মনে পড়ে যায়। আর যা যা মনে পড়ে তা গদ্যভাষায় লেখার শক্তিসাহস আমাদের হয় না, কিন্তু মনে পড়াকে আটকাবে কে?
মাৎস্যন্যায়ের ভরা দিনে আমরা গুটিয়ে যাই। প্রার্থনা ও নালিশ, সবই ওপরওয়ালার কাছেই করতে হয়। আমরা করিও তাই—
‘ক্রমসংকোচে তুমি গুটে যাও/ আসে মাৎস্যন্যায়ের ভরা দিন/ দূরে বুলবুল কাঁপে সন্ধ্যায়/ মার ঠোঁটজুড়ে সুরা ইয়াসিন —’
পদক-পুরস্কার-পৃষ্ঠপোষকতা-জমি-প্লট বুঝে নেওয়ার লোভে একদল কবিমানুষ যখন চোখে উন্নয়নের ঠুলি আর মুখে জিপার টেনে ঘানির গান গেয়ে যাচ্ছে, রোবায়েত তখন উচ্চারণ করেন, ‘ফ্যাসিবাদ’। তার সাহস দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। রোবায়েত বলেন—
‘ফ্যাসিবাদের এসব ক্রুর স্বর্ণযুগে/ তুমি জানতে পাবে /কেউ / কারোর পাশেই/ দেখা বৃষ্টিভিজে পারছে না দাঁড়াতে/ রু / বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে/ তুমি পুলিশভ্যানের পাশে এসে দাঁড়িয়ো না-‘
কিংবা
‘আমরা হারিয়েছি মায়ারোদ /ধলেশ্বরী-মেঘ, পারাপার/ এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে/মিনারে শঙ্খের হাহাকার—‘
তো এইসব সাহসী উচ্চারণ যে রোবায়েত একেবারে একাই করছেন বিষয়টা এমনও নয়। আরো অনেকেই করছেন। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে কবিতার নামে কেবলই শ্লোগান কিংবা স্রেফ পত্রিকার প্রতিবেদনের অনুলিপির মতো কিছুই হয়ে যাচ্ছে সিংহভাগ। এ ব্যাপারে রোবায়েত ছাড় দিচ্ছেন না। শব্দ তার অর্থের জোরে রোবায়েতকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিচ্ছে না, বরং সে-ই শব্দকে কৌশলী সহিসের মতো করে তার ইচ্ছামাফিক কবিতা তৈয়ার করে চলছেন। শব্দ যেন এখানে পোষমানা ঘোড়া। কিংবা গাঁজার নৌকা, যেটা পাহাড় বেয়ে যায় এবং আমরা তা মেনে নিই, অভ্যস্ত হয়ে যাই। এই কারণেই তার কবিতার সাথে পরিচয়ের শুরুর দিকে আমি আরেকজন কবির সাথে মন্তব্য করেছিলাম রোবায়েত কবির চেয়ে বেশি কবিতার কারিগর। নেতিবাচক অর্থেই। তথাপি সে যখন লিখে ফেলে—
‘কোথাও তুমি ধলেশ্বরীর তীর— /বাজ পড়ছে ঢেউয়ের ওপার গ্রামে/ ক্রসফায়ারের শব্দ নড়ে পাতা/ কার মেয়েটা কাঁদছে মধ্যযামে—!’
তখন সেই কারিগরিটা ছাপিয়ে কবিতাটাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। একরামের মেয়েদের রোনাজারির শব্দ কানে বেজে ওঠে। ইমেজ তৈরির খেলায় জিতে যায় কবিতা। আর কবিতা জিতে যায় বলেই রোবায়েতের কবিতা ভালো লাগে। ভালো লাগে ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’।
—সানোয়ার রাসেল
হাসান রোবায়েতের চতুর্থ বই ‘এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে’ পড়লাম।আসলে বইটার কবিতাগুলিতে একটা সময়ের আবর্তনের ব্যাপার আছে। তিনি সেই সময়টাকে কীভাবে কবিতায় কবিতায় ব্যক্তিক দ্বন্দ্ব, সামষ্টিক দ্বন্দ্ব, একটা রাষ্ট্রের মানুষের স্বাপ্নিক সমস্যা সাথে আছে একপ্রকার নিরাশাবাদের ভিতরে আশাবাদী আকুতি। মনোভাব। আমার তাই মনে হয়েছে।
আসলে একজন পাঠকের মাইন্ড বলে একটা ব্যাপার আছে। আর সে মাইন্ডটাকে যখন একজন কবি নানাভাবে তা পাঠকের নিকট নিজস্ব ঢঙে তুলে ধরেন, আঘাত করেন তখন সম্ভবত তা একটু আলাদা হয়েই দাঁড়ায়। একজন কবি তো তার কবিতায় নিজস্বতার জন্যে কত উপায়ই খোঁজে। আমার হাসান রোবায়েত সে উপায়টা যেমন নিজের কবিতার ক্ষেত্রে বের করেছেন, তেমনি পাঠকের সে মাইন্ডটাকে ধরতেও তিনি ভুল করেননি।ওনার কবিতায় নানান দিকের সাথে একটা ধর্মীয় টোন বা সুর তো আছেই, আমি পড়ার ক্ষেত্রে সেটাকে আবেশই বলবো। শৈল্পিক আবেশ যা পাঠককে কল্পনায় ডুবায়-ভাসায় আর তিনি সেই আবেশটাকে আশ্রয় করে কবিতায় চিন্তার সেই খোরাকটুকু দিতে চেয়েছেন। একটা নতুনত্ব দিতে চেয়েছেন। সেটা হোক শব্দ ব্যবহার কিংবা ভাষার। একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
***
ওনার কবিতায় দৃশ্যবলীর অনেক ব্যবহার দেখতে পাই (অবশ্যই তা তো থাকবেই) কিন্তু আমার মনে হয় এই ব্যবহারে উনি সম্ভবত পাঠককে ঘোরে রাখা, মাঝেমাঝে কনফিউশন সৃষ্টি করা, প্রশ্ন তোলা, ভাবা, মনকে নিজে নিজে বলা, ‘আসলেই তো’।
আচ্ছা, আশ্রয়ের একটা কথা বলছিলাম যেমন প্রথম কবিতায় আছে,
‘বাবা রিটায়ার্ড বাবা ক্লান্ত
সুরা ইয়াসিন ঝোলে দেয়ালে’
এখানে পুরো কবিতাটিকে আমি একপ্রকার অপটিমিস্টিক এবং পেসিমিস্টিক অবস্থার দ্বন্দ্ব দেখতে পাই। এই যে ‘ক্লান্তির’ ব্যাপারটা ‘বাবার’ মাধ্যমে এটা তো শুধু একজন হিসেবেই চিহ্নিত নয়, এখানে লুকিয়ে আছে সামষ্টিক জরাগুলো। ক্লান্তিগুলো।ফলে আশ্রয় হিসেবে আমরা আমাদের নিকটে আশাবাদী হতে চাই আর কবি সেটা বোঝাতেই সম্ভবত কবিতার নামকরণে ‘সুরা ইয়াসিন’ আর কবিতায় তা ব্যবহার করেছেন। এখানে একটা শান্তির ব্যাপার দাঁড়ায় মনে। উচ্চারণে। পাঠকের ক্ষেত্রে। আমরা কোনো একটা আশ্রয়, কোনো একজনের প্রতি অবলম্বনের মাধ্যমে আশাবাদী হতে চাই।
আমার মনে হয় কবি একটা আদল গড়ে তুলেছেন এখানে যেটা ভাষা, শব্দ, চিন্তায়, ধর্মীয় টোন বা আবেশের মোহ- আর তার মাঝেই ছুড়ে দিচ্ছেন সময়ের অরাজকতার অবস্থা।
যেমন,
‘বৃষ্টি তোমাকে ডাকছে, তুমি ভিজবে না’ কবিতাটিতে লিখেছেন,
‘ফ্যাসিবাদের এসব ক্রূর স্বর্ণযুগে, তুমি জানতে পাবে
কেউ, কারোর পাশেই, দেখা বৃষ্টিভিজে পারছে না দাঁড়াতে-‘
এখানে প্রশ্ন একপ্রকার সংকটের কথা। আমাদের নির্লিপ্ততা, বন্দিত্বের কথা। এটা কেন? কেন এমনটা হবে? এখানে স্বতন্ত্র হিসেবে কি একজন ব্যক্তি দায়ী নাকি এন্টায়ার দ্য সোসাইটি, স্টেট, ল? -এভাবেই কবি অনেক দৃশ্যকল্পের ভীড়ে এইসব বিষয়গুলো জানান দিচ্ছেন।
‘কথা’ কবিতাটিতে আমার মনে হয়েছে- এখানে মনুষ্যজীবনের নিজস্ব অবস্থানে পাওয়া-না-পাওয়ার আক্ষেপের এক ইঙ্গিত।যেমন,
‘যেদিক দেখি-
সবই লাগে ফ্যাসিস্ট মতন’
আর তখন এই নিজস্ব অবস্থানের ভেতর সত্তাটি আছে তার মধ্যে গড়ে ওঠে বিরক্তিকর, হতাশামূলক এক পানসে মনোভাব। মনে হয় সবকিছুই তার প্রতিপক্ষ। বিপরীতে। এখানেই রাজনীতি কারণ মানবজীবন তো আর রাজনীতির বাইরে নয়। আর সেটা সম্ভবত এইভাবে প্রকাশিত হয়।
‘বিলের নিষাদ-স্বৈরাচারী
বাউল-মাটি-স্বৈরাচারী
বকুল-আতপ-স্বৈরাচারী
কোকিল-বেহাগ-স্বৈরাচারী’
আবার কবিতাটির পরের অংশে,
‘গভীর কোনো আকাঙ্ক্ষাতে
চালতা ফুলের
বদল ঘটে
ফুটছে পুলিশ
ভোরের সাথে’
সময়ের রাজনীতিতে রূপান্তরটা সম্ভবত এভাবেই ঘটে। দিনের সাথে সাথে শৃঙ্খলার বেড়িতে
আবার, যখন কবি বলেন,
‘ যখন তুমি বলতে এলে, নারী-
শহরজুড়ে
নীরবতার দারুণ আহাজারি’
আর সেই পরিবর্তনের ফলটা সম্ভবত এখানেই হয়। অন্যের মধ্যেও যে কিছু ঘটতে পারে- আত্মপক্ষ সমর্থন থাকতে পারে কিছু বলা, ভাষার অনুভূতির মাধ্যমে সেটাও আমার মনে হয় কবিতায় ফুটে ওঠে।
***
আবার, ‘তালতলা’ কবিতাটিতে যে শুধু কবির জন্যে মনে রাখার ব্যাপার তা কিন্তু নয়, এখানে তা বৃহৎ অর্থে হতে পারে। বৃহৎ অর্থে সবার প্রতি স্বতন্ত্রভাবে। শৈশব, কৈশোর, স্মৃতিকাতরতা, ঐতিহ্য। এখনকার সময়ে তো সেসব ভুলতেই বসেছে।রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, কলহ, ডিপ্রেশন, অপরাধের রেষারেষিতে মানুষকে কবির শোনাতে হচ্ছে,
‘আমাকে মনে রেখো, তালতলা
আমাকে মনে রেখো, সাতবিল
আমাকে মনে রেখো, মাধুডাঙা
মায়ের বাম গালে যে আঁচিল-
আমাকে মনে রেখো, শিমফুল
আমাকে মনে রেখো, ছোট নাও
আমাকে মনে রেখো, শিশু পাতা’
আবার ‘কুসুম ও তার না ফোটাটুকু’ কবিতায় আমার মনে হয়েছে এবার কবি একটা দৃশ্যমান পলিটিক্সের ভিতর দিয়ে যাচ্ছেন।জীবন ও রাজনীতির মাঝে সেখানে দেখা যায় মানুষের অবস্থা, শূন্যতা, ব্যক্তির বিষাদাক্রান্ত অনুভূতি। আমার মনে হয় এই বইয়ে সে রাজনৈতিক সময়গুলো যেখানে মানুষের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, সংকটসহ আরো নানান যে গভীর বিষয়গুলো সেগুলো যতটুকু না প্রত্যক্ষভাবে বিকশিত হয়ে তার থেকে পরোক্ষভাবে নানান ঘোরে, উপমায়, রূপকে পাঠকের নিকট উপস্থাপিত হয়েছে এবং তা পাঠক বুঝে নিতে সক্ষম আর তখন তা পাঠকের চিন্তায় রেখাপাত করছে প্রবলভাবে। ভাবাচ্ছে কবিতাগুলোর ব্যাপারে।
তবে আলাদাভাবে যদি বলি তবে বইয়ের শেষ দীর্ঘকবিতাটি
‘মোহাম্মদ, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’
কবির একটি অসাধারণ কাজ। এই কবিতাটিতে আবিষ্ট হয়েছি বেশি। যে সুরেলা একটা দ্যোতনা আছে সেটা অন্তত এক বিকেল জুড়ে মন দোলাতে ও মস্তিষ্ক নাড়াতে সক্ষম। এখানেও আমি আশ্রয়ের ব্যাপারটি পাই একেবারে মনের গহীন থেকে। এক তীব্র আকুতিতে। এই ইমেজগুলোর ভিতরেও একপ্রকার শূন্যতা খুঁজে পাই, শিল্পায়নের একটা বড় প্রভাব খুঁজে পাই, চোখে ভেসে ওঠে।এই ইমেজগুলো কি বাস্তবে আস্তে আস্তে শ্বাসরোধ হয়ে যাচ্ছে না? বদল ঘটছে না? পড়ছে তো অবশ্যই। ফলে জীবনযাপন হয়ে গৎবাঁধা জীবনযাপন। শব্দগুলো হৃদয়ে আঘাত করে। আর এই যে কৃত্রিম বিলুপ্তটা হচ্ছে ভেতরে ভেতরে তখনই আশাবাদী এক আশ্রয় খুঁজি, মানসিক শান্তি খুঁজি।
‘ মৃত্যু টুপটাপ ঝরে যায়
অন্ধ এসরাজে দিনমান
কোথাও বোধ নেই হাওয়াতেও
আলোর গন্ধতে কেরোসিন-
তোমাকে ডাকে তারা, হৃদয়ের
রাহমাতাল্লিল আলামিন’
এতোকিছুর ভীড়ে কিছু কিছু কবিতা পড়ে মনে হয় এখানে দৃশ্যের অবতারণাটা সম্ভবত একটু বেশিই হয়ে গেলো, বাস্তবিক নগর যন্ত্রণার যে ব্যাপারগুলো লুকিয়ে রয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে সেগুলো ভবিষ্যতে কবি আরো তীব্র, প্রকটভাবে তুলে ধরবেন কবিতায়- সে আশা, প্রত্যাশা রাখি কবির প্রতি।
—সারোয়ার রাফী
বইটা নিয়েছি এবারের মেলা থেকে। কবি হাসান রোবায়েতকে চিনি ২০১৯ এ এসে। ফেসবুকের কোথাও একটা কবিতা পড়ে তাকে রিকোয়েস্ট পাঠাই এবং তিনি গ্রহণ করেন। তারপর থেকে তার আইডিতে পোস্টকৃত কবিতাগুলির নিয়মিত পাঠক বলা যেতে পারে আমাকে। আমি মূলত ফেসবুকের হাবিজাবি কবিদের কবিতা নিউজফিডে এলে স্কিপ করে যাই (কয়েকজন ব্যতিক্রম)। এই ব্যতিক্রমদের ভেতর হাসান রোবায়েত একজন।
যার কোনো লেখা একবার আংশিকও ভাল্লেগে যায় তার পরবর্তী লেখাগুলি খুব খুঁটিয়ে পড়া আমার অভ্যেস।
বিভিন্ন জায়গায় কথাবার্তা বলে এবং নিজে কিছুদিন নোটিস করে বুঝতে এবং জানতে পারলাম রোবায়েত কবিতা নিয়ে ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আসলে কি কাজ করছেন তা জানার জন্যে বলা যেতে পারে এক প্রকার পরীক্ষামূলকভাবেই বইটি সংগ্রহ করা।
আমি বিশেষ করে কোনো লেখককে সামনাসামনি প্রেইজ করি না, পেছনে এডমায়ার করি যদি তার লেখা আমার ভাল্লাগে। এই বইটা পড়ার পর হয়তো প্রথমবারের মতো আমি রোবায়েতকে নক করে বলি দাদা আপনার কবিতাগুলির ভেতর কয়েকটা দেখবেন টিকে যাবে। কেনো বললাম এই ব্যাপারে পরে আসি। কিছু কবিতা পড়ার পর আমার ভেতরে এক প্রকার ধাক্কা লাগলো, ধুম মেরে বসে থেকে ওইদিন রাতের বেলা আবার পড়লাম। এবং সিদ্ধান্ত নিলাম এর ব্যাপারে আমায় কিছু লিখতে হবে।
রোবায়েত কবিতা নিয়ে কতো বিস্তৃত এক প্রজেক্ট হাতে নিয়ে এগুচ্ছেন তার কিছুটা আন্দাজ হলেও এই বইটি পড়লে পাবেন।
বইটা বস্তুত বর্তমান বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপট এবং অবস্থা নিয়ে লেখা কিছু অসাধারণ কবিতার একটা হাই ডোজ টনিক।
যা আমাকে বেশ কয়েকদিন ভাবিয়ে ছেড়েছে। আমি হয়তো তেমন বড় কোনো পাঠক নই। এই লেখাটা সমালোচনা নাকি রিভিউ তাও জানি না। কারণ দুইটার কোনোটাই আমার ভালো আসে না। নিজের অনুভূতিগুলি নিজস্ব ভঙ্গিমায় লিখবার চেষ্টা করছি এই আরকি।
কেউ কেউ হয়তো কবিতাগুলি পড়ে তাকে স্যাটায়ারধর্মীর ক্যাটাগরিতে ফালায়ে দিতে পারেন, আমি বলবো না। বইটা আগাগোড়া এক তীব্র প্রতিবাদ। এখন হয়তো আপনারা আমার এইসব বিনয়ে গইলা যাওয়া মার্কা লেখা দেইখা কবির মুরিদ কিংবা বায়াজড বইলা ঘোষণা করতে পারেন, জানায়ে রাখি এই কবিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না এবং তার প্রতি আমার ন্যুনতম দুর্বলতা নাই।
প্যাঁচাল শেষ, এবার কাজের কথায় আসি।
বইটি খোলার পর রোবায়েত আপনাকে প্রথমেই আটকে দেবে এই বলে —
‘যখন আমার
চোখের পাশে
বাড়ছে ক্ষত
ফুল তখনো
ফুটছে মাদারচোদের মতো—
এই চিৎকারের মাধ্যমে তিনি শুরু করেন তার প্রতিবাদ এবং গবেষণার ম্যারাথন।
যদিও তিনি ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদীদের মুখে ধিক্কারের পর ধিক্কার ছুড়ে মেরেছেন তাও আপনি কবিতাগুলিকে সরাসরি মিছিলের স্লোগান মার্কা শ্লোক ভেবে সাইড করে দিতে পারেন না, দেখেন তিনি কি বলছেন
★
ফ্যাসিবাদী দিনরাত্রি
কোমর তোলে সাপ
দিনাজপুরে লেবুর ঘ্রাণে
অংশত সয়লাব
বুঝলেন তো?
আসেন তার কবিতা নিয়া কাজের একটা খুঁটিনাটি দেখাই
তিনি বললেন,
★
গমের বাতাস, এমন প্যানোরামা–খুনে
তুমি বর্তুল
তুমি শ্রেণীদেশ হয়ে
শরীরী –গর্ভের দিকে যাও
বিসর্পিল এই ফুটা নির্জন গড়ে তোলে হাওয়ার মর্মর লেবুগাছটির নিচে—
রোবায়েত এই বইয়ে দুইটি কবিতা রেখেছেন, একটি সূরা ইয়াসিন এবং অন্যটি মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
এখন হয়তো এ দুটি কবিতা পড়ে অনেকেই কবিকে আঙুল দেখাতে পারেন যে তিনি কি তার ধার্মিক চিন্তাধারা কোনোভাবে ঢোকাতে আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছেন? এই উত্তর কবি ভালো দিতে পারবে। তবে একটা আপেক্ষিক উত্তর আমি টানতে পারি এই যে, কবিতার ভাব এবং মর্মার্থ যদি আমি নিজস্ব পয়েন্ট অভ ভিউতে দেখি এইটা কিভাবে নিলাম তা নির্ভর করে একান্তই আমার উপর।
তিনি সুরা ইয়াসিনে বললেন
‘তুমি সঙ্গ ও নিঃসঙ্গের
টানাপোড়নেই ভাবো ’কই যাই—!’
ভাবো, এই সময়েই ছোটো কৌটায়
মা খুঁজতেছে ভেজা দেশলাই
বাবা রিটায়ার্ড বাবা ক্লান্ত
সুরা ইয়াসিন ঝুলে দেয়ালে
এই কবিতাটি পড়ে আমি নিজেরে প্রশ্ন করলাম তিনি কি আমারে জীবনদর্শন শেখাতে চাইলেন? তার ভাষা উপস্থাপনের মুন্সিয়ানা দিয়ে যদি তিনি তার নিজস্ব ওয়েতে তাই চেয়ে থাকেন তবে তাকে অভিনন্দন।
আমি পড়লাম
★
তবুও বালিহাঁস ঠোঁটে তার
রোদের সানোয়ারা মারে ঝিম
পাথরের বাতাসে মাছরাঙ্গা
নিভৃত আকাশের নিচে দিন—
ডাকছি তোমাকেই, হৃদয়ের
রাহমাতাল্লিল আলামিন—
রোয়ায়েতের একটা গুণ আমি ঠাহর করলাম যে তিনি বাতুলতা পুরোপুরি বিসর্জন দিতে পেরেছেন। যা তাকে পড়তে গিয়ে আমায় মগজে আরাম দিয়েছে।
তিনি যে সাবলীল এবং সরল তার প্রমাণ দিলেন এভাবে
★
এখানে নদীর নাম জলমিতা
এখানে আকাশ নীল বহুদিন
এখানে ভেড়ারা চড়ে সারা গ্রাম
এখানে তোমার মুখ কি মলিন!
কিছু জায়গায় হয়তো আপনি ভ্রু কুচকাতে পারেন এই ভেবে যে রোবায়েত কি মডার্নিজমের পথে হাঁটতে গিয়ে আপনাকে সহজ জবানীতে দুর্বোধ্য শব্দ অথচ নিজের স্টাইল ব্যবহারের চটুলতা গেলাতে চাচ্ছেন?
যেমন,
★
মার্কারি বন ডুবছে সহসা —
এমন কুয়াশা
প্রভূত ওড়ার ধুনে
হাজার হাজার শিলাবায়ুহেম— চোখের ফসল হয়ে নেমে আসে
শিকারি তাদের পায়ের চিহ্ন
ফেলে গেছে বহু পাখির হৃদয়ে—
কবিতাটির নাম শূন্যতার প্রভূত গরাদ।
রোবায়েতকে পড়ে বুঝতে পারলাম তার নিজস্ব একটি দর্শন রয়েছে, রয়েছে গাটস এবং মেধা। তিনের সমন্বয়ে তিনি তীব্র গতিতে আগাচ্ছেন। আশা করি তার এই ম্যারাথন অব্যাহত থাকবে। এবং আমরা তার পরিশ্রমের স্বাদ নিয়ে যেতে পারবো।
তিনি আমাদের বলে যাবেন
★
আঠারো কি সাল–ই শুধু
হিংসা ঝরা বন
সারা হাওয়ায় উড়ছে ধু ধু
অজস্র অ্যাপ্রোন
কবির প্রতিবাদ তার প্রতিভার কল্যাণে জাড়ি থাকুক এই ইচ্ছা প্রকাশ করি। তিনি তার কবিতায় অতি সূক্ষ্ম যেই কথাবার্তা অত্যন্ত ব্রডলি বলে যাচ্ছেন তার এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন আছে।
আমরা শুনতে চাই
★
কুয়াশাক্লান্ত এ ফ্যাসিবাদে
প্রেতের উড়ে যাওয়া সন্ধ্যায়
পালংবনে কার পাখি কাঁদে
গোধূলি বেজে ছিলো মনীষায়।
তার বাক্যের শক্ত গঠন, শব্দের স্মার্ট প্রয়োগ আমাদের অভিভূত করে যাবে আশা রাখি। আমি সিদ্ধান্তে আসিনি যে রোবায়েত অমুক পাঠকদের জন্যে কবিতা লিখে যাচ্ছেন, তিনি যদি ধর্মীয় দর্শন শো আপ করে যেতে ভালোবেসে থাকেন তবে করতে পারেন, সেটা যে যার পয়েন্ট অব ভিউতে গ্রহণ করবে। তবে তার মেধা সাথে সাথে প্রতিবাদ এবং হুঙ্কার জাড়ি থাকলে বাংলা কবিতায় নতুন এক বিগ থিং আসতে চলেছে।
তার পরিশ্রম, কাজ, মেধা এবং সাহসের অভিবাদন জানিয়ে শেষ করছি, কবি হাসান রোবায়েতের জন্যে শুভকামনা।
— আবির আবরাজ
কাব্য: এমন ঘনঘোর ফ্যাসিবাদে
কবি: হাসান রোবায়েত
প্রকাশক: ঢাকাপ্রকাশ
প্রচ্ছদের ছবি: কবি
নামলিপি: কাজী যুবাইর মাহমুদ
পাঠকের মূল্য: ১০০ টাকা
বইমেলা প্রাপ্তিস্থান: মেঘ (স্টল নম্বর ২৭৩). ফেস্টুন (লিটলম্যাগ চত্বর)