‘একাত্তর আর বাহান্ন নিয়ে কোন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ নেই’ – নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ।। আলাপকারী : জুয়েইরিযাহ মউ

সমস্ত সংকটের পরেও আমরা আজও মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে বসেই শুনে যেতে পারছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। এই প্রাপ্তি অসংখ্য বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দিতে পারে সময়কে, দেশকে, জাতিকে। এরকম একজন মুক্তিযোদ্ধার সামনেই বসতে চেয়েছিলাম সেদিন মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে। ইতিহাসকে জানতে। আর কেবল মুক্তিযোদ্ধা নন এমন একজন অগ্রজের কথাও মনে পড়লো তখন যিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসের সাথেও জড়িত আজও, এখনো।

এসমস্ত কিছু ভাবতে ভাবতেই ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে পৌঁছে গিয়েছিলাম বাংলামোটর। শ্রদ্ধেয় নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ভাইর অফিসে। সেদিন তিনি প্রচণ্ড ব্যস্ত। নানান কাজ। তবু টানা দেড় ঘন্টা কথা বলে গেলাম তাঁর সাথে, আমার মনে জমে থাকা প্রশ্নের পর প্রশ্ন তখন উঠে আসছে একের পর এক। কথা হলো মুক্তিযুদ্ধ আর সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে এর সুদূরবিস্তারী প্রভাব নিয়ে। দীর্ঘ আড্ডা হলো। সেদিনের সেই আলাপনের বিশেষ অংশটুকুই জমা আছে এখানে।

জুয়েইরিযাহ মউ



“একাত্তর ও বায়ান্ন নিয়ে কোনো গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ নেই”

নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু’র সঙ্গে জুয়েইরিযাহ মউ’র আলাপচারিতা

 

রাস্তায় রাস্তায় যখন বেজে চলছে বিজয়ের গান। তখন বাংলাদেশ আর মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে কিছু কথা জানতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে। তিনি নাসির উদ্দীন ইউসুফ। নাট্যব্যক্তিত্ব, নাট্য নির্দেশক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগঠক, উদ্যোক্তা কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সমস্ত পরিচয়কে মনে রেখেও বসেছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি। আলাপচারিতার কিছু অংশ পাঠকের জন্য …

‘গেরিলা’ দিয়েই কথা শুরু করছি,কতটা সফল এ চলচ্চিত্র? এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে কতটা পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলে মনে হয়?

  • ‘গেরিলা’ কতটা সফল সেটা তো তোমরা বলবে তবে হ্যাঁ তরুণদের কাছে পৌঁছোতে পেরেছি বলে মনে হয়। মনে আছে কি না গনজাগরণ মঞ্চের আগে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটা ‘গেরিলা’ তরুণদের মাঝে নিয়ে আসতে পেরেছিল। হলভর্তি তরুণেরা ‘জয় বাংলা’ বলতে বলতে বের হয়েছে এ স্মৃতি ‘গেরিলা’ দিয়েছে।

চলচ্চিত্রে কিংবা মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে এসেছে তা কি যথেষ্ট। বাংলাদেশের মানুষের একটা মনস্তাত্বিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল যুদ্ধ সেসময় ব্যক্তির সংকটাপন্ন অবস্থাকে কি মঞ্চে বা চলচ্চিত্রে আমরা ধরে রাখতে পেরেছি?

  • না সেভাবে আসেনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে সবচে দুঃখের বিষয় কি জানো, এই এতো বড় ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেছে অথচ এর কোন গ্রেন্ড ন্যারেটিভ নেই। উপন্যাস বা গদ্য যদি লেখা না হয় তবে সমাজ, জীবন বা মানুষ আসে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটা চেষ্টা ছিল ‘খোয়াবনামা’ তে বা ৬৯-এর কে ধরে রাখতে ‘চিলেকোঠার সেপাই’ আছে, সেলিম (সেলিম আল দীন) এর কিছু লেখা আছে। হুমায়ুন আহমেদ-এর একটা চেষ্টা ছিল ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’। আহামরি কিছু না, তবু একটা চেষ্টা ছিল। সেলিনা হোসেন সাতটা উপন্যাস লিখেছিলেন তার মধ্যে একটা ভালো। কিন্তু আমার পয়েন্টটা হচ্ছে অন্য জায়গায়, এই যে উপন্যাসে তেমন ভাবে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে আসা গেল না তাতে একটি জাতির মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনাটা শিল্পগতভাবে ধারণ করতে অক্ষম হয়েছে। তুমি যখন ছোট চরিত্র বা ঘটনার কথা বলছো, তোমার মহাভারত, ওডিসি বা শাহনামা থাকলে তুমি ছোট চরিত্রকে নিয়ে ভাবতে পারো। আমাদের তো নেই সেটাই। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ব্যক্তির সংকট মঞ্চে বা চলচ্চিত্রে সেভাবে আসেনি।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা মোরশেদ-এর চলচ্চিত্রটা (অনিল বাগচীর একদিন) নিয়ে ৫৩টা হবে মনে হয় সর্বমোট। এটা তেমন কোন সংখ্যা হল?

‘১৯৫২’ প্রবলভাবে অনুপস্থিত আমাদের নাটক-চলচ্চিত্রে-সাহিত্যে। কেন?

  • এটা নিয়ে অনেক অভিযোগ অনেকবার লিখেছি-বলেছি। বাঙালির সবচে বড় ব্যর্থতা হল ১৯৫২-কে বাঙালি সেভাবে ধারণ করেনি। গানে-কবিতায় করেছে কিন্তু উপন্যাসে করেনি। কবিতা দিয়ে বোধের বিকাশের জায়গাটায় চর্চা করে পৌঁছতে হয়। আর উপন্যাসের সুবিধা হল একজন পাঠক প্রবেশ করে চরিত্রের সাথে হাঁটতে থাকে তখন পাঠকের অভিজ্ঞতার পাঠ ভিন্ন হয়। সে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বাঙালি যায়নি। না যাওয়াতে এই বিপত্তি ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ ‘গোড়া’ লিখে বাঙালিকে বাঁচিয়েছিল, নয়তো আমরা হয়তো স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে জানতামই না। কিন্তু এই বাংলায় দেখো ৪৭-এর পর আর বড় উপন্যাস নাই। এজন্যই দেখা যায় মঞ্চে ‘কবর’ ছাড়া ৫২ আর নেই কোথাও। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে জহির রায়হান-এর ‘জীবন থেকে নেয়া’ যদি বলি তাও প্রতীকীভাবে উপস্তিত হয়েছে ভাষা আন্দোলন। হ্যাঁ যেটা বলছো ঠিক ভাষা আন্দোলন নিয়ে বড় কোন চলচ্চিত্র একটাও হয়নি। আমার একটা ইচ্ছা আছে, স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেছি। এটা নিয়ে কাজ করতে চাই, দেখা যাক্‌ … একটা গ্রেন্ড ন্যারেটিভ করবো ভাষা আন্দোলন নিয়ে। কিন্তু ব্যক্তির সংকটকে ঘিরে করবো না। কেননা ব্যক্তির সংকট ঘিরে করলে হয় কি সমালোচনার জায়গাটায় দাঁড়াতে হয়। মানুষ খুব ক্ষেপে যায়। সেখানে অসুবিধা নেই কোন, ক্ষেপতেই পারে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে সার্বিক অর্থে বাঙালির ভাষার আন্দোলন নিয়ে কাজটা করতে চাই।

এই জিনিসটা নিয়ে তবে প্রশ্ন করতে চাই, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ইতিহাসের রিপ্রেজেন্টেশন কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন? যেমন মেহেরজাননিয়ে বিতর্ক হল। এটা কিভাবে দেখেন?

  • আমি মনে করি ‘মেহেরজান’ বন্ধ করার কোন কারণ ছিল না, এটা চলতেই পারতো। প্রতিটা ব্যক্তিরই তো অধিকার আছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার একটি জীবনকে। ৭১ তো সবার জীবনকেই ওলোট-পালোট করে দিয়েছিল। ভিন্ন একটা মাত্রা পেয়েছে ঘটনাটা। ঠিক আছে। কিন্তু সংকটটা অন্য জায়গায়। বাংলাদেশের বর্তমান যে অবস্থা তার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের সাথে একজন মুক্তিযোদ্ধার দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে এমন কিছু এই সময়ে দাঁড়িয়ে দেখানোর পক্ষপাতি আমি না। দেখো ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ-এর তিন ঘন্টার সেই ছবি ‘বার্থ অব আ নেশন’ এ দেখানো হল কালোরা মারছে সাদাদের। তাতে সেই সময় আমেরিকায় গ্রিফিথ-এর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই চলচ্চিত্র একটি আকর ছিল, সেই চলচ্চিত্র থেকে আইজেনস্টাইন-এর মন্তাজ এল, পুদভকিন-এর লিরিক্যাল মন্তাজ এর ধারণা এল। গ্রিফিথ ক্ষমা চেয়েও কাজ হয়নি। যে কোন নেশন কিন্তু এটাই করবে বটে। কিন্তু এটা ইতিবাচক নয়। চলচ্চিত্রে প্রচলিত ন্যারেটিভের বাইরে দাঁড়িয়ে কাজ করলে এই জটিলতাগুলোর সৃষ্টি হয়।

ইতিহাসের ভিন্ন পাঠ থাকবে, থাকতেই হবে। তবে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পিরিয়ডটাকে ক্রিটিক্যালি দেখার পক্ষপাতী না আমি। এখন পর্যন্ত বলছি কারণ মুক্তিযুদ্ধের যে পজিটিভ জায়গাটা আছে সেটাইতো ছড়িয়ে পড়েনি এ রাষ্ট্রে। এখন ঐ একটা স্পেসে পা দিলে যদি পা-টা পিছলে যায়, তখন সে পতনের দায়ভারটা কে নেবে বলো? সেদিন দলে (ঢাকা থিয়েটার) একটা নাটক পাঠ করছিলাম সৈয়দ শামসুল হক-এর ‘অন্তর্গত’, সেখানে দুই মুক্তিযোদ্ধার কনফ্লিক্ট দেখানো হচ্ছে ১৬ই ডিসেম্বরের সকালে একটা বিষয় নিয়ে। তো দলের ছেলেমেয়েরা বলছে এটা দেখানো কি ঠিক হবে? কিন্তু আমাদের মধ্যে কি দীনতা ছিল না, ছিল তো। প্রতিটা মানুষের মাঝেই থাকে। তবে এখন এসব বলার সময় না যখন রাজাকারদেরই মন্ত্রী বানিয়ে রেখেছিলে তোমরা, না না তোমরা না আমরা বানিয়েছিলাম (হাসি)।

যাহোক, তো এটার জন্য আরও পঞ্চাশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সেসময় তোমরা বেঁচে থাকবে এবং দেখবে যে নানান ভাবে ক্রিটিক্যালি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে গবেষণা করে, বিশ্লেষণ করে কাজ করা হচ্ছে।

আপনাদের সমকালীন অনেক সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব-নাট্যকর্মী ছিলেন যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, এমনকি অনেকে নাকি নয় মাসজুড়ে দশটা-পাঁচটার অফিস করেছেন শোনা যায়। দেশে কত জন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল আর কতজন বিপক্ষে ছিল বলে মনে হয় আপনার?

  • শোন একটা কথা বলি সবাই কি যুদ্ধ করে, করে না। আমরা যুদ্ধ করেছি আড়াই লাখের মতোন মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের সমর্থন করেছে পাঁচ কোটির উপরে সাধারন মানুষ। এক কোটি দেখা গেছে বিদেশে চলে গিয়েছিল। এখন সব লোক তো বিদেশ যেতে পারতো না।

আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজনরাই অফিস করেছেন, ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন। হ্যাঁ তারা সমর্থন দিয়ে গেছেন। গোপনে আমাদের টাকা দিয়েছেন।

কিন্তু প্রায়ই বলা হয় মুষ্ঠিমেয় রাজাকার, এ কথাটাও ঠিক না। আমার মনে হয় ধরো ছয় কোটি পক্ষে ছিল এক কোটি বিপক্ষে ছিল। এখন সেই এক কোটি বৃদ্ধি পেয়ে তিন কোটি হয়েছে।

আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র-নাটক কিংবা চারুকলা সব ক্ষেত্রেই কলোনিয়াল ধারার উপর ভিত্তি করে পাঠ্যসূচী সাজানো হয়। এতে দেশজ যে সংস্কৃতি তা নিয়ে কাজ করতে হলে একাডেমিক কাঠামোর চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়োজন পড়ে শিক্ষার্থীদের। এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?

  • এই কথাটা আমি আর সেলিম আল দীন গত ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে বলছি। কলোনিয়াল মাইন্ড সেট আমাদের পশ্চাৎপদ করে রেখেছে। আমরা মনে করি সাদা মানেই সুন্দর। আমাদের থিয়েটারের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক থিয়েটার চলছে আবার আরেক দিকে চলছে আধুনিক থিয়েটার এবং বাঙালির নিজস্ব নাট্য ধারা। কিন্তু তুমি যখন তিনশ বছর আগের বস্তাপচা কলোনিয়াল পাঁচ অঙ্কের নাটক তাদের মতোন করে করতে চাও সেটা কি এখানকার জন্য প্রযোজ্য হবে? হবে না তো। আমি আর সেলিম এ তত্বটা দিলাম যে আমরা আমাদের মতো করে করবো। যেমন- ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নাটকে আমি আঙ্গিকগত জায়গা থেকে মণিপুরী নটবালা এবং আমাদের পালা দুটোকে মিশিয়ে পাঁচালী আঙ্গিক তৈরি করেছিলাম। আশার বিষয় হল এখন ধীরে ধীরে সেলিম (সেলিম আল দীন) এর বইগুলো কলকাতায় পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। আগে কিন্তু করা হয়নি। সেলিম গেঁয়ো, গ্রাম্য এ কথাগুলো আলোচনা হয়েছে পূর্বে।

ঋত্বিক ঘটক-এর চলচ্চিত্র কিন্তু পুরোদস্তুর বাঙালির চলচ্চিত্র। একইভাবে দেখো সত্যজিৎ হাইলি ওয়েস্টার্ন কিন্তু প্রাণটা ছিল বাঙালির। পাঠ্যসূচী সাজানোর বিষয়ে বলবো আসলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা আছে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে।

আপনার কি মনে হয় একজন নির্মাতার রাজনৈতিক আদর্শ থাকাটা জরুরী?

  • আমার মনে হয় একজন নির্মাতার দু’টি আদর্শ থাকা জরুরী। একটি শিল্প-আদর্শ অন্যটি রাজনৈতিক আদর্শ।

আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বিস্তারিতভাবে নেই, এ ব্যাপারে কি বলবেন?

  • ঐ পাঠ্যপুস্তকগুলো জ্বালিয়ে দাও (হাসি)। আমার কথা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অত্যন্ত সহজ করে বাংলাদেশ স্টাডিজ এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একসাথে পৃথক বই করতে হবে।

বর্তমানে এই ব্লগার-প্রকাশক হত্যা, অস্থিরতা সাধারণ মানুষ এর কথা যদি বাদ ও দেই, সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যেই অনেককে এসব ব্যাপারে নিস্পৃহ দেখি। দিন দিন এটা বৃদ্ধি পাচ্ছে মনে হয়, কেন হয় এটা?

  • আমাদের এখানে আসলে কি হয়েছে, এই আমাকে আমার বন্ধুরা বলে, খুব কষ্ট লাগে। শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত উনারাই বলেন – এই যে বাচ্চু এসব করছো। এই আন্দোলনের এখন দরকার কি। অথচ এরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধেরই পক্ষের লোক, কিন্তু নিজের যে অবস্থান তৈরি হয়ে গেছে সমাজে সেটা আর ভাঙতে চায় না। গাড়ি ভাঙচুর, পেট্রোল বোমা এসব তো অস্বাভাবিক। ও এসব দেখতে চায় না। ও কিন্তু আবার হেফাজতকেও ঢাকা শহরে দেখতে চায় না। ও নিজের গাড়িটা নির্বিঘ্নে চালাতে চায়, পরিবার নিয়ে শান্তিপূর্ণ সময় চায়, এটুকুই। মানুষ স্বাভাবিক জীবন চায়, এটা দোষের কিছু না। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাস করবে কি না, যারা স্লোগান দিয়েছে তারা সবাই কিন্তু যুদ্ধে যায়নি। যুদ্ধে গেছে এমন মানুষ যারা যুদ্ধ করবে কেউ ভাবেই নি। তো এই জায়গায় একটা ছাড় আমাদের দিতে হবে। আমাদের ভাবতে হবে একটা সংসারে যেমন সবাই কাজ করে না তেমনি একটা দেশে বা রাষ্ট্রে সবাই সমান দায়িত্ব নেয় না।

সাংবাদিকতা-র ভাষা নিয়ে কথা বলতে চাইছিলাম, দেখুন ইদানীং প্রায়ই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বা চ্যানেলগুলোতে রাজাকারদের ‘তিনি’ সম্বোধন করে খবর প্রকাশিত হয় অথচ একজন মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে ‘তাঁর’ লেখা বা বলা হয় না। এ ব্যাপারে কি বলবেন?

  • ৭৫ পরবর্তীকালে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাড়া আর কাউকে ‘আপনি’ সম্বোধন করার চর্চা গড়ে উঠেনি। রাজাকারদের অনেকে মন্ত্রী ছিল এক সময়। তো মন্ত্রী সাহেবদের তো ‘আপনি’ বলার সংস্কৃতিই স্বাভাবিক। এই মানসিকতা দ্বারা আমরা সাংঘাতিকভাবে অবদমিত এখনো। এটা পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক সরকারী সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন জরুরী এবং তর্ক-বিতর্ক হওয়া উচিৎ, আমরা কিন্তু ডায়ালগে যাচ্ছি না। ব্যাপকভাবে সংলাপ আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন এখন এসব নিয়ে।

জামাত নিষিদ্ধের ব্যাপারে কি বলবেন? অনেকে দেশে নৃসংসতার অজুহাত দেখিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছেন। জামাতের সামাজিক অবস্থান সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে কতটা দৃঢ়?

  • দৃঢ় কি দৃঢ় না তারচে বড় বিষয় নাজি পার্টি তো নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল তাইনা? তাহলে জামাত হবে না কেন? জামাত একটা যুদ্ধাপরাধী সংগঠন, কথাটি আমি বলিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এর সাতটা রায়ে মাননীয় উচ্চ আদালত বলেছেন এ কথা।

গণজাগরন মঞ্চ যতটা উদ্যম নিয়ে শুরু হয়েছিল ঠিক ততটা উদ্যম ধরে রাখতে পারেনি সামগ্রিকভাবে মানুষের মাঝে, আজ বর্তমান অবস্থায় এসে এটা কেন হল?

  • প্রথম কথা হল এটি একটি ক্ষোভের বিস্ফোরণ ছিল। তুমি জানো কি না ২০০৭ এর আগে, ৭৫ এর পরে বীরাঙ্গনা নিয়ে কোন আলোচনা হয়নি। এই গৌরবগুলোকে অগৌরবের স্থান দেওয়া হয়েছিল। মানুষ কিন্তু ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছিল। এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটানোর জন্য তরুণদের আমি বাহবা দেই, সাধুবাদ জানাই।

তারপরের ঘটনা তো জানোই, কাদের মোল্লার ফাঁসি যখন হল না প্রথম আমিই বললাম যে এ রায় প্রত্যাখান করছি। আদালত প্রাঙ্গন থেকে শাহবাগে এলাম। BOAN-এর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ছেলেমেয়েরা ছিল ওখানে। তখনও কিন্তু ঠিক হয়নি আমরা এভাবে রাতে বসে যাবো। এরপর তো রাতে মানুষ বাড়তে শুরু করলো। ক্যা্মেরা-সাংবাদিক এসে বিশাল ব্যাপার। এক্ষেত্রে মিডিয়া কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এমনভাবে প্রচার করেছে, গ্লোরিফাই করেছে বিষয়টাকে যে আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেল। সাধারণ মানুষ ঐ গৌরবটা ফিরে পাওয়ার নেশায় মেতে উঠেছিল। ঐ তত্বটা তো জানো সেন্টার ভেঙে দেওয়া, অর্থাৎ কেন্দ্রের শক্তিটাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল শাহবাগ।

আমাদের উচিৎ ছিল ১৭ই ফেব্রুয়ারি (২০১৩) যেদিন সরকার রাজি হল, পার্লামেন্টে পাস করলো যে হ্যাঁ যে কোন এক পক্ষ অর্থাৎ অভিযোগকারী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি দু’তরফই অ্যাপিল করতে পারবে। সেদিন একটা সিদ্ধান্তে আসা। এখানে বলে রাখি- প্রথমেই আমি আন্দোলনকারীদের বলেছিলাম যে একটা কমিটি করো, ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নাম দাও। কিন্তু সবাই ওরা বললো – না বাচ্চু ভাই আপনি আছেন, কমিটি লাগবে না। আমি বার বার বলেছিলাম যে আমাকে দিয়ে হবে না, আমি সাথে থাকবো কিন্তু এটা তোমাদের আন্দোলন। পরে ইমরান-কে মুখপাত্র করা হল সর্বসম্মতিক্রমে। তো ১৭ তারিখ আমি বললাম ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের বলা উচিৎ আমাদের জয় হয়েছে, ফসলটা আমরা হাতে পেয়েছি, ধান পাকলে কাটতে হয়। আন্দোলনকারীরা জয় নিয়ে বাড়ি ফিরে যাক, আন্দোলন চলবে কিন্তু রাস্তা থেকে আমরা বাড়ি ফেরত যাই। তো তখন সেটা করা হল না। এখন ব্যাপার হল কি এই লক্ষ লোক, হাজার লোক তো সাধারণ জনগণ। ও তো রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষা বোঝে না। ও দেখবে আমি কি করবো এখন, কাদের মোল্লার ফাঁসি তো হয়ে যাচ্ছে, আমার তো দাবী পূরণ হয়েছে, আমি তো দোকানে-অফিসে-স্কুলে-কাজে ফেরত যাবো।

পরবর্তীতে আরও নানান ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ঘেরাও শব্দটা ব্যবহৃত হবে না আমি বার বার বলেছিলাম সেখানে দ্বন্দ্ব হল। তো সব মিলিয়ে মানুষকে যদি ফসল দিয়ে ফেরত পাঠানো যেত তবে কিন্তু যে কোন সময় ডাকলেই সেই মানুষগুলো আবার ফিরে আসতো।

আপনার কি মনে হয় ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ যে উদ্দ্যেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল তা সফল হয়েছে?

  • কিছুটা। সামগ্রিকভাবে হয়নি। তবে হ্যাঁ এটাই বাংলাদেশের একমাত্র সংগঠন যা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব আন্দোলনে সক্রিয় থাকছে। শহীদ মিনার বলো, শাহবাগ বলো, যে কোন বিশেষ দিবসে বলো ওরাই কিন্তু পথে থাকছে।

নতুন চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করেছেন শুনলাম, বিস্তারিত জানতে চাইছি। গল্পটা কি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক?

  • না এবারের গল্পটা পৃথক। এই চলচ্চিত্রের কথা তো বিস্তারিত এখনো কাউকে বলিনি, আচ্ছা শোন। ‘আলফা’ চলচ্চিত্রের গল্পটা তৃতীয় বিশ্বের একটা লোককে ঘিরে যে গাধা নিয়ে শহরে চলাচল করে, ধরো আমি আর কী। আমার গাধাটা দেখা যায় না। (হাসি) তো সেই লোকটার কাছে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছোয় একটা লাশ। আলফা-র মধ্যে সেই লাশ নিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। লাশ কোন ধর্মের, ওয়ারিশ আছে না বেওয়ারিশ তা নিয়ে ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে চলে। অস্তিত্বের সংকট, অর্থ-বিত্ত, রাষ্ট্র আর মানুষের দ্বন্দ্ব এসমস্ত নিয়েই গল্প এগোয়।

তরুণদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু বলুন।

  • বলবো কোন বাঁধা না মানতে, বুঝলে? অশুভ শক্তিকে ভেঙে দিয়ে নতুন একটা দেশ গড়তে। এই দেশ ধর্মকে বুঝতে পারছে না। ধর্মের সাথে দ্বন্দ্বে তো কেউ যেতে চায়নি, প্রভাব বিস্তার করে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই জায়গাটায় তরুণদের আন্দোলনটা চালাতেই হবে। এটুকু যেন তোমরা বোঝো জনগণকে বাদ দিয়ে কিন্তু কিছু করা সম্ভব না। আর আমি বিশ্বাস করি এ দেশের ভালো হবে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।


 

[সাক্ষাৎকারটি পূর্বে একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত,

প্রকাশকাল – ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৫]

শেয়ার