এবছর ভালোই বৃষ্টি হলো। অন্তত বিগত তিন-চার বছরের তুলনায়। রাজধানীর আর দশটা (শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত-প্রগতিশীল-আধুনিক-বিদগ্ধ এবং জীবনযাপনে ভীরুতা-অপরাগতা-ব্যর্থতায় সাধুর পোশাক পড়া এবং ভালো মানুষের তকমাঅলা) মানুষের মতো সেই বৃষ্টিতে ভালোই দিন কাটছিলো ফয়সালের, কবি ফয়সাল আহমেদের। কিন্তু কপালে তার সুখ সইলো না। এবারের বর্ষণ একটা গোলমাল পাকিয়ে ফেললো।
এবার, মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার উঠে যাওয়া ২০১১ সালের বর্ষার দিনগুলোতে, কখনও সস্তা রোম্যান্টিকতায় বিভোর-বিহ্বল হয়ে হুডখোলা রিকশায় ভিজেছে সে। কখনওবা ক্রুর রিয়েলিটি, বরং বলা ভালো সারভাইভাল (ফর দি ফিটেস্ট) থিওরির ব্যবহারিক নমুনা হিসেবে, সেই থিওরির ছায়া নিয়ে লেখা নাটকের নাম-ভূমিকা চিত্রণ করে গেছে। অফিস শেষে বাস স্টপেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাকভেজা ভিজে, স্যুয়ারেজ উপচানো মলমূত্র, কাদা-পানি-জল মাড়িয়ে ঘরে ফিরেছে সে নিয়মিত। তারপর অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দের ভেতর গরম খিচুড়ি আর ইলিশ মাছের সালুন স্ত্রী আর কন্যার সাথে ভাগ করে নিয়েছে।
কিংবা ঠিক এরকমও নয়। অন্যরকম। আরও রিয়েলিস্ট। বোরিং। গ্রাম্য। পাশবিক। ফয়সাল ভাবছিল, কাজ-কাম, ঘুম-খাওয়ার রুটিনমাপা আটপৌরে মনোটোনাস জীবনে আবার বৃষ্টি কি? ফালতু সেন্টিমেন্ট! বৃষ্টিতে কি পেট ভরে? চাল-ডাল, তেল-মশলার দামের উত্তরোত্তর উন্নতির ব্যবসাবান্ধব দিনে মধ্যস্বত্বভোগী বৃষ্টিপাত কি পদোন্নতি, নিদেনপক্ষে ইনক্রিমেন্টের চিঠি বিলি করে? না, কিছুই করে না। বৃষ্টির কোনো ক্ষমতাই নেই। মাঝে মাঝে তাই, বৃষ্টিকে নাগরিক জীবনে বছরান্তে আসা উটকো ডিস্টার্ব্যান্স মনে করে দাঁত খিঁচিয়ে গাল দিয়েছে সে। কখনও কখনও আরও ন্যুডলি, থম মেরে থাকা গুমোট কালোমেঘে ঢাকা আকাশের জন্মদাত্রীর দিকে যন্ত্র তাক করে কোমর দুলিয়েছে। এসবের মাঝেই সে ভাবছিল, বরাবরের মতো এবারও বর্ষাটা ভালোয় ভালোয় পার করে দেয়া যাবে।
কিন্তু হিসেবে গড়বড় হলো। এ বছর প্রচুর বৃষ্টি হলো। ঢাকায় প্রতিদিনের জীবনে যেমন হয়, সে ভেবেছিল এ পোড়া জীবনে, তেমনি করে নতুন আর কোনও আলোড়ন তৈরি হবে না। আর কোনও বেদনা তাকে গ্রাস করবে না। দিনের মতো দিন, আপনাআপনি পার হয়ে যাবে। একচিমটি ছায়নটীয় ঘরানায় তৈরি মন, একমুঠো ব্যর্থ কমিউনিস্টের ছিঁচকাঁদুনে প্রগতিশীলতায় তৈরি নাস্তিক মনন আর একগ্লাস তাকদীরে (তাকদীর মানে নিয়তি, মানে স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশে, হ্যাঁ,কাব্যপ্রেমসৃজনময় পৃথিবীর এই সবুজতর ভূভাগে, সৌদি আতরের কড়া গন্ধ,সুর্মা-খোর্মা-খেজুর-দুম্বা, ঐহিক আর পারত্রিক লাভালাভের ঘুটা দিয়ে)বানানো স্যালাইন খেয়ে এ যাত্রায়ও পার পাওয়া যাবে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। একদিকে রোম্যান্টিকতা, অন্যদিকে জল্লাদের মতো খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তবতা—এই দু’য়ের দোলাচলে দুলতে দুলতে বর্ষা থেকে শরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বরবাদ হয়ে গেল। কেন জানি তার কানা মামুদের কবিতার কথা মনে পড়ে গেল।‘হাতির পালের মতো মেঘের গম্বুজ কাঁধে/ নিয়ে হাতির পালের মতো নেমে আসা আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ থেকে বর্ষার দিন যতই গড়াতে থাকল, ততই সে অস্থির হয়ে উঠল। চোখ বুজলেই প্রখর হয়ে ওঠে তার শ্রুতি। সে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ শুনতে লাগল। একসময় শ্রবণও বধির হয়ে উঠলে তার ভেতর নানা শব্দ-ভাব-ইমেজের গুঞ্জরন শুরু হয়ে গেল। সে অনুভব করলো,অস্তিত্বের ভেতর সুপ্ত এক আগ্নেয়গিরি জাগ্রত হচ্ছে প্রবলভাবে। রুপোরকাঠি-সোনারকাঠির পরশ বুলিয়ে যাকে সে সবসময় ঘুমিয়ে রাখে, এই বর্ষায় জেগে যাচ্ছে সে। তার খুব পদ্য লেখার ইচ্ছা হলো।
এই ইচ্ছাটাই তাকে স্মৃতিকাতর করে তুলল। নিমিষেই চলচ্চিত্রের মতো, মানসপটে ভেসে উঠলো এলোমেলো নানা ছবি। এক নির্জন মফস্বল, তার জন্মশহর কিংবা আরও দূরের অস্পষ্ট কালচে কোনও গ্রাম। তারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণতোয়া নদী, বর্ষায় দু’কুল ছাপানো। বর্ষায় কৃষিকাজ, কচুপাতায় টলায়মান জল। কদমফুল। ইত্যাদি। আর মনে পড়ল কানা মামুদ, মানে ৭৫ বছর বয়সী প্রায়-অন্ধ, প্রায়-বধির কবি আল মাহমুদের কথা।
ফয়সাল ভাবলো, কালিদাস থেকে শুরু করে হালের তরুণতম কবি পর্যন্ত বর্ষার নানা কবিতা লিখলেও সার্থকভাবে তার মনে রেখাপাত করেছেন আল মাহমুদই। কেন? কে জানে? তার মনে হলো, বর্ষা মানেই সৃষ্টির প্রস্তুতি। বর্ষা মানেই কৃষকের সফল কর্ষণ। জমিনের গর্ভধারণ। বীজের অঙ্কুরোদগম আর নতুন প্রাণের সঞ্চার। এসত্য যেমন প্রকৃতিতে, তেমনি কবির অনুভবেও। কবি আল মাহমুদই তার মনে এমন অনুভবের সঞ্চার করেছেন। আল মাহমুদের মতো সেও দেখতে থাকল প্রবল বর্ষণে কাঁচা মাটির উঠোনে কেউ একবার চিৎ হয়ে, একবার উপুড় হয়ে ভিজছে। আর সে বই থেকে মুখ তুলে এই গ্রহের আদিমতম পানির ধারাকে দেখছে। মনে হচ্ছে তার রক্তমাংসে যত উদ্ভাবনার বীজ সংগুপ্ত ছিল একসঙ্গে সবই অঙ্কুরিত হবে। কিংবা যেন একটা বাসনা অকস্মাৎ রক্তের ভেতর মাছের মতো ডিম ছেড়ে দিয়েছে। এমন অনুভূতি, অব্যক্ত বেদনার ভারে কবি ফয়সাল আহমেদ অবশ হয়ে গেল। একটা পদ্যের জন্ম অনিবার্য হয়ে গেল।
২.
এমন সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। সাহিত্য সম্পাদক ফোন করলেন। ফয়সাল ভাই, আগামী সপ্তাহে কবি আল মাহমুদের ৭৫তম জন্মদিন। তার সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার টাইপের একটা লেখা দেন।
ফয়সাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, একটা কবিতার সৃজনবেদনা থেকে অন্তত বাঁচা গেল। তারচেয়ে মাহমুদ ভাইয়ের সাক্ষাৎকারই ভালো। কী কী প্রশ্ন করা যেতে পারে তাকে? মনে মনে একটা কোয়েশ্চেনিয়ারের খসড়া তৈরি করতে লাগল সে।
ক. আচ্ছা আল মাহমুদ আপনি বর্ষায় জন্মেছেন। বর্ষার কবিতাও আপনার হাতে খেলে ভালো। জন্মানোর জন্য এবং কবিতা রচনার জন্য আপনি বর্ষাকে কেন বেছে নিলেন?
খ. একসময় আপনি বলেছেন, ম্যাচবাক্স কেনার টাকাও আপনার ছিল না, কেবল স্যুটকেসভর্তি কিছু বই নিয়ে ঢাকা এলেন আধুনিক কবিতার ভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করতে। পত্রিকার প্রুফ রিডার থেকে একসময় হলেন সম্পাদকও। কবিতার জন্য আপনার লড়াইয়ের কথা বলুন।
গ. একসময় আপনার কবিতায় জয়নুলের দুর্ভিক্ষের ছবির কথা এসেছে। তারপর এলো কামরুলের ব্যঙ্গবিদ্রুপ। রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর লুটপাট এমনকি সাম্যবাদের আকাঙ্ক্ষার কথাও আপনি লিখেছেন। তারপর জেলে গেলেন। সেখানে হঠাৎ একটা মায়াবি পর্দা দুলে উঠল। জেল থেকে বেরিয়ে আপনি এক পরিচিত নগরীর ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে শেষ ধর্মগ্রন্থ কোরানকে আঁকড়ে ধরলেন। কিন্তু আপনি সুফিজমের পথে বিশেষ হাঁটলেন না। আত্মার অনুসন্ধান করলেন না। আপনি সঙ্গীত পছন্দ করেন না।বখতিয়ারের ঘোড়ায় এসে আপনার বিশ্বাস আর আস্তিকতার বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট হলো। সবাই সন্দেহ করা শুরু করলো বুঝিবা আপনি মোল্লাদের ঘাড়ে সওয়ার হচ্ছেন। আপনার প্রজন্মের কবিরা সবাই দলাদলি শুরু করলেন। ‘পদাবলী’ হলো। জবাবে হলো ‘কবিকণ্ঠ’। জাতীয় কবিতা পরিষদের জবাবে এশীয় কবিতা সম্মেলন। যেন আওয়ামী লীগের জবাবে বিএনপি। কবিরা বিভক্ত হয়ে গেলেন। তরুণরা ফাঁপড়ে পড়ল। আমরা একজন বড় মাপের সুফি কবির আবির্ভাব থেকে বঞ্চিত হলাম। আপনার কবিতা নিয়ে মুগ্ধতায় একটা আঁচড় লাগল।
এই পর্যন্ত ভেবে ফয়সাল থামল। না, জন্মদিনে এইসব প্রশ্ন করা ঠিক হবে না। তিনি বিব্রত হবেন। রাজনীতির প্রসঙ্গ বরং থাক। পঞ্চাশ-ষাটের কবিদের রাজনীতি নিয়ে মহাকাল হাসাহাসি করুক। তাছাড়া এসব প্রশ্নের উত্তরে তো আল মাহমুদ বহুকাল ধরেই নিরুত্তর। এমনও হতে পারে, প্রশ্ন শুনেই তিনি গোল্ডলিফের একরাশ ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঠা ঠা করে হেসে উঠবেন। তারপর পাল্টা প্রশ্ন করবেন, মুক্তিযোদ্ধা এদেশে কীভাবে রাজাকার হয়, কবি হন মৌলবাদী, ফয়সাল? আর সাহিত্য সম্পাদকও এসব কথা ছাপবেন না। নিশ্চিত।
তাহলে আর কি নিয়ে প্রশ্ন করা যেতে পারে আল মাহমুদকে, তার জন্মদিনে? বরং নারী-প্রেম-দেহ-কাম এসব নিয়েই কথা বলা ভালো। এসব বিকোয়ও ভালো। কিংবা মৃত্যুচেতনা নিয়ে। হ্যা, তরুণ রোম্যান্টিক কবিরা মৃত্যুর স্বাদ মেশানো শরাব গেলে গোগ্রাসে। বুড়োরাও অবশ্য বোধ্য-অবোধ্য নানা কথা বলেন মৃত্যুচেতনা নিয়ে।
ঘ. আচ্ছা আল মাহমুদ, আপনার কবিতায় নারী-প্রেম-দেহ-কাম ইত্যাদি প্রসঙ্গ বারবারই এসেছে। একজন আধুনিক কবি হিসেবে আসাটাও স্বাভাবিক। তবে আমরা দেখছি, সাধারণ নারীকে ছাপিয়ে এক পরমা, এক দেবীর কথা বলেছেন আপনি। প্রথম দিকের কবিতায় তা অস্পষ্ট থাকলেও ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’-এ এসে তা আরও পরিষ্কার হয়েছে, ‘সোনালী কাবিন’-এও। আপনার কবিতায় প্রেমিকারা, নারীরা রক্তমাংসের মানুষী থেকে কখনও কামনায় বিচ্যুত ইভ, কখনও অধরা বা পরমা বা নিরাকার হয়ে উঠেছে। কখনও আবার সে মা-মাতৃভূমিও। নারীর বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা কীভাবে রচিত হয়, আল মাহমুদ?
ঙ. আপনি বলেছেন, মৃত্যু একটি অনিবার্য স্বাভাবিক ঘটনা। তবে একে মোকাবেলার জন্যই সবকিছু। সকল সৃজন। ঘরসংসার, সন্তান-সন্ততি, কবিতা, চিত্রকলা, সবকিছু…। আচ্ছা আল মাহমুদ, জন্মদিনে, মানে এই ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুচেতনা আপনাকে কীভাবে নাড়া দেয়।
ফয়সাল অবশ্য এই দু’টি প্রশ্নের প্রসঙ্গ ভেবে উত্তরটাও পেয়ে যায় নগদেই। মানে অনেকটা দিব্যদৃষ্টিতে ফয়সাল দেখতে পায় কবি আল মাহমুদ নতুন আরেকটা সিগ্রেট জ্বালিয়ে নতুন উদ্যমে বলছেন:
‘তোমাকে খুঁজতে গিয়ে প্রতিবারই পেয়েছি নদীকে,
প্রতিবারই স্রোত ছুঁই, ছুঁতে গিয়ে শাড়ির আঁচল
তোমার আবাস খুঁজে হাঁটিনি কি দিগন্তের দিকে
এখন অসীম শূন্যে তারা জ্বলে। পদতলে অনিঃশেষ জল।’
কিংবা ফয়সালকেও একটা সিগ্রেট অফার করে আল মাহমুদ বলছেন:
‘ফিরতে হবে জানি আমি
কিন্তু কবে, সে ফেরার দিনক্ষণ কবে
জানতে বড়ো সাধ জাগে
তখন কি যাকে বলে মেধা তার কিছু অংশ থাকবে শরীরে
ডাকবে কি নাম ধরে কেউ? বলবে কি
আমাদের মামুদটা দ্যাখো
কি দারুণ ভাগ্যবান
তেল ফুরাবার আগেই গিয়েছে ফুরিয়ে।’
কিংবা—
‘যেন আমি প্রজ্ঞানের জাল ছিঁড়ে পার হয়ে আয়ুর বেদনা
হয়ে যাই নিঃশ্বাসের শেষ হাওয়া
যে বায়ু ফেরে না নাকে আর কোনো মামুদের হৃৎপিণ্ড দোলাতে।’
হ্যাঁ, আল মাহমুদের একটা সাক্ষাৎকার নেয়া যাবে। আত্মবিশ্বাস পায় ফয়সাল। সাহিত্য সম্পাদককে বলে, ঠিক আছে ভাই, দেখি চেষ্টা করে কী হয়!
৩.
অবশেষে সাহিত্য সম্পাদকের অনুরোধে ৭৫তম জন্মদিনে একটি সাক্ষাৎকার নেবার সঙ্কল্প নিয়ে আল মাহমুদের বাসায় যাওয়া হয়। যেতে যেতে নানা পুরনো ঘটনা ঘাই মারে বুকে। মাহমুদ ভাইয়ের সাথে শেষ দেখা বছর সাতেক আগে। এরকম বর্ষারই এক দিনে। তখন তার বাসা গুলশানে। গুলশান অ্যাভিনিউ ধরে দু’জনে হাঁটছিলাম। চোখে কম দেখলেও, সিগ্রেট খেতে খেতে মাহমুদ ভাই আকাশ দেখে বললেন, বৃষ্টি হতে পারে। উচ্ছ্বাস নিয়ে সেদিন ফয়সাল বলেছিল, ভালোই হয়। দুই প্রজন্মের দুই কবি মিলে ভিজব প্রজ্ঞানের অভিন্ন বৃষ্টিতে। মাহমুদ ভাই মনমরা হেসে বলেছিলে, এখন আর বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে হয় না। ঠিক আছে, যদি বৃষ্টি আসে ভিজব। সেদিন আর বৃষ্টি আসেনি।
ফয়সাল, ফয়সাল আহমেদ, নব্বই দশকের কবি। কিংবা বলা যায় কবিযশোপ্রার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হলেও উদ্বাস্তু, উন্মূল। থাকা-খাওয়ার ঠিক নেই। শাহবাগ, আজিজ মার্কেট, এখানে-সেখানে আড্ডা মেরে, অগ্রজদের বাসায় ধরনা দিয়ে তার দিন কাটে। আর এসবের পেছনে লুকানো থাকে হিরন্ময় কবিতার সুলুকসন্ধান, কবিতাভাসান। সেসময় কবিতার সূত্রেই পরিচয় হয় আল মাহমুদের সঙ্গে। তারপর মুগ্ধতা, সখ্য ইত্যাদি। তারপর বহুদিন আড্ডাবাজি। ২০০০ সালের পর থেকেই কবি আল মাহমুদের দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে থাকে মারাত্মকভাবে। নিজের হাতে লেখা, লিখলেও তা পাঠোদ্ধার করা বা অন্য কোনও বই পড়া তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু কবিতা তো আল মাহমুদের পিছু ছাড়ে না। মাথায় পোনা মাছের ঝাঁক নিয়ে অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি।
সে সময় এগিয়ে এসেছিল ফয়সাল। আল মাহমুদ চোখ বন্ধ করে ধ্যানস্থ হতেন। তারপর অনর্গল বলে যেতেন। ফয়সাল সেসব লিখত। এভাবেই রচিত হতে থাকল সেরা সেরা সব কবিতা, গল্প। এভাবে লেখা হতে থাকল উপন্যাসও। সেই ৬৫ বছরেও আল মাহমুদকে সংসারের ঘানি টানতে হতো। টাকার জন্য লিখতে হতো অনেক বাজে লেখাও।
এরপর অবশ্য ছেদ পড়ে যায়। পড়ালেখা শেষ হলে ফয়সালের চাকরি হয় অন্যত্র। ব্যস্ততা বাড়ে। বিয়ে করে সংসারী হয়। আল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগও কমে যায়। এতোদিন পরে আবার তার সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া, কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে আল মাহমুদের? ভাবছিল ফয়সাল। এর মধ্যে অবশ্য আরও অনেক কিছু বদলে গেছে। মাহমুদ ভাইয়ের স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে। গুলশানের বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস পাড়ের সন্তান আল মাহমুদ আবারও বহুদিন পর ফিরে এসেছেন মগবাজারে। থাকেন বড় ছেলে শরীফ মাহমুদের সঙ্গে।
মগবাজারের বাসায় ঢুকতেই বড় ছেলে ফয়সালকে ডেকে বললেন, আব্বার শরীর বেশ খারাপ। তাছাড়া উনি ভালো করে কাউকে চিনছেনও না। ডাক্তার কথা বলাও বারণ করে দিয়েছেন। মাহমুদ ভাই যে ঘরে থাকেন সেখানে ঢুকতেই বেদনায় মনটা ভারি হয়ে উঠলো ফয়সালের। কোথায় কোরান, শেক্সপিয়র বা জালালুদ্দিন রুমির বইয়ে সাজানো আলমারি? অন্ধকার ছোট্ট একটা ঘরে, মলিন চাদরের খাটে শুয়ে আছেন আল মাহমুদ। মুখে নেই কবির চিরপরিচিত দাম্ভিক সেই অভিব্যক্তি। ছোটখাটো শরীরটাকে আরও ছোট মনে হলো। শীর্ণতর মনে হলো হাত দু’টোকে। উঠলেন। চোখে দেখছেন না। শুনছেন না কানেও। দু’তিনবার পরিচয় দেওয়ার পর চিনলেন। মুখে কিছু বললেন না। শুধু ঠোঁটের কোনায় চিত্রিত হলো বিষণ্নতার একচিলতে হাসি।
ফয়সালের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে গেল। বার্ধক্য, একাকিত্ব তাহলে এভাবেই মানুষকে চৌচির করে ফেলে, বদলে দেয়। আল মাহমুদ নয়, ফয়সালের মনে হলো, যেন দুঃখী, রোগশোকে তাপিত কিন্তু ধ্যানী এক বালক বসে আছে তার সামনে। তবে কি মৃত্যুর পথযাত্রায় মানুষকে পুনরায় বাল্যকালে, বাল্যকাল থেকে শৈশবে, শৈশব থেকে মায়ের গর্ভে ফিরে যেতে হয়?
বেশিক্ষণ বসা হয় না ফয়সালের। মাহমুদ ভাই অনেক চেষ্টার পর সাজিয়েগুজিয়ে কয়েকটা বাক্য বলতে পারলেন মাত্র—‘কবিতা হলো এক নিরন্তর পরিশ্রমের কাজ। মৃত্যুকে মোকাবেলা করতে কবির কবিতা ছাড়া আর কোনও অস্ত্র নেই। তাই কবিরও নেই কোনও বিশ্রাম। এখনও মাথায় কবিতার ভ্রমর গুঞ্জন তোলে। কিন্তু সাজাতে পারি না। পরিশ্রম হয়। দৃষ্টি-শ্রুতি-চিন্তা হারিয়ে এখন আমি জড়।’ এরপর ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে পড়লেন আল মাহমুদ। বোধ হয় ঘুমিয়েও পড়লেন।
৪.
একটি ব্যর্থ সাক্ষাৎকারের বেদনা নিয়ে ফয়সাল উঠে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। মৃত্যু বিষয়ক এক নিগুঢ় বোধ নিয়ে বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। অব্যক্তরা তাকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। দীর্ঘদিন বাদে কবি ফয়সালের লেখনি সচল হয়। সে রাতে সে একটি পদ্য রচনা করে। কিন্তু তার যুৎসই শিরোনাম দেয়া হয় না। ফয়সাল পদ্যের খসড়াটি ডায়েরিতে টুকে রাখে। মনে মনে ভাবে, মাহমুদ ভাই সুস্থ হলে পদ্যটি তাকে পড়ে শোনাবে। তার পরামর্শে শিরোনামও ঠিক করবে সে। সদ্য রচিত পদ্যটির জন্য হলেও আল মাহমুদকে দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। জন্মদিনে আল মাহমুদ সুস্থ হয়ে উঠুন, শতায়ু হোন, ফয়সাল প্রার্থনা করে। ফয়সালের লেখা শিরোনামহীন সেই পদ্যটি তুলে দিচ্ছি:
ঈশানের মেঘপাহাড় ডিঙিয়ে—মেঘফুঁড়ে, দিগন্ত বিদীর্ণ করে নিমিষেই নেমে আসো, তুমি অলৌকিক অশ্বারোহী—কালো নেকাবে অবগুণ্ঠিত হৃদয়হীন সন্ত্রাস, নির্দয়, দ্রোহী। আমি তোমারি বন্দনা করি, দ্যাখো কলিজায় উৎকীর্ণ অদেখা তোমারি মুখচ্ছবি আর সত্তার সীমানা জুড়ে দিগ্বিজয়ী, তোমারি স্পন্দন, দেশ-মহাকাল, রাজ্যপাট।শরবাণে খুব বিদ্ধ করো, হে নির্দয়—খেয়ালি সম্রাট, খুব আহত বিক্ষত করো তীক্ষ্ণ তলোয়ারে, অশ্বখুরে।
তাড়া খেতে খেতে বনান্তরে আত্মগোপনে থাকি, সন্ত্রস্ত,একাকি। অরণ্যে,ঘূর্ণিঝড়ে তোমার অজানা কথকতা সতত প্রকাশিত হে খুনে,দক্ষ তীরন্দাজ,নেশাগ্রস্ত।ঝড়ে আমি ক্ষুদ্র তৃণকুটো,তবু দ্যাখো সেজদায় মাথা নত, যেন ধনুকের ছিলা—স্নায়ু এম্নিতরো টানটান;আমি তোমারি বন্দনা করি, নিষ্ঠুর, গাই তোমারি গান।
৫.
ক’দিন বাদে আবারও সাহিত্য সম্পাদেকর ফোন: ফয়সাল ভাই, আমার লেখা কতদূর? আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার।
ফয়সাল: ভাই, লেখা তো সম্ভব নয়। মাহমুদ ভাই কথা বলতে পারছেন না ঠিকমতো। উনি বেশ অসুস্থ। চোখ, কানের পর মাথাও…।ভাই আমারে মাফ করে দেন। উনি সুস্থ্য হলে পরে লেখার কথা ভাবা যাবে।
সাহিত্য সম্পাদক: ভাই আমারে ডুবায়েন না। আপনারে একটা কিছু দেওয়া লাগবেই। নইলে বিপদ হবে। শুক্রবার পাতা ভরুম কী দিয়ে? ভালো-মন্দ, গদ্য-পদ্য-সাক্ষাৎকার, যা হয়, তারে নিয়ে কিছু একটা লেখা দেন।
ফোন ছেড়ে দিয়ে ফয়সাল কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। মনে মনে ভাবে, ঠিক আছে, একটা লেখা শুরু করা যাক। তারপর লিখতে থাকে: ‘এবছর ভালোই বৃষ্টি হলো। অন্তত বিগত তিন-চার বছরের তুলনায়…’