উপাসনা, সোনার পেরেক
সেই মাছটিকে দেখছি,
যার মুখ থেকে
সোনার বড়শি ছাড়াতে ছাড়াতে
ভেবেছিলে,
সে বড় সৌভাগ্যবান মাছ,
সোনার বড়শি মুখে নিয়ে
মরার সৌভাগ্য
কজনের হয়!
দেখছি
সেই মানুষটিকেও,
যে বলেছিল,
‘অন্তত মৃত্যুর পর
আমার কফিনে
সোনার পেরেক মেরো;—
—এটুকু প্রশান্তির লোভে
সে
ছুটে যায়
মধ্যরাতের দিকে,
সামান্য আভা
যখন
কোথাও সাক্ষ্য দিচ্ছে
অগ্নিকুণ্ডের।
কাঠ পুড়ছে,
ফুল পুড়ছে,
পরিধেয় জামা পুড়ছে।
তিনি শুয়ে আছেন…
—নিরুপায় ব্যাঙটির কথা
মনে পড়ে তখন।
অজ্ঞাত কারা যেন
কেঁদেছিল,
সামান্য জল
ছিটিয়ে দেওয়ার আগ্রহ নিয়ে?
যে অন্ধ দেখতে পায়নি
ওই আগুন,
আগুন
তাকেই আগে জড়িয়ে ধরেছিল।
আর
অন্ধ এমনই দুর্ভাগা,
আদতে
সে অন্ধকারও দেখতে পায় না
…এই আভা
সাক্ষ্য দিচ্ছে
কোথাও অগ্নি উপাসনার।
তোমার কী ধারণা—
ওখানে
সবাই
আগুনের সামনে
নত হতে এসেছে?
কেউ কি
আগুন পোহাতে আসেনি?
সেদিন
সবার বুড়ো আঙুলই কি
কুকড়ে এসেছিল
প্রচণ্ড শীতে—
মুক্তাসংগ্রাহক সেই বুড়ো আঙুল,
যাকে
কেউ
কোনোদিন
হন্তারক অভিধা দেয়নি।
পাখি আর বৃক্ষের মতো
একজন খুনী
আর
ঐ বুড়ো আঙুল
সমান্তরালে বাড়তে থাকে,
সেই
নিষিদ্ধ বৃক্ষের মতো—
ঈশ্বর
তোমায় বারণ করেছিলেন
আগেই
যার ফল থেকে দূরে থাকতে;
যার রস
তোমায় জ্ঞান দিয়েছিল
আর
তুমি তাকে ঘৃণা করেছিলে বলে
ফেরত পেয়েছিলে মর্ত্য—
শাস্তিস্বরূপ
যেখানে তুমি নৃত্য করছ,
ভালোবাসছ
হত্যা করছ।
…বরং কোমল হও
মা পাখির মতো,
আলখাল্লার মতো,
পরাগরেণুর মতো—
…মুচির সামনে দিয়ে
নতুন জুতা পরে যাওয়ার
কঠোরতাটুকুও
তোমাকে মানাবে না।
বরং
মুচিকে দেখলেই স্মরণ করো,
যার যতটুকু পা,
ছাপ ঠিক ততটুকু হবে।
নামো
পাতালে,
লীলা ও লালিত্য নিয়ে।
ব্রীড়ানত ফরসা শরীর
গোপন করো,
যেভাবে গোপন হয় চাঁদ,
গাঢ় মেঘ—
আর
কোনো ফরসা হরিণও
তার কালো ছায়াকে
কীভাবে অস্বীকার করবে?
মানুষ মূলত
নিজ ছায়ার দিকে তাকায়
ভেবে পরিতৃপ্ত হতে যে,
কালো হলেও
একজন হুবহু মানুষ
তাকে অনুসরণ করছে
একখণ্ড ক্ষুদ্র পারদ
মিশে যাচ্ছে
বড় পারদখণ্ডের সাথে…
এভাবে মিশে যাও,
দাগহীন।
ফুলসমূহের আগেই
ফুটে ওঠো
ক্ষুধা নিবারক ফলরূপে।
জায়নামাজের মতো
গুটিয়ে নাও হাত
নিরীহ মণ্ডূকের থেকে,
ক্ষুদ্র তৃণের থেকে…
গুটিয়ে নাও ঐ হাত
আর
নিজের সামনে
প্রস্ফূটিত করো।
লক্ষ করো করতল,
রেখা দেখো,
কররেখা—
যা অঙ্কন করেছেন তিনি।
মনে রেখো,
স্পষ্ট কররেখা
জ্যোতিষিরা দেখে
ধ্যান—
প্রকৃতপক্ষে
সেটি হলো অস্পষ্টসমূহকে
দেখা
এই যে তৃণ
আর ঈষৎ হেলে পড়া ফুল
হাসছে,
একটি হরিণ তাদের কাছে
মৃত্যুর দূত বৈ অন্য কিছু নয়।
যেমন
বাঘ—
সে হলুদই হোক,
আর সাদা,
তৃণভোজীর কাছে
সে সবসময়ই অনিরাপদ।
আর
এই তৃণভোজীরাই দলবদ্ধ হয়ে
নেমে আসবে
মাংসাশীদের শিকারে
তৃণের প্রকৃত সংকট হলে।
শেষ পর্যন্ত
নিজেদের সংকটাপন্ন করে তোলাই
সবার নিয়তি।
(অংশবিশেষ)
সারথি, মাহুত, ক্বলব
আর
তার কথা শোনো,
যাকে
পুষে রেখেছ ক্বলবে
খরগোশশাবক ভেবে—
সে
একটি বয়স্ক বনবিড়াল ছিল—
মাদী,
গর্ভবতী—
এত দিনে
তিনটি বাচ্চা প্রসব করে
প্রতি সুবহে সাদিকের পরে
তাদের নিয়ে খেলছে।
গম্ভীর, চঞ্চল আর ক্রুদ্ধ লেজ
ঘুরিয়ে
ঘু
রি
য়ে
বাচ্চাদের শেখাচ্ছে,
কীভাবে
চঞ্চল সাপ
শিকার করতে হয়—
কীভাবে
ক্রুদ্ধ সাপের হাত থেকে
বাঁচতে হয়
অদূরে
পাতাহীন ধূসর একটি বৃক্ষে বসে
সর্পভুক একটি অপবিত্র
পাখি
শিখে নিচ্ছে এই কৌশল—
—মনে রেখো,
এভাবে প্রেমও শেখা যায়
আর
ঐ পাখি
চিনেছে
সেই অন্ধ মাহুতকে
যার
প্রাচীনতম নাম মৃত্যু
এবং
তোমারই দানে
যে বেঁচে থাকে;
সুতরাং
ঐরাবতটিকে
সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে
দ্বিধা কোরো না।
জেনে রাখো,
পৃথিবীতে
মৃতমানুষই একমাত্র নিরাপদ।
যদিও
একটি বিশ্বস্ত কুকুরকে
হত্যা করলে
তোমার শাস্তি হবে না
অথচ
একজন ডাকাতকে হত্যা করলে
মৃত্যুদণ্ড অবধারিত—
এতটাই তুচ্ছ বিষয়
মৃত্যু
আর
মৃত্যুর পর
সর্বাধিক প্রিয়জনকেও
কবরে শোয়াতে গেলে,
ঐ মুহূর্তের
একটি কীটের কামড়
শোকযন্ত্রণার চেয়ে বেশি হয়ে ওঠে।
বরং
ভাবো
সেই সারথির কথা,
তোমার আর দূর থেকে আসা তিরের
মাঝখানে
যার অবয়ব
এখনো দেখা যাচ্ছে।
ভাবো,
বিকলাঙ্গ সেই সৈনিকের কথাও,
যার
শরীরের তুলনায়
অধিক ক্ষত
ব্যবহৃত তরবারিতে—
তার হাতে দেওয়া হয়েছিল
স্বর্গোদ্যান।
ডান হাতে তরবারি
আর
বাঁ হাতে উদ্যান নিয়ে
প্রত্যাবর্তনের দৃশ্য কেমন—
সে নিজেই
জানত না।
সে চাইত,
রোজ ভোরবেলা
কেউ এসে
করুণা বুলিয়ে দিক।
জেনে রাখা ভালো,
—করুণা হলো সেই সুঁইয়ের ছিদ্র
যার মধ্য দিয়ে
পৃথিবী প্রবেশ করানোর
কাঙ্ক্ষাই করা যায় শুধু
আর
পৃথিবী হলো সেই বস্তু
যাকে
সূর্যের আলোতেও
ছারখার করে
দেওয়া যায়,
আতশ কাচের
সঠিক ব্যবহার জানলে
…মূলত
কোনো ভস্মস্তূপ থেকে
যেটি উঠিয়ে আনবে,
সেটি
যদি তোমার সত্তর বছর ধরে লেখা
প্রেমের কবিতাও হয়,
সে তো ছাইয়ের অধিক কিছু নয়
ইহুদির গজল
রাসেল রায়হান
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: জেব্রাক্রসিং প্রকাশন
মূল্য: ১৮০ টাকা
অনলাইন পরিবেশক: rokomari.com