ইমান মারসাল Iman Mersal আরবী ভাষার সমসাময়িক কবিদের মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীজোড়া তাঁর খ্যাতি। মিশরীয় এই কবির জন্ম ১৯৬৬ সালে। তাঁর প্রথম বই ইত্তিসাফাত Ittisafat (Characterizations) প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। এরপর প্রকাশ পেয়েছে আরো পাঁচটি বই। মামার মু’তিম ইয়াসলাহ লিতা’আল্লাম আল-রাগস (১৯৯৫)Mamarr mu’tim yasluh lita’allum al-raqs (A Dark Alley Suitable for Learning to Dance), আল-মাশি আতওয়াল ওয়াক্ত মুমকিন (১৯৯৭) Al-Mashy Atwal Waqt Mumkin (Walking As Long As Possible), জুগরাফিয়া বাদিলা (২০০৬) Jughrafiya Badila (Alternative Geography), হাত্তা আতাখাল্লা’আন ফিকরাত আল-বায়াত (২০১৩) Hatta atakhalla `an fikrat al-buyut (Until I Give Up The Idea Of Home). ২০০৮ সালে These are not oranges, my love: selected poems নামে ইমান মারসালের আরেকটি বই প্রকাশ করেছে শিপ মিডো প্রেস। এই কবির কবিতা অনুবাদ হচ্ছে নানা ভাষায়।শিরিষের ডালপালা পাঠকদের কাছে ইমান মারসালকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর কয়েকটা কবিতা ভাষান্তর কৃষ্টি কর। বাংলা ভাষারধ্বনিমাধুর্য বিবেচনায় প্রায় প্রতিটি কবিতার প্রকরণেই কিছুটা অদলবদল হয়েছে।
ইমান মারসালের কবিতা
মার্ক্সকে সম্মান
উজ্জ্বল দোকান সব
প্রস্ফুটিত প্যান্টির
তার সামনে দাঁড়িয়ে
মার্ক্সের কথা ভাবা ছাড়া আমি আর কি করব?
মার্ক্সকে সম্মাননা
যা একমাত্র সাধারণ জিনিস
আমায় যারা ভালবেসেছিল তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য
আর আমিও, সবাইকে, বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমতি দিয়েছি
আমার শরীরে গোপন
সেসব তুলোর পুতুলে নখ বসাতে। মার্ক্স
কার্ল মার্ক্স
যাকে কোনদিনও ক্ষমা করবো না।
প্রতারিত বাস্তবতা
কোনো একদিন সেই বাড়িটির
সামনে দিয়ে চলে যাব, যা বহুবছর ছিল আমার
এবং দেখার চেষ্টাও করবো না (আর) যে বন্ধুদের
বাড়ি থেকে তার দূরত্বের মাপ ঠিক কত।
প্রেম চেয়ে যে স্বাস্থ্যবতী বিধবাটির কান্না রোজ
আমার ঘুম ভাঙাতো, সে এখন আর আমার প্রতিবেশী নয়
আমি নতুন নতুন ব্যাপার আবিষ্কার করতে থাকি
দ্বিধাকে কাটিয়ে উঠতে
প্রতি পদক্ষেপ গুণে
অধর কামড়ে আস্বাদন করি ম্রিয়মান ব্যথা,
অথবা আঙুলগুলো ব্যস্ত রাখতে ছিঁড়ে ফেলি
আস্ত একটা টিস্যু পেপারের প্যাকেট।
যন্ত্রণা এড়াতে আমি কখনও ওই
সহজ ও সংক্ষিপ্ত রাস্তাকে বেছে নেবো না
নিজেকে আটকাবো না ঘুরে বেড়ানো থেকে
যখন আমি আমার দাঁতগুলোকে
শেখাচ্ছি আমার অন্তর্গত উলম্বিত ঘৃণাকে পিষে খেতে
যেসব শীতল হাত আমাকে ঠেলে দিয়েছিল এর দিকে
তাদের ক্ষমা করার আগে
আমি মনে রাখবো
যে শ্বেতবর্ণ বাথরুমে
আমি নিজের অন্ধকার লেপে দেই নি।
সন্দেহাতীতভাবে এসব আমায় ধোঁকা দেয়।
দেয়ালটা কখনোই আমার স্বপ্নে আসেনি বলে
আমি তার রঙও ভাবিনি
দৃশ্যানুযায়ী আলোকিত করার প্রয়োজনে।
এই ইমারত ছিলো আমার ঘর, বহু বছর ধরে
ছাত্রীদের কোনো হোস্টেল না
যেখানে অনায়াসে সান্ধ্যপোশাক
ঝুলিয়ে রাখা যায় দরজার পেছনের পেরেকে;
অথবা পুরনো ছবি আটকে ফেলা
যায় দেয়ালে, অস্থায়ী আঁঠা দিয়ে।
লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা থেকে
যেসব প্রেমময় বাক্য আমি তুলে এনেছিলাম
এখন নিশ্চয়ই সব উলটপালট হয়ে
সেখানে জন্ম নিয়েছে সার্বিক এক কমিক গদ্য।
যে দেগে দেয় দুর্বলতম বিন্দুটিকে
অবশ্যই
কংক্রিটের থাম জুড়ে কোমলতার অভাব ছিল না
পুরনো বাড়ির থামে এরকমের নিজস্ব নস্টালজিয়া
জড়িয়ে থাকে।
ও আরও বলল, ওদের মধ্যে দুর্বলতম বিন্দুটিকে
নাকি পেয়ে গেছে। আর তার ওজন ছড়িয়ে দিয়েছে
অপেক্ষাকৃত শক্তিমান আরো স্তম্ভগুলির মধ্যে,
এবং সব কড়িকাঠ ও বর্গাগুলিই নাকি
ভালবাসা দিয়ে তৈরি হয়, তারপর সযত্নে হেলান
দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অতো থামের গায়ে।
সে বলেছিল, পুর্নগঠন তার ভিত্তিতেই নাকি খুব যৌন।
আমার সঙ্গে স্কুলে পড়তো, সে প্রত্মবিদ্যা বিভাগে
মাঝে আমার স্কুলছাত্রীর মতো নরম হাত দেখে
খানিক থতমতই খেয়ে গিয়েছিলো।
তারপর, অন্যদিকে হেঁটে যেতে যেতে,
আমাকে বলে গিয়েছিল
যে, না, আমার জন্য নয়, কখনোই নয়
যে সে
মৌলিকস্তরের ধ্বংসে
বেশ পারঙ্গম হয়ে উঠেছে।
আমার পারিবারিক বাড়ির ধ্বংসগাথা
যেন হাতুড়িরা যথেষ্ট ছিল না
একটা ইমারতকে ধ্বংস করার জন্যে,
শ্রমিকেরা ধীরে ধীরে তাদের হাত দিয়ে
খুলে নিতে থাকে সেসব জানালা যার
ভেতর দিয়ে জ্বিনপরীরা আনাগোনা করতো।
এক একটি পদাঘাতের সঙ্গে ধসে পড়ে একটি দরজা;
তাদের সঞ্চিত স্মৃতি।
আমি দাঁড়িয়ে থাকি পরিত্যক্ত চিনির প্যাকেট,
কমলালেবু ও আমের মধ্যে; যেগুলো অতিথিরা
নিতেন তাদের কালো শালে লুকিয়ে।
সূর্যাস্তের প্রার্থনার পর আবার ফিরে আসে তারা
আলখাল্লা দিয়ে ছুঁয়ে যায়
উপহার ও ডাইনিতন্ত্রের পথ
যারা নিজেই নিজেদের দরজা হয়ে গেছে
আর যে ছাদ আমার শৈশবকে আটকে রাখতে
পারেনি বদ্বীপজনিত বৃষ্টি থেকে
সেও ফিরে গেছে তার মূলে, গাছের গুড়ি
যা এক এক গোনা যাচ্ছে।
এরপর ওরা ওর পরিত্যক্ত শোবার ঘরের দিকে গেল
ভিজে চুল গড়িয়ে পড়ছে, কর্দমাক্ত দেয়াল থেকে
যে কোনো মুহূর্তে দেয়ালটাই হয়ে যাবে কাদার, মাটির স্তুপ,
যেন কেউ কোনদিন ওর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়নি।
আমার মা কি শুতে যাবার আগে স্নান করেছিল,
অথবা চিরুনির দাঁড়া থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল চুল
কালোজাদুর ভয়ে।
নাকি আগুন, না প্রতিবেশী বালকটির দৌড়াত্মে
আমার মায়ের চুল সর্পিল গতি নেয়,
উপহার নাকি শাস্তি
কি কি বেঁধে রাখে আর আমাদের?
মায়ের সব শাড়ি দিয়ে দেই চ্যারিটিতে
কারণ আমায় শাড়ি পরলে ভালোই লাগে না,
আর আজ যদি মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়
আমি তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করবো বড় বোনের মতো।
আমাকে এখনও তাঁর সঙ্গে বেঁধে রেখেছে
একটি জড়ায়ু ও ক্যাম্ফর গাছের তলায় সমাহিত মা
যেখানে হাতের কাছে মৃত্যু দেখা যায়।
উৎসবযাপন
স্বপ্নের সুঁতো পড়ে গিয়ে মাটি ছুঁলো, তাই আমি প্রাণপণে
মাটিতে বসে পড়ে তা খুঁজে নিতে চেয়েছিলাম।
অনেক দেশপ্রেমজ উদযাপনের মতো এও একটা,
কিন্তু বিদেশী জুতো ও ভারী বুট ছাড়া আমার কিছু চোখে পড়লো না।
অনেকদিন আগে একজন আফগান রমণী যিনি কখনও আফগানিস্তানকে
চোখেই দেখেননি, আমাকে বলেছিলেন ‘বিজয় আসবে’।
এই কথাটি কি দৈববাণী? আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিলো,
কিন্তু আমার পার্শীজ্ঞান প্রথমভাগেই সীমাবদ্ধ,
মহিলা আমার দিকে তাকিয়েই রইলেন, এমন দৃষ্টিতে যেমনভাবে
দগ্ধ ও মৃতব্যক্তির ওয়ার্ডরোব খুঁজে সামগ্রীর সন্ধান করতে হয়।
ধরে নেয়া যাক, মানুষজন দল বেঁধে এসেছিল স্কয়ারে,
ধরা যাক ‘মানুষজন’ এই কথাটিই নোংরা নয়
আর ‘দলবাঁধা’ এই শব্দবন্ধের অর্থ আমরা জানি।
তবে কি করে পুলিশের এতো কুকুর এসে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে?
কে তাদের পরিয়ে রেখেছে পার্টির রঞ্জিত মুখোশ?
কোথায় সেই ক্ষীণ পার্থক্য পতাকা ও অন্তর্বাসে,
জাতীয় গাঁথা ও অভিশাপ, এবং ঈশ্বরও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে?
হ্যাঁ, যারা হাঁটার জন্য কর পরিশোধ করে হেঁটে বেড়ায়।
‘উৎসবযাপন’ যেন কোনদিন কথাটা আগে উচ্চারণ করিনি,
যেন এর মূলসূত্র সুপ্রাচীন কোনো গ্রিক শব্দ, যা
বিজয়ী স্পার্টানদের পার্সিয়ান রক্তে ভেজা তলোয়ারে জড়িয়ে আছে।
আদৌ কোনদিন কোনো ট্রেন, দৈববাণী, বা আফগান রমণী
ছিলো না বোধহয়। কিছু সময় ঈশ্বর নিজে
মজা পাবার জন্য কিছু স্মৃতি সরিয়ে নেন।
এতকিছু থেকে শেষ পর্যন্ত যাতে উপনীত হয়েছি,
তা হলো,
কোনদিনই জানতে পারবো না, এতো জুতোর থরের মাঝখানে
কার বিরুদ্ধে কে যুদ্ধটা জিতলো?
বাড়ি ও তার ধারণা
আমার সোনার দুল আমি বেঁচে দিয়েছিলাম একটি রূপোর আংটি কিনবো বলে, তারপর সেটাও বেচে দিলাম পুরনো কিছু কালি ও মিশকালো একটা নোটবুকের লোভে। আমি কিছু পাতা একটি ট্রেনের সিটে ফেলে আসার আগেকার ঘটনা এটা, ট্রেন—যে ট্রেন আমায় বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যখনই গন্তব্যে পৌঁছেছে ট্রেন, মনে হয়েছে এ আমার বাড়ি নয়। শহর বদল দরকার।
ওলগা এসব না জেনেও আমাকে বলেছিল,‘জানো, বাড়ি তখনই বাড়ি হয়ে ওঠে যখন তুমি তাকে বেচে দিতে চাইছো, তুমি বুঝে নাও বাগানের পারঙ্গমতা, হাওয়াখোলা ঘরের ঘরের প্রয়োজনীয়তা দালালের চোখ দিয়ে। অত দু:স্বপ্ন যাদের আড়াল করে রেখেছিল জলছাদ, দু’একটা স্যুটকেসেই তো ভরে নিতে হয়, না?’ ওলগা চুপ করে গিয়েছিল , আর তারপরই হেসেছিল সম্রাজ্ঞীর গরিমায়—কফি মেশিন ও ফুলের দৃশ্যে অবনত একটি জানালার মাঝখানে দাঁড়িয়ে।
এই রাজকীয় দৃশ্য ওলগার স্বামী দেখেনি, হয়তো তাই সে এখনও ভাবে এই বাড়িটাই হবে তার একমাত্র সুহৃদ, যখন সে অন্ধ হয়ে যাবে। প্রতি কোণা চিনে রাখবে ওর পায়ের চিহ্ন, যার সিঁড়িগুলো কখনোই ওকে পড়ে যেতে দেবে না অন্ধকারে।
আমার হাতব্যাগের তলায় হারিয়ে যাওয়া একটা চাবি হাতড়াই আমি, যখন ওলগা ও তার স্বামী আমাকে দেখতে পায় না। আর সত্যি সত্যি আমি বাড়ির ধারণাকে মুঠো থেকে ছেড়ে দেবার অভ্যাস করি।
সারা পৃথিবীর ধুলোবালি নখে মেখে তুমি বাড়ি ফিরে আলমারিতে গুঁজে দাও সবকিছু, তুমি বাড়িটিকে আগত এলোমেলো স্তুপের ভবিষ্যত হিসাবে মেনে নিতে চাও না। যেখানে মৃত জিনিস আশাকে কিছু শর্ত প্রদান করছে ক্রমাগত। বাড়িকে এমন জায়গা হতে দাও, যার খারাপ আলো তোমার নজরে পরবে না,আর দেয়ালের ফাটলগুলোকে চওড়া হতে দাও ততদিন, যতক্ষণ না একদিন তোমার মনে হচ্ছে ওগুলো দরজা।
অনুবাদক:
কৃষ্টি কর। কবি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকের ছাত্রী।