আশার বসতি | অলাত এহ্সান

 

দুটি কম্বল ও গৃহস্থালির জিনিসপত্রে ভারী ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে কাচের বাইরে এসে তাজউদ্দিন এক শ্বাসে অনেকটা বাতাস ফুসফুসে টেনে নিলেন, ধুলো ও ধোঁয়ামিশ্রিত, কিন্তু অতৃপ্তি নেই। বাতাসে তার বুক উন্নত হলেও ট্রলির মালপত্তরের আড়ালে ট্যাপার মতো ফুলে ওঠা ভুড়িটা দেখা গেল না।


 

একটা কৃতজ্ঞচিত্ত নিয়ে তাজউদ্দিন দেশে ফিরে এলেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত তার ভেতর নতুন করে কোনো প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে না। তবে এক যুগ আগে যেমনটা আশা করে তিনি দেশ ছেড়েছিলেন, কিছু ব্যত্যয় বাদ দিলে, ঠিক তেমনটাই হয়েছে তার জীবনে। ভাগনের বদলে এয়ারপোর্টে ক্যানপির পাশে অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী হালিমা বেগম এবং শেষবারের মতো বিদেশে যাওয়ার আগে চার বছরের রেখে যাওয়া ছেলে, যে এবার বাবার মুখ উজ্জ্বল করে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় মেট্রিক পরীক্ষায় বসতে যাচ্ছে, সেই সুজন।

দুটি কম্বল ও গৃহস্থালির জিনিসপত্রে ভারী ট্রলিটা ঠেলতে ঠেলতে কাচের বাইরে এসে তাজউদ্দিন এক শ্বাসে অনেকটা বাতাস ফুসফুসে টেনে নিলেন, ধুলো ও ধোঁয়ামিশ্রিত, কিন্তু অতৃপ্তি নেই। বাতাসে তার বুক উন্নত হলেও ট্রলির মালপত্তরের আড়ালে ট্যাপার মতো ফুলে ওঠা ভুড়িটা দেখা গেল না। প্রবাসে খাইদাইয়ের ফলে শরীরের মধ্যভাগ ফুলে উঠে তার শিশ্নের ওপর বাহারি এবং বেঢপ একটা ভুঁড়ি ধরেছে, যা তাকে স্বীকার করতেই হবে, এবার আরও বেড়েছে। বাতাসটা বের করে দিলেন ধীরস্থিরভাবে খ্যাতিহীন বিজয়ের অনুভবে। বাবার কবরের মাটির মতো শান্ত-সমাহিত হয়ে পড়ে তার পেট। দরজার কাচ ঠেলে দাঁড়িয়ে থাকা রক্ষীর গা ছুঁয়ে তখনো ভেতরে আসছিল ঠান্ডা বাতাস; তবু মুণ্ডন করা মাথায় তাজউদ্দিন দ্রুত ঘেমে উঠছিলেন। তার কপাল ঘেমে উঠছিল স্ত্রী-সন্তানকে ত্বরিত খুঁজে না পাওয়ার বিরক্তি আর উৎকণ্ঠার যুগপৎ প্রভাবে। লনে দাঁড়িয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের সহজেই যে দু-তিন জায়গায় চোখ যায়: গাড়ির প্রবেশ আর বাহির পথ, গ্রিলের ওপাশে মুখ ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকা আত্মীয়স্বজন আর ঠিক মাঝখানে কাচে মোড়া ক্যানপির পাশের জায়গাটুকুই বিশেষ। তা ছাড়া গ্রিলের ওপাশে অপেক্ষমাণ শয়ে-বিশে লোকের ভিড়ে কাউকে খুঁজে বের করা সহজ নয়। যদিও মোবাইলে ইন্টারনেট আসার পর ভাইভারে অনেক কথা বলেছেন, ইমো-হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও দেখেছেন, এন্তার ছবি আদান-প্রদান করেছেন; কিন্তু জ্যান্ত মানুষের ভিড় থেকে ঠিক মানুষটা বের করা কঠিনই বটে। একটানা প্রায় বারো বছর দূরে থাকার বিষাদ, নিরাপদে দেশের মাটিতে অবতরণের উত্তেজনা আর গরাদের ওপাশে উৎসুক মানুষের মুখগুলো তাকে বারবার বিভ্রান্ত করে দিচ্ছিল। কিন্তু স্ত্রী যেহেতু তার এবং তারই জন্য এতগুলো বছর অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে অপেক্ষা করেছিলেন, তাকে খুঁজে পাবেন বলে বিশ্বাস রাখেন।

বিমান অবতরণের পাক্কা দুই ঘণ্টা আগে এসেছেন বিশ্বস্ত হালিমা বেগম। তারপর সোয়া তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও স্বামীকে না পেয়ে তার দৃষ্টি তাকে নিয়ত প্রতারিত করে যাচ্ছে। পেছন থেকে যাকে-না-তাকে মনে হয় ‘তিনি’। এতে আনন্দ আছে, উত্তেজনাও কিন্তু প্রতারিত হওয়াই শেষ গন্তব্য। স্বামীর আসা-না-আসা, তাকে খুঁজে পাওয়া-না-পাওয়া আর ঘটনা-দুর্ঘটনার সন্দেহ তাকে জেরবার করে ফেলছে। স্বামীর জন্য এই অপেক্ষা তাকে শরীরসর্বস্ব জীবনের অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে বটে, কিন্তু এক রতিময় যন্ত্রণায় ভুগিয়েছে। সেই দুঃখ বাড়িয়ে দিয়ে এই বিশেষ দিনে মায়ের স্মার্টফোন হস্তগত করে সুজন গেম নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে কে এল আর গেল তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তবু মায়ের অত্যাচারে দুবার টাকা দিয়ে ক্যানপিতে বাবার নাম-ঠিকানা ঘোষণা করিয়েছে। বেগুনি বোরকা পরিহিতা বলেই বিশ্বস্ত হালিমা বেগমকে চিনবেন কি না—তা ভেবে ভেতরে-ভেতরে আরও ঘেমে যান। ক্যানপিতে যখন শেষবারের মতো সৌদি থেকে আসা যাত্রীদের কথা ঘোষণা করা হচ্ছিল, তখন দূরে থেকে স্বামীকে আবিষ্কার করেন হালিমা বেগম এবং ঠিক তখনই তিনি নেকাব উন্মোচন করলেন। যাত্রীদের জন্য হুড়মুড় করে ঢোকা গাড়ির উচ্চকিত ভেঁপুর মধ্যে তার আজ অবধি স্বামীকে ডাকা ‘এই যে’ আর গরাদে মুখ ঠেসে থাকা তিন সারি মানুষের পেছনে ঘামঝরা মুখখানি তাজউদ্দিনের নজর আসবে না বুঝতে পেরে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। স্বামীকে প্রথম আবিষ্কারের কৃতিত্ব সত্ত্বেও বারকয়েক চেষ্টার পর অনন্যোপায় হয়ে সুজনের ধ্যান ভাঙান—‘ওই, উই যে, উই যে তর আব্বায়, ডাক দে’—লজ্জা আর উৎকণ্ঠার সঙ্গে তিনি বলেন। ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানসের  মাঠে সুজন কেবল ড্রাগন নামিয়েছে। পাঁচ স্টেজ পার করে এখন তার অ্যাটাকের উত্তম সময়। অন্যের কাছ থেকেও সৈন্য ধার করেছে। এমন সময় মোবাইলের বাইরের মামুলি শত্রুর আক্রমণের মুখে প্রতিক্রিয়ার মতো ‘কো, কনে’ বিরক্তি নিয়ে বলে সুজন, তার আক্রমণ অব্যাহত রাখে। দীর্ঘক্ষণ লেজার লাইটের আলোকিত স্কিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে যা হয়—     নবজাতকের মতো বিভ্রম তার চোখে-মুখে। এত দিন অপেক্ষার পর-মুহূর্তেই স্বামীকে হারিয়ে ফেলার শঙ্কায় সুজনকে ঝাঁকি দিয়ে স্বর চড়ান হালিমা বেগম—‘ওই যে, চেক শার্ট পরা লোকটা, গাট্টি নিয়া খাড়াই রইছে। জোরে ডাক দে।’

 


‘আব্বা, এই যে আব্বা’ হাত নাড়িয়েও কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে ক্যানপি পারসনের কাছ থেকে খানিক আগে শেখা বিদ্যাটা জুড়ে দেয় সুজন— ‘তাজউদ্দিন—আব্বা। নবাবগঞ্জের তাজউদ্দিন (একটা দম নিয়ে) আব্বা’।

 

দশে-বিশে মানুষের ভিড়ে নাম জুড়ে দেয়ার কৌশলটা তাজউদ্দিনকে সচল করে। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের চেয়ে একটু লম্বা এক কিশোরকে দেখে তার চোখ দ্বন্দ্ব-আনন্দে তাজা হয়ে ওঠে। ভিড় ঠেলে সুজন তার মাকে দেখালেই তিনি নিশ্চিত ভারমুক্ত হন। হাতের ইশারায় গ্রাম থেকে আনা গাড়িটা ক্যানপিতে প্রবেশ করাতে বলে তাজউদ্দিন ট্রলি ঠেলে এগিয়ে আসেন। ছেলের সাথে আলিঙ্গনের পর স্ত্রীকে বাহুলগ্না করে দাঁড়িয়ে থাকা তাজউদ্দিন গর্বিত অনুভূতিতে ড্রাইভারকে দ্রুত মাল তোলার নির্দেশ দেন। বিদেশে কোম্পানির লরিগুলোতে মাল তোলার দক্ষ শ্রমিক তাজউদ্দিনও নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে হাত লাগান। ঘাম জবজবে মুখে হালিমা বেগম সুখী দৃষ্টিতে গাড়ির পেছন ডালা খুলে বাপ-বেটার মাল তোলা দেখেন। সামনে সিট ফাঁকা রেখে একপাশে পুত্র আর একপাশে স্ত্রীকে নিয়ে পেছন সিটে বসে বাড়ির দিকে গাড়ি ছোটাতে নির্দেশ দেন তাজউদ্দিন। ‘এখন বোরকাটা খুইল্যা ফালাও’ গাড়ির কাচ একটু নিচু করতে করতে পুনরায় বলেন। নিয়ম করে দুই বছর অন্তর স্ত্রীর জন্য একটা কালো বোরকা আর মায়ের জন্য তসবিহ ও নরম জায়নামাজ পাঠিয়েছেন তাজউদ্দিন। এবারই তিনি পাঠিয়েছেন বয়েল কাপড়ের রঙিন বোরকা, যাতে চাপ সেলাইয়ে সুতার কারুকাজ করা। ‘যত রঙিন হোক, বুরকা পোরলে গরম লাগেই’ স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে গলায় আটকানো বোরকাটা কৌশলে ছাড়িয়ে সহজ হওয়ার জন্য হালিমা বেগম বিড়বিড় করেন। সামান্য কুশলবিনিময় আর পিতার প্রতিশ্রুত স্মার্টফোন আনার বিষয় নিশ্চিত হওয়ার পর সুজনের কথা ফুরিয়ে গেলে অমীমাংসিত লজ্জা নিয়ে পুনরায় ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানসে মন দেয়। এখন কৌশল এঁটে বড় আক্রমণের যাওয়াই তার কাজ।

ছোটখাটো এবং ফরসা মানুষ তাজউদ্দিন। তিনি এতটাই খাটো যে একটা স্বল্পপাল্লা বাসের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেও তিনি অক্ষম হবেন। ফরসা আর পাতলা ত্বকের নিচ দিয়ে প্রবাহিত রক্তের ধারা পর্যন্ত বোঝা যায়। ক্যাঙারুর ভারের মতো ঝুলে থাকা ভুঁড়ির টানে বিরল পশমশোভিত তার বুক নিচু হয়ে গেছে। মিতভাষী বলে তার যেটুকু সুনাম আছে তা জেদ-খেদেরই অপর পিঠ। তিনি খুব ধার্মিক এবং তার সমান্তরালে কামুক মানুষ, কিন্তু সন্দেহপরায়ণ। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি এতটাই খুঁতখুঁতে যে, কখনো কখনো নিজের ব্যর্থতাকে অন্যের সাফল্য মনে করে ফেলেন। বিশ্বস্ত হালিমা বেগমের শরীর থেকে তখনো ভাঁপ বের হচ্ছিল। দীর্ঘ ও ক্লিশ-শ্যামা চেহারার হালিমা বেগম। তার গন্ডদেশ জুড়ে অজস্র তিল কখনো কখনো যৌনমিলনের বাহানা তৈরি করে। কিন্তু তার দীর্ঘ শরীর তাজউদ্দিনের জন্য যে অবমাননাকর নয় তা বোঝানোর জন্য তাকে অতিমাত্রায় বিনয়ী থাকতে হয়। তার শরীর ঘেঁষে তাজউদ্দিন যে উষ্ণতা বোধ করছিল, তার তুলনায় এটা অনেক বেশি বাহ্যিক আর সংক্রামক। আঁচল দিয়ে মোছার পরও হালিমা বেগমের কপাল আর নাকের ডগায় নতুন করে জমা বিনবিনে ঘাম তাকে উত্তেজিত করে। ফলে পিতৃত্ব আর পুরুষত্বের যুগপৎ দ্বন্দ্বে পড়া তাজউদ্দিন দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করেন। তার ডান হাতটা ঝুলে থাকে ছেলের কাঁধের ওপর আর বাম হাতটা সক্রিয়ভাবে স্ত্রীর বগলের নিচ দিয়ে স্তন স্পর্শ করে। সুজনের জন্মের পর জরায়ুতে সমস্যা ধরা পড়ায় অপারেশনের মাধ্যমে তা অপসারণ করতে হয়েছে। এরপর বেকায়দা রকমের ফুলে যাওয়া শরীর অনেক চেষ্টার পর কমলেও তার স্তন না কমায় দেহের তুলনায় তা একটু বড় এবং তাজউদ্দিনের কাছে প্রলোভন-জাগানিয়া মনে হয়। স্বামীর আগমন উপলক্ষে তার পছন্দমতো অনেক দিন পর হালিমা বেগম কাঁচুলিতে বেঁধে স্তন উন্নত করেছেন। তাজউদ্দিন দুর্দমনীয় যৌনাকাঙ্ক্ষা (যা তাকে হালিমার স্বামীতে পরিণত করেছে) এবং ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করে কথা ও ছবি দিয়ে স্ত্রীকে উত্তেজিত রেখেছেন। পাশে বসে সেই উত্তেজনা খুঁজতে খুঁজতে তার হাতটা যখন অস্ত্রোপচারের পর বর্ধিত চর্বি ধরা স্ত্রীর পেটের ভাঁজ ছেড়ে অন্তত একটা স্তন পুরোপুরি আয়ত্তে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখন সন্তানের উপস্থিতি বোধ করে অস্বস্তিতে পড়েন হালিমা বেগম। পুলক দমনে ব্যর্থ হালিমার মেলে ধরা কাপড়ে একটু আড়াল নিয়ে স্তন মর্দনে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন তাজউদ্দিন। ক্রমেই একদিকে ঝুঁকে পড়া তাজউদ্দিনের ডান হাতের নড়াচড়া সুজনকে খেলায় অমনোযোগী করে দেয়। বাবার হাতটা সরতে সরতে কাঁধ থেকে ঘাড়ের পেছনে এসে পড়লে তার প্রতি শ্রদ্ধা থেকে অস্বস্তিতে পড়ে সুজন। খেলায় সে তখন পিছিয়ে পড়ে, আক্রমণের অবস্থায় নেই। তবু সে আক্রমণ করে বসে, যা আত্মঘাতী ধরনের প্রাসঙ্গিক। বড় একটা ট্রুপ নিয়ে ছত্রখান হতে হতে সুজন যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আজকের খেলায় একটাই জয় তার— ম্যাট্রিক পাস করার সঙ্গে সঙ্গে বাবার কাছ থেকে একটা মোটরসাইকেল আর এবার ফিরে গিয়ে একটা ল্যাপটপ কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করা। তাজউদ্দিন তাকে জিজ্ঞেস করেন—এটা কী গেম? ‘ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস’। ততোধিক সংক্ষিপ্ত জবাব সুজনের। তারপরও বাবাকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু দম নিয়ে যা বলে: এটা একটা গ্রামের গোত্রপিতার গোড়াপত্তনের যুদ্ধ। যেখানে গোত্রপিতাকে অন্য গ্রাম থেকে সোনাদানা-টাকাপয়সা এনে এই গ্রাম শুরু করতে হয়। এগুলো আনতে তাকে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ করতে হয় স্থানীয় দস্যুদের সঙ্গেও। শুনতে শুনতে তাজউদ্দিনের নিজের নতুন বাড়ির কথাই মনে পড়ে কেবল।

নতুন কিন্তু ধূসর বাড়িটা

বারো বছর ধরে দায়িত্বের সঙ্গে হালিমা বেগম একটা নতুন বাড়ির কাজ সম্পন্ন করেছেন, যা তাকে বাড়তি তৃপ্তি এনে দেয়। আগের সফরে ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের রেখে যাওয়ায় অস্বস্তি আর নিজে একটা বাড়ি করার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার এবারের সফর প্রলম্বিত করেছে। সে চেয়েছিল নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি, দুর্ঘটনা সত্ত্বেও সন্তানগুলোর ভাগ্য সুপ্রসন্ন করতে। কিন্তু কোথায় যেন গলদ থেকে গিয়েছিল। এটাকে কপালের লিখন বলে মনে করেন যে, কোনো এক দুর্ঘটনা এড়াতে তড়িঘড়ি করে এমন একটা ছেলের কাছে বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন, যাকে লাখ টাকা যৌতুক দেওয়ার পর এখন খরচের জোগানও দিতে হয়। গুরুতর এক লাঞ্ছনা-গঞ্জনার ভেতর দিয়ে ছোট মেয়েটার বিয়ের সময় কেবল সম্মতিই নয়, সঙ্গে অনেক টাকার দণ্ডও দিতে হয়েছিল। এবার একটা সামাজিক ভোজ আয়োজনের মধ্য দিয়ে মেনে নিতে হবে তাকে। তিনি এসব কিছুর একটা গড় হিসেব চুকিয়েছেন এই কয় বছরে।

সুদিনের অপেক্ষায় অক্ষম বৃদ্ধের মতো নতুন বাড়িতে ওঠার আগে হাতের রশি ছেড়ে দিয়েছেন তার বাবা করিম শেখ। একুশ বছর আগে স্ত্রী-সন্তানকে চরে রেখে বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে নয়শ্রী গ্রামকে তিনি উন্নতির পত্তন হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। আখেরে যা চুল পেঁচিয়ে আঁচিল-কাটা অপেক্ষার চেয়েও নিষ্ফল। পরিশ্রমী ও উদ্যমী করিম শেখ তার খর্বকায় শরীরের শেষটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন ভাইয়ের সংসারে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ শরীর ভাইয়ের সংসারে কেবল খরচই বাড়িয়েছে, এ অজুহাতে তাকে ভিটেবাড়ির অংশীদার না করে একখণ্ড পতিত জমি দেওয়ার চেষ্টা হলে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন। পরে তাকে এক মন্দিরের উঠোনে ঘুমন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পূজারিরা তার সামনে প্রসাদ ঠেলে দিয়ে যখন আবিষ্কার করেন তিনি প্রায় অচেতন, তখন তিনি প্রায় নিশ্বাসই নিচ্ছিলেন না। তখনই একটা ক্ষোভ নিয়ে তাজউদ্দিন নয়শ্রী গ্রামে আসেন। দেশে ফেরার তারিখটা পিছিয়ে তিনি ওমরাহ পালন করে এসেছেন বাবার আত্মার মাগফিরাত কামনায়। হজের ময়দান থেকে তার মুণ্ডন করা মাথায় শীতল অনুভব এখন বাবার গোরের শান্ত অবস্থা বলে মনে হয়। বাড়ি যেতে যেতে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনচিত্ত, হালিমার বক্ষ ছুঁয়ে যা এখন উত্তেজিত-বিচলিত, বারবার খিঁচড়ে যাচ্ছিল রাস্তার যানজট আর ভেঁপুর শব্দে। বিদেশে এত এত যান থাকার পরও জট না থাকা, এমনকি কয়টা ভেঁপুর শব্দ শুনেছেন সুজনকে তা গুনে গুনে বলে দেয়ার ভেতর উষ্মা তৈরি করেন, যা না থাকলে হয়তো তার দেশে ফেরার ইচ্ছেটাই মরে যেত।

তার মুণ্ডিত মাথার মতো বৈশিষ্ট্যহীনভাবে আরবদের অত্যাচারে তিনি বংশীয় ‘শেখ’ পদবি হারিয়েছেন, যা তার আগ পর্যন্ত তিনি গর্বের সঙ্গে বহন করতেন। কখনো কখনো তর্কের আসরে তার পূর্বপুরুষ আরব থেকে আসা বলে চরিতার্থ করতেন এবং উপেক্ষা করতেন এ দেশের অবমাননা-লাঞ্ছনা।

 


কিন্তু কোম্পানির সুপারভাইজার তাকে প্রথম দিনই হাজিরা খাতায় শেখ কেটে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, যা তিনি অনেক পরে, আরবি ভাষা কিঞ্চিৎ আয়ত্তে আসার পর দুঃখজনকভাবে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন, তিনি আসলে শেখ পদবাহী হওয়ার যোগ্য নন, তিনি একজন মিসকিন, যার কেবল আরব শেখদের ‘দাসত্ব’ করার মধ্য দিয়ে তৃপ্ত থাকতে হবে।

 

ইছামতীর ওপর নতুন সরু সেতু পেরিয়ে ঘরে ফেরা ফেরিওয়ালার চেয়েও নিঃশব্দে বাড়ির সামনে তাদের গাড়ি থামে। কার্পেটের মতো সবুজ মাঠের এক কোনায় বল্টে যেন একটা বাড়ি। বড় সড়কের দিকে পেছন দিয়ে তোলা আধপাকা ঘরের সামনের দিকে পুরোনো গ্রাম, তার ওপাশে ইছামতী। ছাদের বদলে টিনশেড ছাউনি পাকা ঘরের মোটা মোটা বিম থেকে মুক্তি দিয়েছে। ঘর লাগোয়া রাস্তার ওপাশে কোঠাবাড়ির চকের সবুজ ময়দান। যেখানে কোনো এক সরকারি প্রকল্পে শিল্পায়িত হওয়ার স্বপ্ন দেখেন স্থানীয়রা। গ্রামের পুরোনো বাসিন্দাদের বাড়ি করার যে ছন্দ, তার থেকে আলাদা ও মূল পাড়া থেকে দূরত্ব পনেরো বছরের বাসিন্দা তাজউদ্দিন পরিবারকে গ্রামের নতুন অভিবাসী বলে মনে হয়। গ্রামের পুরোনো বাসিন্দারা পাড়া-লাগোয়া জমি ভরাট করে বাড়ি করেন, নয়তো পুরোনো ভিটাতে নতুন ঘর তুলে কষ্ট করে থাকেন। একটু পিছিয়ে থাকা এলাকা থেকে আসা নতুন বসতকারীরা সব সময় এগিয়ে থাকতে গিয়ে দলছুটভাবে বড় সড়কের পাশে বাড়ি করে। নতুন বাড়ির ধর্ম হিসেবে দুয়ারে ছায়া ফেলার মতো গাছের অনুপস্থিতি। এক হিসেবে এটা ভালোই, কারণ সচরাচর তাজউদ্দিন মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চান। দেশে এলে নেহাত প্রয়োজন ছাড়া বাজারে না গিয়ে ঘরের ভেতর স্ত্রীসঙ্গেই আনন্দ পান।

একটা হৃদয়বিদারক সন্ধ্যা

কার্তিক মাসে দিনের দ্বিতীয়ার্ধ, সূর্যটা একবার পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়লেই আর অবশিষ্ট থাকে না, দ্রুতই লীন হয়ে যায়, এটা ছিল সেই সময়ের এক বৃহস্পতিবার। একটা আধপাকা আর একটা টিনের ঘরের মাঝের অংশটুকু লোহার শিটের বেড়া দিয়ে মাঝে পকেট দরজা করা হয়েছে, যার বিশেষত্ব, এই দরজা দিয়ে বাইরে থেকে লোক আসে ভেতরে, কিন্তু ভেতর থেকে তেমন যায় না। করপাড়া-ছত্রপুর গ্রামের ওপাশে ডুবতে থাকা সূর্যের লাল আলো তেরছা, অনেকটা টর্চের মতো লেগেছে বাড়ির গেটে। সারা দিন ঘর-উঠোন চেটেপুটে রোদের জিভটা বাড়ি থেকে দূরে মলিন সাদা কাপড়ের মতো ছড়িয়ে আছে। ধুলোমলিন গেটের গায়ে দু-তিন রঙের মোটা ব্রাশ মোছার দাগ গেটের নীল রংকে ছিঁড়ে-ফুঁড়ে দিয়েছে। প্রয়াত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার নামের সঙ্গে দেশি সৌদিয়ানদের বহুল চর্চিত ভিলা যোগ করেছেন (অবশ্যই তা সমীহের সঙ্গে): ‘করিম ভিলা’। অবশ্য তার জানার কথা নয়, ভিলা আসলে রোমান শব্দ; প্রাচীনকালে গ্রামের সম্ভ্রান্ত বাড়িটাকেই ওই নামে চিহ্নিত করা হতো। কিন্তু রোমান প্রজাতন্ত্রের পতনের পর যা হয়ে গিয়েছিল ক্ষুদ্র খামারবাড়িসদৃশ, আজকের দিনে তাই গ্রামের যে কোনো বাড়িকেই ভিলা বলা যায়। কিন্তু ব্রাশের টানে করিমটুকু নষ্ট করে দেয়াকে বাবার প্রতি সরাসরি অসম্মানই মনে হয়। ঘরের পেছন দেয়ালের অনেকটা জায়গাজুড়ে ডিস্টেম্পার রং দিয়ে লেখা রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ প্রচারণা চোখ এড়ানোর সুযোগ ছিল না তার। দরজাটুকু আগলে থাকা শিশুদের ‘গাড়ি আইছে, গাড়ি আইছে’ কিসিমের উত্তেজনায় তিনি বরাবরই অভ্যর্থনা পূর্বানুমান করে বান্দুরা বাজারের লরেন্স বেকারি থেকে পাঁচ কেজি টোস্ট, ফোঁটা ও চারা বিস্কুট নিয়ে এসেছেন। বাড়ির ভেতরে তার জন্য অপেক্ষা করছেন এখন পদ্মার ওপারে পড়ে যাওয়া বোন ও ভাগনে। বোনের অনুরোধে ভাগনেকে এবার একটা ভিসা দেওয়ার কথা ছিল তাজউদ্দিনের, কিন্তু বছরখানেক আগে বিদেশ থেকে আনা সেলাইরেঞ্জ আর দামি হাতঘড়ি চুরির অভিযোগে তার বেড়াতে আসাও নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সেই কারণেই এবার মামাকে এয়ারপোর্টে গিয়ে আনতে না দিয়ে সবচেয়ে মূল্যহীন করে তোলা হয়েছে। তবে পাঁচ দিন আগে ছেলের বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে একমাত্র মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বয়সী মাকে নিয়ে আসায় বোন ও ভাগনের প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করেন তাজউদ্দিন। গেটে মাথা গলিয়ে নিজের যোগ্যতা ছাড়িয়ে আশ্চর্য বোধ করেন, এলাকার নেতৃস্থানীয়রাও তার জন্য অপেক্ষা করছেন, যাদের তিনি তমিজের সঙ্গে কথা বলেন। নতুন বাড়ি তার জীবনে এভাবে সম্মান বয়ে আনবে ভাবতে না পারায় তাজউদ্দিন আরও বিনয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল মুখ করে সবার সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি করেন। বিদেশে শ্রম বিক্রি করে আসা মানুষের যে দুটো জিনিস গ্রামবাসীর মধ্য থেকে তাকে আলাদা করে দেয়: গলায়-হাতে স্বর্ণের ভারী অলংকার ও শরীরে উৎকট গন্ধের পারফিউম— এর দ্বিতীয়টি তাজউদ্দিনের শরীরে তীব্র। এয়ারপোর্টে যাওয়ার আগেই হালিমা বেগম সলজ্জ মুখে তাদের বলেছিলেন, ‘আজক্যা আপনে গো ভাই আসপো।’ তবু এলাকায় কেউ বিদেশ থেকে এলে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যে তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে এটুকু বোঝাতে গিয়ে তারা অনেক কথা বলে ফেলেন। এত বছর পর দেশে ফেরার আনন্দ আর এইসব মানুষের উপস্থিতির ফলে সম্মানবোধে স্বল্পভাষী তাজউদ্দিনের ভেতরও কথা সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি হয়। পিরিচে করে রসে ডোবা দুটি গোল্লা আর শিরায় ডুবিয়ে খাওয়ার জন্য প্লেটে করে বেকারির বিস্কুট দেওয়ার ভেতর দিয়ে বিস্ময় কমিয়ে আনার চেষ্টা দেখা গেল বটে, তার থেকে বেশি দেখা গেল তাদের প্রতি তার অবদমিত ঘৃণার অকরুণ প্রকাশ। ছোট মেয়ের ঘটনার সময় তারা তাজউদ্দিনের কাছ থেকে মোটা অঙ্ক খসিয়েছে। দূর থেকে তাদের কাজকারবার শুনে প্রত্যেকের ব্যাপারে একটা অনুভূতি তৈরি হয়ে গেছে। এসব লোকের ক্ষেত্রে সবার কপালে কমবেশি যে বদনাম জোটে: এরা এক নম্বরের হারামি, স্বার্থহীন কোথাও তারা মুখ ভেজায় না, তবে প্রভাবশালী—এদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

এরা যে কথায় কথায় বাপ-দাদার প্রতাপ ফোটায় তারাও ছিল একটা হাতির লেজসদৃশ করুণ রকম ছোট চরিত্রের লোকজন। বিগত জমিদারদের কাজ করার সুবাদে তারা দেওয়ান, সিকদার, খান, ভূঁইয়া পদবি জুটিয়েছে। কিন্তু এখন ইউনিয়ন-ব্যবস্থা চালু হওয়ায় তারা চেয়ারম্যান পদ ধরতে ব্যর্থ হয়ে পরিণত হয়েছে উচ্ছিষ্টভোগীতে। যদিও তাদের ছানাপোনারা ‘জমিদার যুগের প্রতাপ’ ফেরানোর জন্য হাস্যকর রকমের মরিয়া।

‘তাজ ভাই, বড়গোর জন্যে আর কিছু আনেন নাই?’— একটা আধাখেঁচড়া হাসি দিয়ে মইযদ্দি খান এই কথা বলার পর সকরুণ লজ্জায় তাজউদ্দিন নিজের ভুল খোঁজার চেষ্টা করে। তার লজ্জা প্রলম্বিত হতে না দিয়ে তারা সরাসরি বিদেশি সিগারেটের প্যাকেট দাবি করে। দুই পাটি দাঁতের চাপায় জিভ আটকে দিয়ে তাজউদ্দিন বিস্ময় প্রকাশ করেন— ওমরাহ থেকে আসা একজন মানুষের কাছে সিগারেট চাওয়াকে কাণ্ডজ্ঞানের অভাবই মনে করে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন: তিনি কেবল সিগারেটই খান না তা নয়, এটা তার কাছে হারামতুল্য অপচয়। হঠাৎ ধর্মের প্রসঙ্গ তুলে তাজউদ্দিন অপমানই নয়, তাদের ইমানে আঘাত হানার চেষ্টা করেছেন— এই সমবেত বোধ থেকে তারা বোঝাতে চেষ্টা করেন, বিদেশ থেকে না আনলেও আসার পর অন্তত শহীদের দোকান থেকে বেনসনের প্যাকেট এনে অতিথিদের (যারা নিজেদের সম্মান গ্রামের সম্মানের সঙ্গে যুক্ত বলে মনে করে) আপ্যায়ন করা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ফলত তাদের অনড় দাবির মুখে দৌড়ঝাঁপ করে চাহিদা মোতাবেক সুজনকে কয়েক প্যাকেট বেনসন আনতে দেন। আসন্ন সিগারেটের গন্ধে মশগুল মাতবরদের মনে হয় তাজউদ্দিন তাদের করুণা করছেন, যা কোনোভাবেই তাদের প্রাপ্য হতে পারে না। নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে গিয়ে তাদের স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অবদান তুলে ধরেন, গোপন চ্যালেঞ্জে হেরে যাওয়ার উত্তেজনায় অস্ত্র দেখিয়ে ফেলার মতো। যেমন রাস্তার পাড়ের এই জমি সাফকবলায় কিনে দিতে যে কেউ তিন-চার লাখ টাকা নিত, কিন্তু তারা মাত্র এক লাখ টাকায় তা করে দিয়েছেন, পরোপকারের আনন্দ নিয়ে বলে মনা সিকদার; যে কিনা জমি কেনাবেচা করতে গিয়ে আস্ত একটা বাহিনী গড়ে তুলেছে দখল নেওয়ার জন্য। ছোট মেয়ের ঘটনার সময় তারা পাশে না দাঁড়ালে গ্রামে ঢি ঢি পড়ে যেত, এমনকি চিরদিনের জন্য তাজউদ্দিনের দেশে ফেরার ইচ্ছেটাই মরে যেতে পারত। তাজউদ্দিনের চেহারায় এক ধরনের অপমানবোধ এবং প্রতিবাদ করার অক্ষমতা ফুটে উঠেছে।

‘দেখেন নাই’, এতটা ভর দিয়ে বলে যেন সে অন্ধ, ‘আপনাদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, তার জন্য ঘরের দেয়ালে ডিস্টেম্পার দিয়ে দলের ব্যানার লিখে দিছি। ওটা একটা রক্ষাকবচ, বুঝলেন? ওটা থাকলে একটা পোস্টার লাগানের সাহস রাখে না কেউ’— বলে মইযুদ্দি খান, পুরো ব্যাপারটা যে এক হাতে নাড়িয়েছে। অবশ্য তার বাম হাতটা পোলিও আক্রান্ত রোগীদের মতো করুণ রকমের শীর্ণ ও নেহাত হাতের সংখ্যায় ঝুলে আছে। ওই শীর্ণ বাম হাতের চেয়ে অধিক আঁটসাঁট করে বাঁধা একটা বেমানান হাতঘড়িও তার মূল্য বাড়ায়নি। সাঙ্গদের মধ্যে উত্তেজিত পাবলিক হিসেবে পরিচিত সে, প্রভাবশালী কিন্তু চরিত্রহীন। কোনো এক মদের সুহৃদ ওকে বলেছিল, গরম মাথাটাকে আয়ত্তে রাখার জন্য হাতঘড়ির ফিতেটা কষে পড়লে কাজ হবে। এ কথায় ওর আত্মসম্মান বোধ এতটাই চড়ে গিয়েছিল, সিপির মুখ থেকে বোতলে ডুবেও মরতে পারেনি, ওটা ছিল পেগের গ্লাস ঠোকার চেয়েও লঘু এক ঠাট্টা। তারপর থেকে এমন কষে ফিতা বেঁধেছে, কব্জিটাই মর্মান্তিক রকম চিকন হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ফিতের প্রথম কাঁটায় এসে ঠেকবে। ‘এমনকি রাত-বিরাতে ঘরের টিনে ঢিল, চান্দুরা দিয়ে লাইট মারবে না কেউ’, স্বরটা এমন খাটো করে বলে যেন কথাটা কেবল তাজউদ্দিনের জন্যই সে বহন করে এনেছে। সবচেয়ে বড় কথা, তারা যে সচরাচর সবার বাড়ি যায় না, তা বলতেও বাকি রাখে না। তাজউদ্দিনের নীরবতা বা হতভম্ব অবস্থায় আহ্লাদিত হয়ে মফজেল দেওয়ান আত্মগরিমা নিয়ে আসার পথে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট হয়ে এসেছে কি না জানতে চেয়ে বুঝিয়ে দেয়, তাহলে তারা এক বোতল বিদেশি মদ পেতে পারত, যা তাকে স্থানীয় খ্রিষ্টানপাড়া থেকে কিনে দিয়ে খুশি থাকতে হবে। অন্তত একটা খাসির দাম নগদ না দিলেই নয়, যার প্রতিশ্রুতি হালিমা বেগম অনেক আগে থেকেই দিয়ে আসছেন। তাজউদ্দিন থমকে যাওয়া শামুকের মতো ক্রমেই মুখের ঢাকনা কষতে থাকেন।

উপস্থিতদের হাতে স্টিলের কালো টর্চলাইট, গলায় প্যাঁচানো বিড়ির ধোঁয়ায় ধূসর হয়ে যাওয়া মাফলার ও হাতের চাদর দেখে তাজউদ্দিনের মনে হয় এই মুলা-মুলি ক্লান্তিকরভাবে আরও অনেকক্ষণ চলবে। অসংগত কিন্তু তার পক্ষে উপেক্ষা করা কঠিন এমন অনেক ফেনিল কথার বিস্তার যখন সন্ধ্যা নেমে আসাকে ত্বরান্বিত করেও শেষ হচ্ছিল না, ঠিক এ সময় একটা বয়সী ও কাঁপা কণ্ঠে, বাড়ি অদূরের নতুন মসজিদ থেকে প্রচণ্ড আওয়াজে মাগরিবের আজান আছড়ে পড়লে তিনি একটা উছিলা খুঁজে পান। এই সময়টুকুতে হালিমা বেগমকেও ভাজিয়ে নেয়ার সুযোগ পায় তারা।

 


নামাজের উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়ার মুখে ‘ব্যাপারটা আমার এবং উনাকে রাজি করানোর দায়িত্বও আমার’ হালিমা বেগমের এই কথা শোনার পর নামাজেও ঠিক মন দিতে পারেন না তাজউদ্দিন। ফিসফাস কণ্ঠে ‘তিনি না দিলেও আমি আপনাদের একটা ব্যবস্থা করে দেব’ তার কানে গেলে ক্ষোভে সুরা ভুল করে ফেলেন।

 

ভুল সংশোধনের সহি এক রাকাত পড়ার সময় বাবার ফেরার খবরে ও সন্ধ্যার সুযোগে ছোট মেয়ে এসে কেঁদে পড়লে তিনি আবার ভুল করে ফেলেন, যার সংশোধনী কী হবে তিনি জানেন না। এ সময় দুয়ারে এক হৃদয়বিদারক বা জটিল পরিস্থিতি তৈরি হলে স্থানীয় মাতবররা ধীরে ধীরে উঠোন খালি করে দেয়। বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কৃতকর্মের জন্য কঠিন শাস্তিযুক্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে যেন সে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। এখন তার দিকে কেউ নিবদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালে কেমন শাস্তিবোধ করে, শ্বশুরবাড়িতে কেমন উপেক্ষা-তাচ্ছিল্যের মধ্যে মাথা নত করে থাকতে হয়, তখন মনে হয় এ পৃথিবীতে তার কেউ-ই নেই— এসব কথা সে বলে। সে একই সঙ্গে নিজের দোষ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে, দেড় বছর আগে যখন গ্রামেরই অবস্থাসম্পন্ন কিশোরের সঙ্গে বৃষ্টির দিনে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে মিলিত হবার সময় ধরা পড়ে, তার বাবা টাকা খরচ না করলে ওই ছেলের সঙ্গে বিয়েও হতো না। তখন কলঙ্কিনী হয়ে এই বাবার বাড়িতে, রীতিমতো গৃহবন্দী পড়ে থেকে অন্যের চোখ এড়াতে হতো। এখন অন্তত যার সঙ্গে ধরা পড়েছে তার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় মুখ দেখানো যায়; যদিও তাকে লোকলজ্জার ভয়ে অ্যাবরশন করতে হয়েছে। কারণ এর ফলে যে সন্তান দুনিয়ায় আসত সে বাবা-মার অসামাজিক যৌনাকাঙ্ক্ষার ফসল হিসেবে সবার বিদ্রূপ পেত, পায়ে-পায়ে জড়ানো ধুলোর মতো বংশের জন্য বয়ে আনত অনন্ত ঘৃণা। এর পরে দেড় বছরে পুড়ে পুড়ে সে অনেক খাঁটি হয়েছে। এখন দুই পরিবার একখানে বসে এর একটা সামাজিক সমাধান না করলে তাকে আরও অনেক দিন গ্রামবাসীর চোখ আর কটুকথার দোজখে পুড়তে হবে, তার থেকে মৃত্যুও শ্রেয় এবং দেড় বছরে সে কেবল বাবার আসার অপেক্ষাই করেছে।

মেয়ের কথায় ক্ষুব্ধ, ব্যথিত কিন্তু প্রতিকারহীন তাজউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন, নিজেদের অতীত স্মরণ করেন। একুশ বছর আগে নিজেও এক যৌন জীবনযাপন করতে গিয়ে বিয়ের নির্বাসনের শিকার হয়েছিলেন। নিজের সম্পর্কে বেকার ভাবনা থেকে মুক্তি মিলবে এমন পূর্বভাবনায় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিলেন বটে, যা অচিরে এক জিঞ্জিরে পরিণত হতে থাকে। এমনকি হালিমার সঙ্গে ক্ষিপ্ত যৌনযাপন ছিল তার নিজের প্রতি ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ, শিকল বাজিয়ে নৃত্যের চেয়েও করুণ। তবে একটা কূল হয়েছিল তার। তার ভেতরে তৈরি হয়েছিল স্বপ্ন, যা দুঃস্বপ্নেরই নামান্তর বললেও ভুল হবে না। সেই দুঃস্বপ্ন থেকে বের হতে তাকে যন্ত্রণাকাতর বারো বছর প্রবাসে কাটাতে হলো। একটা তুমুল যৌনগন্ধী রাত তাকে সেই অসহায়ত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারে। বিদেশ থেকে মালপত্র ঘরে তোলার ফাঁকে হালিমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে (সুজনের উপস্থিতিতে ট্যাক্সিতে যা সম্ভব ছিল না মোটেই) চুম্বন দিয়ে এর পূর্বাভাস দিয়েছেন।

একটি যৌনগন্ধী কিন্তু ব্যর্থ রাত

হালিমা বেগম প্রথম থেকেই ভেতর থেকে দরজায় খিল দেয়ার মতো একটা কক্ষ নিজেদের জন্য তৈরি করেছে, যা তাজউদ্দিন বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত সুজনের দখলে ছিল বোনগুলো বিদায় হওয়ার পর থেকে। রুমটাকে সুজন নিজের মতো সাজিয়েছে। পশ্চিম দেয়ালে টাঙানো একটা কোলাজ ছবিতে দেখা যায়, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ কিন্তু মারাত্মক নয় এমন ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবো ডুবো নৌকার যাত্রীদের শ্মশ্রুমণ্ডিত সৌম্য চেহারার এক মহাপুরুষ অভয় দিচ্ছেন তার ডান হাত তুলে, যা দেখেই শর্তহীন ভক্তি জাগে। জলের ভেতর জেগে ওঠা আরও একটি হাত, বিস্ময়করভাবে এটিও একটি ডান হাত, অজস্র মুক্তার দানা, যা সমৃদ্ধির আশ্বাস। সেখানে জলের ওপর ভেসে আছে এমন এক উপাসনালয়, যা মন্দির ও মসজিদ— উভয়েরই আদল বহন করে। ঠিক তার পাশের পোস্টারেই একটা শিশুকন্যা আর ছেলে জায়নামাজে বসে কোরআন পড়ছে, যে দৃশ্য তাজউদ্দিনকে ব্যথাতুর করে তোলে সন্তানদের উচ্ছন্নে যাওয়ার কারণে। পুবের দেয়ালে লাইটের নিচে একটা পাহাড়ি ঝরনার ছবি, দেখেই বোঝা যায় কোনো পছন্দ থেকে নয়, বরং দেয়ালের শূন্যতা ঢাকার জন্য মেলা থেকে এসব কিনে লাগানো হয়েছে। তাজউদ্দিন এই তিনটি ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন উত্তরের দেয়ালে তাকাবেন না এমন দৃঢ়তা নিয়ে; যেখানে সুজনের প্রিয় বলিউড নায়ক-নায়িকাদের ছবিগুলো সহাবস্থান করছে, এমনকি ‘তেরে নাম’ সিনেমার পোস্টারসহ। গোপনীয়তার বিষয় নিশ্চিত হওয়ায় এসব উপদ্রব মেনে নিতে হলো তাদের।

পুরোনো ঘরে নতুন আসবাব বলে কিছুই নেই, একটা খাট আর স্টিলের পুরোনো আলমারিটা ছাড়া। সুজনের ধারণা ছিল এটা বুঝি তার বাবার বিয়ের সময় পাওয়া কোনো উপহার। কিন্তু এটা তার দাদার আমলের কেনা। বাবার বিয়ের সময় কে যেন সেকেন্ড হ্যান্ড কিনে দিয়েছিল, নয়তো চরভদ্রাসনে এটা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। রং উঠে যাওয়া স্থানে নেলপালিশ দিয়ে ঢাকা আলমারি অচিরেই ব্যবহারমূল্য হারাবে, কিন্তু তাজউদ্দিনের মনে হয়, আদতে এটা অবয়ব বদলে গিয়ে এর ভেতরে তার এবং তার বাবার যৌবনের রূপ ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। খাটের শোয়ার স্থান থেকে চূড়া পর্যন্ত আঁকা হয়েছে এমন ধরনের ফুল যা খাট, আসবাব, দরজা-জানালার পাট্টা ছাড়া কোথাও কখনো প্রস্ফুটিত হয়নি। ধারণা করা সহজ, এগুলো সেইসব নিরক্ষর ও ভাবপ্রবণ কাঠমিস্ত্রিদের কল্পনার ফসল, যারা কাঠের শরীরেই কেবল কল্পনা পাখা মেলতে দিয়েছিল। অথচ এই ফুলতলাতেই মানুষের শরীরগন্ধা সুবাস বের হয়। কক্ষ হারানোর প্রাথমিক সান্ত্বনা হিসেবে মায়ের মুঠোফোনটা সারা রাত ব্যবহারের অনুমতি সুজনের হাতে এসেছে, যা তার জন্য আনা মুঠোফোনটা হাতে দেওয়ার আগ পর্যন্ত প্রলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। সুজন সেখানে মায়ের কেনা ইন্টারনেট প্যাকেজের অবশিষ্ট ডেটা, বাবা বাড়ি আসায় যা আর লাগবে না বলে তার বিশ্বাস, দিয়ে গ্রুপ ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানসে লেগে পড়ে।

চরভদ্রাসনে যে যৌনসংসর্গ শুরু করেছিলেন হালিমা বেগমের সঙ্গে তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করার আগে তাজউদ্দিন দুই রাকাত নফল পড়েন খোদাকে ধন্যবাদ জানানো ও সফলকাম হওয়ার গোপন উদ্দেশে। এই ফাঁকে হালিমা বেগম তৈরি হচ্ছিলেন তার কাঙ্ক্ষিত এবং প্রায় নির্দিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য। শরীর থেকে সরিয়েছেন ঘাম, জবজবে পোশাক, বিশেষ করে ঢিলেঢালা কাঁচুলির বদলে খসখসে ও আঁটসাঁট কাঁচুলি বুকে চড়িয়েছেন, যা তাজউদ্দিন নিজেই হাতে ধরিয়ে বললেন— শক্ত ব্রা ছাড়া আমার তেজ জাগে না। একুশ বছর আগে নিজের চেয়ে রং-খসা তরুণের সঙ্গে হালিমা বেগমের, বিপরীত দিক থেকে নিজের চেয়ে রং-বোজা কিন্তু সুডৌল তরুণীর সঙ্গে তাজউদ্দিনের যৌনতার তেজ ছিল। বীজ ছাড়ানো খড়ের গাদা, যুবতী ভুট্টাখেত, কাশবনের আড়াল, শিশু পাটের খেত, নদীর বে-মোচড় পাড়, এমনকি পদ্মায় গোসলে নেমে এক টুকরো কলাগাছ ধরে ভাসতে ভাসতে তারা মিলিত হয়েছে নদীর জোয়ার আর জমির উর্বরতার মতো। খুব কাছাকাছি থাকার ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। অস্বীকার করা যাবে না, এমন এক যুবকের সঙ্গে মেয়ের মিশতে দেওয়ার একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় হালিমার বাবার ভেতরও ছিল। নইলে ঘরে সেয়ানা মেয়ে থাকতে বাড়ি হারানো করিম শেখের পরিবারকে বাহির বাড়িতে ঘর তোলার অনুমতি দিয়ে দেখভালের দায়িত্ব দিতেন না। চরভদ্রাসনের সবচেয়ে বড় গৃহস্থ গয়যুদ্দি শেখের বাড়িতে ফসল তোলার দিনগুলোতে তাজউদ্দিনের মা ফুলমতি বেওয়া কাজ করতেন স্বামী করিম শেখের সারা বছরের রাখালির সুবাদে। মায়ের গৌরবর্ণ গায়ের রঙে উজ্জ্বল সন্তানগুলো আদর পেত সে কারণেই। হালিমা বেগমের কাছে তাজউদ্দিন এ কারণেও অধিক গুরুত্ব পেত, যা তাদের সম্ভোগকে আসন্ন করে তোলে। একটা অশুভ অবস্থার পূর্বাভাসের ছায়া ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দিনের ভেতর। চাঁদনি রাতে লতানো মিষ্টি আলুর খেতে যৌন উদ্‌যাপনের তৃষ্ণা তাদের ভোর হওয়ার আগেই স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত করেছে কুৎসা-রটনা এড়ানোর জন্য। বংশীয় মেয়েকে বিয়ে করে তাজউদ্দিন মনে মনে খানিকটা সুখী ছিলেন, তখনকার অবস্থায় তিনি কোনোভাবেই এর যোগ্য ছিলেন না বলে। করিম শেখ অবশ্য খুশি ছিলেন এতে ছেলের কপাল খুলবে আশা করে, সঙ্গে নিজেদেরও। তাজউদ্দিনের প্রতি সে সময়ে হালিমা বেগমের উত্তেজনাটুকু বাদ দিলে তাকে একপ্রকার যৌনদাসও বলা যাবে, বিয়ের পর যা গৃহবন্দী দশায় পরিণত হয়। এ থেকে মুক্তি পাওয়া, যা একই সঙ্গে পৌরুষত্ব ফিরে পাওয়ার মতো ব্যাপার ছিল তাজউদ্দিনের। নিজের ঘরে হালিমা বেগমের সঙ্গে মিলিত হওয়া সেই মার্গ স্পর্শ করে।

তাজউদ্দিন বুঝে উঠতে পারছিলেন না যে ঠিক কোথা থেকে সেই পর্ব শুরু করা যায়। প্রবাসে কঠিনভাবে প্রতিহত এবং দুঃসহ-দুর্লভ নারী সংস্পর্শহীনতায় পীড়িত হয়ে ইউটিউবে বহু-ফিল্ম ভিডিও থেকে রপ্ত করতে চেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত মনে হওয়া সব আইটেমে, নিজেও যার জন্য উপযুক্ত নন শরীরের কারণে। সেই সব প্রশিক্ষিত নারীর মতো শীর্ষকায়ও নন তার স্ত্রী। তবু তিনি অজস্র ভিডিও পাঠিয়ে, সেক্স আইটেম নিয়ে উত্তেজিত আলাপে তাকে চোস্ত করেছেন সাধ্যমতো। যেমন তাজউদ্দিনের ইচ্ছে করছিল হালিমাকে কোলে তুলে দেয়ালে ঠেকিয়ে পাগলের মতো সেক্স করতে, কিন্তু তার পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি শরীরের মাঝখানে বেজায় ফুলে ওঠা বেঢপ ভুঁড়ি শরীরকে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছে যে তা আর সম্ভব নয়। হালিমার শরীরজুড়ে প্রার্থিত প্রেমিকসুলভ স্পর্শের পুলক দিতেও তিনি হতাশভাবে অস্বচ্ছন্দ। ইউরোপের ফর্সা রমণীদের সেক্স ভিডিও দেখে কী এক আকর্ষণে স্ত্রীর ধূসর যোনিতে জিভের কসরত করতে গেলে বিপুল পুলক আর বেসামাল সুড়সুড়িতে হাসির দমক চেপে রাখতে গিয়ে অস্থির হালিমা বেগম থরথর করে কাঁপতে থাকেন। যাকে বলে ওরাল সেক্স, তাতে অনভ্যস্ততা, অস্বস্তি, এমনকি তাকে রীতিসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন তিনি, কিন্তু স্বামীর দাবি অস্বীকার করতে পারেন না।

হালিমার মেলে ধরা শরীরের উপরিভাগে রঞ্জন ও উত্তেজিত করার মতো আকর্ষক জামা থাকতেও তাজউদ্দিন প্রায় রীতিসিদ্ধভাবে তার দুই ঊরুর মাঝে মুখ নামিয়ে দিলে সে বিরক্ত হয়। সে কোনোভাবেই ঘরের ভেতর লাইট জ্বেলে নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, লজ্জায় প্রায় কুঁকড়ে যায়, যা তার কাছে নিন্দনীয় রকমের আদিম মনে হয়। কখনো কখনো হালিমা বেগম বাড়ির ঢালের ডুমুরগাছের নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী ভাবি-সখীদের কাছে ঘিনঘিনে দুঃখ নিয়ে বলেছেন, ‘আপনার ভাই যানি কিমুন, রোজই বিদ্যাশি বিটি-ব্যাটাগো এইটা-হেইটা বিডিও পাটায়। তারপর দ্যাশে আইস্যা আমার হেরুম করব্যার কয়? আমার তো শরম লাগে! আমরা কি বিদেশিগো মতো বেলিহাজ নি? আমার লগে ওই জুয়্যান জুয়্যান ব্যাটাগো লাগাল করব্যার চায়, তয় পারলে সে না!’ তিনি স্বীকার করেন, তাজউদ্দিন তার যোনিতে মুখ লাগিয়ে সুড়সুড়ি দেয়। এমনকি বিদেশ থেকে ভিডিও-কলের মাধ্যমে স্ত্রীর স্তন আর যৌনাঙ্গ দেখতে চান এবং নির্দেশমতো নাড়ানাড়ি-দলাইমলাই করতে বলেন, যা দেখে তাজউদ্দিনের হস্তমৈথুনে সম্পন্ন হয়।

একটার পর একটা সেক্স আইটেমের নাম উচ্চারণ করেন এবং নিশ্চিত ব্যর্থ হবেন জেনেও তিনি দুর্দমনীয় অভিযান পরিচালনা করেন। আর কুসংস্কার-আচ্ছন্নভাবে ওই নামগুলো ফিসফিস করে উচ্চারণ করেন হালিমা বেগম। এই অস্বস্তিতে বিরক্ত তাজউদ্দিন নিজের শরীর তার ওপর চড়িয়ে দিলে বেকায়দা পেটের কারণে আরও এক করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। এটা সার্কাসের বামনদের মতো একটা গোল বল বা পাইপের ওপর তক্তা দিয়ে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যালেন্স রক্ষার চেয়েও করুণ রস তৈরি হয় নিজের ভেতর। তাজউদ্দিন যখন উত্তেজনায় হালিমার সঙ্গে যৌনাঙ্গ মিলিয়ে একাকার হতে যান তখন তার বুক কপিকলের মতো উপরে উঠে যায়, আবার যখন তিনি উপুড় হয়ে বুক মেলাতে পারেন তখন তার শিশ্ন ঝুলে থাকে মাথা ঝুঁকে ডুবতে থাকা জাহাজের প্রপেলারের মতো কিন্তু জলের সংস্পর্শহীন ও ক্রুদ্ধ।

মায়ের কেনা ডেটা প্যাকেজ ফুরিয়ে গেলে কিংবা রিক্ত হয়ে মুঠোফোন মেমোরি ঘাঁটতে গিয়ে সুজন আবিষ্কার করে এমন এক জগৎ, যা তাকে অস্বস্তিকর উত্তেজনায় ফেলে দেয়। হেডফোনটা পাশের রুমে আটকা পড়ায় শব্দ বন্ধ করে ভিডিওগুলো সসংকোচে দেখছিল, যা তার বাবা ইমোতে মাকে পাঠিয়েছেন। পাশের রুমের আসবাবের নড়াচড়ায় তৈরি খুব চাপা কিন্তু অর্থবহ শব্দ, বন্ধুবান্ধবের আড্ডা থেকে প্রাপ্ত ধারণায় ভিজ্যুয়াল অনুবাদ তৈরি হতে থাকে তার মাথায়। বাবা-মার ক্লান্ত ফিসফাস, ঘন ঘন শ্বাস, চাপা চুকচুক শব্দ সুজনের কানে এলে সে ভিডিও দেখা বন্ধ করে দেয়। গান মনে করে চালিয়ে দেয়া একটা রেকর্ডিং উন্মোচন করে আরও এক জগৎ। কানের কাছে ফোনটা নিয়ে শুনতে পায় একজন পুরুষ মোটা গলায় চাপা শব্দে বলছেন, ‘তুমার ‘নাসিমা’ কিমুন আছে? কত দিন থেকে ধরি না। আর গুদ, ভালো আছে তো? পরিষ্কার রাইখো, কার্তিক মাসে বাড়ি আইলে লাগবো। তোমার বড় বড় ‘নাসিমা’ আমার খুব ভালো লাগে।’ একজন নারী, চিকন আর লাজুক কণ্ঠ, রপ্ত না হওয়া শব্দের সমাবেশে বলছেন, ‘তুমার ‘জব্বর’ কিমুন আছে, ওইড্যা কইলাম আমার, আর কাউরে দিও না। কত দিন তোমার ‘জব্বরে’ চুমা খাই না।’ তারপর দুজন হাসতে থাকেন। সাংকেতিক শব্দের আড়ালে কণ্ঠগুলো সুজনের অস্বস্তিকর রকমের পরিচিত। তাদের প্রতি সম্মানজনিত সংকোচ, ঘৃণা এবং উত্তেজনায় মুঠোফোন বন্ধ করে দেয়।

শেষ পর্যন্ত হালিমার শরীরটাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরীর লাশের মতো খাটের কিনারায় টেনে এনে যৌনতা সম্পাদন করতে চেষ্টা করেন তাজউদ্দিন। তাতে অতৃপ্তি আর অমিত ক্রোধে সংযোগহীন ফোনের মতো ভুক্তিহীনভাবে গা হেলিয়ে দিয়ে গজগজ করতে থাকেন। হালিমা বেগম তখন পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। স্বামীর শিথিল শরীরের পাশে উন্মুক্ত নিজেকে মেলে ধরেন, পোড়া ধানগাছের মতো দেখতে গোটা কয় সোনালি-ধূসর পশমওয়ালা বুকে মুখ ঘষেন, কখনো নাচিয়েদের মতো স্তন ঝুলিয়ে পুলকিত ও সফল করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর একনিষ্ঠ সমর্থকের মতো নিজেও ব্যর্থ হলেন। শেষ পর্যন্ত নিজের অনাপ্রাপ্তি চেপে রেখে ও স্বামীর প্রতি করুণামিশ্রিত সহানুভূতিতে নিজহাতে বীর্য নির্বাপণ করেন যেন তার শরীর-মনে এই বোধ উসকে ওঠে, আদতে তিনি তুমুল এক সঙ্গম করে তবেই শান্ত হয়েছেন। বললেন, ‘অনেক দূর থিক্যা আইছাও, তুমি ক্লান্ত, ঘুমাই পড়ো। কাইলক্যা অইব্যানে।’ অনাকাঙ্ক্ষিত পরাজয়ের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তাজউদ্দিন, আগামীকাল থেকে একটা স্থাণু জীবনের জন্য।

আসার বসতির মুখোমুখি

পরদিন জুমা ঘনিয়ে আসায় রশির অজস্র গিঁট খোলা এড়ানোর জন্য কার্টনের এক কোনা কেটে (এমন কিছু একটা ঘটতে পারে এই পূর্বধারণা থেকে যেন গুছিয়ে রেখেছিলেন), পাঁচটা জায়নামাজ, এক গোছা তসবিহ বের করেন, যার দানাগুলো লুডুর মতো বর্গাকার, তবে সব পাশে একটা ফোঁটা দেয়া। ট্রলিব্যাগ থেকে বের করেন সবুজ রং রেকসিনের চমৎকার বাঁধাই করা বঙ্গানুবাদসহ দুটি কোরআন শরিফ। এটা যে-সে বঙ্গানুবাদ নয়, খোদ সৌদি রাজপরিবারের অর্থায়নে সম্পন্ন, যেখানে ভুল থাকার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন তাজউদ্দিন। তার ধারণা, দেশের অধিকাংশ মাওলানারা ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বিভেদ ও বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। তাই তিনি সৌদির বঙ্গানুবাদ, যদিও তিনি বাংলা-আরবি কোনোটাই ভালো পড়তে পারেন না, তবু কিনে এনেছেন। ঘরের কাছে মসজিদ থাকার পরও ফজরের ওয়াক্তে কেন তার ঘুম ভাঙেনি, এ জন্য দুঃখ করছিলেন। কিন্তু সবকিছুর দোষ যেভাবে তিনি স্ত্রীর ওপর চাপান, যেমন মেয়ে দুটির কলঙ্কময় বিয়ে ও প্রথমবার ছেলে অকৃতকার্য হওয়ার জন্য তিনি স্ত্রীকে দায়ী করেন, গত রাতের পর তা করতে পারছিলেন না। বিদেশে থেকে আনা তসবিহ-জায়নামাজ-কোরআন ও মিলাদের জন্য আনা পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে তড়িঘড়ি মসজিদে প্রবেশ করে তিনি টের পেলেন, ইমাম যেন তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যা তিনি আশাও করেননি। মিলাদের আগে তার আগমনকে অভিষেক করে মুসল্লিদের উদ্দেশে প্রয়াত পিতা এবং পরিবারকে নিয়ে ইমাম যে প্রশস্তি করলেন তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তিনি বারবারই দুনিয়াতে স্রেফ মুসাফির বলে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান। সুদূর এবং সবার প্রার্থিতও বটে, আরব দেশ থেকে বয়ে আনা কোরআনের গুরুত্ব প্রকাশ করার আগেই মিম্বরের পাশের যে কুলুঙ্গি তাতে প্রায় স্তূপ করে রাখা কিতাব-রেহেলের ভেতর থেকে একটা রেজিস্ট্রার খাতা টেনে বের করেন। অনভ্যস্তভাবে পৃষ্ঠা উলটাতে উলটাতে ইমাম সাহেব প্রশস্তির ইতি টানলেন এই তথ্য জানিয়ে যে, মসজিদ উন্নয়নে তার জন্য ৩০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে, যা কোনো মতেই পঁচিশের নিচে আনা যাবে না, বরং বেশি দিতে পারেন। তাজউদ্দিন নতুন করে বিস্মিত হতে হতে ঘোষণা করলেন, তিনি নিজ থেকেই সর্বসাকল্যে হয়তো পাঁচ হাজার টাকা নিয়ত করেছিলেন, কিন্তু তার বেশি কোনোভাবেই না। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাইলেন, তাকে না জানিয়ে এই ধরনের টাকা ধরার ব্যাপারটা কি অন্যায় নয়? কিন্তু ব্যাপারটা গিয়ে দাঁড়াল তিনি সমাজবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন বলে। মুহূর্তে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় কেবল অবিশ্বাস্যই নয়, উত্তরের অযোগ্য সব অভিযোগ। উপস্থিত মুসল্লি, যাদের কেউ কেউ গত সন্ধ্যায় তাজউদ্দিনের সঙ্গে এক পশলা বাহাস করেছেন মদ ও বকশিশের জন্য; ঔদ্ধত্যের সঙ্গে জানালেন, মসজিদে না এলেও তাকে বিষয়টা জানানো হতো।

 


তবে আসার ফলে প্রসঙ্গক্রমে ভরা মসজিদে সবার সামনে আরেকটি গুরুতর বিষয় জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, তার পরিবারের কীর্তি (যা আসলে কলঙ্কের নামান্তর বলে বোঝানো হচ্ছিল), তা স্মরণ করে গ্রামজোড়া ‘সামাজি খাওন’ এবং কম-সে-কম ত্রিশ হাজার টাকা হাজতি দিয়ে সমাজভুক্ত হতে হবে এবং অবশ্যই শহরের মতো সমাজভুক্ত না হয়ে বছরের পর বছর গ্রামে বাস করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

 

তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ব্যাপারটা এর আগে তার স্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি তা স্বামীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। শাস্তিটা ছিল এতটাই সুনির্দিষ্ট ও পূর্বনির্ধারিত, এ নিয়ে প্রশ্ন করাটাই হবে বেদনার ভার বাড়ানো কিন্তু সান্ত্বনাহীন। তাজউদ্দিনকে সবাই এমনভাবে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছিল, তার মনে হচ্ছিল, যেন তাকেই খাদ্যের মতো দেখছে। তিনি এতটাই বিব্রত বোধ করেন যে, ব্যাপারটা অমীমাংসিত রেখেই বেরিয়ে আসেন।

মসজিদের উঠোন-লাগোয়া অর্ধেক পাঁচিল পাকা রাস্তায় ফুটপাথের মতো, যা আদৌ দরকার পড়ে না, সেই ঘাস গজানো পাশ অনেকটা আড়াল করে রেখেছে। পাঁচিল ঘেঁষে একটা সাইনবোর্ড আসলে মসজিদের; কিন্তু মুঠোফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন এতটা বড় করে দেওয়া যে, নিচের দিকে ফেট্টির মতো সাদা অংশে তুচ্ছাতিরকম ক্ষুদ্র লেখাটা প্রায় চোখেই পড়ে না। অধিকার-সচেতনতাবোধ থেকে (যা সব সময়ই উপেক্ষিত) তাজউদ্দিনের পরিতাপমূলক হাসি পায়, শুধু সাইনবোর্ড করে দেবে বলে মালিককে কত ছোট করে ফেলা হয়েছে। মসজিদের উঠানে দাঁড়িয়ে পায়ে যখন জুতা পরছিলেন, সেখান থেকেই তার ঘরের পেছন দেখা যায়। তখনই তিনি খেয়াল করেন ঘরের পেছনে সবুজ আর সাদা রঙের রাজনৈতিক-বিজ্ঞাপন দেয়ালের দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে। এক কোনায় কোলাজ করে একজন পুরুষ যিনি একটা দম নিয়ে নাক-মুখ বন্ধ করে আছেন আর একজন নারীর ছবি, যিনি হাত উঁচিয়ে আছেন। এটা এখন হালের বড় দলগুলোর রাজনৈতিক লোগো হয়ে গেছে। দেয়ালচিত্রের ঠিক মাঝখানে একজনের ছবি বড় করে আঁকা, কিন্তু মুখ বোঝা যায় না। চিত্রে মুখের অংশে একটু বেশি রং দেয়া হয়েছে বলে রোদ-বৃষ্টিতে ওগুলোই আগেই খসে গেছে। প্রচারণাটাই একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি দেয়ালের বাকি যে অংশটুকু ফাঁকা, সেখানে কোনো রং করা হয়নি বলে কালচে হতে শুরু করেছে। এমনকি দেয়াল সুরক্ষার জন্য শক্ত বেড়া বা হাফ পাঁচিলও দেওয়া হয়নি, যাতে রাস্তার গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হয়েও সরাসরি ঘরের দেয়ালে না লাগে। কেউ একজন পুরোনো ও স্ট্যান্ড নেই এমন একটা বাইসাইকেল দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ব্যাপারটা তাজউদ্দিনের ব্যক্তিগত নিখুঁতচারী সীমানা, যা তিনি সব সময় মজবুতভাবে রক্ষা করে চলেন, সেখানে অনুপ্রবেশ বলে মনে হয়।

গেট থেকে স্ত্রীকে ডাকতে ডাকতে সামনের ঘর সন্নিহিত দুয়ারে দাঁড়ান। সেখানে না পেয়ে ব্যক্তিগত কামরায় প্রবেশ করেন। তার বিস্ময় ও ক্রোধের পারদ উপরে উঠে যায় যখন দেখেন, ফরিদ দেওয়ান, যার সঙ্গে গত সন্ধ্যায় সবচেয়ে বেশি বাত-চিত হয়েছে, সে বসে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছে। তার অভিজ্ঞতার অভাবকে শোধ দিতেই যেন ফরিদ জিজ্ঞেস করে, ‘এত তাড়াতাড়ি নামাজ থেকে আইলেন, মাইকে মিলাদ তো শুরুও হয় নাই।’ তারপর খানিকটা থিতু হয়ে বলে, ‘আপনার সঙ্গে আবার দেখা করতে এসেছিলাম। কাল তো ভালোমতো কথা বলা হইলো না।’ তাকে স্পর্শ করেনি এমন এক অপমান লুকিয়ে সে বলে, ‘গতকালের বিষয় নিয়ে ভাবির সঙ্গে কথা কইলাম। ওইডা কোনো ব্যাপার না, ভাবি সাবরে কইছি, অনেক দিন বিদেশে থাইক্যা আইছেন, তাই বুঝব্যার পারেন নাই গ্রামের পুলাপান কিছু আশা করবারই পারে। ওই নিয়া বাজলে তো অইবো না।’ হালিমা বেগমকে অবনমিত কিন্তু সজাগ বসে থাকতে দেখে তাজউদ্দিন বলে ফেলেন, ‘ওইডা আমরা স্বামী-স্ত্রী দেহুম, আপনাগো চামিচ ঘুরান লাগবো না।’ ক্ষুব্ধ কিন্তু খেপে উঠবেন না পণ করেও তাজউদ্দিন এমন একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেন, যা ফরিদের ক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জে ফেলে দেয়। ‘শুনেন ভাই’ অপমান ধাতস্থ হয়ে উঠে যেতে যেতে ফরিদ বলে, যেন এটা আত্মরক্ষার শেষ সময়, ‘এইড্যা খালি স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার না। খালি বিয়া করলেই স্বামীগিরি করা যায় না।’ এমনভাবে চোয়াল নাড়িয়ে বলে, যেন কথাটা এই অলস দুপুর খান খান করার জন্য সবচেয়ে উপযোগী হয়, ‘আমরা যদি দেখ্যা না রাখি, তাইলে এই গ্রামের ব্যাটাগো বিদেশ থেকে আইস্যা বউ পাওন লাগতো না, আর স্বামীগিরি ফলানোও লাগতো না, বুঝলেন?’ একটু জোর দিয়ে থামে ফরিদ।

আত্মসংযমে ইস্পাতকঠিন তাজউদ্দিন অবিরাম নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে হালিমার ওপর অধিকার পুনরুদ্ধার-স্পৃহায় তাতিয়ে ওঠেন, ‘ঘরে পেছনে রং করো নাই ক্যান! ঘরের মধ্যে মজমা জমলে বাইরে তো চোখ যাইবোই না!’ তিনি নিজের মধ্যে তৈরি করেন এমন এক আবরণ যা ভেদ করে হালিমার পক্ষে ভেতরে যাওয়া কঠিন। ‘কাইলক্যাই তুমি ঘরে রং করব্যা। খালি ঘরে বইস্যা মেলকা-মেল্কি, ন্যা?’ তিনি এমন স্বরে বলেন যে বাড়ি থেকে যেতে যেতে ফরিদ দেওয়ানের কান পর্যন্ত তা পৌঁছে যায়।

সেদিন বিকেলেই ক্রিকেটের মাঠ থেকে নাক-মুখ ফুলিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে সুজন। সে গায়ে-পায়ে বড় হয়েও নির্বোধ ও প্রতিরোধহীন দুর্বল, যা তাজউদ্দিনকে আহত করে; কিন্তু বুদ্ধি আর শক্তি সব সময় অভ্যর্থিত হয় না, বরং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। এটা তিনি প্রতিনিয়ত অপমান হতে হতে শিখেছেন। যদিও তার ইচ্ছে ছিল মেট্রিক (এসএসসি শব্দটা এখনো তার আয়ত্তে আসেনি) পাসের পর পড়তে না চাইলে সুজনকে তিনি বিদেশে মানিয়ে দিয়ে নিজে একেবারে দেশে ফিরে আসবেন। কিন্তু ঘরকুনো ও ভিডিও গেম-আসক্ত সুজনের শিশুসুলভ স্বভাবই দূর হয়নি। হালের ফ্যাশন, চুলে রং মেখেছে বটে, তবে এখনো শিশুদের মতো হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। ক্রিকেট তাজউদ্দিনের অপছন্দের খেলা এবং অনৈসলামিক জ্ঞান করেন, এটা বাবার সঙ্গে জুমা পড়তে না যাওয়ার ঐশ্বরিক ফল হিসেবে দেখে বাবার আদর প্রসারিত করেন, যা মাঠের ঝগড়া হিসেবে দ্বিতীয় দিনে মেনে নেওয়ার মতো মন তখনো থাকে। কিন্তু সুজন বারবারই বোঝাতে চাইছিল এবং প্রায় কান্না সহযোগে, এটা কোনো ঝগড়া ছিল না, সরাসরি তার ওপর আক্রমণ ছিল। যে কারণে বড়রা উপস্থিত থাকলেও কেউ ফেরাতে আসেননি। সুজন তার আঠারো বছরের জীবনের সমস্ত দুঃখকে জড়ো করে উপস্থাপন করে, যখন সে ছোট ছিল, ধরা যেতে পারে দশ বছর, তাজউদ্দিন তখনো ঠিক নিজেকে পরিচিত করে তুলতে পারেনি, তখনো সে এর-ওর মার খেয়ে আসত। খেলা শেষে সবাই এক জোট হয়ে ঢিল ছুড়েছে ওর ওপর। কিন্তু জামা খোলার পর সুজনের মারের নমুনা দেখে এটা পরিষ্কার, কোনো মামুলি ঘটনা নয় বরং প্রতিশোধমূলক ঘটনার অর্বাচীন জের সে টেনে চলেছে। যেরকম একবার ঢোলে বাড়ি পড়লে মানুষের কান পরের ঘার জন্য অপেক্ষা করে, সে রকম। কিন্তু এত দ্রুতই এই অঘটনগুলো ছন্দ পেয়ে যাবে তা ঘুণাক্ষরেও অনুমান করতে পারেননি তাজউদ্দিন। যে কারণে একজন সবজিবিক্রেতার কাছ থেকেও শুনতে হয়, তিনি নেতাদের সঙ্গে দাঙ্গা বাধাতে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে যা অপ্রত্যাশিত কিন্তু অবধারিত, কেউ আর ভয়াবহ গল্পটি বলেই ক্ষান্ত হয় না, ভয়ের পরিণতি ও সাবধানবাণী বলে দেয়, যেন ভয় তার মনে স্থায়ী আসন গড়ে তুলতে পারে।

বাজারে সবজিবিক্রেতা মঙ্গল, ঘাড় কুঁজো এই মানুষটা, ধারণা করা যায় পদ্মাপাড়ের ধুলশুড়া হাটে চর থেকে সবজির বোঝা কিনে আনতে আনতেই এমন হয়েছে, তার কাছ থেকে প্রথম থেকেই সবজি কেনেন তাজউদ্দিন। মঙ্গল ব্যাগে পটল তুলে দিতে দিতে গলগণ্ড রোগীর মতো কণ্ঠে বলে, ‘শুনলাম ফরিদ দেওয়ানের সাতে নি আপনের লাগছে!’ আসলে এটা তার মুণ্ডন করা মাথার মতো স্পষ্ট দৃশ্যমান যে, এসব ঘটনা ইতোমধ্যে এতজন জেনে গেছে যে এটা শোনার কোনো ব্যাপার ছিল না, বরং এর বিপরীতে তাজউদ্দিন কোনো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে তা জানার জন্য উসকে দেয়া। তাজউদ্দিন খুবই বিব্রত কিন্তু কোনো কথা বলবেন না এমন একটা পণ করে ‘হুম’ বলে এড়িয়ে যেতে চান। বিছানো একটা বস্তা মুখের দিক ভাঁজ করে তৈরি ক্যাশ থেকে সবচেয়ে ময়লা ও পুরোনো টাকা খুঁজে ফেরত দিতে দিতে মঙ্গল বলে, ‘ওর সঙ্গে লাইগ্যা লাভ নাই, উরা বজ্জাদ, এই ঘটনার জন্য মানুষকেও বাড়িছাড়া করে।’ মঙ্গল তাকে বলছে বলে নয়, এ কথা যে কেউ তাকে বলতে পারে এই পূর্বধারণা তাজউদ্দিনের মাথায়, যা এখন কাটা-কাটা এবং ধূসর ধরনের চুলে ছেয়ে গেছে, আগেই এসেছিল।

মানুষ যখন অনুভব করে অন্যরা তার সমালোচনা করছে, এর ভেতর সে নিজের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা বোধের প্রকাশ করে, হোক তা নিজেকে ঘৃণার মধ্য দিয়েও। তাজউদ্দিন মনে মনে পণ করেন, বাড়িটাকে নিজের মতো সাজাতে পারলেই এই বাড়িছাড়া করার হুমকির সমীচীন জবাব দেয়া হবে। সেজন্য অচিরেই হাট থেকে দ্রুত বাড়ে এমন গাছের চারা— মেহগনি, আকাশমণি, রেইনট্রি নিয়ে বাড়ি ফেরেন। বাড়ির তিন পাশে (যেহেতু একপাশ রাস্তা অধিকার করে নেয়ায় তিনি চারা রোপণের ক্ষমতা হারিয়েছেন) প্রচুর পরিমাণে ও সঘন দূরত্বে চারা রোপণ করেন। এমনকি তিনি বাড়ির ফাইনাল টাচ দেওয়ার সময় চারপাশে যে ‘কাঁচার খোল’ তৈরি হয়েছে, সেখানেও গাছ লাগান। তিনি আশা করেন গাছগুলো তার জন্য নির্ভেদ নিরাপত্তা ও উপদ্রবহীন নির্জনতা এনে দেবে; যদিও পাখির কলকাকলি তার আদর বঞ্চিত শিশুদের মতোই উপভোগ করেন, কিন্তু তা নেওয়ার মতো কেউ আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি তার প্রিয় ছোট পাখিগুলো যখন গাছের ডালে বসে ডাকবে তাও যেন নিজেদের কামরা থেকে শুনতে পান, যা তার সন্তানপ্রিয় মনকে শান্ত করবে, প্রবাসে থাকার কারণে যা কাউকে তিনি দিতে পারেননি এবং এখন চাইলেও কেউ নিতে পারবে না, বিশেষ করে হালিমা বেগমের গর্ভাশয় অপসারণ করার পর তা একেবারেই উবে গেছে। দৃশ্যত তা হবে বাড়ির একটা আড়াল ও দেয়ালের বিকল্প। এই গাছের ভবিষ্যৎ সবুজের একটা দৃশ্য মাথায় তৈরি করার পর তার মনে হয় আপাত নতুন বাড়ির ঢাল আসলে প্রিন্টের জামার উল্টো পিঠের মতো রংহীন আর ধূসর দেখাচ্ছে। বাড়ির পূর্বদিকের ঢাল মাঠের সবুজ কার্পেটের টেনে দেওয়ার মতো কোদাল কোদাল দুর্বার চাপ দিয়ে ঢেকে দেন যেন বাড়িটাকে মনে হয় আসলে ফসলি মাঠের সবুজেরই সম্প্রসারণ। এভাবে নিয়মিত গাছের যত্নআত্তি করতে করতে তার বেলা কেটে যায়।

মেহগনির বীজ, গাছের চারা উপুড় হয়ে পুঁততে পুঁততে কিংবা ঝুলে পড়া ভুঁড়ির টানে তার মেরুদণ্ড এতটাই ঝুঁকে গিয়েছিল যে, তিনি পুরোপুরি সোজা হতে পারছিলেন না। সেই বেঁকে যাওয়া শরীর টানতে টানতে পুরোনো ও পরিত্যক্ত একটা মন্দিরের মতো দাঁড় করান, যেখানে অনেক আগেই পূজারিরা প্রসাদ দেওয়া বন্ধ করেছে, কিন্তু সময়ের প্রবাহে অর্জিত প্রাচীনত্ব, যা তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হবে না, তাই তাকে গৃহের অধিক সমীহ দান করেছে। এটা ছিল তার মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা আর সব চাকুরের মতো ছয় মাসের ছুটির সেই সব দিন যখন তিনি টের পাচ্ছিলেন, ধীরে ধীরে তিনি মসজিদের প্রথম কাতার থেকে শেষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন, এমনকি কোনো কোনো দিন কোন্ ফাঁকে এতটা নিঃশব্দে পেছনে থেকে নামাজ আদায় করে চলে আসেন যে, তা কেউ জানে না। তার ছোট মেয়ের আসা-যাওয়া ব্যাপারটা উন্মুক্ত হলেও তার শ্বশুরবাড়িতে খবর দিয়েও মীমাংসার কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। ব্যাপারটা গুমোট হয়ে উঠতে উঠতে তাজউদ্দিন টের পান একটা অদ্ভুত রিংটোন হালিমা বেগমের মোবাইলে অসহনীয় রকমের উচ্চশব্দে প্রায়ই বেজে ওঠে। রিংটোনের উচ্চশব্দের বিপরীতে হালিমা বেগমের গলার স্বর থাকে ততটাই খাটো। সবচেয়ে বেশি যেটা বলে কথা শেষ করেন, তা হলো, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি দেহুমানি, আমি কোমানি; কোমানি…’। কিন্তু বিষয়টা তাজউদ্দিনের গোচরে এলেও হালিমা কোনো দিন বলেননি। যখন তিনি সুজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, হতে পারে এটা অবজ্ঞা প্রকাশের শামিল, কে তাকে এভাবে ফোন দেয়? ব্যাপারটা হালিমা বেগম অপরিচিত নম্বর থেকে আসা কল হিসেবে দাবি করলে, তাজউদ্দিন খেপে গিয়ে, যা তার স্বভাবসিদ্ধ কিন্তু দীর্ঘদিন অচর্চিত, বলেন—‘নম্বোর এ্যাত ছাড়ায় কেমনে!’ ‘কার্ড কিনে আনলেই হয়’ তিনি বলেন, হালিমার ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে নম্বর ছড়ানোর অজুহাতের পরিপ্রেক্ষিতে। তার পরও উপর্যুপরি ফোনের যন্ত্রণা তাকে এই কথা মনে করতে বাধ্য করে যে, তার প্রবাসে ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু এসবের বিহিত করা ছাড়া ফিরে যাওয়া তার দায়িত্বজ্ঞানের উচ্চকোটিতে বাঁধা তৈরি করবে। একই সঙ্গে তার বাড়ি ঘিরে স্থানীয় নেতাদের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তার কাছে দৃষ্টিকটু রকমের প্রকট। বৃদ্ধি পেয়েছে তার সমাজি খাওয়ান, হাজতি এবং মসজিদের চাঁদা পরিশোধের চাপটা।

সৌভাগ্যের দেশে বসবাস

দুপুরের যে সময়টা বিদেশে তিনি কাজের মধ্যে কাটান, এমনকি কাজের চাপে অনেক দিন তাকে দাঁড়িয়ে খাবার খেতে হয়, সেই সময়টায় বাড়িতে ভাতঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে হঠাৎ করে তাজউদ্দিনের ‘তালার মতো তালা রইছে সিন্দুকের মাল চইল্যা গেছে’, খুলির ভেতরে শৈশবে শোনা গানটা বেজে উঠলে তার মনে হয়, স্ত্রীর সম্পর্কে তার আরও সচেতন হওয়া উচিত। ব্যাপারটা আরও জেঁকে বসে হালিমার গর্ভাশয় অপসারণে প্রসঙ্গ মনে আসার পর, যেখানে শত সঙ্গমেও গর্ভধারণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ভুঁড়ির টানে বেঁকে গিয়ে একটা অপরিমার্জিত ধনুকের মতো তৈরি হয়েছে তার শরীরের পেছন দিকে। সে জন্যই ধনুকভাঙা একটা পণ করে ফেলেন, যেটা তার বিবেচনায় যৌক্তিক ও অবশ্যপালনীয়, এটা হতে পারে তার স্থূল শরীরে ক্রমেই বাসা বাঁধা রোগ-শোক, যার কারণে তিনি তার অশ্ব যৌনশক্তিও হারাতে বসেছেন, যা একসময় থাকবেও না। এমনকি তিনি টের পেয়ে গেছেন চরভদ্রাসন পদ্মায় বিলীন হয়ে যাওয়ার পর আঁকড়ে ধরে বাঁচার মতো তার জীবনের এই বাড়ি আর স্ত্রী-সন্তান ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই।

যদি তাকে সত্য স্বীকার করতেই হয়, প্রবাসে তার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে প্রতিনিয়ত অপমান হতে হতে, যেমন: তাকে বলা হয় ‘মিসকিন শেখ’, ভিখিরিতুল্য তাচ্ছিল্য, মজুরির দিক দিয়ে সবচেয়ে কম দেওয়া, রাস্তাঘাটে সৌদি-শিশুদের পানির বোতল ছুড়ে দেওয়া, অহেতুক পুলিশের হয়রানি, কথায় কথায় মালিকের দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি কিংবা সুউচ্চ ফর্সা নারীদের দিকে কঠিন-কঠোর সংযমের সঙ্গে তাকানো ইত্যাদি। এ-ও সত্য, দীর্ঘ প্রবাসের অবসাদ ও স্ত্রী-পুত্রের প্রতি টান তৈরি হয়েছে। চরভদ্রাসন ছেড়ে আসার আগে জমিজমা বিক্রি করতে দেখে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ তাকে বলেছিলেন, ‘দেশের ঠাকুর বিদেশের কুকুর। মাটি হইল খাঁটি। মাটির জন্যই চলে কত পুরুষ ধরে রক্তারক্তি-কান্নাকাটি। মাটির জন্য খুন হওয়াও অসম্মানের না।’ এসব কথা ভেবে ক্রমাগত পেছাতে পেছাতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেয়ে কম চাওয়া নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, তিনি দেশেই থেকে যাবেন।

চাকুর খোঁচায় হারিয়ে যাওয়া হালিমার ডান হাতের অনামিকায় একটি পরিচিত তিল খুঁজতে খুঁজতে এই সিদ্ধান্তের কথা তাকেও জানিয়ে দেন। সেই দিন দুপুরেই তারা দুপুরের আলস্যে আড়মোড়া ভাঙা এক রতিক্রিয়ায় মিলিত হন। তাজউদ্দিন চাইছিলেন ভিডিও কলের মাধ্যমে যেভাবে উন্মুক্ত ও বিভক্ত শরীরের হালিমা বেগমকে দেখেন, তেমন উন্মোচন করতে। আসলে কিঞ্চিৎ অবসরে ইউটিউব, ফেসবুক, ভিডিও কলের ক্যারিশমা তাকে এমনভাবে আটকে ফেলেছে, তাকে খুঁজতে গিয়ে বাস্তবতাকেই উপেক্ষা করে ফেলেছিলেন। যে কারণে বাস্তবে উন্মোচন করেও ভিডিও কলের মতো তৃপ্ত হতে পারেননি। হালিমা তার দ্বিধাবিভক্ত অতৃপ্তি নিয়ে বরাবরের মতোই বিষয়টা রাতের জন্য তুলে রাখলেন। দিনভর সেই অনুভূতির ফুলিঙ্গ জড়ো করে তাজউদ্দিন রাতে যে আগুন জ্বালতে চাইছিলেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী এক আলোর রেখা দেখতে পান যা ঘরের চান্দুরার ওপর দিয়ে ঘরের ভেতরে আসছে। এ আলোই তার ভেতরের আগুনকে নিভিয়ে দেয় গড়পড়তা বীর্যপাতের মাধ্যমে।

পরের দিন প্রায় প্রতিশোধ গ্রহণের মতো, সবজিবিক্রেতা মঙ্গলকে জানিয়ে দেন, আর বিদেশ যাচ্ছেন না, বরং দেশেই কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন। বিক্রেতা মঙ্গল তাকে উত্তর দেওয়ার চেয়ে উত্তম উদাহরণ দেখিয়ে দেয় বাজারে পুলিশের ভ্যানে তুলতে থাকা এক ব্যক্তিকে, যে থানায় গোপনে ফরিদ দেওয়ানের বিরুদ্ধে গাঁজা বিক্রির অভিযোগ করায় তাকেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সচরাচর মানুষ যেটা পারে না, অন্যকে দীন দেখার আগে নিজের সমৃদ্ধিকে বুঝতে পারার সমৃদ্ধি তার আছে। তিনি প্রাণান্তকরভাবে বোঝেন, শক্ত না হলে তার সংসার এবং সারা জীবনের উপার্জন দিয়ে করা বাড়িটা বেহাত হয় যাবে। তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ও আজ্ঞাবহ থাকেন। এক কৌটা ডিস্টেম্পার রং আর বড় ব্রাশ নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখে অনেকে মনে করেন তিনি বুঝি পুরো বাড়িটার রং বদলে দেবেন। কিন্তু দুই দিন পার হলেও বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না (যেহেতু তিনি ঘরের ভেতরে রং করছেন), তিনি আসলে কী করছেন। এমন সন্দেহ ও আশঙ্কার দিনে তাজউদ্দিন আবিষ্কার করেন, রাতে ঘরের চান্দুরার ওপর দিয়ে একটা আলো প্রায়ই নড়াচড়া করে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেই রেখেছেন, এর মুখোমুখি হবেন। পা টিপে টিপে তিনি যখন ওই ছায়া-অন্ধকার মানুষটার পাশে গিয়ে প্রায় ধমকে উঠলেন ভয়ার্ত ও রাশভারী কণ্ঠে— ওই, কে, কে এখানে, কে? লোকটা তখনো ঘরের চাল বরাবর টর্চের আলো নাড়িয়ে যাচ্ছে। যেহেতু তার ঘরের পেছনটায় রাস্তা, তাই তিনি তাৎক্ষণিকই তাকে চোর বলে উঠতে পারছিলেন না। লোকটাও চমকে ওঠা বেড়ালের মতো অপ্রত্যাশিত ধরনের লাফিয়ে ওঠে— কে, কে? দুজনেই তখন দুলছিলেন ঝরে পড়তে যাওয়া হলুদ পাতার মতো। লোকটা ফরিদ দেওয়ানের ছোট ভাই আজাদ দেওয়ান। প্রায় একটা মোক্ষম জবাবও তৈরি ছিল তার হাতে— ‘দ্যাওয়ালের ল্যাখা দেখছিলাম। কেউ নষ্ট করছেনি।’

‘নষ্ট হলেই কী, আমার ঘরের দেয়ালের ল্যাখা যদি আমি মুইছ্যা দেই, তয় কার কী!’ তুমুল গতিতে বলেন তাজউদ্দিন। এ সময় রাস্তা দিয়ে ফিরতে থাকা, খানিকটা নেশায় টাল কয়েকজন দলীয় লোকজন দেখে আজাদ দেওয়ান বলে, ‘না, এইড্যা ল্যাখা না, এইড্যা আমাদের দলের পরিচয়। এইড্যা নষ্ট করা যাইবো না।’ যেহেতু এটা ছিল রাত আর পরিবারের সম্মানের ব্যাপারে তাজউদ্দিনও যেমন ছিল ফিরতে থাকা দলীয় লোকগুলোর মতোই মাতাল, তাই ব্যাপারটা আগামীকালের জন্য তুলে রাখা হয়।

তাজউদ্দিন টের পাচ্ছিলেন সঙ্গে করে আনা টাকা-পয়সা দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। এর মধ্যে কিছু একটা শুরু না করলে কিছুই হবে না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ঘরের একটা কামরার পেছনদিকের কিছু অংশ ভেঙে শাটার লাগিয়ে একটা মুদি দোকান দিলে তার বাড়ি রক্ষা ও বাণিজ্য দুই-ই হবে। পরের দিন নয়নশ্রী গ্রামেরই এক রাজমিস্ত্রি, যিনি আগের দল ভেঙে নতুন দল গঠন করেছেন স্রেফ সরদার হওয়ার জন্য, ডেকে ফিতা টেনে দেয়ালের গায়ে, দুর্ভাগ্যক্রমে যেখানে দলীয় ব্যানার আঁকা হয়েছে, তার ওপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাগ দিয়ে নকশা করে ফেলেন তার পরিকল্পিত দোকানের আয়তন অনুযায়ী। একেবারে প্রকাশ্য দিবালোকে তাজউদ্দিনের ফিতা টানাটানি দেখে বাজার ফেরত অনেকে আগ্রহী হয়ে জানতে চায় সেখানে তাদের জন্য আসলে কী চমক অপেক্ষা করছে। তাজউদ্দিনও তার পরিকল্পিত দোকানের ভবিষ্যৎ এবং অবশ্যই প্রার্থিত কাস্টমারকে মুদি দোকানের কথা অগ্রিম প্রচার করেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না, তার জন্য আজ কী অপেক্ষা করছে। হঠাৎ করে ফরিদ দেওয়ান রাজমিস্ত্রির হাতের ফিতা কেড়ে নেয়। যদিও দেয়ালের লিখন যা এত দিনে প্রায় ধুয়ে-মুছে গেছে, তাদের না বলে তার ওপর কিসের ফন্দি আঁটা হচ্ছে— তা সে জানতে চায়। ব্যাপারটা যে ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর চেয়ে সরল তা বুঝতে পেরে তাজউদ্দিন রুখে দাঁড়ান, যে প্রতিবাদী ইমেজ তিনি ধারণ করতে চান, তিনি এখানে মুদি দোকান দিতে চান। মুহূর্তেই এটা স্থানীয়দের ক্ষণিক বিনোদন ও স্থায়ী আলোচনার বিষয় হতে যাচ্ছে দেখে অনেকেই জটলা করে দাঁড়িয়েছে। তাদের উপস্থিতিতেই ফরিদ দেওয়ান নিজেকে সরকারি দলের ইউনিয়ন কমিটির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে জাহির করে শক্ত করে বলে দেয়, কোনোভাবেই এই দেয়াল লিখন নষ্ট করে দোকান তৈরি করা যেতে পারে না।

 


প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েই বলে, তাকে অবশ্যই এসব লেখা একেবারে ধুয়ে-মুছে যাওয়া কিংবা যখন তারা এটাকে বাতিল ঘোষণা করবে, তত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। নয়তো তারা তার বিরুদ্ধে দলীয় ও পুলিশি পদক্ষেপ নেবে, প্রয়োজনে ঘর গুঁড়িয়ে দিতে হলেও।

 

ফরিদ দেওয়ানের কথা এখানে বলে লাভ নেই। একটা হম্বুচম্বু ভাব নিয়ে সব সময় ঘুরে বেড়ায় এবং কারণে-অকারণে যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করে ফেলাই তার সবচেয়ে তৎপরতার বিষয়। এলেমেলে একটা খুনের গল্পও প্রচারিত আছে স্থানীয়দের মধ্যে। তবে তার চলাচলতিকে মহিমান্বিত করা হলেও কপালে কোনো দলীয় পদ এখনো জোটেনি। বরং সবার কাছেই সে ন্যায়পরায়ণ কিন্তু অবিবেচক হিসেবে বিবেচিত। তার কাছে বাদী ও বিবাদী উভয়েই সমান ভোগান্তি ও অর্থদণ্ডের শিকার হয়। তারপর সে বিষয়টাকে বিচারিক সম্পত্তি হিসেবে দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে বিক্রি করে, যা উভয়কে সর্বস্বান্ত ও গ্রামছাড়া করার ভেতর সম্পন্ন হয়। ঘরের দেয়াল ভাঙার জন্য শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছাতে যুক্তির পথে হাঁটার চেষ্টা করেন তাজউদ্দিন, যা ছিল তার জন্য মারাত্মক কণ্টকাকীর্ণ ও সংকীর্ণ পথ। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন, দেয়ালের প্রায় সব রং-লেখা উঠে গেছে, পড়াও যায় না, এটা থাকার কোনো মানে নাই, বরং অসম্মানের, তাই অন্য কোথাও তৈরি করা হবে সঠিক কাজ।

কিন্তু দলীয় লোকজন, মানুষের প্রতিবাদের ব্যুৎপত্তি দেখে ফেলা কয়েকজন নেতা, যারা দলবদলের পরও নিজেদের কখনোই সরকারের বাইরে দেখতে চায় না, তেমন অনেকেই ততক্ষণে উপস্থিত হয়েছে এবং নিজেদের মধ্যে ভাষা-অবস্থান প্রায় ঠিক করে ফেলেছে, তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের ঘরের দেয়ালে ইউনিয়নের সবচেয়ে রংবহুল চিত্র ছিল তা এখন প্রায় সর্বজন-প্রচারিত, তাই এটা অপসারণের প্রশ্নই আসে না, বরং বহুল প্রচারিত স্মারক হিসেবে এটাকে বহন করতে পারেন মাত্র। তাছাড়া দেয়ালচিত্রের কোনায় আঁকা প্রায়-জীবিত মিলিয়ে দলীয় সর্বোচ্চ নেতাদের বংশ-পরম্পরার ছবি, রং খসে গেলেও সমীহর কারণে তাকে শ্রদ্ধা জানাতেই হবে। এবার শঙ্কায় বিচলিত তাজউদ্দিন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ঘরের পেছনের দেয়ালে ছবি এঁকে কি তারা ঘরটাই কিনে নিয়েছে? এ কথার পর তিসি সাপ-লুডুর মই বেয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন মূল সমস্যায়, যা একই সঙ্গে একটা গুরুতর প্রশ্নও—বাড়ির মালিকানা কার? এ সময় দলীয় লোকজন, যাদের আলাদা করে চেনা যায় না; কারণ তারা স্ব-সম্মতভাবে নিজেদের নেতা বলে মনে করে এবং সংঘর্ষের সময় পরস্পরের শরীরে এঁকে দেয় একাধিক কোপের স্থায়ী চিহ্ন, অথচ নেতৃত্বের বিশাল কর্মযজ্ঞে তাদের অবদান এত অনির্ণীত রকমের ক্ষুদ্র যে, প্রায়ই তা উপেক্ষিত থেকে যায়; সেই সঙ্গে তারা এতটাই দলকানা, তাদের কাছ থেকে মানবিক ও যুক্তিপূর্ণ আচরণ আশা করা যায় না। তারা পইপই করে বুঝিয়ে দেয়, তাজউদ্দিন যদি দেয়াল ভাঙেন তাহলে মাঝখানে আঁকা (যদিও তার কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না) ইউনিয়ন সভাপতির ছবির অর্ধেকটা ভাঙা পড়বে, তা স্পষ্টতই তাকে অসম্মান করা এবং তাকে অসম্মান করে এই ইউনিয়নে থাকার কারও অধিকার নাই। আর দেয়ালের অর্ধেকটা ভাঙা পড়লে থাকবে ‘গের অঙ্গ সংগঠন’, যেটা দলের অবমাননা, আর তাদের চোখে এটা দেশ অবমাননারও শামিল! ফলত, তিনি এ দেশেই থাকার অধিকার হারাবেন। কোনো এক নব্য শিক্ষিত বড়দের কথায় ফোড়ন কাটে—‘গের মানে গে’(সমকামী)দের সংগঠন’, এটা হতেই পারে না।

‘খবরদার’— দলের আত্মসম্মান প্রকাশে উৎসাহী কিন্তু ভিতু গোছের এক কর্মী উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে প্রায় তাজউদ্দিনের শার্টের কলার চেপে বলে, ‘আপনে জানেন কোনো সংগঠনের লেখা নষ্ট করার চিন্তা কোরছেন, আমাগো দল এ্যাহন ক্ষমতায়, উঁস কইর‌্যা কতা কইয়্যেন কইলাম।’

‘ক্যান, কী অইছে। আমরাও এই দ্যাশের মানুষ’— রাজনীতির সুবিধাবাদের কোনো ভোক্তা নন, এমনভাবে তাজউদ্দিন প্রায় খেপে গিয়ে বলেন।

‘আরে রাখেন, হি ইজ দা মাদার অব দা ফাদার।’ রাজনীতির মতো ইংরেজিতে অজ্ঞ এক কর্মী বুক চাপড়ে হুমকি দেয়।

ব্যাপারটা একটা অর্থহীনতার দিকে চলে গিয়ে যেহেতু গায়ে হাত তোলার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, রক্তারক্তির পর্যায় উন্নীত হওয়ার আগেই আর বাড়তে দেয়া যায় না মনে করে ফরিদ দেওয়ান বলে, (যে এতক্ষণ ছিল এই নাটকীয়তার মুগ্ধ দর্শক ও নেপথ্য নির্দেশক), আপনি দেয়াল ভাঙবেন তা সমস্যা না, কালকে ওয়ার্ডের পার্টি অফিসে আসেন, বসেন, আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। যাওয়ার সময় স্বামীর পাশে সন্ত্রস্ত হালিমা বেগমকে বলে, ‘ভাইরে বোঝান ভাবি, এইভাবে চলে না। এইড্যা হ্যার বিদ্যাশ না, এইড্যা বাংলাদ্যাশ।’

ত্রাতাদের সমারোহ

কোনো বিষয়ে কখনো যিনি স্ত্রীর কাছে কিছু জানতে চাননি, এমনকি তার দুর্ভাগ্য অনেকটাই যার কারণে ঘটেছে বলে মনে করেন, তার কাছ থেকে কিছু বুঝ নেয়ার মতো বিপর্যয়কর অবস্থা তাজউদ্দিনের কখনোই আসেনি। প্রায় স্বভাববিরুদ্ধভাবে আজকে লেগে যাওয়ার কোনো ইচ্ছেও তার ছিল না। কিন্তু কখনো কখনো দুর্বিপাক নিজেই তার ভুক্তভোগী খুঁজে নেয়। ‘খোদা যা করেন ভালোর জন্যই করেন’— এমন ধারণা নাকচ করে সেদিন বিকেলেই তাজউদ্দিন ওয়ার্ড কমিটির অফিসে যান, বাজারের কাছে যা রাস্তার অনেকটা অংশ দখল করে গড়ে উঠেছে, অথচ তিনি কখনো খেয়ালই করেননি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন নেতারা সবাই একটা বিচারে গেছেন, ফিরতে সন্ধ্যা লেগে যাবে। এই সময়টুকুতে তাজউদ্দিন ওয়ার্ড কমিটিতে ঠাঁই না পেয়েও পার্টির জন্য নিবেদিত এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে কাটান, যে মনে করে শুধু অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় সে দলকে ক্ষমতার চিরস্থায়ী আসনে রাখার যে মহাপরিকল্পনা এঁটেছে দল তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অচিরেই এর জন্য দুঃখ করতে যাচ্ছে।

সন্ধ্যার পর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি রশিদ ভূঁইয়া, যার আপন ছোটভাই প্রতিপক্ষ দলের সভাপতির পদ অলংকৃত করেছে, তাজউদ্দিনের আসার কারণ শুনে বুঝতে পারেন না আসলে কী ঘটছে। পরে বুঝতে পারেন ফরিদ দেওয়ান তার অজ্ঞাতেই কিন্তু তারই নামে দোহাই দিয়েছে, তবে এখনো তার কাছে বলার সময় পায় নাই, তার বলেই তাজউদ্দিন ধরা পড়েছেন। তিনি প্রায় সবজান্তার মতো আগের রায়কেই পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ব্যাপারটা যেহেতু ওয়ার্ড অফিস পর্যন্ত গড়িয়েছে, তাই তাকে অবশ্যই পাঁচ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে আজকের ঘটনা মীমাংসা করার জন্য। নতুন করে আরও পাঁচ হাজার টাকা দণ্ডের তলে পড়ে তাজউদ্দিন নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করেন একজন গর্দভ ও পায়ে সুতা জড়ানো আরশোলার মতো, যে কেবল পা নড়াতে নাড়াতে আরও পেঁচিয়ে যায়। তিনি একটা মামুলি অজুহাতে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।

এইসব ঘোরের ভেতর আরও একটা বিপদ, যা চোরাবালির মতো ভয়ংকর ও প্রতারক ফাঁদ ছড়িয়ে থাকে উপদেশের নাম করে। পরের দিন বাজারে মঙ্গল তাকে বলে, যেন গতকালের সবকিছু সে অবলোকন করেছে, ‘বাপেরও বাপ আছে। পচা শামুকে পাও কাইট্যা লাভ নাই, আপনে বরং পার্টির ইউনিয়ন সভাপতির কাছে যান, তিনি নিশ্চয় একটা পথ করে দিতে পারেন।’ এমনকি সভাপতি প্রসঙ্গে একটা ফিরিস্তিও দেয় যেখানে এই সব ওয়ার্ড সভাপতিদের শায়েস্তা করার একটা কাহিনি বিদ্যমান। আর দেয়ালে যেহেতু তারই ছবি আঁকা, মঙ্গল স্মরণ করতে পারে, তাই ওই ব্যানারযুক্ত দেয়াল ভাঙার ব্যাপারে তিনি সম্মতি দিলে কারও কিছু বলার থাকবে না।

তাজউদ্দিন দ্রুতই হাজির হন ইউনিয়ন পার্টি অফিসে, যেখানে তখনো পর্যন্ত তার লাঞ্ছনার খবরটা পৌঁছায়নি। তবে পার্টি অফিসে তাজউদ্দিনের উপস্থিতি এই দলের কর্মতৎপরতা ও অস্তিত্বের ন্যায্যতা প্রমাণ করে। ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস সিকদার একটা পুরোনো মানচিত্রে খুঁজে খুঁজে খাস জমিগুলো চিহ্নিত করতে করতে দেয়াল ভাঙার ভেতর সমস্যার কিছুই না পেয়ে বুঝতে পারেন বিষয়টা তার দলের স্থানীয় দাপটের সঙ্গে যুক্ত। তিনি দ্ব্যর্থহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বলেন, এতে তার কিছুই করার নেই, একে স্থানীয়ভাবেই সমাধা করতে হবে। তারপরও না হলে তিনি তো আছেন। পরে তাজউদ্দিনের প্রতি দয়াবশত, যেহেতু তার ছবি ভাঙতেই হবে, তিনি নতুন কোনো দেয়ালে এটা আবার আঁকার ব্যয় হিসেব করে— তিনটি রঙের দাম, পেইন্টারের টাকা, তদারকি খরচসহ অন্যান্য ব্যয় প্রায় পনেরো হাজার, সঙ্গে আরও দশ হাজার মিলিয়ে পঁচিশ হাজার টাকা দাবি করেন, যা দিলে তিনি বরং ওয়ার্ডের নেতাদের অনুরোধ করতে পারেন যেন বিষয়টা আর না এগোয়। এরপর ওয়ার্ড পর্যায়ে আর কিছু হবে না এমন একটা নিশ্চয়তাও দেন। তার ব্যবহারে তাজউদ্দিন এতটাই ক্ষুব্ধ হন, মঙ্গলের কাছে বলতে কসুর করেন না যে, অনাগ্রহ সত্ত্বেও তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন, তবু এই সব পাতিনেতার কাছে হার মানবেন না। ‘একবার শেয়ালরে ভাঙা বেড়া দ্যাহাইলে সুযোগ পাইয়্যা যাইবো, রোজ রোজ ওনদ্যাই ঢুকপো’— যুক্তি টেনে বলেন তাজউদ্দিন। অবশ্য ইতোমধ্যে ওই নেতাদের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে এতবার কথা হয়েছে, তাদের সঙ্গে নতুন করে কথা শুরু করারও সুযোগ তার নাই।

ঠিক এই সময় একদিন জুমার নামাজের আগে মাইকে ইমামের বয়ান শুনে তাজউদ্দিনের হাতের বদনার পানি এমনি এমনি গড়িয়ে পড়ে যায়। ইমামেরা প্রায় স্বভাবসিদ্ধভাবে সারা সপ্তাহে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাদের চোখে যেসব বিচ্যুতি ধরা পড়ে, শুক্রবারের বয়ানে তা-ই ফিরে আসে বিষয় ও উদাহরণ হিসেবে, যা তাকে গ্রামে নজরদারি ও সমীহ তৈরিতে সাহায্য করে। ইমাম উদ্দেশ্য না লুকিয়েই বয়ান করেন, ঘরে ছবি টাঙানো ইহুদি-নাসারাদের কাজ। তবে ঘরে অন্য ধর্মের ছবি নিজের ধর্মের মনে করে টাঙালে তা হবে শিরক। মসজিদের উপস্থিত মুসল্লিদের মধ্য থেকে তার কথার মানে বুঝতে পারা ক্ষুদ্র কয়েকজন বয়ানের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। কেউ একজন প্রায় বলেই দেন, তাজউদ্দিনের ঘরে যে সাদা দাড়িওয়ালা এক ধর্মীয় পুরুষের ছবি টাঙানো আছে, তিনি ইসলাম ধর্মের কেউ নন, তিনি শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক, অথচ ওমরাহ করে আসা তাজউদ্দিন এখনো তা উৎখাত করেননি। ব্যাপারটা তাজউদ্দিনের সেদিনের মতো মসজিদে যাওয়ার পথে দুর্লঙ্ঘ্য দেয়াল তুলে দেয়, যা তার পক্ষে পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তার মাথায় কেবল আফসোসের মতো মনে পড়ে চরভদ্রাসনের বয়োজ্যেষ্ঠের কথাটা— আত্মীয় আপ্যায়ন করতে হয় ঘরের ভেতরে এনে, যেন বাইরের কেউ না দেখে; আর মুনশি-মাওলানা আপ্যায়ন করতে হয় ঘরের বাইরে থেকে, যেন ঘরের ভেতর না দেখে। তিনি স্মরণ করতে পারেন সে রাতে তিনি ঘরের চালে এবং দেয়ালে ঢিল ছোড়ার মতো শব্দে চমকে উঠেছিলেন। তিনি খুব বিপন্ন ও প্রতিরোধ-ইচ্ছুক মন নিয়ে বোধ করেন, এই কথাগুলো থানায় অন্তত জানিয়ে রাখা দরকার। এ জন্য নবাবগঞ্জে রওনা হওয়ার পর তার মনে হয়, তিনি পার্টির থানা কমিটিকে একবার বলেই দেখতে পারেন। কিন্তু সেখানেও তিনি আবিষ্কার করেন ওই দুষ্টু সংঘের একাধিক শাখা-প্রশাখা। মূল দল তো আছেই, সেই সঙ্গে এখানে আছে নানা নামের আরও বহু অঙ্গ-সংগঠন। এর প্রত্যেকটির থানা কমিটি আছে জানার পর তাজউদ্দিনের জন্য গোলকধাঁধা তৈরি হয় আসলে কাকে দিয়ে তার সমস্যার সমাধান হবে, কেননা এসব উপদলের প্রত্যেক নেতাই জানায় ব্যাপারটা তার জন্য মামুলি; কিন্তু ‘একটু জটিল’। শেষ পর্যন্ত এক তাগড়া গোছের লোক, যার ছবি গাছে টাঙানো ফেস্টুনে সবচেয়ে বেশি দেখেছেন তাজউদ্দিন, নিজেকে মূল দলের সভাপতি দাবি করেন। তার প্রভাব এতটাই যে, কিছুদিন আগে তিনি দলবদলের মাধ্যমে সরকারি দলের সভাপতির পদ অর্জন করেছেন। তিনি অত্যন্ত কঠোর ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে দল পরিচালনা করছেন বলে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও ভালো আছে এবং তার কাছ থেকে সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যায় বলে প্রচারণাও আছে। তিনি চাইলে আঙুলের টোকায় এর মীমাংসা করতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু পাড়া থেকে ওয়ার্ড, ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন এবং ইউনিয়ন থেকে থানায় এসে তার হাতে পৌঁছেছে, তাই তিনি কোনোভাবে তাদের উপেক্ষা করতে পারেন না। ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’—মুখস্থ বুলির মতো তিনি আওড়ান। বলেন, তাকে অবশ্যই সব শাখা ও কেন্দ্রগুলো নিয়ে এর সমাধান করতে হবে। এ জন্য ক্ষেত্রভেদে তাকে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে, যা তিনি নীতিগতভাবেই সবাইকে নিয়ে ভাগ করবেন, তাতে দল-দেশ দুইয়েরই রক্ষা হবে। ব্যাপারটা এমনই, তিনি এখন চাইলেও এটা এড়াতে পারেন না, এই টাকা দিয়েই তাকে সমাধান নিতে হবে, নইলে তার আশার বসতি বিপন্ন হলে কোনো দায় তাদের সরকার নেবে না। আর সতর্ক করলেন, এসব ক্ষেত্রে থানা-পুলিশ না জড়ানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কেননা এগুলো তাদেরই ইশারাতেই চলে। তাজউদ্দিনের মনে পড়ে, চরভদ্রাসনের সেই বয়োজ্যেষ্ঠের কথা:

যে করে মামলা সে খাটে কামলা।

আরও একটি শিক্ষণীয় সন্ধ্যা

তাজউদ্দিন বাড়ি ফিরে আসেন সন্ধ্যার আগে, যখন সূর্য পৌনঃপুনিকভাবে পশ্চিমের করপাড়া-ছত্রপুর গ্রামের ওপাশে ডুবতে যাচ্ছে। একটা তির্যক ও দুর্বল আলো তার ঘরের পেছন আলোকিত করে রেখেছে। তখনই মনে হয় হালিমা তাকে একটা মুখের ক্রিম আনার জন্য বলেছিলেন, যা তিনি ভুলেই যাননি কেবল, স্মরণেও আনতে পারছেন না। নিজেকে তার মনে হয় কুশপুত্তলিকা যা নেহাত কাকতাড়ুয়ার–ওয়ার চেয়েও অধম। শেষ মুহূর্তে তিনি হালিমার জন্য ক্রিম খুঁজে পাওয়ার ভেতর সারা দিনের একটা সান্ত্বনামূলক সাফল্যের কথা চিন্তা করেন। তিনি যেহেতু ভুলেই গেছেন ক্রিমের নাম, বিভ্রান্তি এড়াতে তখন তিনি একটা বর্ণনা তৈরি করেন। ‘দাদা, মুখের কিরিম আছে?’ এ কথা বলার পর সুভাষ দোকানদার কয়েক রকমের ক্রিম নামিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘ওই যে, চাইর কুনাইচ্যা এ্যাকটা প্যাকেট, একপাশে গোলের মধ্যে একটা ফর্সা মহিলার ছবি, আরেক পাশে সাদা পাহাড়ের মতো আঁকা, ওইটা।’ সুভাষ দোকানদার একটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ক্রিমের প্যাকেট এগিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘না, এই টুথপেস্টের মতো না, ওই যে বসাইয়্যা রাখা যায়। দুই পাশে ফিরোজা (চরে থাকতে যা বলতে নেভি ব্লু বুঝতেন) আর দুই পাশে কঁচিপাতা রং, সঙ্গে সোনালি রংও আছে। চিনতে পারছেন? মহিলার ছবির ওখানে সোনালি রঙে তারা আছে।’ সোনালি রঙের সূত্রে স্বর্ণ ও স্বর্ণ সূত্রে স্বর্ণকারের দোকান মনে পড়ে, যা তাকে কাঙ্ক্ষিত নামটা ফিরিয়ে দিতে পারে। সুভাষ তারপরও চিনতে না পারলে তাজউদ্দিন নিকটতম একটা উদাহরণ খুঁজে পান স্বর্ণকার কাশিনাথের দোকানে— আসলে তা এখানকার সব স্বর্ণকারের দোকানেই আছে— কারিগরদের টেবিলে পানিসহ যে কাচের ছোট কৌটা থাকে ওই কৌটার ক্রিম। সুভাষ তখন বিরক্তি ও চাতুরী মিশিয়ে বলে, তিনি যেন স্বর্ণকারের দোকান থেকে ওই কৌটাগুলোয় কি ক্রিম ছিল তার নাম জেনে আসেন। তাজউদ্দিন তখনই গিয়ে কাশীনাথকে ওই কথা জিজ্ঞেস করলে প্রথমে বিস্ময় ও পরে কৌতুকপূর্ণভাবে বিস্তারিত শোনে। বিষয়টা যেহেতু স্ত্রীর জন্য ক্রিম কেনা, তাই এটাকে সে এক চতুর রসিকতায় উন্নীত করে। কাশীনাথের দোকান বরাবর বাজারের অন্য সারিতে গফুরের বেকারি দেখিয়ে বলে, দোকানটায় গিয়ে গফুরের কাছে তার কথা বলে মুখে দেয়ার ক্রিম আছে কি না জিজ্ঞেস করলেই দিয়ে দেবে, কোনো নাম লাগবে না। দ্রুত অন্য সারিতে গিয়ে গফুরকে তিনি কাশীনাথের দোকান দেখিয়ে মুখের ক্রিমের কথা বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারে এবং দুঃখভরাতুরভাবে অপারগতা প্রকাশ করে আজিজের স-মিলে যাওয়ার পরামর্শ দেয় এবং এ-ও বলে যে সেখানে তার নাম বললেই হবে। সেখানে প্রথমে ঘটনা বর্ণনা দিয়ে ক্রিমের কথা বলতেই তারা আরও বেশি কপট লজ্জা ও আফসোস প্রকাশ করে নাসিরের পোলট্রি দোকানে পাঠায় এবং বলে যে, তিনি যেন অবশ্যই আদায় করার চেষ্টা করেন। নাসির (যাকে সবাই ‘মুরগি নাসির’ বলে ডাকে এবং নারী ও মদ-সংসর্গের জন্য ‘বিখ্যাত’) তখন পোলট্রিকে সন্ধ্যার খাবার দিচ্ছিল। তাজউদ্দিন তার কাছে ঘটনার একেবারে শুরু থেকে বর্ণনা করেন। নাসির তার প্রতি করুণ সমবেদনা দেখিয়ে বলে, ওটা তারই কাছে ছিল কিন্তু আজই শেষ হয়ে গেছে, তিনি সন্তা শীলের সেলুনে দোকানে নিশ্চিত পাবেন, কারণ সে দেখে এসেছে সামনে ঈদ বলে সে আজ সন্ধ্যায় ক্রিম এনেছে। এভাবে কয়েকটা দোকান ঘোরার পর তাজউদ্দিনের ভেতর একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। কিন্তু তিনি ক্রিমের প্রতি এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, যেন যেকোনোভাবে ওটা হাতে এলেই ল্যাঠা চুকে যায়। সিনেমার জোকার প্রকৃতির মানুষ সন্তা শীল, যা অনিবার্যভাবেই কোনো ভিলেন বা নায়কের সঙ্গে যুক্ত। সেলুনের সামনে দাঁড়িয়েই নাসিরের কথা বলা শুরু করেন তাজউদ্দিন। কিন্তু তার আগেই কাজের চাপে ব্যস্ত সন্তা শীল, যেন করুণ রসেরও সময় নেই তার, পাশের খগেন কামারকে দেখিয়ে দেয়। বাজারের দুর্গাপূজা ও রথ উৎসবকালীন বিশেষ চৌকিদার খগেন কামার তখন বটতলার বেড়াহীন ছাউনির নিচের ছোট্ট ঝুপড়ি থেকে হাঁপর খুলে সন্তা শীলের সেলুনের পায়ের কাছে রাখছিল, যেন রাতে তা চুরি হয়ে না যায়। তারপর চুলাটা ছালা দিয়ে ঢাকার বন্দোবস্ত করছিল। খগেন কামার প্রায় বিরক্তি ও করুণাহীনভাবে তাজউদ্দিনকে হদ্দ বোকা বলে মন্তব্য করে এ জন্য যে, তিনি কেন একবারও চিন্তা করেননি ওই সব দোকানে কখনো মুখের ক্রিম পাওয়া যায় না! তাজউদ্দিন তার প্রতি শ্রদ্ধা ও অন্যদের প্রতি অক্ষম করুণা থেকে অশ্রু নির্গত হওয়ার অবস্থায় বলেন, তিনি কেবল ক্রিমটার নাম খুঁজতে বেরিয়েছিলেন; কিন্তু সবাই ক্রিম পাওয়ার সম্ভাবনায় তাকে এতটাই উত্তেজিত করেছিল বলেই গোল বেঁধেছে। তার মনে হয় (যেটা তার আগেই হওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয়), এলাকায় তার বাড়ি রক্ষা নিয়ে যেভাবে নেতাদের কাছে হুমকি-ধমকির মুখে ধর্না দিয়েছেন, এটাই তাই। তাতে তার অবস্থান সবচেয়ে অধমের কাতারে নেমে এসেছে, যে কারণে তার সঙ্গে সবাই এই করুণ উপহাস করল। একটা লজ্জা ও ঘৃণামিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে বাড়ি ফিরে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।

পরের দিন তার ঘুম ভাঙে কানাঘুষা শুনতে শুনতে যে, তাজউদ্দিন গত সন্ধ্যায় কাশীনাথ স্বর্ণকারের দোকান, গফুরের বেকারি, আজিজের স-মিল, নাসিরের পোলট্রি, সন্তা নাপিতের সেলুন ও শেষমেশ খগেন কামারের দোকানে মুখের ক্রিম খুঁজেছিলেন। এরই মধ্যে কে যেন হালিমা বেগমকে সমাজি খাওয়া ও হাজতি, মসজিদের টাকা এবং পার্টি অফিসে টাকা দিয়ে আসার কথাও বলে, এমনকি তা না করলে— রাখঢাক ছাড়াই বলে— বাড়ি ছাড়তে হবে তা নিশ্চিত। বিষয়টা তাজউদ্দিনের টাকা-পয়সা হওয়ার কারণে হালিমার হৃতগৌরব আর আপস মানস, যা এই গ্রামে থাকার জন্য জরুরি, তার পক্ষে জোরালো সমর্থন জোগান দেওয়ায় তিনি বলেন— তিনি কি এতটাই নির্বুদ্ধি যে বোঝেন না ওইসব দোকানে তিব্বত স্নো থাকে না এবং এই নেতাদের হাজার পাঁচেক টাকা প্রথম দিন দিয়ে দিলেই এই গোলকধাঁধায় পড়তে হয় না, যার কথা তিনি আগে থেকেই বোঝাতে চেয়েছেন। নিজের বুঝের অক্ষমতার লজ্জায় প্রায় সারা দিনই ঘরের মধ্যে কাটে তার। তাছাড়া প্রবাসে ফিরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসায়, যদিও তার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন, তার লজ্জা আরও বৃদ্ধি পায়। রাতে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে তার সারাজীবনের উপার্জন দিয়ে গড়ে তোলা আশার বসতি হারানোর শঙ্কায় বারবার কুঁকড়ে উঠছিলেন। কিন্তু পাশেই বিবসনা হালিমা বেগমের বুকের উপত্যকার দিকে অমনোযোগী তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবছিলেন, তিনি আসলে এই বাড়িতে আর থাকবেন নাকি থাকবেন না। ওপাশ থেকে সুজন তখনো ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস খেলে যাচ্ছে।


অলাত এহ্সান

মূলত গল্পকার। নিজেকে মনে করেন ‘পাঠকপর্যায়ের’ মানুষ। প্রবন্ধ ও সমালোচনা লেখেন। তার নেওয়া সাক্ষাৎকার অনেকবার নেটিজেনদের চিন্তা ও তর্কের খোরাক হয়েছে। প্রথম গল্পগ্রন্থ-ই পেয়েছে পাঠক-সমালোচকের সমাদর।

কবিতাচর্চা এখনো আছে, তবে অনিয়মিত। যা লিখতে চান, যেভাবে লিখতে চান তা কবিতায় লেখা যাচ্ছিল না বলে নিয়েছেন গল্পের আশ্রয়। বিচিত্র বিষয়ে পাঠাভ্যাস লেখাকে করেছে সীমিত ও সংহত। 

জন্ম ১৯৮৭ বা তার আগে, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার করপাড়ায়, বেড়ে ওঠা বারুয়াখালী। ঢাকা কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। ক্যাম্পাসে নেতৃত্ব দিয়েছেন বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের। 

পেশা শুরু এনজিওতে অনুবাদক হিসেবে। বর্তমানে একটি জাতীয় দৈনিকে কর্মরত। অবসরে চর্চার বিষয় জাপানি ভাষা।

তত্ত্বের উপনিবেশমুক্ত তার গল্প। তবে বিষয়-বৈচিত্র্য, দেখার সূক্ষ্মতা, উপস্থাপনের অনির্দিষ্টতা, কৌতুক, চিন্তার স্বচ্ছতা, ভাষা ও উপস্থাপনের প্রতি অভিনিবেশ আর আবেগের প্রতি সৎ থাকা তার প্রকাশকে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্য।

* অনভ্যাসের দিনে (গল্পগ্রন্থ), প্রথম প্রকাশ২০১৮

* দশকথা: বিশিষ্টজনের মুখোমুখি (সাক্ষাৎকার সংকলন), বেঙ্গল বুকস, ২০২৪

শেয়ার