গত ১৫ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন কবি আল মাহমুদ। এতকালের বয়ে আসা হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে, লোকাচারের সঙ্গে মহা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সদাচর্চিত ইসলামী সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়েছেন তিনি। ঐতিহাসিক ঘাটতি মিটিয়েছেন। তবু তাঁর শেষকৃত্যে ঢাকার কবি-লেখকরা প্রায় অনুপস্থিত থাকলেন!
‘নতুন ধানের দুধে সবাকার মন
আমরা ভরিতে চাই গেঁয়ো কবি,
পাড়াগাঁ-র ভাঁড়ের মতন।’
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন। মৃত্যুর পরও কবি আল মাহমুদকে ‘গেঁয়ো কবি’ হিসাবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরী। তামাম বাংলা ভাষার একালের অতিকায় কবির কবরের মাটি জুটল না মস্ত ওই মহানগরে। তাঁর মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি মিলল না। তাঁর পরিবারের সদস্যরা চেয়েছিলেন কবি নজরুলের সমাধিক্ষেত্রের পাশে অথবা ঢাকার মিরপুরে বুদ্ধিজীবী সমাধিক্ষেত্রে তাঁর সমাধির ব্যবস্থা করতে। অনুমতি মিলল না। ঢাকার ‘বাংলা অকাদেমি’ প্রাঙ্গনে তাঁর মরদেহ কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে শ্রদ্ধা জানালেন কতিপয় মানুষ। কবি-লেখকদের কাউকেই দেখা গেল না। ঢাকায় ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ’-এর সামনে জানাজা-য় (অন্ত্যেষ্টির অনুষ্ঠান) ভিড় জমল না। পাশেই ঢাকা প্রেস ক্লাব। বুদ্ধিজীবী, লেখক, কবিদের কাউকেই দেখা গেল না।
আত্ম-পরিচয় দানে আল মাহমুদ একদা লিখেছিলেন—
‘বলবে নাকি, এসেছে কোন গাওয়ার?’
১৫ নভেম্বর শুক্রবার বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ৫ মিনিটে ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে প্রয়াত হন কবি আল মাহমুদ। পরদিন সকালে ছবিতে আমি শববহনে দেখলাম কেবল আমাদের সময়ের এক কবিবন্ধুকে, তিনি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, তিনি কানাডার নাগরিক, এবার কলকাতার বইমেলায় এসেছিলেন, স্বদেশ হয়ে টরন্টো ফিরবেন এ মাসের শেষে। ছবির পর ছবি দেখলাম আমি। বিস্মিত হলাম আমার বন্ধুদের, আমাদের অনুজ কবিতাপ্রয়াসীদের অনুপস্থিতিতে। শনিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌরাইল গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে সমাধিস্থ করা হল কবি আল মাহমুদকে। জন্মস্থানে অবশ্য সমাদর জুটল তামাম বাংলার এই বিরাট কবির। সাত গ্রামের সজল মানুষজনের ভিড় জমেছিল আল মাহমুদের দাফনে। অদূরে ধূসর সন্ধ্যায় ছলছল করল যে নদীর নাম তিতাস। তাঁর মৃত্যুতে লোকজন আসবে না, কেউ কাঁদবে না— আত্মাভিমানে লিখেছিলেন আল মাহমুদ, শুধু একজন তার হাতের চুড়ি ভেঙে ফেলবে, আর পৃথিবী ফোঁপাবে— লিখেছিলেন তিনি। সত্যিই কবি আল মাহমুদকে গোর দেওয়ার পর গুমরে উঠল মাটি, ওই সন্ধ্যাতেই চট্টগ্রামে মৃদু ভূকম্পন হল।
তবু বলব, তবু বলব, স্তম্ভিত হলাম আমাদের কালের মহাকবির প্রতি রাজধানী ঢাকার উপেক্ষায়।
মৃত্যুর পরও আল মাহমুদকে লক্ষ্য করে অপবাদের, অভিযোগের, দোষারোপের কত না ঢিল-পাটকেল সামাজিক মাধ্যমগুলিতে। সূর্যে গুলতি হানছে বামনরা। আল মাহমুদের অপরাধ, তিনি তাঁর বামপন্থা থেকে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়ে ইসলামে আস্থা স্থাপন করেছেন। ব্যস, আল মাহমুদের জীবনকালে প্রায় গত চার দশক ধরে তাঁকে ‘জামাতি’, ‘মৌলবাদী’, ‘রাজাকার’ এসব আখ্যায় জর্জরিত করেছে বাংলাদেশে স্বঘোষিত গণতান্ত্রিক মহল। ইহলোক ছেড়ে এখনও তাঁর শান্তি নেই, যেন তাঁর সমাধিতেও এসব অপরাধের সিলমোহর দেগে দিতে চাইছে ঢাকার গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী মহল।
হাতে টিনের স্যুটকেস, ১৯ বছর বয়সী তরুণ আল মাহমুদ ঢাকায় আসেন ১৯৫৫ সালে। সমবয়সী শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরীদের মাঝে আল মাহমুদও সেসময়ের সাহিত্যপত্রগুলিতে চিহ্নিত হয়ে যান তাঁর নিচু কণ্ঠস্বর, পারিপার্শ্বিক কম্পমান জনজীবন থেকে উঠে আসা ভাষায় ভাটিবাংলার সদাব্যবহৃত শব্দরাজির সৌন্দর্যময় প্রয়োগে লেখা ছন্দ কবিতায়। সূচনাতেই বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তর’-এ।এ বই বের হয়েছিল ১৯৬৩-তে। ১৯৬৬-তে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস’। মুক্তিযুদ্ধকালে কলকাতায় এসেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে কলকাতার ‘বেঙ্গল পাবলিশার্স’ থেকে ‘কালের কলস’-এর দ্বিতীয় মুদ্রণ বের হয়েছিল। কলকাতায় সেসময় তাঁর প্রকাশিতব্য ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতা সঙ্গে ছিল তাঁর। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ১৯৭১ সালে সোনালি কাবিনের ১৪টি সনেট নিয়ে বের করেন মিনিবুক সিরিজের একটি বই। কলকাতায় সেসময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যুক্ত ছিলেন আল মাহমুদ।
তখন, ওই সময়ে আল মাহমুদ একেবারেই কোনঠাসা, একঘরে, পরিত্যক্ত। গণতান্ত্রিক প্রকাশকরা আল মাহমুদের বই প্রকাশ করেন না। কবিসভাগুলিতে আর আল মাহমুদকে ডাকা হয় না। আমি আল মাহমুদের এই নিগ্রহ দেখেছি।
স্বাধীনতার পর আল মাহমুদ তাঁর বামমার্গিতায় মওলানা ভাসানির অনুগামী ছিলেন। বামপন্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় সম্পাদক পদে কাজ করলেও এই দলটির কর্মী বা সদস্য হিসাবে যুক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে আল মাহমুদ কলকাতার ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করলেও ‘জাসদ’ দলটির কর্মী বা সদস্য ছিলেন না। গণকণ্ঠে মুজিব সরকারের সমালোচনা করায় ১৯৭৪ সালে আল মাহমুদের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। পত্রিকাটিও মুজিব সরকার বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ সালে আল মাহমুদ মুক্তি পাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানই ঢাকার ‘শিল্পকলা অকাদেমি’-তে তাঁর চাকরীর ব্যবস্থা করে দেন। ১৯৮৩ বার ৮৪ সালে কলকাতার ‘আবৃত্তিলোক’ সংস্থার আয়োজনে কবিতা উৎসবে একত্রে এসেছিলেন শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ। আমি ওই সময়ই তাঁদের প্রথম দেখি। তখন বাংলাদেশে জেনারেল এরশাদের ফৌজি শাসন। বছর কয়েক ঘুরতে না ঘুরতেই বাংলাদেশে এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সূচনা হতে ঢাকায় গিয়ে দেখি কবিমহলে আল মাহমুদ আর শামসুর রাহমানের মধ্যে দেওয়াল উঠে গিয়েছে। দেওয়ালের একদিকে একা, নির্বান্ধব আল মাহমুদ, তাঁর সঙ্গী বলতে গুটিকয় তরুণ অনুরাগী। পাঁচিলের এপাশে গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী মহল। সাংবাদিকতার কাজে এরপর বারবার বাংলাদেশে গিয়েছি। আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানের সঙ্গে দেখাও করেছি। তবে মনে হয়েছে সর্বত্রই আল মাহমুদের নাম-উচ্চারণ একটা ঘিনঘিনে ব্যাপার— গণতান্ত্রিক সংকীর্ণতায় স্তম্ভিত হয়েছি আমি! সে সময় শুনেছি আল মাহমুদ মুজিব-হত্যার পর জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আল মাহমুদ এরশাদের ঘনিষ্ঠ। এরশাদ তাঁকে বনানীতে (গুলশানে) জমি জমি দিয়েছেন— ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ। আমার প্রশ্নে আল মাহমুদ হেসেছেন। বনানীর (গুলশানের) জমি, আল মাহমুদ বলেছেন, তাঁর পাঁচ ছেলে। তাদের বহু ধার-দেনা, বনানীর (গুলশানের) জমি তাই বেচে দিয়েছেন।
ওই সময়ই আল মাহমুদ ইসলামে আস্থা স্থাপন করেছেন। তিনি দাড়ি রাখতে শুরু করেছেন। মাথায় টুপিও। আমেরিকার কুয়েত যুদ্ধের সময়টাতেই বাংলাদেশে অনেকে দাড়ি রাখতে শুরু করেন। ‘বাংলা অকাদেমি’-র প্রাক্তন প্রধান আসাদ চৌধুরীকে দাড়ি রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হেসে তিনি বলেন, বিশ্বে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সময় এসেছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সময়।
এই সময় থেকেই আল মাহমুদের বিরুদ্ধে জামাত-ই-ইসলাম দলের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ উঠতে থাকে। মগবাজারের ফ্ল্যাটে আল মাহমুদ ছেলের কাছে চলে যাওয়ায় অভিযোগ ওঠে ওই বাড়ি জামাত নেতা গোলাম আজমের বাসভবনের কাছে। কেন? তখন, ওই সময়ে আল মাহমুদ একেবারেই কোনঠাসা, একঘরে, পরিত্যক্ত। গণতান্ত্রিক প্রকাশকরা আল মাহমুদের বই প্রকাশ করেন না। কবিসভাগুলিতে আর আল মাহমুদকে ডাকা হয় না। আমি আল মাহমুদের এই নিগ্রহ দেখেছি। তখন ইসলামি প্রকাশনগুলি এগিয়ে এসেছে। এসব প্রকাশনী থেকে, অনুজ কবি আবিদ আজাদের ‘শিল্পতরু’ পত্রিকার প্রকাশন থেকে বের হয়েছে আল মাহমুদের ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যেবাদী রাখাল’ কাব্যগ্রন্থগুলি।
বাংলা কবিতায় সবুজ মখমলে সোনালি জরির কারুকাজ বুনে আল মাহমুদ মৌলবাদী হয়ে গিয়েছেন— ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলের এই কুযুক্তি আমি মেনে নিতে পারি না। এর অতলে সাহিত্যিক ঈর্ষা রয়েছে, তা-ও বেশ বোঝা যায়। আমার বিবেচনায় ঔপনিবেশিক উদর-সঞ্জাত আধুনিকতায় দলাইমলাই করে ভাটি বাংলার লোকায়তের ভাষাসৌন্দর্যকে আল মাহমুদ এতকালের বয়ে আসা হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে, লোকাচারের সঙ্গে মহা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের সদাচর্চিত লোকসংস্কৃতির সঙ্গে মিলিত করেছেন।
ঐতিহাসিক ঘাটতি মিটিয়েছেন। তাই তো তিতাস ছলোছলো।
মতামত নিজস্ব
mridul_dasgupta@yahoo.co.in
পূর্বসূত্র: সংবাদ প্রতিদিন