‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।’ আল মাহমুদের এই লাইনটা আমাকে প্রথম তীব্রভাবে আকর্ষণ করে। কবিতার নাম ‘কবিতা এমন’। আমি যখন খুব শৈশবে মক্তবে যেতাম আলিফ বা তা ছা আর আমপারা পড়ার জন্যে তখন আমার পাশে কখনো একটা মেয়ে বসতো, যাকে একদিন আমি হয়তো দুষ্টুমির ছলে চিমটি কেটেছিলাম। ফলত মক্তবের হুজুর আমার পিঠের উপর পুরো একটা বেত ভেঙে ফেলেছিলো। সেই মার খেয়ে আমি মক্তবই ছেড়ে দিয়েছিলাম। আর কখনো যাইনি। তো কবিতার লাইনটা পড়লে আমার সেই মেয়েটির কথাই মনে পড়ে যায়। তার নাম কী ছিলো তাও ভুলে গেছি। হয়তো আয়েশাই ছিলো। তবে একটা মক্তবের মেয়ে চুলখোলা হওয়া, এইটা একটা খোলসছেঁড়ার মতো ব্যাপার। তার মানে কবিতা মানে উইদআউট বাউন্ডারি। সেইটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। যখন বুঝেছি তখনো আয়েশা আক্তারের কথাই মনে হয়েছে, মক্তবের নিয়মের বিপক্ষে একটা মেয়ে হিজাববিহীন চুলখোলা বসে আছে, তার সামনে রেহেলে বুক খুলে শুয়ে আছে আমপারা, তার কালো সব হরফ দেখছে আয়েশার মুখ। আর কবিতা তৈরি হচ্ছে ঘিরে থাকা পরিমণ্ডলজুড়ে। আর আমি এই দৃশ্যে আটকে থাকি, নৃত্যের ভিতর যেমন চক্রমনে হারিয়ে যায় চরাচর।
আল মাহমুদ চলে গেলেন। তাকে আমি মানুষ হিশেবে অপছন্দ করতাম। অপছন্দ করার অনেক কারণ ছিলো। কিন্তু তার কবিতা আমি পড়তে ভালোবাসতাম, এখনো বাসি। সুতরাং তিনি আমার প্রিয় মানুষদের একজন নন, কিন্তু তিনি অবশ্যই জগতজুড়ে আমার প্রিয় কবিদের একজন।
‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেছে শেষে / হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাঙলাদেশে।’ এই পঙক্তি আমার মাথার ভিতর, রক্তের ভিতর ঢুকে গিয়েছিলো সেই শৈশবে। এখনো আছে। হয়তো মায়ের কথা আছে বলেই। তারপর শৈশবে পড়া আল মাহমুদের আরো অনেক ছড়া পদ্য এখনো আমাকে তাড়িত করে।
ইত্যাকার অজস্র নঞ্চর্থক দিক থাকা সত্ত্বেও আল মাহমুদ আমার কাছে কবি। চেতনাধারীরা তার নামের আগে ‘‘কবি’’ শব্দের দুপাশে কোটেশন দিলেও তিনি সন্দেহাতীতভাবে কবি। এমন কি তার নামের আগে কবি না লিখলেও তিনি কবি। জীবনদাশোত্তর বাঙলা কবিতাকে তিনি একা হাতে যে প্রবল শক্তিমত্তা নিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শুধু এই একটা কারণেই তার সকল অন্ধকার মুছে যায়।
যখন ধর্ম-কর্ম করতাম, তখন আল মাহমুদের একটি লাইন পঙক্তি যখনই পড়তাম গায়ে কাঁটা দিতো, ‘শরীর যখন ক্লান্ত শিথিল পক্ব মাথার কেশ / তোমার হুকুম শ্রবণ করে কাঁপছে পরিবেশ।’
আল মাহমুদ। এইটা তার পেন-নেম বা লেখক-নাম। কবিতা লিখবেন বলে তিনি এই নাম নিয়েছিলেন। তার আসল নাম মীর আবদুস শুকুর। এই যে কবিতার জন্যে নিজের একটা নাম দেওয়া, এইটা আমি প্রথম আল মাহমুদের কাছে জেনেছি। তিনি এই বিষয়ে আমার প্রথম অনুপ্রেরণা। যদিও এর আগে ছদ্মনামধারী অনেকের লেখা আমি পড়েছি, তথাপি নামের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিশেবে কাজ করেছে আল মাহমুদ।
আল মাহমুদের কবিতাসমগ্র বের হয়েছিলো ২১ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে। ওই বছরই সেইটা আমি সংগ্রহ করেছিলাম। তখন আমি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছি মাত্র। এর আগে আমার কাছে তার ‘সোনালি কাবিন,’ ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ আর ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ এই ৪টা কবিতা ও পদ্যের বই ছিলো। তো সমগ্রে এক মলাটে পেয়ে গেলাম ১৩টা বই। জীবনদাশের কবিতা সমগ্রের সঙ্গে আরেকটা সমগ্র যুক্ত হলো, সেটা আল মাহমুদের। দুইটা বই দুইটা থান ইটের মতো মাথার বালিশের পাশে পড়ে থাকতো। কতো লাইন পড়তে পড়তে মনস্থ হয়ে গিয়েছিলো! এখন স্মৃতি ক্ষয় হচ্ছে বলে মনে নাই কিছু।
আল মাহমুদের ‘পুরুষ সুন্দর,’ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ এইসব আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। যদিও ‘পুরুষ সুন্দর’ শেষ অবধি এক মেলশভিনিস্ট অ্যাখ্যান। তারপরও তার গদ্যভাষা, আর বুনন আমাকে মুগ্ধ করেছে। মুগ্ধ হয়ে পড়েছি ‘আগুনের মেয়ে।’ পড়া ছাড়া আল মাহমুদের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো স্মৃতি নাই। প্রথমবার তাকে দেখি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫/১৬ বছর আগে, ছাত্রশিবিরের নবীনবরণে। হচ্ছিলো বুদ্ধিজীবী চত্বরে। আমি দেড়টার ট্রেন ধরার জন্যে যাচ্ছিলাম স্টেশনের দিকে। আল মাহমুদের নামের ঘোষণা শুনে কাটাপাহাড়ের মুখেই দাঁড়িয়ে গেলাম। ছাত্রশিবিরের ছেলেদের গুণের প্রশংসা দিয়ে তিনি তার ভাষণ শুরু করলেন শুনে আর কাছে গেলাম না। অবশ্য কাছে গেলে মাইর খাওয়ার সম্ভবনাও ছিলো। তো সেদিন তার প্রতি পুনর্বার বিবমিষা তৈরি হলো। সেটা ব্যক্তি আল মাহমুদের প্রতি।
দ্বিতীয়বার আল মাহমুদের মগবাজার ওয়্যারলেস গেটের বাসায় গিয়েছিলাম। দুই হতদরিদ্র ছোটকাগজকর্মী ছোটভাইয়ের সঙ্গে। তারা তাদের কাগজের জন্যে কবিতা চাইবে কবির কাছে। আমি বিবমিষার কারণে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলে দুইটা মন খারাপ করে বের হয়ে এলো। বললো, ‘কবি তো লেখক সম্মানী ছাড়া কবিতা দিবেন না বলেছেন।’ তাদের চেহারা দেখে আমার হাসি পেলো। কিছু বললাম না। ফিরে এলাম।
তৃতীয়বারও মগবাজারের বাসায়, একটা সাহিত্য সভার সভাপতি পদ অলংকরণ করার জন্যে কয়েকজন হতদরিদ্র লেখক ছোটভাইয়ের সঙ্গে গেলাম। আগের মতোই বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর তারা মুখ কালো করে বের হয়ে এলো। বললো, ‘কবি তো হলুদক্যাব ছাড়া সভায় যাবেন না বলেছেন। কিন্তু হাতে হলুদক্যাব ভাড়া করার টাকা নাই।’ তাদের চেহারা দেখে আমার হাসি পেলো। কিছু বললাম না।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘটনা নয়-দশ বছর আগের। তো আল মাহমুদ মানুষ হিশেবে সুবিধাভোগী, খানিকটা অসহায়, কিছুটা অভদ্র, কিছুটা গোঁয়াড়, কিছুটা হিংসুক, কিছুটা গোঁড়া, কিছুটা ধর্মান্ধ, কিছুটা কৃপণ, তার কথা ও কাজের মিল নাই। তিনি তার ‘কবির আত্মবিশ্বাস’ বইতে একটু পর পর ঘৃণা ছড়িয়েছেন, অনেককে খারিজ করে দিয়েছেন। রফিক আজাদ সম্পর্কে বলেছেন, রফিক আজাদের একটা লাইনও কবিতা নাই ইত্যাদি। তো ইত্যাকার অজস্র নঞ্চর্থক দিক থাকা সত্ত্বেও আল মাহমুদ আমার কাছে কবি। চেতনাধারীরা তার নামের আগে ‘‘কবি’’ শব্দের দুপাশে কোটেশন দিলেও তিনি সন্দেহাতীতভাবে কবি। এমন কি তার নামের আগে কবি না লিখলেও তিনি কবি। জীবনদাশোত্তর বাঙলা কবিতাকে তিনি একা হাতে যে প্রবল শক্তিমত্তা নিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন শুধু এই একটা কারণেই তার সকল অন্ধকার মুছে যায়।
কবিতা-সহ সকল প্রকার শিল্পসাহিত্যকে আমি সকল প্রকার মানবিক, ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক ইত্যাদি নৈতিকতার অনেক ওপরে মনে করি। এরা নৈতিকতার ধার ধারে না। কথা ও কাজের সততাই চরিত্রের ব্যাকবোন এই জাতীয় কথা নবীদের জন্য প্রযোজ্য, কবি-শিল্পীদের জন্য নয়।
চেতনা কী? চেতনার একটা সার্বজনীন পয়েন্ট থাকে, সেটা চেতনা উদ্গত হওয়ার উৎসে। তারপর চেতনার রকমারি ধরন তৈরি হয়। সেই জায়গা থেকে আমি বাতিল বা গ্রহণ এইসব করতে পারি। আপনার প্রশ্ন হলো শুধুমাত্র ভাষা ও নন্দনের উপর একটি সাহিত্যকর্ম দাঁড় করানো আসলে সম্ভব কি না। আপনার এই কথার মধ্যে নৈতিকতার গন্ধ আছে। কবিতা-সহ সকল প্রকার শিল্পসাহিত্যকে আমি সকল প্রকার মানবিক, ধর্মীয়, সামাজিক, দার্শনিক ইত্যাদি নৈতিকতার অনেক ওপরে মনে করি। এরা নৈতিকতার ধার ধারে না। কথা ও কাজের সততাই চরিত্রের ব্যাকবোন এই জাতীয় কথা নবীদের জন্য প্রযোজ্য, কবি-শিল্পীদের জন্য নয়। শিল্পসাহিত্যের ইতিহাস পরস্পর বিরোধের ইতিহাস। হিটলার ভালো ছবি আঁকতেন। কিন্তু মানুষ হিশেবে তার বিকৃতি ছিলো। রাজনৈতিক অবস্থানও আমার সঙ্গে মিলে না। কিন্তু তার আঁকার ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগে। আর একজন কবি বা শিল্পী বা সাহিত্যিক রাজনৈতিক বা দার্শনিকভাবে আমার চোখে পতিত মনে হলেই যে তার সব বাদ দেবো তাও আমি ভাবি না। তিনি যদি তার সেই রাজনৈতিক বা দার্শনিক ক্লেদ তার সাহিত্যকর্মে ঢেলে দেন তবে অবশ্যই তা আমি পড়বো না। যেমন ফরহাদ মজহার। এখন তাকে আমি পড়ি না। কিন্তু আগের কবিতা আমি এখনো চোখের সামনে পেলে পড়ি।
আল মাহমুদকে পড়ি। তার কথা ও কাজের মিল নাই। কিন্তু তিনি কবিতায় সৎ। তিনি কবি হিশেবে বৈপরীত্য নিয়েই শেষপর্যন্ত দেদীপ্যমাণ ছিলেন। তিনি কবিতায় (তার কতিপয় কবিতা বাদে) তার রাজনৈতিক বা দার্শনিক ক্লেদ কখনোই ঢেলে দেন নাই। অন্তত আমার চোখে পড়ে নাই।
আল মাহমুদের অনেক বাউন্ডারি ছিলো—ধর্ম, শিক্ষা, দর্শন, বিশ্বাস-সহ আরো অনেক বিষয়ে। তারপরও তিনি তার সময়ের সব থেকে শক্তিমান কবি। তার এইসব সীমা যদি না থাকতো, তবে তিনি কী হতেন তা আমি জানি না। তিনি এমনই একজন কবি যিনি কবিতায় কখনো বৃদ্ধ হন নাই। শেষ বয়সে অনেকেই ফুরিয়ে যান, তারপরও লিখতে থাকেন অভ্যাসের বসে। কিন্তু আল মাহমুদ কখনোই ফুরিয়ে যান নাই।
এইবার পড়ি সোনালি কবিন—‘সোনার দিনার নেই , দেন মোহর চেয়ো না হরিণী /যদি নাও , দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি/আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনো কালে সঞ্চয় করিনি/আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;/ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।’ তো মূলত আমরা প্রত্যেকেই ‘কাবিনবিহীন হাত’ই চেয়েছিলাম।
আল মাহমুদ মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস আর পিতৃতন্ত্রের একজন শক্তিমান প্রতিনিধি ছিলেন। দুইযুগ ধরে তার লেখাপত্র পড়ে-টরে আমার সেটাই উপলব্ধ হয়েছে। তিনি উস্কানী কোথাও দেননি। কিন্তু মিশনারির মতো তার কবিতা ও গদ্যে তার বিশ্বাসকে প্রচার করেছেন।