১.
পরিচিত কবিতা এটা। তাঁর সোনালি কাবিনের সনেটগুলি, বা খনার বর্ণনা থিমের সনেটগুলি, বা অন্য প্রিয় আরো লেখার ফাঁকে এই কবিতাটা আমাদের জন্য বিশেষ ছিল।
তখন কৈশোর। টেরা প্যাট্রিক দেখে যেমন একলার যৌনতা, তেমনই গোপনে ভাষার/ধ্বনির সুখ আবিষ্কার তখন। জগত আমাদের প্রধানত তখন শব্দ, এবং আকাশ তখন বাংলা ভাষায় ভরা। তারই তলে শরৎ ঋতু, স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ, আষাঢ়-শ্রাবণ আমরা জ্বাল দেই পিপা ভরে ।
ফলত, আমাদের শহরে সুন্দর বৃষ্টি হত। এবং, চা-বাগানের ভিতরদিকে আরো গভীর পাহাড়ে সাপ, ব্যাঙ, বান্দর, বিছা, এড়েলা আমার জগতকে সমুচ্চয়ী অব্যয়ের মত স্থিতিস্থাপকতা দিয়ে খাপে খাপে আটকে রাখত। যেনবা ধ্বনি, দৃশ্যাবলি ও অলংকারের আরামদায়ক একটা বাক্য লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে রেলের রেখাদ্বয়ে সকালে উপবন এক্সপ্রেসের মত আসতে থাকলে গাছ থেকে জংলিফল মুখে টিয়া উড়ে যায়, — একটা লম্বা কিন্তু ঢেউ-খেলানো ড্যাশের মত ।
চর্যাপদের কোনো এক পাদানাম হয়ত হাহাকার করলেন, ‘নগর বাহিরি রে ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ’ ! বৌদ্ধরীতি থেকে আলগা হয়ে আমার মানচিত্রে আসার জন্য আত্মবিশ্বাসী হয় শব্দগুলি, তাদের অর্থের মালিকানা আমাতে ধীরে অর্শাইতে থাকে।
সেমানটিক্সের তখনো চোখ ফোটার দরকার হচ্ছে না ।
আমরা দীপ্তি ত্রিপাঠীর তিরিশিদের উপর খ্যাতনামা বইটা পড়ে ফেলেছি , এবং বুদ্ধদেব বসুর সমালোচনাগদ্য আমাদের ধর্ম ও অধর্ম ঠিক করে দিচ্ছে তখন। সুধীন্দ্রনাথের ‘ভ্রষ্টতরী’ পুরাটা গুটিগুটি হরফে আমাদের ক্যালকুলাস খাতার ভূমিকা-পৃষ্ঠায়, বা বিষ্ণু দে’র ‘ঘোড়সওয়ার’ [অংগে আমার দেবে না অংগীকার?…. /দীপ্ত বিশ্ববিজয়ী বর্শা তোলো /কেন ভয়? কেন বীরের ভরসা ভোলো?] আমাদের জিহ্বা পূর্ণ করে আছে তখন ।
এইসব। বহু এমন। তখন জিগজ্যাগ স্বাধীনতার সুখ। ছোটতে বড় বিস্ময় আবিষ্কারের অবসরের দিন।
আমরা ছন্দ শিখলাম (নীরেন্দ্রনাথ নয়; ক্লাস নাইনে, মাহবুবুল আলমের ‘বাংলা ছন্দের রূপরেখা ‘ ; পরে কলেজ লাইব্রেরিতে আব্দুল কাদিরের ‘ছন্দসমীক্ষণ’)। কী যে আপদ আর আনন্দ ! কবিতাকে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুলবার কৈশোরিক ঘোর ! ভূপৃষ্ঠের উপর প্রায় সকলকিছু মাত্রায় মাপার সিদ্ধান্ত নেই আমরা, — আমার বন্ধু দেবাশিস ভৌমিক ও আমি ।
শুধু রবীন্দ্রনাথের গানে গিয়ে আমাদের ট্রাক্টরের চাকা বিকল হয়ে যেত প্রায়শ।
একদিন আমরা জানতে পাই, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভাষাপ্রকাশ বাংগালা ব্যাকরণ’ বইয়ে ছন্দ বিষয়ে পরিচ্ছেদটাতে একই কবিতা বিভিন্ন ছন্দে যিনি লিখে দেখিয়েছেন , তিনি কবি সজনীকান্ত দাশ, — তিনি মূলত একজন ভিলেন, জীবনানন্দের-নজরুলের জান খারাপ করে দিয়েছিলেন এই লোক।
২.
ফলে, এসব বেড়া-ছেড়া এনলাইটেনমেন্টের শিকার কিশোর বন্ধুদ্বয় অংক করি, ফিজিক্স পড়ি এবং প্রভাতে ও প্রদোষে ঘরে ফিরে যাই। বোধয় কেমিস্ট্রির (ইন্টারমেডিয়েট ফার্স্ট ইয়ার) শহীদুল্লা স্যারের বাসা থেকে ফিরার পথে একদিন খবর পাই ট্রিওলেট (Triolet) নামে একটা কবিতা-ফর্ম আছে। আরো নাকি আছে ভিলানেল, সেস্টিনা এসব।
আমাদেরকে ইংরেজি বা ফরাসি ছন্দ শিখাবে তেমন সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ তখন সুলভ ছিলেন না ( পরেও আমার ইংরেজি সাহিত্যের বন্ধু-বান্ধবীরা শিখায় নাই। ফলে, তা না শিখেই, দুঃখিত চিত্তে, ভবলীলা সাংগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি )।
আমরা, সেই সামান্য সাধ্যের টেলিস্কোপে খালি হতাশ হতে থাকি। আমার মনে আছে, অদ্ভুতভাবে, প্রমথ চৌধুরীর লেখা Triolet এর কয়েক লাইন , (শ্রীশচন্দ্র দাসের ‘সাহিত্য-সন্দর্শন’ বইয়ে ছিল ; স্মৃতি থেকে উদ্ধার করি। ভুল মার্জনা করবেন) :
“ঊষা আসে অচল-শিয়রে,
তুষারেতে রাখিয়া চরণ।
ধরে বুকে নীহারে শীকরে
সে-হাসির কণক-বরণ।
ঊষা আসে অচল শিয়রে…. ” ইত্যাদি।
ভিলানেল আছে বিষ্ণু দে’র। সেস্টিনা আছে।
তো, তেমন দিনে হঠাৎ আবিষ্কার করি আল মাহমুদের এক কবিতায় ট্রিওলেট ( Triolet) এর ফর্ম!
আল মাহমুদ সেই অর্থে ছন্দের গৌণ হাতুড়িপেরেকের ওস্তাদি দেখাইন্না লোক নন। সোনালী কাবিনের সনেটগুলির অক্ষরবৃত্ত পরিষ্কার ও দ্বিধাহীন সাউন্ডস্কেইপের ৮+১০। সেখানে, এবং অন্যত্রও, আল মাহমুদের ধ্বনির কান/ধারণা রেখাপ্রধান আর্কিটেকচারাল ড্রয়িং-এর মত নির্দিষ্ট । সে অন্য আলোচনাযোগ্য বিষয়।
তো, আল মাহমুদ-ই অবলীলায় লিখলেন বাংলাভাষায় সম্ভবত সবচেয়ে স্মরণীয় ট্রিওলেট।
কবিতার পাঠকেরা জানেন, ট্রিওলেট মধ্যযুগে ফরাসি ভাষায় প্রবর্তিত কবিতা ফর্ম। ৮ লাইনের কবিতা। ১ম লাইনটি ৪ র্থ আর ৭ম লাইনে পুনরাবৃত্ত হয়, এবং ২য় লাইনটি ৮ম লাইন হিসেবে ফিরে আসে । পুনরাবৃত্ত লাইনগুলোতে এক দুই শব্দ বদলে প্রায়ই অর্থের বদলও ঘটানো হয়। (সূত্র : নীলরতন সেন , ‘বাংলা ছন্দ-বিবর্তনের ধারা’ )।
আল মাহমুদের কবিতাটার নাম ‘শোণিতে সৌরভ ‘। এর প্রতিটা স্তবক আট লাইনের। প্রতিটা স্তবক একেকটা ট্রিওলেট (Triolet) । কবিতাটাকে ৫টা স্বাধীন ট্রিওলেটের যোগফল ভাবা যায়।
আপনারা অবশ্যই বহু মনে করতে পারবেন, আরো অনেকের লেখা ; — কিন্তু বাংলায় ‘ট্রিওলেট’ মাত্রেই আমার কাছে মাত্রাবৃত্তে ৭ মাত্রার আল মাহমুদ রচিত এই কবিতাটার স্তবকগুলো , এবং কিশোরকালের সেই অসীম খুশির ভার।
কবিতাটা আরেকবার পড়া যাক:
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
লুটিয়ে দিতে পারি পিতার তরবারি
বাগান জোত জমি সহজে সস্তায়
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায় ;
পরীর টাকা পেলে কেউ কি পস্তায়?
কে নেবে তুলে নাও যা কিছু দরকারী,
তোমার মুখ আঁকা একটি দস্তায়
বিলিয়ে দিতে পারি একটি তরবারি।
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ?
প্রতিটি দিন যায় আহত, নিষ্ফল
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল—
ঈভের মতো আজ হও না চঞ্চল
আমার ডানহাতে রাখো সে গৌরব;
তোমার মাংসের উষ্ণ আতাফল
শোণিতে মেশালো কি মধুর সৌরভ।
তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি
দেবে কি গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ?
সেখানে পাখি নেই রক্ত দ্রুতগামী
তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি
মধ্যযুগী এক যুবক গোস্বামী
দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ
তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি
নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ।
গোপন রাত্রির কোপন যাদুকর
আমার করতলে রেখেছি অগ্নি,
পুড়িয়ে এসেছি তো যা ছিল নির্ভর
গোপন রাত্রির কোপন যাদুকর—
দেখালো সেই মুখ দারুণ সুন্দর
জেনেছি সে আমার কৃপণ ভগ্নি!
গোপন রাত্রির কোপন যাদুকর
আমার করতলে জ্বেলেছে অগ্নি!
কনক জঙ্ঘার বিপুল মাঝখানে
রচেছো গরিয়সী এ কোন দর্প?
আকুল বাঁশরীর অবশ টানে টানে
কনক জঙ্ঘার বিপুল মাঝখানে,
আবাস ছেড়ে আমি আদিম উত্থানে
ধরছি ফণা নীল আহত সর্প
কনক জঙ্ঘার বিপুল মাঝখানে
মেলেছো গরিয়সী এ কোন দর্প।