পরস্পরকে শুধু পিঠ চাপড়ানো থেকে বের হওয়াই এই আড্ডার উদ্দেশ্য। প্রয়াস – নিজেদের কবিতার দোষ এবং সম্ভাবনা খুঁজে বের করা। যতটা না সাক্ষাৎকার, তারচেয়ে অনেক বেশি মন খুলে আলাপ করা, আড্ডা দেয়া। কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশের কবিতা, এ সময়ের কবিতার প্রবণতাই বা কী? দ্বিতীয় দশকে লিখতে আসা নির্বাচিত কবিদের এই আড্ডায় এসব প্রসঙ্গে নিয়মিতই কথা উঠছে। যুগ যুগ ধরে চর্চিত বাংলায় লেখা বিদেশি কবিতা থেকে বেরিয়ে বাংলার নিজস্ব কবিতা লেখার তাগিদ পাওয়া যাচ্ছে এসব আড্ডা থেকে। কবি রাজীব দত্তকে মধ্যমণি করে এই আড্ডা শুরু হয়েছিল। এরপর একে একে হাসান রোবায়েত, হাসনাত শোয়েব, শাহ মাইদুল ইসলাম এবং রাসেল রায়হানের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আড্ডা হয়েছে। এবার আড্ডা হয়েছে বিধান সাহার সঙ্গে। ২০১৫ সালে প্রকাশ হয় বিধানের প্রথম কবিতার বই ‘অব্যক্ত সন্ধির দিকে’; এ বছর প্রকাশিত হয়েছে গদ্যের বই ‘এসো বটগাছ’। দুটি বইয়েরই প্রকাশক চৈতন্য। বিধানের কবিতা, কাব্য-দর্শন, গদ্য তো বটেই এই আলাপচারিতা নানা দিকে ডালপালা ছড়িয়েছে। বিধান সাহাকে মধ্যমণি করে এই আড্ডায় অংশ নিয়েছেন শাফিনূর শাফিন, ফয়সাল আদনান, রুহুল মাহফুজ জয়, মোস্তফা হামেদী, হাসান রোবায়েত ও রাজীব দত্ত।
”আমি আমার মাঝে পুরো জগতকে দেখতে চাই না। জগতের উপর আমাকে প্রতিষ্ঠা করি। অর্থাৎ, আমারই মনের রঙে জগত রঙিন।”
শাফিনূর শাফিন: কেমন আছেন বিধান’দা?
বিধান সাহা: এই যে, শাফিন। ভালো আছি।
শাফিনূর শাফিন: ভালো থাকাটা কেমন অস্বাভাবিক উত্তর!
বিধান সাহা: আমরা সকলে মিলে একটা অস্বাভাবিক সময়ের ভেতর দিয়েই তো অগ্রসর হচ্ছি। এই অস্বাভাবিকতাই যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
শাফিনূর শাফিন: ‘তাসের পাহাড়’ শুরু হয়েছে এক ধরণের সন্দেহ, দোনামনা নিয়ে। আবার শেষ হয়েছে হাল ছেড়ে দেয়া ভঙ্গিতে। (আমার মনে হয়েছে)… এমন কেন?
ফয়সাল আদনান: বিধানের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছি, কাছাকাছি টপিকে আমারো প্রশ্ন ছিলো
বিধান সাহা: হাল ছেড়ে দেয়া মনে হয় না। সম্ভবত টু বি কন্টিনিউড, এমন একটা ভঙ্গিতে শেষ হয়েছে। আর, শুরুটা, হ্যাঁ, এক ধরনের সংশয়বাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে।
ফয়সাল আদনান: ওয়েল আপনার বইয়ের এই খণ্ডটার কবিতাগুলার একটা ডিসিশান দেয়ার প্রবণতা কিন্তু দেখছি শুরুতে, সেখান থেকে এক পর্যায়ে যেয়ে আপনি অনেকটাই রিলাক্স হয়ে যান। এমন কি নয়?
বিধান সাহা: ডিসিশন দেবার প্রবণতাও মেবি না। নিজেকে শোনানোর, বা, নিজেকেই বলার এক ধরণের প্রবণতা থাকতে পারে।
ফয়সাল আদনান: আরেকটা প্রবণতা আছে, রিকোয়েস্ট এন্ড ইন্সট্রাকশান। পুরো ‘তাসের পাহাড়’ জুড়েই। নিজেকেই বলছেন হয়তো স্বগতোক্তির মতো। যেমন ‘পাথরের পাশে তার জ্বলে ওঠা দেখিও আমায়’ কিংবা ‘একদিন কাটামুন্ডুর সেলফি তোমায় দেখাবো গোপনে’।
বিধান সাহা: থাকতে পারে। পাঠক আবিষ্কর্তা। আমার দিকে থেকে এটুকু বলবার, যে, লেখাগুলো ভীষণ রকম ঘোরের মধ্যে রচিত হয়েছে। এবং আমি অনেকটা আমার অবচেতনের উপর নির্ভর করেছি এক্ষেত্রে। তার আগে খুব সংগোপনে আমার নিজের কিছু প্রিপারেশন ছিলো। সেগুলোও যে খুব সচেতন প্রিপারেশন, এমন না।
যেমন, নিজেকে খুব করে খুঁড়তাম আমি। নিজের ভেতরে যতটা ডুব দেয়া যায়। দিতাম। ধরেন, শুয়ে আছি কিংবা হাঁটছি, আমি আমার ভেতরে ডুবে যেতাম। নানা গল্প ফাঁদতাম নিজেই। এমনও হয়েছে নিজের সথে কথা বলতে বলতে আমি বহু বহু পথ হেঁটে চলে গেছি। এরকম হয়েছে। ফলে, জগত এবং অতিজাগতিক একটা আবহ মেবি তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
ফয়সাল আদনান: ঘোর ব্যাপারটা নিয়ে আপনার একটা ফ্যাসিনেশন আছে আমি জানি। আমার হোস্টেলে কিংবা শাহবাগে, ছবির হাটে আড্ডায় বহুবার এসেছে এই শব্দটা আপনার কাছ থেকে। আমি একটু ডিপ ডাইভ চাই, ঘোর আসলে কি? অবচেতন শুধুই? আনকন্ট্রোল্ড একটা ইরাপশন নাকি আপনি এইটাকে কিছুটা হলেও কন্ট্রোল করতে পারেন? আমার মনে হয়েছে আপনি কবিতাকে একধরনের স্পিরিচুয়ালিটির চর্চা আকারে দেখেন। আত্মার মাঝে পরম খোঁজার মতো। লালন, রুমি কারো প্রভাবে কি সেটা?
বিধান সাহা: দেখেন, আমার ভাবনামগ্ন হয়ে থাকতে ভালো লাগে। কখনও কখনও এমনও হয়, প্রচল জগত থেকে ডুব দিয়ে আমার নিজের জগতে জেগে উঠি। সেখানে বিচরণ করতে আমি স্বস্তি পাই। একটু ডিটেইলে যাই আজকে। বেশ কিছু কথা বলবো, যা কখনই বলা হয় নাই আগে।
ফয়সাল আদনান: প্লিজ গো অ্যাহেড, ডিটেইলেই জানতে চাই আমরা বিধান সাহাকে।
বিধান সাহা: আমি আমার অবচেতনের উপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে চাই। চাই বলতে, আমার ভালো লাগে এটা নিয়ে খেলতে। খুব ছোটবেলায় আমার একটা প্রশ্ন খুবই মনে হতো, সামাজিকভাবে যাদের আমরা ‘বড়’ বলি, তাদের দেখে আমার বিস্ময় জাগতো, খুব গভীরে খেয়াল করে দেখতাম, নানা ক্ষেত্রেই হয়তো তার পারফেকশন নাই, তবু তিনি নিজেকে চূড়ায় তুলেছেন। আমি খুব গভীরভাবে সেই ‘বড়’ মানুষগুলোর কথা ভাবতাম, যে, এমন কোন কোন ক্রাইটেরিয়া লোকটি ধারণ করেছেন, যার দরুণ তিনি আজ এই চূড়ায়। আমি আমার মনকে নানা কায়দায় ফানা ফানা করি। আবার গড়ি। নিজেকে শূন্যে তুলে, শূন্য করে দিয়ে জগতকে দেখি কখনও কখনও। এটা আমার জন্য কাজে দেয়। মেকি জিনিসগুলো তখন ঝরে পরে। মানে, বলতে চাইছি, পুকুরের পানি যখন স্থির হয়, তখনই তাতে প্রকৃতির ছায়া স্পষ্টভাবে দেখা যায়। আমি সেই স্থিরতা সর্বান্তকরণে বাঞ্চা করি।
ফয়সাল আদনান: সুতরাং আপনি নিজের মাঝে পুরো জগৎকে দেখতে চান, সেই স্থিরতার মাঝ থেকেই আপনার কবিতা আসে। কিন্তু জগতের এই রিফ্লেকশন কতটা অনেস্ট। আপনি স্থিরতা খোঁজেন কিন্তু জগৎতো ক্যাওটিক। কিভাবে ডিল করেন এই কনট্রাস্ট?
বিধান সাহা: না। আমি আমার মাঝে পুরো জগতকে দেখতে চাই না। জগতের উপর আমাকে বিস্তৃত করি। অর্থাৎ, আমারই মনের রঙ জগত রঙিন।
রুহুল মাহফুজ জয়: বিধান, সাক্ষাৎকার দিতে আপনার কেমন লাগে? ঠিক এই মুহূর্তে কি কি ভাবছেন?
বিধান সাহা: এই মুহূর্তে আমি ভীষণরকম ফাইটিং মুডে আছি। ‘উড়ায়া দেবো’ মনোভাবে আছি।
ফয়সাল আদনান: আপনার এই ভাবালুতা/দার্শনিকতার উৎস জানতে চাই, বিধান।
বিধান সাহা: দেখেন, এগুলোকে দার্শনিকতা বলে কিনা আমি জানতে চাইছি না এই মুহূর্তে। তবে, খুব সম্ভবত প্রচণ্ড রকম ধাক্কা মানুষকে এমন অবস্থানে টেনে নেয়।
রুহুল মাহফুজ জয়: কি কি ধাক্কা আপনাকে এই অবস্থানে এনেছে, জানতে পারি?
বিধান সাহা: আমার আসলে হারিয়ে যাবার কথা ছিলো।
রুহুল মাহফুজ জয়: যেমন?
বিধান সাহা: ধাক্কাগুলো আজ এড়িয়ে যাবো সচেতনভাবেই। কী কী অনুঘটনা আমাকে আজ এখানে টেনে এনেছে সেটা বলি বরং।
সামাজিকভাবে সকলে যে সব সুযোগ সুবিধার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়, আমার ক্ষেত্রে তেমন হয় নাই। কিছুটা দায় আমারই। কিন্তু আমার কল্পনায় ততদিনে আমি একটা ক্যারেক্টার তৈরী করে নিয়েছিলাম। এতো বেশি কল্পনায় গড়েছিলাম যে তিনি তার বাস্তবতা হারিয়েছিলেন। বলতে পারেন, আমি সেই মুগ্ধতার দিকে ছুটতাম। যে, ওটা আমাকে স্পর্শ করতেই হবে। কিংবা, আমাকে সেই সুদূর নীহারকিার কাছাকাছি পৌঁছাতেই হবে। এমন একটা তেজ আমি ততদিনে ধারণ করতে পেরেছিলাম। ওটাই আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। আমি সর্বদা একটা ঘোরের মাঝে ছুটতাম। শুধু ছুটতাম… সেই ঘোরটাই পরবর্তীতে নানান ডাইমেনশ পেয়েছে মনে হয়।
“যে বাস্তবতার দিকে আমি ছুটতাম, তা, বাস্তবতার বাইরে নয়। আমার কল্পনা সেই বাস্তবতার উপর রঙ চড়াতো মাত্র।”
ফয়সাল আদনান: কেমন ডাইমেনশন? কেনইবা?
বিধান সাহা: ডাইমেনশন বলতে, এই যে আপনি বললেন দার্শনিকতা কিনা, বা, অন্য যা কিছু, এর শুরুটা হয়েছিলো ওইরকম সাদামাটাভাবে। একটা উদগ্র বাসনা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। বুঁদ হয়ে থেকেছি তাতে।
ফয়সাল আদনান: সেখান থেকে কবিতায় কিভাবে? কেনইবা?
বিধান সাহা: ওই যে, সুদূর নীহারিকার কাছাকাছি আমাকে পৌঁছাতেই হবে এমন একটা বাসনা আমার ছিলো। কিন্তু আমার পক্ষে উপায় ছিলো মাত্র লিখতে পারা। আর কোনো বিকল্পই ছিলো না তখন।
শাফিনূর শাফিন: অ্যাবসার্ডের দিকে ছোটা?
বিধান সাহা: না না, অ্যাবসার্ডের দিকে নয়। লেখালেখির দিকে।
ফয়সাল আদনান: আপনার লেখাকে আপনার কাছে কি অ্যাবসার্ড মনে হয়। শাফিন, বিধানের লেখাকে কি আপনি অ্যাবসার্ডিজমের ক্যাটাগরিতে ফেলেন?
বিধান সাহা: না, অ্যাবসার্ড মনে হয় না আমার। কিন্তু ভীষন রহস্যপ্রবণতা আছে কিছু কিছু লেখায়।
ফয়সাল আদনান: শাফিন, দ্বিমত?
শাফিনূর শাফিন: না, মেটাফিজিক্যাল মনে হয়েছে অনেকবার। কিন্তু স্পিরিচুয়ালের প্রশ্নটা করায় এই নিয়ে প্রশ্ন আর করি নাই, ফয়সাল। অ্যাবসার্ড বললাম, দাদা যে বললেন উনি একটা ঘোরের মধ্যে ছুটেছেন, এইজন্য বললাম।
ফয়সাল আদনান: হুম, আমার কাছেও মেটাফিজিক্যাল একটা তাড়না দেখেছি বলে মনে হয়। সেটাই স্পিরিচুয়াল হয়ে উঠেছে।
শাফিনূর শাফিন: অলীক কিছু ভাবতে ভাবতে যে ঘোর এটাকে কি অ্যাবসার্ড জগত বা অ্যাবসার্ডিটির পিছনে ছোটা মনে হয়?
বিধান সাহা: না, অলীক নয় ওটা।
রুহুল মাহফুজ জয়: একটু ব্যাখ্যা করবেন, বিধান?
বিধান সাহা: অর্থাৎ, যে বাস্তবতার দিকে আমি ছুটতাম, তা, বাস্তবতার বাইরে নয়। আমার কল্পনা সেই বাস্তবতার উপর রঙ চড়াতো মাত্র।শোনেন, জুয়ারিকে আমার খুব ভালো লাগে। তার মুখের সেই রহস্যভরা হাসিটাও। মদের গন্ধভরা মুখে গোঁফে পাক দিতে দিতে তিনি যে হাসিটা ছুঁড়ে দেন, তার মাধ্যমে উপস্থিত সবাইকে জাস্ট খুন করেন তিনি। প্রচল জগত যা দেখে না, জুয়ারি জুয়ার বোর্ডে তখন তা দেখতে পান। জুয়ার বোর্ড অলীক নয়। তার দেখাটাও না।
ফয়সাল আদনান: এবার একটা গুরুতর কথা বলতে চাই। গুরুতর কারণ অধিকতর ইমম্যাচিওর কবিরা অন্য কবিদের ল্যাং মারার তালে এই ধরনের কথা বলে থাকে। যদিও আমার তেমন কোনো ইন্টেনশন নাই। বরং মনে হয় এমনটাই স্বাভাবিক। যাই হোক ভূমিকা শেষ। প্রশ্ন।
মজনু ভাইয়ের (মজনু শাহ) কবিতার বিশেষত জেব্রামাস্টারের ছাপ আপনার ‘অব্যাক্ত সন্ধির দিকে’তে আমরা পাই। এবং প্রথম যে কবিতাগুলো, সেখানে বলার ঢং, ভাবনা কে এপ্রোচ করা, ইমেজ ফোটানো বেশ একটা সিমিলারিটি নিয়েই। এই প্রভাবকে আপনি কিভাবে দেখেন? স্বীকার করেন? বা এই প্রভাব কি আপনাকে ইভলভ করতে সাহায্য করছে?
বিধান সাহা: ফয়সাল, সেভাবে আমি ভেবে দেখি নাই কখনও। তবে, সমালোচকেরা, ল্যাং মারাই যাদের মূল উদ্দেশ্য, তাদের এর বেশি কিছু দেখতে পাবার কথা নয়। ‘কম্পমান জলের ’পরে সকল ছায়াই অস্পষ্ট আকৃতি নিয়ে হাজির হয়।’
রুহুল মাহফুজ জয়: আচ্ছা বিধান, কবে কখন কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন। কবিতার সেই মুহূর্তটা মনে পড়ে, প্রথম কবিতার মুহূর্ত?
বিধান সাহা: হুম, মনে পড়ে। সম্ভবত ক্লাস সেভেন বা সিক্সে পড়ি তখন।
ফয়সাল আদনান: আমার প্রশ্নটা মনে হয় আন্সার হয় নাই, নাকি?
বিধান সাহা: আচ্ছা, ফয়সালের প্রশ্নটা শেষ করে নেই আগে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ সকলের মুখ কি একই রকম, ফয়সাল?
ফয়সাল আদনান: আবারো ক্ল্যারিফাই করি, অপরের কবিতার প্রভাব সকলের কবিতাতেই থাকে, স্বীকার করা আর না করা খালি। আর অস্বীকারের মাঝ দিয়েই অপরাজনীতির সূচনা। মানে প্রভাবকে একটা বিরাট অপমান ভাবা, তারপর অমুকের কবিতায় তমুকের প্রভাব বলে নাকচের চেষ্টা। যেখানে কবিতা মাত্রই প্রভাবিত, ভাষা মাত্রই।
বিধান সাহা: আমি স্বীকারই বা কি করবো অস্বীকারই বা কী করবো। আমি ভেবেই দেখি নাই বিষয়টা।
ফয়সাল আদনান: একরকম না কিন্তু প্যাটার্ন আছে, মনগোলয়েড, ইউরোপিয়ান, গ্রীকো, রোমান!
বিধান সাহা: তবে, হ্যাঁ, মজনু শাহর কবিতা আমার ভালো লাগে।
“কবিতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি আঘাত করার অভিপ্রায় আমার নেই। কবিতা, আমি মনে করি, খুব স্লো পয়জনের মতো কাজ করে।”
ফয়সাল আদনান: আচ্ছা, সমস্যা নেই, কথাটা গুরুতর আপাত মাত্র, আদতে এর গুরুত্ব তেমন না।
বিধান সাহা: আমি অত জটিল করে ভাবিই নাই, ফয়সাল। কিংবা যদি প্রভাব থাকেও সেটা আমার সচেতন প্রয়াস না। আমি পরেও কখনও ভেবে দেখি নাই। ইচ্ছে হয় নাই। কেন ইচ্ছে হয় নাই তা একটু বলি, আমার মনে হয়েছে আমার জার্নিটা মাত্র শুরু। দীর্ঘ পথ চলতে চলতে তবেই না পথের একটা রেখা ফুটে ওঠে। আমি বরং আমার সামনের পথটার কথা ভেবেছি বেশি।
আচ্ছা, এবার জয়ের প্রশ্নটার উত্তর দেই?
রুহুল মাহফুজ জয়: প্লিজ…
বিধান সাহা: ক্লাস সিক্স বা সেভেন তখন। আমাদের স্কুলে ড্রিল নামে একটা ক্লাস হতো। বৃষ্টির দিনে মাঠের পরিবর্তে একটা হল রুমে আমাদের বসানো হতো, তো, সেখানে বিভিন্ন সেকশন থেকে কাউকে গান গাইতে বলা হতো, কাউকে কৌতুক, কেউ ছড়া… তখন আমি সেইটায় খুব মজা পেয়ে গেলাম। সব ক্লাস ভয়ে ভয়ে করলেও ওইটায় আমার আনন্দের সীমা থাকতো না। বিশেষত বৃষ্টির দিনে। তো, তখন কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার মতো করে একটা লেখা লিখেছিলাম শুধু ড্রিল ক্লাসে পড়বো বলে। এটা শুরু বলা যায়।
ফয়সাল আদনান: না আপনার বইটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং। প্রথম কিছু কবিতা বিশেষত ‘তাসের পাহাড়’ যেখানে ওরকম একটা ধারাবাহিকতার আভাস রাখে, এর পরে যেয়ে খোলনলচে পালটে যায়। অন্ধের নখরা যেমন। কবি মাত্রই তো এক নিঃসঙ্গ প্রুফরিডার।
বিধান সাহা: ভালো বলেছেন, ফয়সাল।
শাফিনূর শাফিন: বিধান’দা, অনেকে দেখা যায় অনেক তর্ক-বিতর্কে জড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়-তুফান তুলে ফেলে নানা ইস্যু নিয়ে। আপনাকে খুব কম কথা বলতে দেখা যায়।
বিধান সাহা: সোশাল মিডিয়ায় সম্ভবত সকলেই সমালোচক, সকলেই সোসাল অ্যাক্টিভিস্ট, সকলেই কবি, সকলেই… মানে সকলকে সকলই হতে হবে এমন একটা প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আমি কবি হতে চেয়েছি। ক্রিয়েটিভ হতে চেয়েছি। আমার দায়িত্ব, আমি মনে করি, কবিতাকে উৎকৃষ্ট করে তোলা। হয়তো, কবিতায় সেসব প্রসঙ্গ আসতে পারে। কিন্তু সোসাল অ্যাক্টিভিস্ট তো আমি হতে চাই না। আরেকটি ব্যাপার, রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আমার উন্ন্যাসিকতা আছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমি ক্ষুব্ধ, লজ্জিত এবং নিরাপত্তাহীন।
ফয়সাল আদনান: এই ক্ষোভ, লজ্জা ও নিরাপত্তাহীনতা কি আপনাকে কোনো একটিভিটির দিকে ঠেলে দেয় না?
বিধান সাহা: সংকুচিত করে। রাষ্ট্রের কাছে যে-কোনো অন্যায়ের বিচার না চাওয়া, আস্থাহীন, এক ঊনমানুষের নীবরতাটুকুও তীব্রতম প্রতিবাদ এই অবিশ্বস্ত সময়ে।
রুহুল মাহফুজ জয়: কখন বুঝলেন বা ঠিক করলেন, কবিতাই আপনার গন্তব্য?
বিধান সাহা: যখন আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। শোনেন, একটা কথা বলি…
ফয়সাল আদনান: আপনার কবিতাও কি একারণে ভীষণভাবে অ্যাপলিটিকাল, নীরব?
বিধান সাহা: অ্যাপলিটিক্যাল?? জীবনে কোন জিনিসটা পলিটিক্সের বাইরে, ফয়সাল? আমরা কেউই রাজনীতির বাইরে না। ভঙ্গি একেকজনের একেক রকম। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন আমরা পাঠ করি তখন মনে হয় তীব্রতম রাজনৈতিক। সেই তুলনায় ভাস্কর চক্রবর্তীকে অনুউচ্চকণ্ঠ মনে হবার কথা। কিন্তু যখন আমরা ভাস্করের ‘স্থিরচিত্র’ কবিতাটি পড়ি তখন কি এটাও ভীষণ রকম রাজনৈতিক মনে হয় না?
স্থিরচিত্র কবিতাটি পড়া যাক এই সূত্রে –
‘গাছ আর
গাছের ছায়ার নীচে দড়ির খাটিয়া
আমাদের তৃতীয় পৃথিবী।’
ফয়সাল আদনান: এক্স্যাক্টলি, তাহলে এই নীরবতা দিয়ে আপনি কিভাবে ডিল করবেন এসব প্রতিষ্ঠানকে। প্রবাবলি, আমি অনেক লাউড বিধায় আপনার নীরবতা ধারণে আমার ঘাটতি থাকে, আর সে জন্যেই বোঝার ইচ্ছেটা প্রবল হয়তো।
বিধান সাহা: কবিতা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি আঘাত করার অভিপ্রায় আমার নেই। কবিতা, আমি মনে করি, স্লো পয়জনের মতো কাজ করে।
ফয়সাল আদনান: মোটকথা আপনি কবিতা দিয়েই প্রতিষ্ঠানের সাথে ডুয়েল লড়তে চান?
শাফিনূর শাফিন: আমার মনে আছে, আপনি আমার নেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কবিতা ব্রহ্মতেজের মতো।
বিধান সাহা: হ্যাঁ, কবিতা ব্রহ্মতেজকে ধারণ করে, অব্যক্ত সন্ধির দিকে কবির একা একা ছুটে চলা।
শাফিনূর শাফিন: অব্যক্ত সন্ধির দিকে’কে টোটাল ধরলে আমার কাছে স্মৃতি আর বর্তমানের টানাপড়েন মনে হয়। ফেলে আসা শহর আর তার স্মৃতি থেকে বেরুতে না পারা কারো জার্নি।
বিধান সাহা: এমনটা হতে পারে।
শাফিনূর শাফিন: নাগরিক পরিচয়ের সংকট?
বিধান সাহা: আমার লেখায় নাগরিক জীবনের সংকট আছে। সাথে আছে শেকড়ের প্রতি দুর্নিবার টান। যাকে স্মৃতিকাতরতা বলে মনে হচ্ছে।
শাফিনূর শাফিন: আপনি শেকড়ে ফিরতে চান?
বিধান সাহা: আমি শেকড়কে ফেরাতে চাই।
শাফিনূর শাফিন: কবিতার জন্য এমন সংকট থাকা কতটা জরুরি?
বিধান সাহা: শিল্পের জন্য সবই ভালো। সবই উপকরণ।
শাফিনূর শাফিন: কবিতা কি শুধুই টুলসের প্রয়োগ?
বিধান সাহা: না।
শাফিনূর শাফিন: তাহলে?
বিধান সাহা: সোল আর বডি যেমন, তেমনি বোধ, টুলস আর আঙ্গিকের সুসমন্বয়কে কবিতা হিসেবে ভাবতে চাই।
রুহুল মাহফুজ জয়: আমি যেটা জানতে চাইছিলাম। ঠিক কখন এবং কেন মনে হয়েছিলো, কবিতাই আপনার গন্তব্য?
বিধান সাহা: আমার আর কোনো উপায় ছিলো না সামনে। মানে, লিখতাম ছোটবেলা থেকেই। তো, একটা পর্যায়ে এসে আমার ভীষণ ক্রাইসিস পিরিয়ড শুরু হয়। বলতে গেলে জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়। জীবনের জন্য তখন আমার সামনে কয়েকটা পথ খোলা ছিলো। আমি রিস্ক নিয়েছিলাম। পরিবারের সকলের অমতে আমি গিয়ে ভর্তি হই আর্ট কলেজে। আর্ট কলেজে ভর্তি হলেও মূলত ওটা ছিলো কবিতার দিকে সিরিয়াসলি আমার প্রথম পদক্ষেপ।
রুহুল মাহফুজ জয়: আচ্ছা। কবিতা কি? যদিও আপনি এসো বটগাছ-এ লিখছেন, কবিতা কিছুই না।
বিধান সাহা: আমি ওই কথাটাই আবারও বলতে চাই। ওই পুরোটাই। শুধু ‘কবিতা কিছু না’ ধরে নিলে আবার সমস্যা হবে। বললে ওই পুরোটাই বলতে হবে। মানে, কবিতা যে কী, আমি বুঝি কিন্তু স্পষ্টত বোঝাতে পারবো না।
‘আমি তো প্রেমিক না পাউরুটি’ এমন একটা বক্তব্যে নিজেকে পাউরুটি বলায় নিশ্চয় প্রেমিকত্ব নাশ হয় না।’
মোস্তফা হামেদী: রিলেটেড একটা প্রশ্ন, আপনার একটা লাইন আছে এমন, ‘কবিতা লিখি না আমি, বাকব্রহ্মে নিজেকে ছড়াই’-এইটার ভিতর দিয়ে কবিতাকে নাকচ করছেন কি না আপনি?
বিধান সাহা: না। কবিতায় আমি আমাকেই বিস্তৃত করি। বাকব্রহ্ম বলতে শব্দের যে ঈশ্বরিক ক্ষমতা সেটাকে বোঝানোর অভিপ্রায় ছিলো।
মোস্তফা হামেদী: স্ববিরোধ থেকে যাচ্ছে কিনা ব্যাপারটায়?
বিধান সাহা: হামেদী, ‘আমি তো প্রেমিক না, পাউরুটি’ – এমন একটা বক্তব্যে নিজেকে পাউরুটি বলায় নিশ্চয়ই প্রেমিকত্বকে নাকচ করা হয় না।
শাফিনূর শাফিন: ‘অন্ধের নখরা’ নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিলো। প্রথম কবিতা একটা ধাক্কা দেয়। ‘পুরো পৃথিবী একজন অন্ধের কাছে বিরুদ্ধ শিবির’। ফিলজফিকাল স্বগতোক্তি দেখা যায়, এরপরের কয়েকটা কবিতাতে। ফয়সাল যেমন বললেন সিদ্ধান্ত এবং স্বগতোক্তি একসাথে। অথচ অল্প কয়েকটা পরের কবিতাতে গিয়েই মনে হয় যেন প্রেমিকা বা এমন কাউকে উদ্দেশ্য করে উক্তিগুলো। তখন মনে হতে থাকে অন্ধটাই হচ্ছে প্রেমিকা (প্রেমিকও হতে পারে), যে না বোঝার ভান করে নখরামি করছে। কিন্তু আবার শেষের দিকে গিয়ে সেই স্বগতোক্তি ফিরে আসছে। এটা কী পাঠককে দ্বিধান্বিত করার জন্য?
বিধান সাহা: সবগুলো কবিতায় একই ভঙ্গি খুঁজলে ভুল হবে। কোনো কোনো কবিতায় স্বগতোক্তির মতো এসেছে। কোনটায় হয়তো কাউকে উদ্দেশ্য করে বাক্যগুলো এসেছে।
রুহুল মাহফুজ জয়: ‘যদি কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি পঙ্ক্তি মানুষের শরীরকে দুলিয়ে দিতে পারে; তাহলে নিশ্চয়ই… নিশ্চয়ই একদিন…’ সম্ভাবনাগুলা কেমন?
বিধান সাহা: আমি যখন কবি, তখন মানুষকে, এমনকি নিজেকেও স্বপ্ন দেখিয়ে মধ্য দিয়ে চার্জড করানো আমার কাজ। সেই সূত্রে সম্ভাবনাগুলো ছুঁড়ে দেয়া। পাঠক নিজের মতো করে তাকে বিস্তারিত করুক।
রুহুল মাহফুজ জয়: আপনি বাংলা কবিতার কি কি সম্ভাবনা দেখেন?
বিধান সাহা: সে অর্থে সম্ভাবনা যা দেখি, প্রায়ই সবই স্থুল। আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বাংলা কবিতা অন্যদের ডমিনেট করবে এমনটা আশা করি। এটুকুই।
রুহুল মাহফুজ জয়: সেই ডমিনেট করার ভিত্তি তো তৈরি হতে হবে। আমরা কেন পারছি না?
বিধান সাহা: ভাষা একটা ফ্যাক্ট এক্ষেত্রে। আবার রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ারও প্রয়োজন আছে। এ নিয়েও কথা হয়েছিলো রাসেলের সাথে কদিন আগেই।
রুহুল মাহফুজ জয়: ভাষার দূরত্ব তো ঘোচানো খুবই সম্ভব।
মোস্তফা হামেদী: দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা আছে। মানসিক দাসত্বের ব্যাপারও আছে।
বিধান সাহা: আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার জন্য ভাষাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি, যদি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং প্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্র হওয়া যায়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের শিল্প-সাহিত্যও প্রতিনিধিত্বশীল হবে। বাংলাদেশ যদি ডমিনেটিং রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে, তাহলে বাংলা ভাষাও ডমিনেট করবে। ধীরে ধীরে বাংলাই হয়ে উঠবে আন্তর্জাতিক ভাষা। তখন সাহিত্যও আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠবে। মূল কথা, রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কোনো বিকল্প নাই এক্ষেত্রে।
রুহুল মাহফুজ জয়: কলকাতা পারছে, ঢাকা কেন পারছে না?
বিধান সাহা: কলকাতা পারছে? আমার তো মনে হয়, কলকাতায় বাংলা ভাষাটাকেই বাঁচিয়ে রাখা মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রুহুল মাহফুজ জয়: শুধুই কি পলিটিক্যাল? হ্যাঁ, কলকাতার বেশ কজন কবি-লেখক বাইরে খানিকটা পরিচিত।
বিধান সাহা: বাইরে বলতে ইউরোপে?
রুহুল মাহফুজ জয়: আমাদের তো একটা স্বাধীন দেশ। হ্যাঁ, ইউরোপ-আমেরিকা।
বিধান সাহা: আমাদের তাহমিমা আনামের লেখাও তো সে সূত্রে বাইরে পরিচিত। কদিন আগে আমাদের সুমন রহমানের গল্প ‘কমনওয়েলথ ছোটগল্প পুরস্কার ২০১৬’-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় এসেছিলো।
মোস্তফা হামেদী: রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার আগে ভাষার রাজনীতি শক্তিশালী করাটা জরুরি। আমার তো মনে হয়, রাজনীতিবিদের চেয়ে লেখকের চোখ বেশি শার্প? কী বলেন?
বিধান সাহা: আমার মনে হয়, প্যারালালি আগানো দরকার।
রুহুল মাহফুজ জয়: অনুবাদ হয়েও পৌঁছাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পোয়েট্রি সাইটগুলোতে কলকাতার কবিদের লেখা পাওয়া যায়। শ্রীজাত পর্যন্ত। আমাদের আল মাহমুদকেও পাওয়া যায় না।
বিধান সাহা: সে দায় তো আমাদের কবিদের নয়। সেটা যারা অনুবাদ করেন, তাদের দায়।
রুহুল মাহফুজ জয়: নাকি সিস্টেমের দায়?
বিধান সাহা: সিস্টেমের দায়ও অস্বীকার করার উপায় নাই।
রুহুল মাহফুজ জয়: এই সিস্টেমের দায়টা কতখানি প্রকাশনা সংস্কৃতির উপর পড়ে? আপনি তো প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত।
বিধান সাহা: প্রকাশকদের দায় আছে। আমি যেখানে কাজ করি, সেখান থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গত বছর সেলিনা হোসেনের একটা বই ট্রান্সলেট করে প্রকাশিত হয়েছে। এবছরও কয়েকটা বই প্রকাশের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো প্রয়োজনের তুলনায় কম।
রুহুল মাহফুজ জয়: পেশাদার প্রচার-প্রচারণাও তো করে না প্রকাশকরা। বইমেলার একমাসের চিন্তায় কি সাহিত্যের আন্তর্জাতিক প্রসার ঘটানো সম্ভব?
বিধান সাহা: দেখেন, প্রকাশক শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ী। দিন শেষে তাকে তার পুঁজির হিসেব মেলাতে হয়। এরই মাঝ দিয়ে কেউ কেউ চেষ্টা করেন।
রুহুল মাহফুজ জয়: অন্য দেশের প্রকাশকরাও তো ব্যবসায়ী। সারা দুনিয়ায় তাদের ব্যবসা।
বিধান সাহা: আমাদের কোনো কোনো প্রকাশক সেই চেষ্টার করে চলেছেন। বাস্তবতা দেখেন, আমাদের বইমেলা এলে কত কত ভ্যানিটি পাবলিকেশন্স দেখা যায়। বইমেলার পরে এদের কর্মকাণ্ড সেভাবে চোখে পড়ে কতটুকু?
রুহুল মাহফুজ জয়: প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাংলা একাডেমিরও তো অনেক দায়িত্ব আছে। চিরায়ত বাংলা সাহিত্যকে তারাও তো বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে পারতো?
বিধান সাহা: তা তো আছেই। বাংলা একামেডিরই তো সবোর আগে এই উদ্যোগগুলো নেয়া দরকার। এখন হয়তো বলা হবে, বাংলা একাডেমিও উদ্যোগ গ্রহণ করছে। যেমন হে ফেস্টিভ্যাল, লিট ফেস্ট এসব করছে। কিন্তু এই উদ্যোগগুলো ফলপ্রসু হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না।
রুহুল মাহফুজ জয়: লিট ফেস্ট তো বাংলা একাডেমির না। ডেইলি স্টার-প্রথম আলোর।
বিধান সাহা: ও, আচ্ছা। একাডেমি চত্বরে হওয়ায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু এটাও একটা উদ্যোগ। ফলপ্রসু হচ্ছে কই?
রুহুল মাহফুজ জয়: কিছু তরুণ-তরুণীকে আকৃষ্ট করছে। এটা একটা ফলপ্রসু দিক। আচ্ছা, এবার জানতে চাই নতুন কবিতা বলতে আপনি কি বোঝেন?
বিধান সাহা: প্রথমত আমি কবিতার সন্ধান করি। যে কোনো লেখা শেষ পর্যন্ত কবিতা হয়ে উঠলো কিনা, সেটা দেখি। তারপর করণকৌশলগুলো খেয়াল করি। নতুনত্ব খোঁজার সময় আমার কেন জানি ঘরানা ব্যাপারটা মাথায় আসে।
রুহুল মাহফুজ জয়: কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে আপনার মনে হয়? আর নতুন কবিতা নিয়ে আপনার ভাবনাটা জানতে চাই।
বিধান সাহা: সার্বজনীনভাবে এটা বলা কঠিন। লেখক নিজেই টের পান তার নিজের লেখার ক্ষেত্রে।
রুহুল মাহফুজ জয়: কঠিনটাও যদি বলার চেষ্টা করতেন…
বিধান সাহা: অন্যের লেখার বিচার করা কঠিন। সেখানে রুচির প্রশ্নে সকলে বিভক্ত।
“যৌনতাকে স্ট্রেইটকাট আনার পক্ষে না আমি। আমার মনে হয় যৌনতা আবরণ রিলেটেড। ছদ্মবেশ চায়।”
রুহুল মাহফুজ জয়: আপনার নিজের অভিজ্ঞতাটাই জানতে চাই। কখন মনে হয়, কবিতা – কবিতা হয়ে উঠলো?
বিধান সাহা: নিজের নতুন কবিতা নিয়ে খুব সরল করে ভাবতে ভালো লাগে আমার। আমার যে জগত, আমার যে পারিপার্শ্বিকতা, তা আমার আগের সময়ের লেখকদের ছিলো না। ফলে আমি আমার অভিজ্ঞতার ভেতর যদি নিবিড়ভাবে ডুব দিয়ে যথাযথভাবে তুলে আনতে পারি সেটা একটা কাজ হয়ে উঠতে পারে।
রুহুল মাহফুজ জয়: আর কবিতার ভাষা? ভাষা নিয়ে আপনার দর্শন বা ভাবনা কি?
বিধান সাহা: ভাষা নিয়ে আলাদা করে ভাবি না আমি। তবে, সুর, লয়, রস, আবেগ এসবের উপস্থিতি ভীষণভাবে প্রত্যাশা করি। আর একটা মোচড় আশা করি বাক্যে। একটা গল্প বলি, ভাষার এই বিষয়টা আমি মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করি। দেখবেন একেক মানুষ কথা বলার সময় একেকভাবে বাক্য থ্রো করছে। কারো কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আপনা-আপনিই এক-একটা ভঙ্গিমা নেয়। কারো শরীর দুলে উঠছে, কারো চোখ খেলা করছে – আমি এসব নিবিরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। আর লেখার সময় আমার শরীরের ভেতর সেরকম উত্তেজনা খেলা করে। সেই উত্তেজনা বা সেই স্তব্ধতা আমার বাক্যে প্রতিষ্ঠা পায়।
রুহুল মাহফুজ জয়: আচ্ছা, আমার শেষ প্রশ্ন। লেইম ওয়ান। কবিদের মধ্যে আপনি সুদর্শনতম। নায়ক-টায়কও তো হইতে পারতেন।
বিধান সাহা: হা হা হা… আমি শীর্ণকায় মানুষ। নায়ক হবার জন্য যে স্মার্টনেস, ম্যানলি ভাব দরকার আমার তা নাই। সবচেয়ে বড় কথা, আমার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড যা, সেখান থেকে নায়ক হবার সুযোগ তখন ছিলো না।
রুহুল মাহফুজ জয়: শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। এখন তো হতে পারেন। আর আপনার প্রেমগুলার ক্ষেত্রে কোনটা বেশি প্রভাব রেখেছে, কবিতা, আঁকা না চেহারা, নাকি অন্যকিছু?
বিধান সাহা: হা হা হা… প্রায় সবগুলোই। একেকজনের ক্ষেত্রে একেকটা। এখন কয়েকটা শর্টফিল্মে কাজ করার কথা চলছে। করতে পারি কাজগুলো। দেখা যাক।
শাফিনূর শাফিন: প্রচ্ছদশিল্পী বিধান সাহার জন্য চিত্রকর বিধান সাহা কি হারিয়ে গেছেন? আরেকটা প্রশ্ন, কবিতার বইয়ের পর আরেকটা কবিতার বই না করে গদ্যের বইয়ের ভাবনা মাথায় এলো কেন?
বিধান সাহা: একটা কথা বলে রাখা ভালো। একাডেমিক ওয়ার্কের বাইরে আমার তেমন কোনো কাজ করা হয় নাই। আমার বরং ভালো লাগতো লিখতে। ভাবতে। আমি সেসব নিয়েই থাকতাম বেশিরভাগ সময়।
শাফিনূর শাফিন: করতে ইচ্ছে করে নাই? যেমন অন্য প্রচ্ছদশিল্পীরা করছেন?
বিধান সাহা: করতে ইচ্ছে করে যে নাই, তা না। কিন্তু একাডেমিক সিস্টেমটা আমার সেই আগ্রহটাকে নষ্ট করে ফেলেছিলো। তখন সিস্টেমের বাইরে গিয়ে ভাবার মতো সাহস বা একাগ্রতা আমার ছিলো না। ফলে আমি পালাতাম মনে মনে। কবিতায় আশ্রয় নিতাম। কিন্তু এই একাডেমি আমার খুব বড় একটা উপকারও করেছে। তা হলো শিল্পের নন্দনতত্ব সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি। শিল্পের বিভিন্ন ইজমগুলো ধারাবাহিকভাবে আামাদের পাঠ্য ছিলো। ফলে বিভিন্ন শিল্প আন্দোলনগুলো সম্পর্কে এবং সেসবের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছিলাম। যা কবিতা চর্চায় আমার কাজে এসেছে।
শাফিনূর শাফিন: প্রচ্ছদশিল্পী হবার আগ্রহ কীভাবে তৈরি হলো?
বিধান সাহা: ঢাকায় এসে জীবিকার তাগিদে আমি গ্রাফিক্সের কাজ শিখি। তো, একসময় খুব কাছের দু’একজন লিটলম্যাগের প্রচ্ছদ করে দিতে বলতেন। তখন আমি শুধু গ্রাফিক্সটুলস ব্যবহার করে প্রচ্ছদ করে দিতাম। একসময় কিছু কাজ অনেকে পছন্দ করতে থাকেন। এভাবে আসা আর কী!
ফয়সাল আদনান: আপনার কবিতায় যৌনতা নিয়ে কিছু কথা হোক। যৌনতাকে আপনি কবিতায় কিভাবে আনতে চান? আপনি কি কিছুটা বিশুদ্ধতাবাদী? ট্যাবু আক্রান্ত?
বিধান সাহা: নাহ, যৌনতা আছে আমার লেখায়। তবে বইতে কম রাখা হয়েছে। যখন বলা হয়, ‘সেই থেকে আমার ফুলাকাঙ্ক্ষা আর মৈথুনেচ্ছা সমান্তরাল লাল হয়ে আছে!’ তখন তো পুরো পরিবেশটাই কেমন লাল হয়ে ওঠে, দেখতে পাই।
ফয়সাল আদনান: ‘সেই থেকে আমার ফুলাকাঙ্ক্ষা আর মৈথুনেচ্ছা সমান্তরালে লাল হয়ে আছে’। এই লাইনটা যখন পড়ি আমার মনে হচ্ছিলো আমি একটা দূর্ধর্ষ লাল মোরগকে দেখছি সিনা টান করে যে ভোরের সূর্যকে ডুয়েলে ডাকছে। তবে আমি কিন্তু বলি নাই আপনার কবিতায় যৌনতা নাই, জানতে চাইলাম কিভাবে সেটাকে আপনি ডিল করেন।
পরের প্রশ্নটা: ব্ল্যাংক সিডি, টিস্যুর স্তুপ থেকে দিদির স্তনে যখন আমরা যাচ্ছি, অব্যাক্ত সন্ধির দিকেই কি আমরা গেলাম? যৌনতার এই পরোক্ষ, কিঞ্চিৎ লজ্জিত আয়োজন কি অব্যাক্ত সন্ধির দিকে আপনার অবচেতনের সেল্ফ রিপ্রেজেন্টেশন নাকি সচেতন আয়োজন?
বিধান সাহা: যৌনতাকে স্ট্রেইটকাট আনার পক্ষে না আমি। আমার মনে হয় যৌনতা আবরণ রিলেটেড। ছদ্মবেশ চায়।
কিছুটা সচেতন প্রয়াস বলা যায়। পুরোটা না। মানে, শুধু লেখাগুলোর গতিপথ অব্যক্ত সন্ধির দিকে ভাবলে সে সংকুচিত হয়ে পড়ে। পুরো গ্রন্থটির গতিপথ অব্যক্ত সন্ধির দিকে ভাবতে চেয়েছি। সেই অসীম, যা অব্যক্ত, সেই মহাশূন্যের দিকেই শেষাবধি আমাদের যাত্রা, এমন ভাবতে ভালো লাগে।
হাসান রোবায়েত: বাঙালির সাইকির মধ্যে বটগাছ-নদী-ঘাস-বিস্তীর্ণ ধানপ্রান্তর-চাঁদ এইসব বিরাজ করছে প্রায় হাজার বছর ধরে। আমার ধারণা এ জন্যই আপনার ‘এসো বটগাছ’ হয়ে ওঠে পাঠকের খণ্ডকালীন আশ্রয়-বিশ্রামের থান। কিন্তু যখনই আপনি শহরকে ন্যারেট করেন গদ্যে তখনই কেমন যেন সুষমা নষ্ট হয়ে যায় [আমার পাঠে]। না-ভালো লাগা তৈরি হয়। তো, গদ্যের এই ব্যাপারটা কেন ঘটলো আপনার টেক্সটে?
বিধান সাহা: এটা যদি হয়ে থাকে, সেটা আমি সচেতনভাবে করি নাই। এই বইটাতে আমি খুব সরল, স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে চেয়েছি। এবং অনুভূতির উপর আলাদা কোনোকিছু আরোপ করতে চাইনি। ফলে, চলতে চলতে নগর আমার অনূভূতিতে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, সেভাবেই এসেছে।
হাসান রোবায়েত: আপনার গদ্য কেন যেন শহরের ভার নিতে পারেনি। যতটা সাবলীলভাবে নিয়েছে গ্রামকে। এটা আমার মত। অন্যরা কী ভাবে সেটা জানলে বেশ হইতো। অবশ্য গদ্য নিয়ে আমার আরো কিছু অবজারভেশন ছিলো।
রুহুল মাহফুজ জয়: স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে বইটা পড়ে আরাম পাওয়া যায়।
বিধান সাহা: যতদূর মনে পড়ছে, বইটাতে শহর খুব কম এসেছে। শহরকে আমি ওভাবেই দেখেছি। ঠিক শহরকে দেখা না এটা। শহরের মাঝে আমাকে আমি ওভাবেই আবিষ্কার করেছি। তাছাড়া, গ্রাম আসার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। এটা যখন লেখা হয় সেই সময়, সেই প্রেক্ষাপটটা বিবেচনায় নিলে সেটা টের পাওয়া যাবে।
হাসান রোবায়েত: এই বইটা পড়ে আমি আপনাকে লিখেছিলাম, ‘অনেকদিন পর, সত্যিই, একটা বই পুরোটা পড়লাম। এক ধরনের প্রজ্ঞা মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়েছে। এ যেন ইস্টের আসল চরিত্র।’ তো, ইদানিং আমার ঐ কথাটা নিয়েই বেশ কিছু চিন্তা মাথায় ঘুরতেছে।
বিধান সাহা: আচ্ছা। কেমন?
হাসান রোবায়েত: আপনার গদ্য অসাধারণ সান্দ্র। কিন্তু আমার কাছে সান্দ্রতাই আবার সমস্যা মনে হয়। যেমন, বাংলা গদ্যে এইটা রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার। ‘লিপিকা’, ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’, ‘ছিন্নপত্র’ এইসব বইয়ে রবীন্দ্রনাথের যে ক্রাফটস, কেন যেন মনে হয় ‘এসো বটগাছ’-এও সেই একই ক্রাফট ব্যবহার করা হইছে। সেটা কি সচেতন ভাবেই করেছেন?
বিধান সাহা: না, সচেতনভাবে করা না। এই সুযোগে এটা লেখার প্রেক্ষাপটটা একটু বলে নেই। এই বইটার বেশিরভাগ লেখা অন দ্য স্পট। অ্যান্ড্রয়েডে। পরে হয়তো কোনো কোনোটায় আরেকটু ডিটেইলিংয়ে গেছি। বইটার ভূমিকায় যদিও কিছুটা বলা হয়েছে, তবু আরেকবার বলি, এই বইটার ভেতর দিয়ে আমি মূলত সেরে উঠতে চেয়েছি। আমার মা তখন ভয়াবহ অসুস্থ। আমি জানতাম তাঁর ক্যান্সার। একা জানতাম আমি। পরিবারের সবাইকে আশার বাণী হিসেবে মিথ্যে বলতে হয়। অথচ আমি ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছি। কান্না চেপে রেখে মৃতন্মুখ একজন মানুষের সামনে গিয়ে হাসি হাসি মুখ করে মিথ্যে বলতে হয়। এটা খুবই কঠিন পরিস্থিতি। এভাবে চলতে চলতে আমি নিজেই খানিকটা ট্রমাটাইজ হয়ে পড়েছিলাম। ঠিক একই সময়ে আমার প্রেমিকা, যাকে বিনা যোগাযোগে পনের বছরের বেশি সময় ধরে যাপন করে গেলেও, যোগাযোগটা কাকতালীয়ভাবে ঠিক ওই দুঃসময়েই হয়ে ওঠে। তিনি তখন আগ্রহ আর অনাগ্রহের মাঝে দ্বিধাগ্রস্থ। তো, সব মিলিয়ে ভীষণ রকম বিপন্ন সময়ের ভেতর দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিলো। নিজেকে ঠিক রাখার জন্য নানারকম কসরত করতাম মনের সাথে। ইচ্ছে করেই মনকে নানা রকম গল্প সাজাতে দিতাম। প্রায়শ অবচেতন থেকে উঠে আসতাম বর্তমানে। চারপাশটা দেখতাম তাকিয়ে তাকিয়ে। আসন্ন সেই ফলাফলের ভয়াবহ আতংক থেকে পালাতে চাইতাম। এক্ষেত্রে, টুলস হিসেবে যে ভাষাটাকে আমি বেছে নিয়েছি, তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে নেয়া। সঙ্গে এক্সপ্রেশনটা যুক্ত হয়েছে কোথাও কোথাও। কবিতা চর্চার কারণে কাব্যিকতাও যুক্ত হয়েছে অনেকাংশেই। দুয়েকটা লেখা বেশ আগের।
হাসান রোবায়েত: আমার কিন্তু দৈনন্দিন ভাষা বলে মনে হয় নি। এক ধরণের ডায়েরির মতো হলেও ভাষা এসেছে নম্র সুরে, অনেকটাই কবিতা হয়ে ওঠার ইচ্ছা নিয়ে। মানে, ন্যারেটিভটা বেশ সাজানো-গোছানো, সান্দ্র। টানাগদ্যের ঢঙ বলতে পারেন।
বিধান সাহা: দৈনন্দিন ভাষা বলতে আমি যেটা বলতে চাইছি, বাক্যগঠনে আমি তেমন কোনো ক্যারদানি করি নাই। যেভাবে মনে এসেছে, সেভাবে লিখে ফেলা। টানা গদ্যের ঢঙ তো অবশ্যই। অনেকটা জার্নাল গোছের। কিন্তু এর অনেকগুলো লেখাকেই কবিতা হিসেবে ভাবা যায়। আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে, নতুন একটা পথের রহস্য আছে এই লেখাগুলোর মাঝে।
হাসান রোবায়েত: হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথও একই কাজ করতে চেয়েছিলেন। যেমন:
‘ওগো পায়ে চলার পথ, অনেক কালের অনেক কথাকে তোমার ধূলিবন্ধনে বেঁধে নীরব করে রেখো না। আমি তোমার ধুলোয় কান পেতে আছি, আমাকে কানে-কানে বলো।’
পথ নিশীথের কালো পর্দার তর্জনী বাড়িয়ে চুপ ক’রে থাকে।
‘ওগো পায়ে চলার পথ, এত পথিকের এত ভাবনা, এত ইচ্ছা, সে-সব গেল কোথায়!’
বোবা পথ কথা কয় না। কেবল সূর্যোদয়ের দিক থেকে সূর্যাস্ত অবধি ইশারা মেলে রাখে।
‘ওগো পায়ে চলার পথ, তোমার বুকের উপর যে-সমস্ত চরণপাত একদিন পুষ্পবৃষ্টির মতো পড়েছিলো আজ তারা কি কোথাও নেই?’
পথ কি নিজের শেষকে জানে, যেখানে লুপ্ত ফুল আর স্তব্ধ গান পৌঁছল, যেখানে তারার আলোয় অনির্বাণ বেদনার দেয়ালি-উৎসব।’
বিধান সাহা: এ ধরণের কাজ বাংলা সাহিত্যে প্রচুর আছে। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয়, এর মাঝে নতুন কোনো গুপ্ত পথের সুরঙ্গ আছে। খুঁজে দেখা দরকার। যে কারণে, আমি কিন্তু বইটাকে ঠিক গদ্য বলছি না। বলছি না-কবিতা। মানে, আমার নিজের এক ধরণের সংশয় আছে।
মোস্তফা হামেদী: আমার কাছেও ক্যাজুয়াল মনে হয় নি। অনেক ফরমাল, গোছানো মনে হয়েছে। যেটা হয়তো আপনার সহজাত। কাব্যিক মগ্নতা এই লেখাগুলির অন্যতম দিক।
বিধান সাহা: হ্যাঁ, হামেদী। কাব্যিকতা যুক্ত হয়েছে কবিতা চর্চার কারণেই।
হাসান রোবায়েত: আমি আসলে একটু অন্যভাবে ভাবতে চাচ্ছিলাম বিধান’দা। যেমন ধরেন, আপনার টেক্সটটা আমাদের সময়ের একটা উজ্জ্বল গদ্য হয়ে থাকবে। কিন্তু যেভাবে কমলকুমার, সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভূষণ, সন্দীপন এরা বাংলাগদ্যকে ভাঙলেন, তৈরী করলেন নতুন ক্রাফট, সেই দিকে যদি আরেকটু আগাইতো ‘এসো বটগাছ’ তাহলে অসম্ভব খুশি হইতাম। তো, পরবর্তীতে কি গদ্য নিয়ে অমন কোনো ভাবনা আছে, বিধান’দা?
রুহুল মাহফুজ জয়: সম্বিত বসুর ‘গদ্যলেন’ একই ক্যাটাগরির বই। পড়ে মনে হয় কবিতা, আবার মনে হয় গদ্যই।
বিধান সাহা: না, রোবায়েত। কমলকুমার বা সতীনাথ ভাদুরি বা অন্য যাদের নাম উল্লেখ করলেন তাঁরা যে ভাষায় বলেছেন, আমার টেক্সেটের অভিমুখ এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাদের মতো, মানে, ওরকম ভাষায় লিখলে আমি যা বলতে চাইছি, তা যথাযথভাবে আনা কঠিন হতো।
হাসান রোবায়েত: আচ্ছা।
মোস্তফা হামেদী: বাংলা কবিতার খবর বলেন। কেমন চলছে বাংলা কবিতার দিনকাল?
বিধান সাহা: তাবৎ বাংলা কবিতার খবর বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমার কবিতার কথা জিজ্ঞেস করেন, বলতে পারবো।
মোস্তফা হামেদী: বাংলাদেশের বাংলা কবিতার খবর বলেন। ছোট পরিসরে বললে এই সময়ের কবিতার খবর।
বিধান সাহা: আচ্ছা। আমি ভীষণ আশাবাদী আমাদের সময় নিয়ে। বেশ কিছু প্রতিভাবান কবি এসেছেন এই সময়ে। এবং তারা কবিতার নানা মাত্রা নিয়ে চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। এবং প্রচুর ভেরিয়েশন লক্ষ্য করা যাচ্ছে এই সময়ে।
“দেখেন ছন্দ তো টুলস। টুলস তো মাস্টার-অমাস্টার সবার জন্যই উন্মুক্ত। তার ব্যবহারটার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। সংস্কৃত ছন্দের ব্যবহার করছে এই সময়ের কবিরা। রোবায়েতের দশমাত্রার যে বইটা আসছে, সেটা তো সাহসী কাজ।”
মোস্তফা হামেদী: কারা কারা? একটু বিশদ করবেন… কী কী ধরনের ভ্যারিয়েশন? যেটা আগে দেখা যায় নি।
বিধান সাহা: নাম না উল্লেখ করলেও ভেরিয়েশনটা লক্ষ্য করা যায়।
মোস্তফা হামেদী: তাদের কাজের দু-একটা অনন্য দিক নিশ্চয়ই বলবেন?
বিধান সাহা: কবিদের মধ্যে এখন ছন্দসচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গদ্যছন্দেও দক্ষ কবি এইসময়ে দেখতে পাবেন। তাছাড়া ছন্দের নানান অলি-গলি ঘুরছেন এইসময়ের কবিরা। ব্যাপারটা আশাব্যঞ্জক। আবার একই কবির হাতে দেখা যাচ্ছে দুধরণেরই লেখাই শক্তিশালী হয়ে উঠছে কখনও কখনও।
মোস্তফা হামেদী: ছন্দচর্চা তো নতুন কোনো ব্যাপার নয়। এটা বাংলা কবিতার বরং সবচেয়ে শক্তিশালী ধারা। এই সময়ে এসে এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠার কারণ কী হতে পারে?
বিধান সাহা: গুরুত্বপূর্ণ একারণের হতে পারে, খেয়াল করে দেখবেন এই সময়ের পূর্বের (শুন্য দশকটা ধরি অন্তত) সময়ে টানাগদ্যের প্রভাব এতো বেশি এবং তা একঘেয়ে প্রায়। ফলে আমাদের সময়ের কবিতা হয়তো একটু শ্বাস ফেলতে চাইছে ভিন্নভাবে। অথবা টানাগদ্যে লিখলেও ভিন্নতার কথা ভাবছে।
মোস্তফা হামেদী: একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য পুরনো পথেই হাঁটা হচ্ছে কি না? যেখানে ছন্দের অনেক মাস্টার পোয়েট অতীতে আমরা পেয়েছি। সেই তুলনায় এখনকার ছন্দচর্চার অত ঔজ্জ্বল্য কোথায়?
বিধান সাহা: দেখেন ছন্দ তো টুলস। টুলস তো মাস্টার-অমাস্টার সবার জন্যই উন্মুক্ত। তার ব্যবহারটার উপর নির্ভর করে অনেক কিছু। সংস্কৃত ছন্দের ব্যবহার করছে এই সময়ের কবিরা। রোবায়েতের দশমাত্রার যে বইটা আসছে, সেটা তো সাহসী কাজ।
মোস্তফা হামেদী: ছন্দচর্চায় নতুন কোনো মাত্রা যুক্ত হয়েছে কি না, যেটা ইতিহাসে দুর্লভ? রোবায়েতের কাজটা সাহসী কোন দিক থেকে?
বিধান সাহা: বাংলা সাহিত্যে দশ মাত্রায় পুরো একটা বইয়ের কাজ আমার চোখে আগে পড়ে নাই। সে কারণে আমি সাহসী কাজ বলছি। আমার অজ্ঞতাও হতে পারে। কিন্তু আমি দেখি নাই আগে। সংস্কৃত ছন্দের ব্যবহার আমি আমার সময়েই বেশি দেখেছি।
মোস্তফা হামেদী: মাত্রাবৃত্তে দশ মাত্রার বই সম্ভবত নাই।
বিধান সাহা: তাহলে তো সাহসী বলতেই হবে। আবার দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতাও লেখা হচ্ছে এই সময়ে, এটাও আমাদের পূর্বের সময়ে কম দেখেছি।
ফয়সাল আদনান: আমার কাছে কেন জানি টুলসের ব্যবহারে সাহসের পরিচয় আছে এমন মনে হয় না। মানে, টেন্ডুলকার একটা দশ কেজি ব্যাট দিয়ে ব্যাট করত নাকি ১৮ কেজি সেইটা নিয়া আলোচনার কিছু নাই আসলে, আলোচনা হইলো রান হইছে কিনা।
বিধান সাহা: সাহসটা হলো পুরো একটা বই একই ফরম্যাটে সাজানোর সিদ্ধান্তে। ঝুলে যাওয়ার চান্স থাকে তো।
মোস্তফা হামেদী: সংস্কৃত ছন্দের কবিতা নতুনত্ব আনলো কি না, এটা আসলে বিশদ গবেষণা ও তর্কের বিষয়। হয়তো ভবিষ্যৎ এর সুরাহা করবে।
বিধান সাহা: দেখেন, আমি বলছি না যা চর্চা হচ্ছে তার সবই মহৎ কিছু হয়ে গেছে। আমি বলতে চাইছি, এসবই ভ্যারিয়েশন। বহুদিক নিয়ে চর্চা হচ্ছে এই সময়ে।
ফয়সাল আদনান: না, বুঝছি আপনার কথাটা, বিধান। গোলমাল একটাই, সবাই হাতিয়ার নিয়া আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে আছেন। আমি নিজেও সুরাহা খুঁজি। নতুন কবিতা কি হইতে পারে, কিভাবে পারে, কোনো সদুত্তর নাই, যেহেতু আমি টুলসের মাতামাতি খারিজ রাখতেছি। আপনার কী মত? কী-ই বা পথ?
বিধান সাহা: ভাই, আমি কানা ঘোড়া, আমার সোজা দৌড়। সত্য কথা বলতে কি, আমি এতো কিছু নিয়ে ভাবি না। চিন্তার সেই উচ্চতর, গভীর এবং নীরবতায় নিজেকে পৌঁছে দিয়ে একটা ধারাবিবরণী দিয়ে যেতে পারা আপাতত আমার উদ্দিষ্ট।
রাজীব দত্ত: এইসময়ের কার কার গদ্য ভালো লাগতেছে বিধান, আপনার?
বিধান সাহা: দু’একজন ছাড়া আমি সেভাবে তেমন কোনো গদ্যকার দেখি না। সেই দু’একজনকেও গ্রেস দিয়ে ভালো লাগাতে হয় কখনও কখনও।
রাজীব দত্ত: এখন কি গদ্য সত্য সত্য কম লেখা হচ্ছে? নাকি যারা লিখতেছেন তারা আমাদের কুয়ার বাইরে?
বিধান সাহা: তুলনামুলক বিচার করলে যতজন কবি আছে, তার অর্ধেকও গদ্যকার নাই। কম তো লেখা হবেই। কুয়ার বাইরে বলতে কী, যে, আমাদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ নাই, এরকম? তাতেও সমস্যা হবার কথা না। ভালো লেখা চোখে পড়ার কথা। কিংবা সংবাদটা কানে আসার কথা এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। গদ্য যারা লেখেন তাদেরকেও অনেক সময় অনুরোধ করে লেখাতে হয়। দেখা গেলো, সম্পাদকের অনুরোধে একটা লেখা শেষ করে আর খবর নাই। মানে, গদ্যটা তার প্যাশান না।
রাজীব দত্ত: আমার রিসেন্ট অবশ্য তানিমের ‘ঘর পলায়নসমূহ’ ভালো লাগছে।
রুহুল মাহফুজ জয়: আমার মনে হয় সাদ রহমানের সম্ভাবনা আছে গদ্যে, তানিমের লেখা ভালো লাগে।
বিধান সাহা: হ্যাঁ। সেই দু’একজনের মাঝে তানিম একজন। কিন্তু, একজন বা দুইজন দিয়ে কি আমাদের সময়ের গদ্যকারে অভাব পূরণ হবে? বড় জিজ্ঞাসা এটা।
রুহুল মাহফুজ জয়: হাসনাত শোয়েব গদ্য লেখায় নিয়মিত হলে আমরা ভিন্ন কিছু পেতে পারি। আমার মনে হয়।
রাজীব দত্ত: সবচে কম লেখা হচ্ছে প্রবন্ধ। কবিরা খালি কবিতাই লিখবেন এমন না হইলেই ভালো। অবশ্য প্রবন্ধ লেখা কষ্টসাধ্য।
বিধান সাহা: প্রবন্ধ খুবই কম। উপন্যাসেও দু’একজন ছাড়া কেউ হাত দিচ্ছে বলে খবর জানা নাই।
রাজীব দত্ত: তবে কবিদের ভালো হয়। আমি রিসেন্ট জয় গোস্বামী শুরুর দিকের দুইটা উপন্যাস পড়লাম। ভালো লাগছে।
রুহুল মাহফুজ জয়: জয় গোস্বামীর প্রবন্ধও খুব ভালো। ওনার লেখা রৌদ্রছায়ার সংকলন বইটা তো দারুণ। তাঁর প্রিয় পাঁচ কবির কবিতা নিয়ে লেখা।
রাজীব দত্ত: কবিতাআক্রান্ত গদ্য নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। আপনার কী মত?
বিধান সাহা: অতিমাত্রায় অ্যাবস্ট্রাকশন ভালো লাগে না। তবে কাব্যগদ্যের এই প্যাটার্ন আমার ভালো লাগে। এ ধরণের গদ্য পড়তে গিয়ে একধরণের ‘না-কবিতা’র অনুভুতি পাওয়া যায়, সেটা একটা কারণ হতে পারে।
মোস্তফা হামেদী: গত দশ বছরে প্রকাশিত পাঁচটি বইয়ের নাম বলেন, যেগুলো অনেকদিন টিকে থাকবে বলে মনে হয় আপনার।
বিধান সাহা: এটা আমি বলতে পারবো না।
মোস্তফা হামেদী: আপনার প্রিয় পাঁচটা বলেন?
বিধান সাহা: মুশকিল হলো, বই হিসেবে পুরোপুরি ভালো লাগা বই কম। কিন্তু দেখা গেলো, প্রায় সব বইয়েরই কোনো না কোনো কবিতা আমার ভালো লেগেছে। সেই সূত্রে পুরো বইয়ের নাম বলা যাচ্ছে না।
শাফিনূর শাফিন: আপনাকে যদি আলোচনা করতে বলা হয় কোন কোন বইয়ের উপর করতে চাইবেন?
বিধান সাহা: কৌশলগত কারণে বলতে চাইছি না।
রুহুল মাহফুজ জয়: এই আড্ডায় সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
বিধান সাহা: আপনাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ, ভালোবাসা।