গৌতম চৌধুরীর জন্ম ২রা মার্চ, ১৯৫২। প্রথম জীবনে সম্পাদনা করেছেন একটি কবিতাপত্রিকা ‘অভিমান’ (১৯৭৪-৯০)। প্রথম কবিতার বই ‘কলম্বাসের জাহাজ’ প্রকাশ হয় ১৯৭৭ সালে। সম্প্রতি বইটির পুনঃমুদ্রণ করেছে রাবণ। সর্বশেষ কবিতার বই ‘কে বলে ঈশ্বরগুপ্ত’ কলকাতার ধানসিঁড়ি থেকে বের হয়েছে অল্প কিছুদিন হলো। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার সংবেদ থেকে প্রকাশ হয় ‘বনপর্ব’। ‘ধ্যানী ও রঙ্গিলা’ প্রকাশ করেছে চৈতন্য, ২০১৫ সালে। নির্বাচিত কবিতা (২০১০) প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে। কবিতার সমান্তরাল কিছু গদ্য নিয়ে ই-বুক ‘গরুর রচনা’ প্রকাশ হয় ২০১২-তে। এক সময় কলকাতার নাট্যদল ‘নান্দীকার’-এর একাধিক প্রযোজনার জন্য তর্জমা করেছেন ‘ব্রেখট’-এর কবিতা ও গান। ওই সংস্থা তাঁর রূপান্তরিত নাটক ‘হননমেরু’ মঞ্চস্থ করেছে; এর বাইরে অনুবাদ করেছেন মোহন রাকেশের হিন্দি নাটক ‘আষাঢ়ের একদিন’। ‘আমি আলো অন্ধকার’ শিরোনামের কবিতার বইটি প্রকাশ হয় ১৯৯৬ সালে। বইটি বাজারে নেই। বইটি থেকে শিরিষের ডালপালা পাঠকদের জন্য নির্বাচিত ২৫ কবিতা বাছাই করেছেন কবি নিজে। কবিকে ধন্যবাদ।
রাত্রিগান
০১
পুনর্ভবা রাত্রি, যদি জেগে আছ, কেড়ো না স্বপ্নের শেষ ছবি
কেড়ো না অন্তিম হাসি, দূরের নক্ষত্র থেকে ঝরে পড়ে কণা-
মাত্র আলো, কেড়ো না চৈত্রের ঝড়ে ঠোঁটে-ধরা সামান্য খড়কুটো
ইশারার ক্ষীণ আভা স্পর্শ ক’রে যেতে হবে অনিশ্চিন্দিপুর
রক্তাক্ত সিঁড়ির বুকে থিরিথিরি অন্ধকারে নেমে গেছে পথ
তুমুল হাতছানি যদি বেজে ওঠে স্থবিরের দিকশূন্য ঘুমে
কাঠুরিয়া হবে মন ঢুকে পড়বে অরণ্যের স্তর থেকে স্তরে
কুঠার যেখানে স্তব্ধ, সবুজ সন্ত্রাসে মত্ত বৃক্ষের সাঁজোয়া
দরোজা, থেকো না বন্ধ, খুলে দাও অন্তহীন সমস্ত প্রস্তাব
ওপারে আকাশ আর পৃথিবীর অনর্গল আশ্চর্য প্রতিভা
যদি আছ নিদ্রাহীন, ধরো হাত, ফেলে দাও কৃপণ লন্ঠন
অন্ধের তরঙ্গে চলো ঝাঁপ দিই দুর্নিবার – স্বপ্ন যদি শেষ …
০২
তোমার প্রাণের কাছে যাব বলে ওগো রাত্রি, যে-ভাষা খুঁজেছি
কখনও পেয়েছি তার চকিত প্রলাপ আর কখনও বা ঘুমে
পিছল সিঁড়ির পথে হারিয়ে ফেলেছি তার একমাত্র মুখ
ভাঙাচোরা আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি তবু বৃষ্টিভেজা পথে
দেখেছি সুন্দর তুমি আমাকেও তিলে তিলে করেছ সুন্দর
সে-সৌন্দর্যভার তবে কীভাবে বহন করব শেখালে না কেন
করতলে তুলে নেব অবলুপ্ত সভ্যতার মৃৎপাত্রগুলি
তুমি মদ ঢেলে দিলে কীভাবে তা পান করব প্রাচীন শতকে
এত যে দিয়েছ তবু কেন বলো বারংবার শূন্য হয়ে যাই
ভেঙে ফেলি মূর্তি আর ভেঙে পড়ি অশ্রুহীন জন্মান্ধ কান্নায়
কেবলই হারাই পথ, হেঁটে মরি হিজিবিজি বিপন্ন ধাঁধায়
তোমার প্রাণের কাছে যাব বলে, ওগো রাত্রি, তবু জেগে থাকি
০৩
পৃথিবী হয়েছে স্তব্ধ, এবার পাঠাও দ্রুত তোমার সংকেত
রাত্রির পোশাকে ডুবে চুপিচুপি নেমে আসি প্রাচীরের কাছে
নীরবে প্রস্তুত করি ছেনি ও হাতুড়ি, আর নির্মম আঘাতে
গড়ে তুলি অল্পে অল্পে সুরঙ্গের দীপ্ত মুখ নিভৃত দ্যোতনা
আমি নৈশ কারিগর, প্রকাশ্য আলোয় হাঁটি ভিড়ের গভীরে
গূঢ় অভিসন্ধিগুলি যথাসাধ্য ঢেকে রাখি হাসির আড়ালে
মর্মের গোপন ক্ষত যদিও অস্থির করে কামড়ে কামড়ে
তবু নিই বাতাসের তোমাকে জড়িয়ে থাকা শ্বাসরোধী ঘ্রাণ
তারপর তারা ফোটে, শুরু হয় গাছেদের সুপ্ত কানাকানি
দু’চোখে জড়ায় তন্দ্রা, মাঝে মাঝে টলে পড়ি মাতৃহারা ঘুমে
আবার দাঁড়াই উঠে, পায়চারি করি, আর স্নায়ুর গভীরে
কান পেতে রাখি, শুনি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে এল তোমার ইশারা
০৪
জানালায় কেঁপে ওঠে পাণ্ডু রাত চক্ষুহীন নিঃস্বতার ছায়া
ও-প্রেত আমার, তাকে কোন্ ভাঙনের পথে দেব বিসর্জন
নক্ষত্র গিয়েছে সরে দিনে দিনে তাকে আর ফেরাতে পারি না
তবুও দু’হাত ভরে ছুঁতে যাই অন্ধকার শারদ মনীষা
পারি না, ঘুমিয়ে পড়ি, শ্লথ আলো নেমে আসে বিপন্ন রাত্রির
দেখি নদী, দেখি ধান, কাশের দিগন্তে মোড়া চন্দ্রকেতুগড়
যা ছিল অতীত লুপ্ত বৃষ্টিধোয়া পাথরফলকে লেখা নাম
দেখি তারা জেগে উঠে ভোরের আলোর মতো আদরে জড়ায়
তবু এ-আঙুল, ভাবি, আঙুরলতার মতো পড়ুক ছড়িয়ে
শূন্যতাকে মুছে দিক দ্রাক্ষারসে, ইতিহাস পুনর্লিখনের
০৫
যদি দিলে প্রাণ আর কানে কানে দুর্নিবার ভ্রমণ শেখালে
বোলো না হে পথ তবে ফিরে যেতে স্মৃতিহীন অস্পষ্ট তন্দ্রায়
বরং ফেরার সেতু ভেঙে ফেলি, পালাবার সমস্ত সড়ক
মুছে ফেলি একে একে, তারপর মুখোমুখি দাঁড়াই স্বপ্নের
হয়তো চোখ ঝলসে যাবে, গৃহযুদ্ধে খসে যাবে বিবর্ণ পতাকা
হয়তো সে-রূপ আমি সহ্য করতে না-পেরে চিৎকার করব শেষে
তবুও ফিরব না আজ, ওগো রাত্রি, হেঁটে যাব আগুন মাড়িয়ে
চলতে চলতে জ্বলে উঠব, অন্ধকারে মেলে ধরব হাড়ের মশাল
০৬
মুছো না এ-অন্ধছবি, কানে কানে বলে যাওয়া নিঃশব্দ হরফ
কেড়ো না এ-জন্মরথ, বসন্তের ভিক্ষুকের ক্ষণিক পতাকা
ভেঙে না এ-রাত্রিগান, গলন্ত মোমবাতি, হাওয়া, কাঁপা উচ্চারণ
ছিঁড়ো না অদৃশ্য রজ্জু, নদীর নির্জন বাঁকে লুকানো তরণী
বাতাস উধাও আজ, ঢেউ দাও, কেঁপে ওঠো তরঙ্গ অপার
ফেনায় ফেনায় নাচো, ফুলে ওঠো, ধুয়ে দাও মজ্জার মরিচা
এ-নৈশপ্রলাপটুকু তুলে রাখো, গায়ে তার এঁকে দাও ডানা
উড়ে যাক্ ক্ষণমাত্র – যতদূর আশ্বিনের শান্ত ছায়াপথ
বৃক্ষতম
০১
সমস্ত বৃক্ষের মর্মে চিরদিন তোমাকে খুঁজেছি বৃক্ষতম
সমস্ত মেঘের পুঞ্জে তোমাকেই, বৃষ্টিঘোর প্রার্থনার মেঘ
সমস্ত নদীর গর্ভে তুমি স্বচ্ছ উতরোল সমুদ্রসংকেত
রাত্রির আড়ালে রাত্রি তুমি মহানিশীথের অলঙ্ঘ্য ব্যঞ্জনা
পথের জটিল লাস্য ছুঁয়ে দেখি তুমি দূর ছায়াপথিকের
আলোর গভীরে তুমি অন্ধকার হরিণের জ্বলে ওঠা চোখ
চিরবিষাদের রক্তে বেড়ে ওঠ তুমি তীব্র সুরকাতরতা
তুমিই চূড়ান্ত হর্ষ অফুরন্ত থরো থরো সিঁড়ির কিনারে
বাক্যের ইঙ্গিতগুলি নিভে এলে জ্বলে ওঠে তোমার ইশারা
সব অগ্নি তুচ্ছ, তুমি ক্ষমাহীন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দাবানল
সমস্ত জাগর দৃশ্যে তোমাকেই খুঁজে গেছি চিরজাগরণ
ঘুম শেষ হ’লে তুমি নিয়ে চলো অন্তিমের আরও গাঢ় ঘুমে
০২
তুমি তো তরল নও, তবু দেখি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মদ তুমি
যত পান করি তত অগ্নিভারে দাউ দাউ জ্বলে ওঠে স্নায়ু
শ্বেতাশ্ব ছুটেছে তীব্র মেঘে মেঘে আমি তার নির্মম সওয়ার
অস্ত্রের ঝিলিকে ভেঙে টুকরো হয়ে ঝ’রে যায় বধির আকাশ
কোন যুদ্ধে যেতে হবে বলো তবে, মর্মরিত রক্তের নিশান
হাওয়ায় দুলেছে, আর অন্তহীন মেরুদাঁড়া হয়েছে মাস্তুল
ভেসেছে নাবিক, ঘোর ঊর্মির রহস্যে ঢাকা দ্বীপান্তর তুমি
লবণের ঘন গন্ধে রাত্রি-ফসফরাসে হাসে মায়াবী দু’চোখ
নিয়ে এসো নাস্তাপানি, আজ আমি হলায়ুধ অদম্য কৃষাণ
অশ্রুতে করেছি নম্র এঁটেলের বজ্রটান, ধূলিস্নানে মজে
এবার ছড়াব বীজ কীর্তনের বাউলের, আউলা হয়ে নাচে
মেতে উঠব তালে তালে শিস দেবে এ-বাংলার রঙ্গিলা পাখিরা
০৩
ডুবুরির মতো আমি নেমে যাই জলের সুরঙ্গ খুঁড়ে খুঁড়ে
শিরস্ত্রাণ থেকে আলো ঠিকরে প’ড়ে ছিঁড়ে যায় পাথরের পথ
জলও কঠিন জেন’ – দুর্বিনীত, অভিশপ্ত, ঘন অন্ধকার
কেবলই দোলায় আর টান মারে মৃত নক্ষত্রের কালো বুকে
দিই ঝাঁপ প্রতি রাত্রে, কটিবন্ধে বাঁধা আছে অদৃশ্য রজ্জুর
সোনালি চুম্বকরেখা, অন্যপ্রান্তে কেউ কেবলই পাঠায় বার্তা –
তুলে আনো তুলে আনো মুঠো ভরে, ওগো প্রিয় ডুবুরি আমার
জলজ গাছের চারা, মাছের কঙ্কাল স্পঞ্জ কড়ি শঙ্খ নুড়ি
হয়তো সাজাব ঘর কোনওদিন ভাঙা কোনও জাহাজের বুকে
হয়তো হারিয়ে যাব নীল স্রোতে লবণের গভীর দ্রবণে
আজ শুধু নাচে ঢেউ, রুপোলি আঁশের মতো জ্বলে ওঠে চাঁদ
আর কোনও শ্রান্তি নেই ক্ষান্তি নেই, শুধু তুমি, সমুদ্র অপার
০৪
কুড়িয়ে এনেছি আজ ভাঙা ব্যাঞ্জো আশ্বিনের বর্জ্যস্তূপ থেকে
ডুবসাঁতারের ছলে যে কেবল তারাখসা জলের পাতালে
ঘুমিয়ে পড়েছে আর পৃথিবীর দৃষ্টিহীন কক্ষপথ ছিঁড়ে
কেবলই গিয়েছে সরে একা একা কল্পনার চিরনির্বাসনে
ধাতুর কঙ্কাল ঘিরে সবুজ চকমকি যেন উদ্ভিদের ক্ষুধা
তুচ্ছতম শরীরের গোপন বার্তার মতো, অসহ্য সংকেত
বয়ে যেত দিগন্তের পারাপারহীন কোনও পোড়ো আস্তাবলে
আর সেই উতরোল স্বপ্নের ঝটিকাকেন্দ্রে তুমি বসে একা
ঝংকার তুলেছ তারে, ধমনীর মহান প্লাবনে ভেসে ভেসে
ছড়িয়ে পড়েছে সুর সপ্তডিঙা নাবিকের ঘুমন্ত বন্দরে
সেই মহানিদ্রাঘোর রাক্ষসের কানে কানে আজ গিয়ে বলি
সময় হয়েছে দ্যাখো, মাতৃভাষা ফুটে ওঠে পাথরের ঠোঁটে
উঠে আসে রাঙা ব্যাঞ্জো ক্ষতস্থানে আজও উষ্ণ রক্তের প্রলেপ
জঠরের সাতপাকে হাসে অগ্নি, মহাকাল ছুঁয়ে আছে মুঠি
০৫
আমাকে প্রশ্রয় দাও হে তমসা, অনিঃশ্বাস কবরের ঘোরে
শৃঙ্খলে বেঁধেছি আত্মা, অভিশপ্ত জাদুকর যেন ভুলে গেছে
সমাধিগহ্বর থেকে ধীর পায়ে উঠে আসতে গুপ্ত সিঁড়ি বেয়ে
মঞ্চের অশ্রাব্য আলো করতালি তাকে জেন’ ফেরাতে পারে নি
চোখের তারায় আজ ঝুঁকে পড়ে দ্যাখ’ যদি সহসা ঘূর্ণন
ভ্রূকুটিতে দ্যাখ’ মেঘ আঙুলের ভাঁজে দ্যাখ’ গোপন টঙ্কার
যদি দ্যাখ’ বাহুমূল দিগন্ত-আঁধার থেকে সমূহ উদ্যত
যদি ওষ্ঠ নড়ে উঠে ভিক্ষুকের মতো চায় করুণ চুম্বন
বোলো না সংযত হতে হে তমসা, খরজ্যৈষ্ঠে মায়ার কাজল
বিগত জন্মের মতো নিষ্ঠুর হয়ো না আর ফিরিয়ো না চোখ
সিন্ধুরোল ভেঙে যদি দ্বীপান্তরে ভেসে এলে গোধূলি মান্দাস
শ্যামল আভায় তবে তুলে নাও ছিন্নমূল কররেখাগুলি
০৬
দু’হাতে প্রাচীর গাঁথি এসো আজ হৃদয়ের অন্ধকূপ ঘিরে
পাথরে ঢেকে দি’ চোখ, শ্বাসবায়ু, অতলান্তে পড়ে থাকা জল
যাতে কোনও আচম্বিত ঢেউ এসে ফণা তুলতে না-পারে কখনও
যাতে মহাশূন্য থেকে ভেসে আসা আর্ত কোনও নক্ষত্র-ইশারা
তোলপাড় না-তোলে এই শ্বাসরুদ্ধ মনীষার দুর্বল সঞ্চয়ে
এসো আজ মুছে দিই ধমনীর চিত্রপট, রঙের পিপাসা
মুছে দি’ লবণপথ, বনরাজি, শ্রাবণের মেঘে মেঘে ফেরা
মুছি বাক্য, যতিচিহ্ন, হরফের ধ্বনিহীন আর্ত হাহাকার
মুছি প্রণামের ডানা, করতল, থরো থরো ঠোঁটের বিভাষা
নিজেকেই মুছি যেন অনুলেখা কবরের পাথর ফলকে
আমি
০১
আমিও বিভক্ত জেনো, খণ্ডে খণ্ডে বিকিরিত নানা টুকরো হয়ে
যেন কেউ প্রতিবেশী, জানালা টপকালে কারও ভাঙাচোরা মুখ
কেউ অর্ধপরিচিত, কেউ বন্ধু মেঘে মেঘে অস্পষ্ট বৃষ্টিতে
কেউ অনাবাসী দূর সিন্ধুতীরে স্বেচ্ছানির্বাসিত, ভাষাহীন
মুখচ্ছবিহীন তার হাঁটাচলা, রাত্রি ঘিরে হাঁটু মুড়ে বসা
উদ্ধত গর্জন আর সহসা কান্নায় ভেঙে পড়া গানগুলি
চিরঅচেনার মতো থেকে যায় রক্তঢেউ স্মৃতির ওপারে
তবুও রয়েছে তারা, রয়েছে কথোপকথনের চাপা স্বর
কত না আকুতি, জেদ, পরামর্শ, প্রার্থনার বিষণ্ন সোপান
কাঁধে হাত রেখে চলা, ছুঁড়ে ফেলা, ঘৃণায় লজ্জায় প্রতিশোধে
কত চিহ্ন বিনিময় ধ্যানে জ্ঞানে অগোচর ব্যর্থতা উল্লাসে
স্তরে স্তরে পুঞ্জে পুঞ্জে বিভক্তি প্রত্যয়ে গাঁথা নকশিকাঁথা জুড়ে
অজস্র হারায় তার চৈত্রঝড়ে করতলশিথিলতা বেয়ে
হয়ত সামান্য মাত্র কেঁপে ওঠে অভ্রখচা সুবর্ণরেখায়
০২
নিজেকে বুঝি না, তাই বোঝাতে পারি না এই পথের তমসা
কেন যে খনির মর্মে জ্বলে ওঠে অশ্রুদীপ, নিভে যায় কেন
আঁধার সুরঙ্গ বেয়ে ছুটে আসে ঘনঘোর জলের চেতনা
দোলায় ভাসায় নাচে টান দেয় পাকে পাকে মৃত্যুর ইশারা
ব্যবহার-বিধি, সভা, ভাষার মরিচা নিয়ে মত্ত জনপদ
ছুটে আসে পিছু পিছু ছুঁড়ে দেয় জাল, দড়ি – যেন মহাত্রাতা
আমি সে-জীবনরেখা ছুঁতেও পারি না, শুধু প্রাণপণে দেখি
জনপদ শেষে হ’লে এখনও আকাশে কাঁপে রক্তমাখা চাঁদ
ভয় করে! প্রতিটি সঞ্চিত পাপ একে একে খুবলে নেবে চোখ
ছিঁড়ে ফেলবে জিহ্বা-ওষ্ঠ দন্তরুচি, খসে পড়বে লিঙ্গ অণ্ডকোষ
তবু কি দুর্বৃত্ত পথ স্পষ্ট হবে, ফুটে উঠবে সোপান সারণি?
মহাপ্রলয়ের দিন তবু কি জানাবে প্রচলিত লোকগীতি?
০৩
কেন যে হারাই চোখ, দিগন্তকে স্পর্শ করা মুঠির ইশারা
গাছের পাতার মীড়ে ডুবে যাওয়া ছায়াভিক্ষুকের কাতরতা
চাঁদের ত্বকের মতো অতল গহ্বর থেকে ভেসে আসা ডাকে
কেন যে বধির মর্মে পারি না প্রস্ফুট করতে আগুনের ফোঁড়
কেন রাত্রিস্তব্ধতার বেদীমূলে ছিন্ন করতর্জনীর শোকে
কেবলই তন্দ্রার দিকে ঢলে যাই, তবু স্বপ্নপাতালের ছবি
তবু পথ – দিগ্বিদিকে ছুটে যাওয়া ধিকিধিকি পুঞ্জ পুঞ্জ পথ
ভ্রূ থেকে কেন যে ঝরে, যেন জ্বরতপ্ত জলপটি, স্মৃতিহীন
কেন যে ঝরনার শব্দ মুছে আসে ধমনীর অতল প্রবাহে
পাথরের গর্ভমুখে কান রাখি : রয়েছে কি গোপন কম্পাস
আছে কি মানচিত্র, তবে আনো দেখি দড়িদড়া গাঁইতি ও শাবল
আনো মেরুচূড়া, আনো সিঁড়িতে সিঁড়িতে গাঁথা সুরঙ্গের ডানা
তবে কি প্রার্থনাভঙ্গি ফিরে আসে অশ্রুদের স্তব্ধ চরাচরে?
তবে কি স্পর্শের কিছু নেই এই সারিবদ্ধ কাতরোক্তি ছাড়া?
০৪
প্রতিদিন আঁকি পথ, প্রতিদিন তার চিহ্ন মুছে মুছে যায়
কোথায় চলন শুরু, কোনখানে চুপিসাড়ে নিতে হবে বাঁক
কোথায় ধরেছে চিড়, উঠে আসে অন্ধকার পাতালের থাবা
কোথায় ভাঙন গেছে পায়ে পায়ে চাঁদে-পোড়া নদীর কিনারে
সহসা গমনভঙ্গি দ্বিধা হ’য়ে দুই বাহু দু’দিকে উদ্যত
কোথা যে গন্তব্য কার – কোনওদিকে ধিকিধিকি বালির হাতছানি
হাওয়ার কাঁপনে শূন্যে ফুটে ওঠে শুশ্রূষার আলেখ্যবিভ্রাট
কোনও দিক চলে গেছে হিমাঙ্ক পেরিয়ে আরও বরফের নিচে
হয়ত তৃতীয় কোনও বিকল্পও আছে ঘোর অবচেতনায়
ঝোপঝাড় লতাগুল্মে লাফ দিয়ে পড়া ওই সর্পিল রেখায়
যে-পথ গিয়েছে চলে শ্রাবণপ্রান্তর ছোঁয়া মেঘনীলিমায়
শ্যামল গন্ধের ভারে রোমকূপ ভরে ওঠে মৃত্তিকামায়ায়
এ-পথ আঁকিনি আমি, এই পথ বয়ে আসা বাংলা কবিতার
এই পথ সভাহীন রাষ্ট্রহীন ক্ষমাহীন কালপুরুষের
০৫
জ্বলন্ত সেতুর বুকে ছুটে যাই শ্বাসরুদ্ধ একা অশ্বহীন
আকাশে থমথমে মেঘ, মাঘের সংক্রান্তি ঘিরে এলোমেলো হাওয়া
পেছনের পথরেখা মুছে যাচ্ছে ঝরে যাচ্ছে অভ্যস্ত কবচ
ছিঁড়ে যাচ্ছে জন্মগ্রন্থি, বিশাল তোরঙ্গ-বন্দি রাঙা রূপকথা
শিকারি কুকুরগুলি ছুটে আসছে পিছু পছু মাংসের নেশায়
খচ্চরের পিঠে কেউ পাঠিয়েছে প্রেতসিদ্ধ ভাষার কঙ্কাল
বিষাক্ত হুলের বর্শা ঘাড়ে ক’রে উড়ে আসছে লক্ষ লক্ষ মাছি
আমারই স্খলিত বীর্যে অর্ধকামে বিকলাঙ্গ ভূমিষ্ঠ শিশুরা
তবে কি ওপারে মুক্তি, শ্যাম শষ্প তরুগুল্ম বনস্পতি ঘেরা?
অথবা মেছুয়াপল্লী – জাল দড়ি শুঁটকি মাছ উল্টানো নৌকার
পেছনে আলকাতরা লেপা, গলুয়ের আঁকা-চোখে স্বপ্ন কলরোল?
না কি সে দর্পণ মাত্র, ঠিকরে দেবে আরও এক ঘাতক শহর?
সমস্ত কুয়াসাঢাকা, কিংবা চোখ দ্বিধাগ্রস্ত অশ্রুবাষ্পময়
সেতুর ওপারে তবে মাথামুণ্ডু অশ্বডিম সম্পূর্ণ অজানা
এখন আগুনই সত্য সর্বব্যপ্ত একমাত্র দ্যোতনার ধ্বজা
পেছনে অতীত, সামনে ঝাপসা ভবিষ্যৎ, মাঝে সামান্য যোজক
০৬
জীবন্ত আগুনে আজ জ্বলে যাচ্ছে কারুকার্য ভাষার আড়াল
উপমা সংকেতলিপি ইঙ্গিতগূঢ়তা শ্লেষ – সব পুড়ে ছাই
পুড়ে যাচ্ছে যত্নে গড়া আলো-আঁধারির রঙে আঁকা ছদ্মবেশ
লুকানোর রাস্তা নেই, সমস্ত পৃথিবী দেখছে কোটি চক্ষু মেলে
যা ছিল গোপন ক্ষত অরণ্যের চোরাপথে নিভৃত ছাউনি
তৃণবৎ উড়ে যাচ্ছে চূড়ান্ত বাতাসে তার নাজুক নির্মাণ
অকূল নগ্নতা এসে মেলে ধরছে ক্ষমাহীন ভাষার কঙ্কাল
মহাবিশ্ব ছেদ ক’রে প্রতিটি নক্ষত্রপুঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে আলো
তবে কি সমুদ্রগর্ভে ছুটে যাব, লুকাব এ-জিহ্বাজটিলতা?
কিন্তু জিহ্বা যন্ত্রমাত্র, ভাষা? সে তো উৎসারিত অন্তহীন মনে
কীভাবে শমিত করব তার ডানা, ছিঁড়ে ফেলব ক্ষুধার্ত শেকড়
গভীর সুরঙ্গ থেকে সে যে তবু ছুঁড়ে দেয় উদ্ধত প্রলাপ
০৭
উন্মাদের হাসি ওই ভেসে আসে পাথরের দুর্গ ভেদ ক’রে
চোরাচালানির হাতে নিষিদ্ধ গ্রন্থের মতো নক্ষত্রখচিত
ইঁদারার কালো গর্ভে যেভাবে চুরমার হয় প্রতিধ্বনিমালা
রাত্রির আকণ্ঠ তন্দ্রা মুছে যায় ছুটে আসা উল্কার স্তবকে
সে-হাসি পথের ধারে একাকী বৃক্ষের মতো মেলে ধরে ছায়া
ভ্রমণের পিছু পিছু ধেয়ে আসে কখনও বা, যেন আততায়ী
কখনও গম্ভীর রিক্ত সর্বনাশা অভ্রলেহী, কখনও ভিখারি
বঙ্কিম চপল নৃত্যভঙ্গিমায় ভেঙে পড়া উদ্ধত আকুল
সে-হাসি জন্মের মতো কেড়ে নেয় দুই চক্ষু বিষাক্ত ছোবলে
আলো আর অন্ধকারে কেঁপে ওঠা মহাজল দুয়ারে দুয়ারে
রাত্রিকে বানায় দিন, দিনকে বানায় মেঘ, ছোটে অশ্বারোহী
ধুলোয় ধুলোয় লেখে ইতিহাস, মুছে দেয়, বাজায় খঞ্জনি
কখনও স্তব্ধতা নামে, বোধিগাছ থেকে টুপ ঝরে পড়ে পাতা
রক্তের সঞ্চয় থেকে তুলে আনে হাসি তার অজ্ঞতার ভাষা
কেঁপে ওঠে তারাগুলি, হাওয়া বয় অন্তহীন মহাশূন্য ঘিরে
উন্মাদের হাসি শুধু জেগে থাকে মৃত্যুহীন বন্দরের আলো
০৮
ছড়িয়ে পড়েছি যেন কেন্দ্রহীন ধোঁয়ার পরিধি, প্রতিদিন
খানা ও খন্দের খাঁজে সামান্য কল্পনাহীন জলের কান্নায়
অন্ধ গলিঘুঁজি চিরে ছন্নছাড়া কুয়াসার ভিক্ষা প্রলোভনে
মেঘে ও মাটিতে, যমে, নিয়মের অন্ধকার কব্জায় কোটরে
ঝরে গেছে সুর এই চোখ থেকে, ঘন চুল থেকে, প্রতিদিন
ঝরেছে ঘ্রাণ ও স্পর্শ, অন্তরাল, একাকিত্বে যৌথ অভিযান
ঘরের নিবিড় স্বপ্ন, পথে পথে নক্ষত্রখচিত হাহাকার
হাঁসের শরীর থেকে পালকেরা চৈত্রঝড়ে যেভাবে ঝরেছে
এখন দু’চোখে ঘুম, চরাচর অনর্গল মুছে মুছে যায়
রাত্রি-অন্ধকারে তবু একা একা শীর্ণ পায়ে বেরিয়ে পড়েছি
প্রতিটি পালক ওই অকাতরে ঝরে যাওয়া পরমহংসের
কুড়াব দু’মুঠো ভরে, একে একে গুঁজে রাখব শরীরের ভাঁজে
আবার জড়িয়ে আসবে ঘন হয়ে মাঞ্জাসুতো লাটাইয়ের পাকে
তারপর দিকে দিকে উড়ে যাবে আলো-ঝলমলে ঘুড়িগুলি
০৯
সুরঙ্গের গর্ভ থেকে ছুটে আসে প্রতিধ্বনি তৃষ্ণার্ত থাবায়
যত তাকে মুছে দিই মনে মনে, যত ছিঁড়ি গোপন ডাকনাম
শূন্যতার মর্ম থেকে তবু কেন ভেসে আসে সিন্ধুকলরব
যেন রুক্ষ বর্গক্ষেত্র ভেদ ক’রে ফুটে উঠল বৃক্ষের উড়াল
আর তার ছায়াপুঞ্জ বল্কল কোটর কাণ্ড পাতা ও শেকড়
ছুঁড়ে দেয় লক্ষ হাত, কেবলই জড়াতে চায় নশ্বর প্রতিভা
বলে – বৃত্তপথ, তুমি যতই ছড়াও শূন্যে মহাবিশ্বলোকে
ছুটন্ত বিন্দুর চোখ ভেসে যাক যতদূর শ্যামনীলিমায়
জেন’ এ-ভাষার লিপ্সা জন্মান্ধ কান্নার সুর হাহাকারগুলি
বেজে যাবে অন্তহীন ধমনীর গাঢ় স্পন্দে সুপ্ত নাভিমূলে
আর সেই গুহামুখ ব্যাসার্ধের মতো এক অদৃশ্য রজ্জুতে
বেঁধে রাখবে পরিধিকে, ছুঁড়ে দেবে প্রতিধ্বনি স্তবকে স্তবকে
বুঝি, এ ভ্রমণ মায়া, নিঃসঙ্গ সঞ্চারপথও দূরনিয়ন্ত্রিত
যেহেতু চোখের তারা বাউলের হাতে উঠে বেজেছে বাংলায়
১০
এসো আজ পাঠ করি মেঘের অস্ফুট বার্তা ছায়াভাষ্যগুলি
সমুদ্রের শ্যামগর্ভ কোন্ চিহ্ন এঁকে দিল লবণাক্ত চোখে
অবলুপ্তি ছিন্ন ক’রে অরণ্য পাঠাল কোন্ আরূঢ় ইশারা
কোন্ মেরুচূড়া থেকে ভেসে এল চারুপাঠ, ইয়েতির হাসি
পাঠ করি ধূলিকণা, মৃত্তিকার আঁকাবাঁকা নদীমুগ্ধ বাঁশি
জলৌকার চোরাটান, গঞ্জে ও বন্দরে বোনা কাহিনির জাল
জটিল শহর ছিঁড়ে উঠে আসা রাজনীতি, ঘুড়ির কঙ্কাল
দাবার উলটানো ছক, ভোরের ময়দান আর বন্ধ মিলগেট
পাঠ করি চুপি চুপি রোদের উল্লাসে কেঁপে-ওঠা ক্লোরোফিল
বীজের রহস্য, যেন দৃশ্যাতীত অনিরুদ্ধ জলতরঙ্গের
সারি সারি অন্ধ সুর এইমাত্র মেলে দেবে চোখের প্রার্থনা
পড়ি আগুনের ভাষা, প্রতীক্ষায় থরো থরো লুপ্ত অভিষেক
এসো পড়ি নিজেকেও, কী আছে সে-গুহাচিত্রে সোপানের স্তরে
সুরঙ্গের অন্ধকারে হরফে হরফে গাঁথা কোন্ প্রত্যাদেশ
রক্তের তুমুল স্রোতে দূর থেকে ভেসে আসা নিশানের ভাষা
পাঠ করি বাক্য আর প্রতিধ্বনি খুলে দেয় অদৃশ্য পাথর
১১
আবার নতুন ক’রে পাঠ নিই এসো তবে স্বরবর্ণ থেকে
কণ্ঠনালী থেকে শ্বাস ছুটে আসে মুখগর্ভে বিভিন্ন ভঙ্গিতে
ওষ্ঠ তাকে ছুঁড়ে দেয় বিনাবাক্যে সন্নিহিত আকাশের বুকে
যেন শূন্যে আঁকা হচ্ছে সারি সারি স্বপ্নলব্ধ চুম্বনভঙ্গিমা
জেগে ওঠে নাদব্রহ্ম, নদী উৎস থেকে সুর নেমে আসে ঢালে
ছোটে মোহানার দিকে, তীরে তীরে জেগে ওঠে আর্ত জনপদ
অতঃপর জ্বলে চুল্লি, জঠরাগ্নি শান্ত করতে অন্ন ও ব্যঞ্জন
বাধাগ্রস্ত স্বরগুলি ভেঙে পড়ে মর্মে মর্মে মূর্ছিত ধ্বনিতে
এবার ব্যঞ্জনবর্ণ। কণ্ঠ তালু মূর্ধা দাঁত ঠোঁট ছুঁয়ে ছেনে
উঠে আসে কত শ্বাস, ঝুঁকে পড়ে, টান দেয়, জড়ায় মুঠিতে
গভীর গম্ভীর কেউ, কেউ উষ্ণ, কেউ স্পৃষ্ট, কেউ তীব্র শিসে
বাতাস মন্থন ক’রে ছুটে যায়, কেঁপে ওঠে আত্মার আত্মীয়
এ-কম্পন শেষ হয় অনুস্বর বিসর্গ ও চন্দ্রবিন্দু দিয়ে!
১২
ধুলো থেকে শুরু করি, আহ্লাদী নগর যদি চূর্ণ হয়ে গেছে
আমর্ম সভ্যতা স্তব্ধ, তার কাটা, নিষ্প্রদীপ ছিন্ন শালখুঁটি
পথে পথে আর্ত চিড়, সংযোগচিহ্নের বুকে অজস্র ফাটল
সুরঙ্গের বুকে ধায় উড়ন্ত গ্রন্থের পৃষ্ঠা, জোনাকিরা, যদি
যদি বাক্য ডানাঝরা নদীর চড়ার বুকে পাখির কঙ্কাল
স্বপ্নের কপাল কেটে গড়িয়ে চলেছে বাঁকা শ্যাম রক্তরেখা
ফসলের স্রোতে হুহু ভেসে আসে একচক্ষু কীটের ইশারা
যদি মাটি ভেদ ক’রে উঠে আসে অন্ধকার স্তবকে স্তবকে
তবু শুরু ধুলো দিয়ে, জাদু নেই, আছে রক্তে আদিম পৃথিবী
আছে নদী মৃত্যুহীন, অস্থি-র কোটরে আছে মেঘের সঞ্চয়
আছে পথ হৃদিমধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া ডুবে যাওয়া আধোনীলিমায়
আবার নামাব বৃষ্টি, আজানের শব্দে যেন নেমে আসবে ভোর
ধুলো থেকে হব তৃণ, তৃণ থেকে ছায়াচ্ছন্ন গুল্মকুঞ্জলতা
আবারও বৃক্ষের দিকে মেলে দেব ডালপালা ধুলোয় ধুলায়
১৩
যেখানে পথের শেষ, সেই স্তব্ধবিন্দু থেকে শুরু হোক চলা
যেখানে আলোর ঢেউ চূর্ণ হয়ে ভেঙে গেছে অন্ধকণিকায়
যেখানে নিষ্পত্র গাছ, বিবর্ণ তৃণের গুচ্ছ, ছায়াহীন মাটি
নদীতে রক্তের স্রোত, সমুদ্র যেখানে মত্ত ফুটন্ত লাভায়
সুড়ঙ্গের প্রান্তমুখ যেখানে পাথরচাপা, বাতাস গম্ভীর
শ্বাসরুদ্ধ গন্ধকের অনর্গল কুণ্ডলিত ধোঁয়ায় আবিল
আকাশে নক্ষত্র নেই, চন্দ্র সূর্য রসাতলে, আদিম ভয়াল
একচক্ষু ময়ালের ক্ষুধার্ত চোয়াল থেকে ঝরে পড়ে ক্ষার
যেখানে পাখির গান ধীরে ধীরে শুষে নেয় মাকড়সার জাল
পর্বত যেখানে ভীরু, নতজানু, বামন দৈত্যের পদনখে
শহর শাসন করে যেখানে হৃদয়হীন গভীর আসবাব
নিথর সড়কদ্বীপ ভরে যায় ক্ষমাহীন ভাষার কঙ্কালে
শুরু হোক সেখানেই, যেখানে সমস্ত দৃশ্য কুয়াসালাঞ্ছিত
যেখানে সমাপ্তি বলে মনে হ’ল, জেনো তা-ই পথের সূচনা