অক্সফোর্ডের কষ্টার্জিত বৃত্তি পাবার পর আমার লেখালেখি করার সময় এসেছে বলে মনে হল। কিন্তু বাস্তবে আমার লেখার শূন্য থলিটা একেবারে ফাঁকাই রয়ে গেল। ফিকশন আর উপন্যাস লেখার কাঠামোটা আমার কাছে তখনও মস্ত ধাঁধার মতো, যেখানে উপন্যাসের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হচ্ছে এটি হলো একটি কল্পকাহিনী বা ফিকশন তৈরি করা ; অন্যদিকে আবার এই কাহিনী হতে হবে সত্যের মতো, জীবন থেকে নেয়া। সুতরাং সংজ্ঞার দ্বিতীয় অংশটা তার প্রথম অংশ অর্থাৎ ফিকশন তৈরির ধারণাকে বাতিল করে দিয়ে বাস্তবতাকে দেখতে বলে, এবং উপন্যাসের এই বিষয়টিই আমাকে ধন্ধে ফেলে দিত।
পরবর্তীকালে আমি যখন আমার লেখার বিষয়বস্তু আর উপকরণগুলো চিনতে শুরু করলাম এবং নিজের প্রজ্ঞার উপর ভর করে আংশিক বা পুরোপুরি লেখক হয়ে উঠলাম তখন উপন্যাসের সংজ্ঞা বিষয়ক এই অস্পষ্টতাটুকু দূর হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্য এই পরিবর্তনটা আসে ১৯৫৫ সালে। এ সময় ইভলিন ওয়াট এর দেয়া ফিকশনের সংজ্ঞাটি (ঐ বছর প্রকাশিত ইন দ্য ডেডিকেশন টু অফিসারস অ্যান্ড জেন্টলম্যান-এ ওই সংজ্ঞাটি ছিল) আমি পড়ি। ইভলিন বলেছেন ফিকশন হচ্ছে “সম্পূর্ণভাবে রূপান্তরিত অভিজ্ঞতা।” কয়েক বছর আগে হলে এই সংজ্ঞাটি আমি বুঝতাম না, বুঝলেও হয়ত সেটি বিশ্বাসে নিতে পারতাম না। কিন্তু ১৯৫৫ সালে ইভলিনের দেয়া এই সংজ্ঞাটিই আমাকে ফিকশন লেখা বিষয়ক ধাঁধার জবাব দিয়ে দেয়।
এর প্রায় চল্লিশ বছর পর, টলস্টয়ের সেবাস্টোপোল স্কেচেস পড়তে গিয়ে লেখক হিসেবে নিজের প্রথম দিককার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে যায়। ফিকশনের সংজ্ঞা বুঝতে পারার পর আমার সামনে যেন একটা বন্ধ পথ খুলে গিয়েছিল। সেবাস্টোপোল স্কেচেস এর মধ্যে আমি যেন তরুণ টলস্টয়কে দেখতে পেলাম; যে ফিকশন আবিষ্কারের তীব্র নেশায় ছুটে বেড়াচ্ছে। টলস্টয় শুরু করেছিলেন সাবধানী বর্ণনামূলক লেখা দিয়ে (সে সময় তার লেখার ধরন ছিল রাশিয়ার লেখক উইলিয়াম হাওয়ার্ড রাসেলের মতো, যিনি বয়সে টলস্টয়ের চেয়ে খুব বেশি বড় ছিলেন না। রাসেল ছিলেন টাইমস পত্রিকার নিয়মিত লেখক)। এরপর টলস্টয় সেবাস্টোপোল নগরী দখলের ভয়াবহতা আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় আরেকটি সহজতর পথ খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে তিনি একসময় সেটি পেয়েও গেলেন। এই সহজতর পথটিই হলো ফিকশন —যেখানে চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলে বাস্তবতাকে পাঠকের আরো কাছে নিয়ে আসা যায়।
লেখালেখি নিয়ে টলস্টয়ের মতোই একটা আবিষ্কার আমি করেছিলাম। তবে সেটি অবশ্যই আমার অক্সফোর্ড জীবনে নয়। অক্সফোর্ডে তিন বছরের কোর্স করার সময় আবিষ্কার করার মতো কোন জাদুকাঠির ছোঁয়া আমি পাইনি। এমনকী ঔপনিবেশিক সরকারের দেয়া আরেকটি বাড়তি বছরও আমার লেখালেখির কোন কাজে আসেনি। এ সময়টুকুতে ফিকশনের পুরোনো সংজ্ঞা অর্থাৎ গল্প তৈরি করার সংজ্ঞা নিয়েই আমাকে তৃপ্ত থাকতে হয়েছিল। এই তৈরি করা গল্প (কনরাডের ভাষায় ‘দুর্ঘটনা’) নিয়ে কতখানিই বা লেখা যায়? এ ধরনের লেখার মূল্য বা যৌক্তিক কারণই বা কী হতে পারে? এ রকম আরো অনেক নিরাশা ছাড়াও সেসময় আমি আরো উপলব্ধি করলাম যে লেখকদের অন্যান্য যে সব গুণ থাকা প্রয়োজন সেগুলোও আমার নেই। আমার ব্যক্তিসত্তা একজন লেখকের ব্যক্তিত্বের সাথে হাস্যকরভাবে সামঞ্জস্যহীন। একটা টেবিলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে লেখার চেষ্টা বা ভান করার ভেতর আমি কোন আনন্দ পাই না। এ ধরনের চেষ্টায় নিজেকে আমার আত্ম-সচেতন আর নকল লেখক বলে মনে হয়।
এ অবস্থায় লেখক হবার বাসনাটাকে আমার ছেলেবেলার ছেলেমানুষী খেয়াল বলে মনে হতে থাকে। বলা যায় লেখক হবার ইচ্ছাটা একটা বোঝার মত ধীরে ধীরে আমার উপর চেপে বসতে থাকে। হাতে যদি অল্প কিছু টাকা অথবা ভাল কোন চাকরির সুযোগ থাকতো তবে হয়ত লেখালেখির ইচ্ছটাকে আমি সেখানেই বিসর্জন দিতাম। কিন্তু যেহেতু আমার হাতে টাকা-পয়সা বা অন্য কোন উপায় ছিল না। তাই ঐ ইচ্ছাটার ওপরই নির্ভর করে আমাকে বসে থাকতে হলো।
তখন আমি প্রায় নিঃস্ব। বৃত্তির সব টাকা বেহিসাবী খরচের ফলে কেবল বাড়ি ফেরার বিমান ভাড়াটুকই বাকি আছে। নিজের পকেটে মাত্র ছয় পাউন্ড সম্বল করে আমি লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার বাসনায় অক্সফোর্ড ছেড়ে লন্ডনে চলে এলাম। এই চরম দুঃসময়ে আমার চেয়ে বয়সে বড় এক খুড়তুতো ভাই আমাকে আশ্রয় দেয়। ভাইটি নিজেও তখন মারাত্মক অর্থকষ্টে ছিল। সিগারেট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে নিজের পড়ার খরচ সে নিজেই চালাতো। আমার লেখক হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সে যথেষ্ঠ সম্মান করতো। লন্ডনের পরবর্তী পাঁচটি মাস আমি তার সাথে প্যাডিংটনের বেসমেন্টের অন্ধকার এক কুঠুরিতে কাটিয়ে দিলাম।
এই পাঁচ মাসে আমার লেখালেখির কোন উন্নতি হয়নি। পরবর্তী পাঁচ মাসও একইভাবে কেটে যায়। এরপর বলা যায় একদম হঠাৎ করেই একদিন আমি লেখার বিষয়বস্তু খুঁজে পেলাম। ভেবে দেখলাম, ছেলেবেলার যে মিশ্র সংস্কৃতির শহরে আমরা আগুন্তুকের মতো নিজেদের আটকিয়ে রাখতাম, সেটা নিয়েই তো লেখা যায়! অথবা তারও আগের গ্রাম্য জীবন যেখানে ভারতীয় জীবনের আচার আচারণের স্মৃতিকে আমরা বাস্তবে রূপ দিতাম, সেটাও লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে। উপকরণগুলো খুঁজে পাবার পর এগুলো নিয়েই লেখাটাই সহজ আর অবশ্যম্ভাবী মনে হল; নিশ্চিত হতাশার অন্ধকারে আমি একটু একটু করে আশার আলো দেখতে শুরু করলাম। এই পথটা খুঁজে পেতে আমার প্রায় চার বছর সময় লেগেছিল। প্রায় একই সময়ে আমি লেখার উপযুক্ত ভাষা, লেখকের কণ্ঠ আর কণ্ঠের ধরনও খুঁজে পেলাম। মনে হলো লেখকের কণ্ঠ, বিষয়বস্তু আর কাঠামো যেন একে অন্যের সাথে পূর্বনির্ধারিতভাবে অঙ্গাঅঙ্গি জড়িত ছিল।
ভাষা প্রদানকারী সেই কণ্ঠের একটা অংশ আমি আমার বাবার কাছ থেকে পেলাম। আমাদের গ্রাম্য জীবনে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর গল্প বাবা এই স্বরেই বলতেন। কণ্ঠের আরেকটা অংশ ষষ্ঠ শতকের অজানা স্প্যানিশ লেখকের লেখা লাযারিলো থেকে এল। (অক্সফোর্ডের দ্বিতীয় বছরে আমি পেঙ্গুইন ক্লাসিক প্রকাশনীর সম্পাদক ই.ভি রিউ কে লাযারিলো অনুবাদ করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে আমাকে স্বহস্তে লিখে চিঠির উত্তর পাঠিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, লাযারিলো অনুবাদ করাটা খুবই দুঃসাধ্য এবং এটিকে তিনি ক্লাসিক বলে গণ্য করেন না।) এরপরও আমার লেখালেখি না করতে পারা সময়টাতে আমি কোন কাজ না পেয়ে লাযারিলো এর সম্পূর্ণ অনুবাদ করে ফেলেছিলাম। বাবা এবং লাযারিলো থেকে পাওয়া কণ্ঠ দুটির মিশ্র ভাষা আমার লেখার জন্য একেবারে মিলে গেল। প্রথম যখন এই ভাষায় লেখা শুরু করলাম তখনও এটি পুরোপুরি আমার নিজের না থাকলেও এতে লেখালেখি করতে কোন অসুবিধা হয়নি। ধীরে ধীরে ভাষাটি আমার আয়ত্তে চলে আসে। আসলে লেখার কণ্ঠটিকে খুঁজে বের করতেই আমার সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম হয়েছে। তারপর মাথার ভেতর এই কণ্ঠের কথা বলায় আমি অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। এভাবে আস্তে আস্তে কখন এই কণ্ঠটা সঠিক বলছে আর কখন ভুলের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে শিখলাম।
লেখক হিসেবে লিখতে শুরু করার জন্য আমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হলো। মনে মনে আমাকে পেছন দিকে হাঁটতে হলো, অক্সফোর্ড আর লন্ডন ভুলে যেয়ে ছেলেবেলার সাহিত্যজ্ঞানকে ঝালাই করতে হলো। এসব জ্ঞানের মধ্যে কিছু ছিল, যা নিয়ে আমি কখনোই কারো সাথে আলোচনা করিনি। আর সেগুলোই নিজের চারপাশ সম্পর্কে আমার একান্ত ধারনাগুলো গড়ে তুললো।
(চলবে)