আমার পড়ালেখা — ভিএস নাইপল ।। ভাষান্তর: মূর্তালা রামাত ও শারমিন শিমুল ।। পর্ব ১১

                                                  পর্ব ১১

১৯৬১ সালে নারায়ণের সাথে লন্ডনে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি তখন ভারতে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নারায়ণ আমাকে বললেন যে তিনি দেশে ফিরে যেতে চান। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তার প্রাত্যহিক হাঁটাহাঁটি  (রোদ থেকে বাঁচার জন্য একটি ছাতা তার হাতে থাকত) আর তার চরিত্রদের কাছে তাকে ফিরে যেতেই হবে।

 

নিজের জগতে নারায়ণ নিজেই অধিকর্তা ছিলেন। তার জগতটা ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, কেবল তার আগমনের অপেক্ষাই সেখানে বাকি ছিল। নারায়ণের সেই জগতটা বহির্বিশ্বের প্রাণকেন্দ্রের সমস্ত কর্মকাণ্ড থেকে এতাটাই দূরে যে গোলযোগের শব্দ সেখানে পৌঁছানোর পথেই মারা যেতো। এমনকী উনবিংশ শতকের ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাপও সেই জগতকে স্পর্শ করতে পারেনি। সেই জগতে বৃটিশদের উপস্থিতি বলতে ছিল কেবল রাস্তাঘাট আর দালান-কোঠার বৃটিশ নামকরণ। নারায়ণের সৃষ্ট ভারত যেন বৃথা গর্ববোধকে ব্যাঙ্গ করে নিজের পথেই নিজের মতো চলতো।

 

একের পর এক রাজবংশের উত্থান হয় তারপর পতন ঘটে। প্রাসাদ আর ভবন গড়ে ওঠে আবার অদৃশ্যও হয়ে যায়। পুরো দেশ আক্রমণকারীর  তরবারির নিচে জ্বলে ওঠে। আবার সারাযু’র (স্থানীয় নদী) দুকূল ছাপিয়ে গেলে সে আগুনও নিভে যায়। কিন্তু চিরকালই এর পুর্নজন্ম আর বিস্মৃতি ঘটে।

নারায়ণের এই দৃষ্টিভঙ্গি (যা তার অন্যান্য বই থেকে অধিকতর আধ্যাত্মিক) থেকে দেখা যাচ্ছে যে আগুন আর পরাজয়ের তরবারিকে তিনি কেবল সার-সংক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সত্যিকারের কোন কষ্টের বর্ণনা সেখানে নেই আর পুনর্জন্ম যেন অলৌকিকভাবেই ঘটে। নারায়ণের গল্পে বর্ণিত নিম্নবর্ণের নিম্নবর্গের মানুষেরা ছোট ছোট কাজ করে সামান্য পরিমাণ আয় করে। তাদের জীবন জুড়ে আছে তাদের আচার-আচরণ, যা দিয়ে তারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অদ্ভুত এক উপায়ে এইসব মানুষেরা ইতিহাসের স্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা যেন হাওয়া থেকে সৃষ্টি হয়েছে। একটু খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে তাদের কোন আদি পুরুষ নেই। নারায়ণের চরিত্রদের কেবল বাবা, খুব বেশি হলে দাদা থাকে; তাদের সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি অতীতের খবর পাওয়া দুষ্কর। চরিত্রগুলো প্রাচীন মন্দিরে ঠিকই যাওয়া-আসা করে, কিন্তু ঐসব মন্দিরের প্রাচীন নির্মাতাদের ওপর ভরসা করতে পারে না। অন্যদিকে তারা নিজেরাও এমন কিছু তৈরি করতে পারে না, যা কালের আঘাতে টিকে থাকতে পারবে।

 

কিন্তু, নারায়ণের বর্ণনায় যে দেশকে আমরা দেখি তা পবিত্র এবং সেই দেশের একটি অতীত আছে। উপরে উল্লেখিত তার আধ্যাত্মিক ধরনের উপন্যাসটিতে একটি চরিত্র তিনি সৃষ্টি করেছেন। চরিত্রটি সাধারণ নাটকীয় ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে মনের চোখ দিয়ে ভারতের অতীতের একটি সাধারণ চিত্র দেখার সৌভাগ্য লাভ করে। এইসব ধারাবাহিকতার প্রথমটি হচ্ছে ১০০০ খৃস্টপূর্বের রামায়নের একটি চরিত্র, দ্বিতীয়টি ৬০০ খৃস্টপূর্বের মানুষ বুদ্ধ, তৃতীয়টি নবম শতকের দার্শনিক শঙ্কারাচার্য, চতুর্থটি প্রায় এক হাজার বছর পরে বৃটিশদের আগমনের সময়কালের একটি চরিত্র। বর্তমান সময়ের স্থানীয় ব্যাঙ্ক ম্যানেজার শিলিং সাহেবের মাধ্যমে নারায়ণের গল্পের এই ধারাবাহিকতা শেষ হয়।

 

তার তৈরি করা নাটকীয় এই ধারাবাহিকতায় মুসলিম আক্রমণের শতকগুলো এবং মুসলমানদের শাসনামলের সময়কাল খুঁজে পাওয়া যায় না। নারায়ণের ছেলেবেলা  কেটেছে মহিশূর রাজ্যে। মহিশূরের একজন হিন্দু মহারাজা ছিলেন। বৃটিশরা মহিশূরের মুসলমান শাসককে পরাজিত করার পর ঐ হিন্দু রাজাকে সিংহাসনে বসায়।  হিন্দু ঐ মহারাজা এক প্রসিদ্ধ বংশের মানুষ ছিলেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিল দক্ষিনের বিখ্যাত হিন্দু রাজত্বের শাসক। ১৫৬৫ সালে সেই হিন্দু রাজত্ব মুসলিমদের কাছে পরাজিত হয়। এবং সেই সাথে ধ্বংস হয়ে যায় রাজ্যের জাঁকজমকপূর্ণ রাজধানী (শহরের প্রসিদ্ধ জ্ঞানী-গুণীজনেরাও মারা যান)। কেবল পড়ে থাকে দরিদ্র এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি রাজ্য যার সৃষ্টিশীল মানুষেরা সবাই মৃত। জায়গাটি দেখে কে বলবে যে ঐখানে এক সময় এক মহান সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। রাজধানীর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে মহিশূর শহর মাত্র এক দিনের পথ। এখনও সেই ধ্বংসস্তুপের চিহ্ণ বিদ্যমান যা চার শতাব্দী পরেও খুন, লুট, মৃত্যু আর হিন্দুদের পরাজয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।

 

তাই নারায়ণের লেখা নিয়ে সর্বোপরি এটাই বলতে হয় যে, দেখে যতোটা সম্পূর্ণ বলে মনে হয়, তার জগত ততোটা পরিপূর্ণ নয়। তার সৃষ্টি করা সাধারণ মানুষগুলো অতীত নিয়ে কেবল স্বপ্নই দেখে, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত বংশের খোঁজ সেখানে নেই; তাদের অতীতে একটি বিরাট ফাঁক আছে। যেমনটা ছোট হওয়া উচিত তেমনই ছোট্ট তাদের জীবন। ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে তাদের এই ছোট গণ্ডিবদ্ধ জীবনকেই কেবল বের হয়ে আসার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বৃটিশদের ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতায় সেখানে সামান্য কিছু নতুন কাঠামো যুক্ত হয়েছে মাত্র (উদাহরণস্বরূপ: স্কুল, রাস্তা, ব্যাঙ্ক, কোর্ট)। নারায়ণের বইতে যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে জ্ঞানী এবং কষ্টসহিষ্ণু হিন্দু ভারতকে কমই খুঁজে পাওয়া যায়। বরং নারায়ণের বইয়ে বৃটিশদের শাসনামলের সেই শান্তিকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যার ক্ষীয়মান ধারা এখনও কিছুটা হলেও রয়ে গেছে।

 

সুতরাং ইংরেজি বা ইউরোপিয়ান উপন্যাস থেকে ধার করা ভারতও মাঝেমাঝে নিজস্ব ধ্যান-ধারণার নির্যাসকে তুলে ধরতে ব্যর্থ হতে পারে। এ ধরনের উপন্যাসে বাহ্যিক বিষয়বস্তুর উপস্থাপনটা ভালো হয়ে থাকলেও ভেতরের দিকটা ফাঁকাই রয়ে যায়। ঠিক যেমনটা ঘটেছে নারায়ণের বেলায়। উপন্যাসের লেখক হওয়া সত্বেও আমি  নিজেই আমার নিজের জগতটাকে সামান্যই বুঝতে পারতাম। আমাদের পরিবারের অতীত, দেশত্যাগ, প্রায় মলিন হয়ে যাওয়া স্মৃতি থেকে গড়ে তোলা কৌতূহলদ্দীপক ভারতীয় পরিবেশ যেখানে আমাদের প্রজন্ম একাধারে বাস করে আসছে, ওয়র্ম স্যারের ক্লাস, বাবার সাহিত্যিক হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা– এগুলো সবই প্রমাণ করে যে, ভারতকে নিয়ে ভাবতে গেলে আমি নিজেও শুধু বাহ্যিক বিষয়গুলোকেই দেখি। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতেই এই ধারণার বাইরে বের হয়ে আসার জন্য আমাকে নতুন পথ খুঁজে বের করতে হলো। তখন পুরো একটি নতুন জগত আমার সামনে অপার বিস্ময় নিয়ে বেরিয়ে এলো। আমার আবিষ্কারের জন্য এমন একটি জগত অপেক্ষা করে আছে, বলতে গেলে এ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিল না।

 

                            ৩.

উনবিংশ শতকের প্রায় ষাট বা সত্তর বছর ধরে ইউরোপের দক্ষ সাহিত্যিকদের লেখনিতে ব্যবহৃত হতে হতে উপন্যাস সাহিত্যের এক অসাধারণ মাধ্যমে পরিণত হয়। রচনা, কবিতা, নাটক, ইতিহাস- সাহিত্যের আর কোন শাখাতেই ঐ সময়ে এতো উন্নতি হয়নি। উপন্যাসের কারণেই শিল্প বিপ্লব পরবর্তী আধুনিক সমাজের একটি পরিষ্কার ছবি আমরা পেয়েছি। আর প্রাপ্ত এই ছবির কারণেই সমাজ সম্পর্কে পাঠকের ধারণা অবিলম্বেই পাল্টে যায়। কাঠামোর কিছু কিছু দিক পরবর্তীতে পরিবর্তিত এবং পরিমার্জিত হলেও আধুনিক উপন্যাসের মূল কাঠামোটি বস্তুত ঐ সময়েই দাঁড়িয়ে যায়। এবং এখনও লেখকেরা কম-বেশি সেটাই অনুসরণ করে চলেছে। (চলবে)



দশম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শেয়ার