পর্ব ৯
লেখক এবং ভারত
ভারতবর্ষ যেন এক বিশাল ক্ষত। পুরো ভারত দেশটাই লেখার জন্য চমকপ্রদ একটি বিষয়। আবার এই দেশেরই করুণ দারিদ্রের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমাদের দাদা-পরদাদারা প্রবাসে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে সেটা আজকের কথা নয়। সেটি উনবিংশ শতকের শেষ দিককার কাহিনী। ঐ সময়কার ভারতের দুটি রূপ ছিল যারা পরস্পরের থেকে পৃথক। এর মধ্যে একটি হলো ভারতের রাজনৈতিক রূপ যেটি তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সুখ্যাত। অন্যদিকে ভারতের আরেকটি রূপ যা মূলত নিজস্ব অস্তিত্ব নির্ভর, সেটির অবস্থান ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে। স্মৃতি ক্রমশ মলিন হওয়ার সাথে সাথে ভারতের দ্বিতীয় ওই রূপটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। ভারতের এই রূপ কোন সাহিত্যে পাওয়া যাবে না। কিপলিং, ই.এম ফরস্টার অথবা সমারসেট মমের লেখায় যে ভারত আমরা দেখি তার সাথে এই ভারতের কোন মিল নেই। আবার নেহেরু এবং রবীন্দ্রনাথের জাঁকজমকপূর্ণ ভারতেও এই রূপের খোঁজ মেলে না। (প্রেমচাঁদ [১৮৮০-১৯৩৬] নামে এক ভারতীয় লেখকের হিন্দি এবং উর্দু ভাষায় লেখা গল্পে আমাদের সেই চির পরিচিত ব্যক্তিগত ভারতের গ্রাম্য জীবনের অতীত রূপটি ফুটে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু এই লেখকের লেখার সাথে আমাদের পরিচয় ছিল না; এ ধরনের লেখা পড়ার মত মানসিকতাও আমাদের ছিল না।)
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়কার সুখ্যাত ভারত আমায় টানেনি। পরবর্তীতে, যখন সময় এলো, তখন আমি ভারতের এই নিজস্ব সত্তার দিকে ফিরে তাকালাম। অবশ্যই সত্যকে দেখতে পারার মত যথেষ্ঠ মানসিক শক্তি আমার ছিল। তারপরও ভারতের নিজস্ব ব্যাক্তিগত সত্তাকে ভালোভাবে অবলোকন করতে যেয়ে আমি শিউরে উঠলাম। ভারতের ভয়াবহ রকমের ক্ষত-বিক্ষত যে জীবন আমি দেখতে পেলাম সেটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার পরিচিত আর কোন দেশকেই প্রত্যেক পরতে পরতে এতোটা দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। আর ভারতের মতো এত বিরাট জনসংখ্যাও খুব কম দেশেরই ছিল। ভারতকে পর্যবেক্ষণ করতে যেয়ে মনে হল আমি যেন পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক মহাদেশে এসে পড়েছি। এবং সেই মহাদেশটি রহস্যময় বিপর্যয়ে পর্যুদস্ত। এত কিছুর পরও ভারতের এই প্রতিচ্ছবির মূলভাগে আমি এমন কিছু খুঁজে পেলাম যা আমাকে অভিভূত করে দিল। আমার পরিচিত আধুনিককালের ভারতীয় বা ইংরেজি সাহিত্যে এই প্রতিচ্ছবি পাওয়া যাবে না। কিপলিংয়ের লেখা একটি ইংরেজি রোমান্সের পটভূমিতে ভারতের মহামারির প্রসঙ্গ এসেছে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সকল ধরনের ইংরেজি এবং ভারতীয় সাহিত্যে ভারতের দুঃখ-দুর্দশার কথা সাধারণত এমনভাবে এসেছে যেন তা চিরস্থায়ী; ভারতের সেই দুর্দশা অচ্ছুত্যের মতো কেবল নেপথ্যে থাকারই যোগ্য। আর বরাবরের মতোই কিছু লেখক আছে যারা ভারতের বিশেষ বিশেষ দুর্যোগ-দুর্দশার ভেতর অনবরত এক ধরনের আধ্যাত্মিক সংযোগ খোঁজার চেষ্টা করে গেছেন।
কেবল গান্ধীর আত্মজীবনী, দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্টস উইথ ট্রুথ এর কয়েকটি অধ্যায়ে ১৮৯০ এর দশকে দক্ষিন আফ্রিকায় বসবাসরত অসহায় ভারতীয় শ্রমিকদের দুঃখ-দুর্দশার সংক্ষিপ্ত ছবি ফুটে উঠেছে। এবং সেখানেই (পরোক্ষভাবে হলেও) আমি আমার পরিচিত ভারতের আঘাতগুলোর নগ্ন বহিঃপ্রকাশ খুঁজে পেয়েছিলাম।
ভারতের এই রূপকে নিয়ে আমি একটি বই লিখেছিলাম। তারপর এ বিষয়ে আর লেখা না হয়ে উঠলেও ঐ আঘাতের প্রতিচ্ছবি আমি কখনো ভুলতে পারিনি। ভারতের ঐ বিনষ্ট রূপকে অতিক্রম করে অন্য ভারতের ছবি আবিষ্কার করতে আমার আরো অনেক সময়, আরো অনেক মানসিক অবস্থা পেরিয়ে আসতে হয়েছে। বলা যায় ভারতের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ভারতীয় রাজনৈতিক ধারণার প্রচলিত প্রবণতা এবং দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে আমার বেশ সময় লেগেছে। ভারতীয় সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রেই দুর্দশার প্রমাণ উপস্থিত থাকা স্বত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রাম আর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের কারণে বৃটিশরা ভারতের এ দুর্দশাগ্রস্থ পরিস্থিতির দিকে তেমন একটা নজর দিতে পারেনি। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামও ভারতীয়দের এ দুর্দশার বিষয়ে অন্ধ ছিল। ধর্মের মতোই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল একরোখা; তার অপছন্দের বিষয়গুলো থেকে সে ঠিকই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলো।
১০০০ খৃস্টাব্দের ছয়শ বছর পরে মুসলিমরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করে তছনছ করে দেয়। রাজত্ব আর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পরও তারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। যুদ্ধবাজ এই মুসলিমরা ভারতবর্ষের উত্তর দিকের ধর্মীয় মন্দিরগুলো নিশ্চিহ্ণ করে দেয়; দক্ষিণের অনেক গভীর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তারা সেখানকার মন্দিরগুলোও ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে।
বিংশ শতকের ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে অতীতের ঐ সব শতকের পরাজয় বড্ড অস্বস্তিকর। তাই, ইতিহাসকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করা হল। ফলে বৃটিশদের পূর্ববর্তী শাসক এবং শাসিত, বিজয়ী এবং প্রজা, বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী, সকলে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। বৃটিশ শাসনের বিরাট সাম্রাজ্যের সামনে এই একীভূত ইতিহাসের কিছুটা গুরুত্ব ছিল বৈকি। তারপরও বৃটিশদের সামনে ভারতের সমগ্র ভাবটুকু ফুটিয়ে তুলতে চাইলে জাতীয়তাবাদী লেখকদের সামনে একটাই সহজ পথ খোলা ছিল। সেটি হল পঞ্চম এবং সপ্তম শতকের প্রাক-ইসলামী যুগে ফিরে যাওয়া যখন কিছু সংখ্যক জাতির জন্য ভারত ছিল পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র। বলে রাখা ভালো, ঠিক এ সময়টাতেই অর্থাৎ প্রাক-ইসলামী যুগেই চীনদেশীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং জ্ঞানী-গুণীরা ভারতের বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে তীর্থযাত্রায় আসতেন।
চৌদ্দ শতকে মরক্কোর মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক এবং পর্যটক ইবনে বতুতাকেও ভারতের সামগ্রিকতার ধারণা স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য কম কষ্ট করতে হয়নি। ইবনে বতুতার ইচ্ছা ছিলো মুসলিম বিশ্বের সবকটি দেশ ভ্রমণ করা। তিনি যেখানেই গেছেন সেখানেই মুসলিম শাসকদের উদার ছত্রছায়ায় দিনানিপাত করেছেন আর বিনিময়ে তিনি তাদেরকে দিয়েছেন আরবদের খাঁটি ধর্মানুরাগ।
বতুতা যখন ভারতে আসেন তখন ভারত মুসলিমদের অধিকৃত ভূমি। ভারতের তখনকার শাসকদের কাছ থেকে বতুতা পাঁচটি গ্রামের সমস্ত রাজস্ব (বা শস্য) উপহার পান। এমনকি সেবার দূর্ভিক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তার উপহার সংখ্যা বাড়িয়ে পাঁচ থেকে সাতটি গ্রাম করা হয়। বতুতা ভারতে সাত বছর থাকার পর পালিয়ে বাঁচেন। তার সর্বশেষ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দিল্লীর শাসক। এই শাসক ছিলেন মারাত্মক রক্তলোভী। বিচারের নামে ফাঁসির আদেশ আর অত্যাচারের নির্দেশ দেয়াই ছিল তার দরবারের প্রাত্যহিক নিয়ম। নির্দয় এই শাসকের নির্দেশে ফাঁসিতে লটকানো মৃতদেহগুলো কমপক্ষে তিনদিন জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখা হতো। পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম স্বৈরশাসকদের শাসন দেখে অভ্যস্ত ইবনে বতুতা পর্যন্ত তার ভারতীয় পৃষ্ঠপোষকের এহেন নিষ্ঠুরতায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন। দিল্লীর সম্রাট যখন তাকে নজরবন্দী রাখার জন্য চারজন সেপাই নিয়োজিত করলেন তখন বতুতা ভাবলেন তার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। সম্রাট এবং তার সভাসদদের কাছে এটা-ওটা নিয়ে প্রায়ই অভিযোগ করতেন বতুতা। তার ভাষ্য ছিল যে সম্রাটের দেয়া উপহার তার কাছে পৌঁছানোর আগেই কতিপয় সভাসদেরা সেগুলো হাপিস করে ফেলে। কিন্তু, পরে উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে বতুতা ভয় পেয়ে ঘোষণা দিলেন যে, সভাসদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি অনুতপ্ত। তিনি টানা পাঁচ দিন রোযা রাখলেন, উপবাসের সময় সারাদিন কোরান তেলোয়াত করলেন। অবশেষে ভিক্ষুকের বেশে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলেন। ধর্মতাত্তিকের এই অনুতপ্ত ভাব দেখে সম্রাটের পাথর হৃদয়ও গলে গেল। ফলে ইবনে বতুতাকে নজরদারী থেকে মুক্তি দেয়া হল। (চলবে)