বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি নদীর পানি দুই দিকের পাড় উপচে গ্রামের বড় রাস্তাটার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের গ্রামের মহিলা তামবোরোর বাড়ির দিকে পানি দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে। শব্দ শোনা যাচ্ছিল কীভাবে নদীর পানির ধারা তামবোরোর বাড়ির সাথে লাগোয়া খোঁয়ারের ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
দিনকে দিন অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে আমার খালা মারা যান, এরপর শনিবার, তাকে দাফন করবার পর যখন আমাদের মৃত্যুশোক ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে, শহরে তখন পাগলের মতন বৃষ্টি শুরু হয়। আমার বাবা ভীষণ মুষড়ে পড়ে। মাঠ থেকে তোলা বার্লি সবে বাড়ির উঠানে শুকাতে দেওয়া হয়েছিল। বৃষ্টিটা এমন হঠাৎ শুরু হয়, আর এত তীব্র বেগে, আমরা একমুঠো বার্লি সরানোরও সময় পাই নি; যারা সেসময় বাড়িতে ছিলাম, টিনের চালার নিচে জড়ো হয়ে কেবল দেখে গেলাম কেমন করে আকাশ থেকে নেমে আসা শীতল পানির ধারা ক’দিন আগে কাটা আমাদের হলুদ বার্লিগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে।
আর গতকাল, আমার বোন টাচার বারোতম জন্মদিনে আমরা খবর পাই, তাকে আমার বাবা তার সন্তের দিনে যে গরুটা কিনে দিয়েছিল সেটা নদীতে ভেসে গেছে।
নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছিল তিনদিন আগে, সন্ধ্যার দিকে। আমি তখন বাড়িতে আরামে ঘুম, বাজ পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমানোর সময় গায়ে দেওয়া চাদরটা হাতে নিয়েই লাফ দিয়ে উঠে পড়ি আমি, মনে হচ্ছিল প্রকাণ্ড শব্দে যেন বাড়ির চালাটাই মাথার উপর ভেঙে পড়বে । তারপর বুঝতে পারি শব্দটা নদীর স্রোতের, তখন আবার ঘুমিয়ে পড়ি, ভেসে আসা স্রোতের একটানা আওয়াজই আমাকে ঘুম-পাড়ানি গানের মতন ঘুমের দেশে ডেকে নিয়ে যায়।
পরদিন আবার যখন ঘুম ভাঙে, ভোরের আকাশ তখন বিশাল বিশাল সব মেঘে ঢাকা, চারপাশ দেখে মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে বৃষ্টি পড়ছে। নদীর স্রোতের শোঁ শোঁ শব্দ আরো উচ্চগ্রামে, আরো কাছ থেকে শোনা যেতে থাকে। আগুনের গন্ধের মতন নদীর ভেসে যাওয়া পচা পানির ঘ্রাণ নাকে এসে লাগছিল আমার।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি নদীর পানি দুই দিকের পাড় উপচে গ্রামের বড় রাস্তাটার একদম কাছাকাছি চলে এসেছে। আমাদের গ্রামের মহিলা তামবোরোর বাড়ির দিকে পানি দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে। শব্দ শোনা যাচ্ছিল কীভাবে নদীর পানির ধারা তামবোরোর বাড়ির সাথে লাগোয়া খোঁয়ারের ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই, ইতোমধ্যে নদীটার একটা অংশ হয়ে যাওয়া বাড়িটার ভেতর বারবার ঢুকে তামবোরো তার মুরগীগুলো ধরে এনে রাস্তার এখনো শুকনো দিকটায় ছেড়ে দিচ্ছিলেন।
অন্য দিকটায়, মোড়ের কাছে, কে জানে কখন, খরস্রোতা নদী এসে হেসিন্তা খালার উঠোনের তেঁতুল গাছটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমাদের শহরে এই একটাই তেঁতুল গাছ ছিল, এজন্যই লোকে বলাবলি করছে কখনও এই নদীর পানি এতটা উচ্চতায় আগে ওঠে নি।
ঈশ্বর তার কপালে কেন এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার শাস্তি রেখেছেন আমার মা বুঝতে পারে না, তার পরিবারে, তার দাদী নানী থেকে শুরু করে একজনও কোন মন্দ মেয়েমানুষ ছিল না। প্রত্যেকে বড় হয়েছে খোদাভীরু হিসেবে, সবাই ছিল খোদার প্রতি বাধ্য, এমনকি কেউ কখনও কারও সাথে খারাপ ব্যবহারও করত না।
বিকেলবেলা আমার বোন আর আমি ব্রিজের ধারে যাই, বানের পানির স্রোত বাড়তে বাড়তে ঘন আর কালো হয়ে ব্রিজের উপর উঠে গেছে। আমরা দু’জন সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকি, তারপরও একটুও একঘেয়ে লাগে না। এরপর গিরিখাত বেয়ে উঠি, লোকজন কী বলাবলি করছে শুনতে, নিচ থেকে লোকজন জড়ো হয়ে গল্প করছে দেখতে পারছিলাম আমরা, কিন্তু পানির স্রোতের আওয়াজ ছাপিয়ে তাদের কথা শোনা যাচ্ছিল না। গিরিখাতটা বেয়ে উঠি, লোকজন কী কী ক্ষতি হয়েছে তাই নিয়ে কথা বলছিল। তখনই আমরা জানতে পাই যে নদীটা আমার বোনের গরু সার্পেন্তিনাকে ভাসিয়ে নিয়েছে। টাচার জন্মদিনে আমার বাবা গরুটা কিনে দিয়েছিল উপহার হিসেবে। গরুটার দুটো কানের একটা ছিলো শাদা আরেকটা লাল, আর ছিল ভীষণ সুন্দর দুটো চোখ।
কে জানে সার্পেন্তিনা নদী পার হতে গেল কেন, তার তো না-বোঝার কথা না এই নদী আর তার প্রতিদিন পার হওয়া নদী এক নয়। সার্পেন্তিনা অতটা বোকা গরু কখনোই না। নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে হাঁটছিল সে। প্রতিদিন সকালবেলা ওকে আমি গোয়ালঘরের দরজা খুলে বের করে আনতাম। তা না হলে, ও সারাদিন গোয়ালঘরেই সোজা দাঁড়িয়ে থাকত, আর বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলত, ঘুমের ঘোরে গরুরা যেমন ফেলে।
কিছু একটা অবশ্যই তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। হয়তো-বা সে জেগে ছিল ঠিকই, কিন্তু হঠাৎ ধেয়ে আসা পানি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ফিরে আসতে চেয়েও আর পারে নি, থকথকে কালো কাদায় পা হয়তো আটকে গিয়েছিল। হয়তো সাহায্য পাওয়ার জন্য চেঁচিয়েও ছিল।
ও যে কী ভীষণ চেঁচাতে পারত!
একটা লোক, যে সার্পেন্তিনাকে ভেসে যেতে দেখেছিল তাকে জিজ্ঞেস করি ওর সাথে কোন বাছুর ছিল কিনা। উত্তর দেয়, সে শুধু গরুটাই দেখেছে, তার খুব কাছে দিয়ে চার পা বাতাসে তুলে কিছুক্ষণ ভেসে ছিল, তারপর ডুবে গেছে। গরুর শিং মাথা পা বার আর কিছুই দেখেনি। নদীতে অসংখ্য গাছের গুড়ি ভেসে যাচ্ছিল, আর শেকড়-বাকড়, লোকটা সেখান থেকে লাকড়ি যোগাড়েই ব্যস্ত ছিল, তার দেখার সময় ছিল না নদীতে গাছের গুড়ি ভেসে যাচ্ছে নাকি কোন জানোয়ার।
জানি না, বাছুরটা বেঁচে আছে নাকি তার মায়ের সাথে নদীতে ভেসে গেছে। যদি গাভীটার সাথেই যায় তাহলে খোদা তাদের দুজনকেই রক্ষা করুক।
কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো আমার বোন টাচার, তার আর কিছুই থাকলো না। বাছুর সার্পেন্তিনাকে যোগাড় করতেই বাবার বড় কষ্ট করতে হয়েছিলো।
এত কষ্ট করে বাবা সার্পেন্তিনাকে টাচার জন্য যোগাড় করেছিলো, যেন ওর একটা সহায় হিসেবে থাকে গাভীটা, আমার আর দুই বোনের মতো যেন ওকে বেশ্যা হতে না হয়।
আমার বাবার ধারণা, আমার আর দু’বোন বেপথে গেছে কারণ আমরা গরীব আর ওরা ছিল শোধরানোর অতীত। ছোটবেলা থেকেই তারা দিনরাত আমাদের দারিদ্র্য নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতো। বড় হওয়ার সাথে সাথে তারা যত সব খারাপ লোকজনের সাথে মেলামেশা শুরু করে, আর সেসব লোক তাদেরকে খারাপ কাজ শেখাতে থাকে। সবই তারা দ্রুত শিখে যায়, বুঝে নেয় রাতের বেলার পুরুষ মানুষের শিস দেওয়ার মানে কী। প্রায়ই তারা ভোর পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকত। মাঝে মাঝে যখন নদী থেকে পানি নিয়ে আসার কথা, তখন তাদের পাওয়া যেত গরুর খোঁয়াড়ে, মেঝেতে শোয়া, নগ্ন, দু’জনের গায়ের উপর একজন করে পুরুষ মানুষ।
শেষ পর্যন্ত বাবা তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বেচারা অনেক দিন সবকিছু সহ্য করেছে, কিন্তু আর নিতে পারে নি, একসময় তাদের দু’জনকে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার দরজা দেখিয়ে দেয়। তারা আয়ুতলা না কোথায় যেন চলে গেছে, আমি ঠিক জানি না, কিন্তু এখন তারা বেশ্যা।
এ কারণেই বাবা টাচাকে নিয়ে এতো ভয়ে থাকে যে সেও আমার আর দুই বোনের মতোই হবে শেষ পর্যন্ত, একসময় আমাদের দারিদ্র্য অনুভব করবে এবং বুঝতে পারবে তার বড় হওয়ার সময় তার সহায় হওয়ার মতন কিছু নেই যাতে কোনো ভদ্রলোক তাকে বিয়ে করতে পারে, যে কিনা তাকে সবসময় ভালোবাসবে। সবকিছু এখন আরও কঠিন হয়ে গেল। গরুটা থাকলে তখন ব্যাপার ভিন্ন ছিল। যদি ওর চমৎকার গরুটা বেঁচে থাকত, ওকে বিয়ে করার মতো কোনো বুদ্ধিমান লোক ঠিকই খুঁজে পাওয়া যেত।
এখন আমাদের একমাত্র যে আশাটা বেঁচে আছে তা হলো, বাছুরটা হয়তো মরেনি। হয়তো সে তার মায়ের পিছুপিছু নদীটা পার হওয়ার কথা ভাবে নি। যদি তাই করে তাহলে আমার বোন টাচার বেশ্যা হয়ে যাওয়ার আর বেশি দেরি থাকবে না। আর আমার মা তা চান না।
ঈশ্বর তার কপালে কেন এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার শাস্তি রেখেছেন আমার মা বুঝতে পারে না, তার পরিবারে, তার দাদী নানী থেকে শুরু করে একজনও কোনো মন্দ মেয়ে-মানুষ ছিলো না। প্রত্যেকে বড় হয়েছে খোদাভীরু হিসেবে, সবাই ছিল খোদার প্রতি বাধ্য, এমনকি কেউ কখনও কারও সাথে খারাপ ব্যবহারও করত না। পরিবারের প্রত্যেকটা মেয়েই ছিল এমন। কে জানে তার মেয়েরা কোথা থেকে এমন বাজে স্বভাব পেয়েছে। মা অনেক চিন্তা করেও খুঁজে পায় না তার কী ভুল ছিল কিংবা ওদের জন্মের সময় কী পাপ করেছিল যে এমন একটার পর একটা বাজে স্বভাবের মেয়ে জন্ম হলো। কিছুতেই তার বোধে আসে না। যখনই তাদের কথা মনে হয়, কাঁদে, আর বলে, “ খোদা ওদের ভালো করুক।”
বাবা বলে এখন আর তাদের নিয়ে কিছু করার নেই। এখন বিপদের মধ্যে আছে টাচা, সেও দিনকে দিন বড় হচ্ছে, বুকের ওপর স্তন দেখা দিতে শুরু করেছে, যেগুলো তার বোনদের মতোই হয়ে উঠছে : সূঁচালো আর উঁচু আর বেয়াড়া আর মনকাড়া।
“হ্যাঁ,” সে বলে, “ও যেখানেই যায়, লোকজন তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। এর পরিণাম খারাপ; আমি এখনই দেখতে পারছি, এর পরিণাম খারাপ।“
একারণেই আমার বাবা এত ভয়ে থাকে।
টাচা যখন বুঝতে পারে নদী ওর গরুটাকে মেরে ফেলেছে, সে আর কখনও ফিরে আসবে না, ডুকরে কেঁদে ওঠে। সে আমার পাশেই দাঁড়ানো, গোলাপী একটা জামা পরা, উপত্যকার চূড়া থেকে নদীটার দিকে তাকিয়ে থাকে, কান্না চেপে রাখতে পারে না। তার চেহারা দিয়ে ময়লা পানির স্রোত বয়ে যায়, যেন নদীটা ঠিক ওর বুকের ভিতরেই বয়ে যাচ্ছে।
আমি ওর কাঁধে হাত রাখি, স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু ও কিছুই শোনে না। আরও জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। নদীর পারে দাঁড়ালে যেমন বাতাসের আওয়াজ পাওয়া যায়, ওর ঠোঁট থেকে অনেকটা তেমন শব্দ বের হয়, সে শব্দে ও কেঁপে ওঠে বারবার, ভয়ানক ভাবে কেঁপে উঠতে থাকে। ততক্ষণে, পানির উচ্চতা আরও বেড়ে চলে, নিচ থেকে আসা পচে যাওয়া ময়লা টাচার ভেজা মুখে এসে জমে। তার ছোট দুই স্তন ওঠে আর নামে, ক্রমাগত, যেন সেগুলো হঠাৎ করে বড় হতে শুরু করেছে, আর তাকে নিয়ে যাচ্ছে সর্বনাশের একেবার খুব কাছাকাছি।
লেখক ও অনুবাদক পরিচিতি
হুয়ান রুলফো
১৯১৮ সালে মেহিকোতে জন্ম হুয়ান রুলফোর, যার হাত ধরে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে জাদুবাস্তব ধারার সূচনা হয়েছিল। যদিও তাঁর রচনা বলতে গেলে একটা কৃশকায় উপন্যাস আর পনেরটা ছোট গল্পের এক সংকলন। আর তা দিয়েই তিনি প্রভাবিত করেছেন ফুয়েন্তেস, মার্কেজ, কিংবা য়োসার মতন জগৎবিখ্যাত লেখকদের।
জি এইচ কুন্ডু
জন্মঃ ১৫.০১.১৯৮৮
প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ
দা স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি (হারুকি মুরাকামি)