আদনান আলীর পাঁচটি কবিতা


অন্য কোনো মাহবুবুর রহমান


অন্য কোনো মাহবুবুর রহমান কাল এসেছিল
আমি যাকে চিনি, সে না
আমার পরিচিত মাহবুবুর রহমান
বেলা শেষ হওয়ার আগেই বিদায় নিয়েছিল
যদিও তখনো পল্টন মোড়ে মেট্রোরেলের নিচে
অন্ধকার জমাট বেঁধে ওঠেনি
এভাবে বিদায় নেয়ার কারণ জানার জন্য
আমি রোজ বিকেলে নীলক্ষেত যেতাম
কিন্তু সেখানে বইয়ের খোলসগুলোর ভিতরে
বাসা বেঁধেছে রঙিন সাপ
তাই জ্ঞানের পায়রাগুলো অসহায় চিল হয়ে
উড়ে বেড়ায় জগন্নাথ হলের আকাশে
কিন্তু সেখানে ন্যাপালদা আর ঝাল ফ্রাই বানান না
কারণ টেনিস কোর্টে এখন আগুন জ্বলা নিষেধ
জোনাকিরা সেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে কিনা
তা জানতে আমি বান্দরবানও গিয়েছিলাম
কিন্তু নতুন রাস্তাগুলো জোনাকিদের খেয়ে ফেলায়
আমি মাহবুবুর রহমানের খোঁজে বাড়ি ফিরছি।


মশা


একটা মশা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না
নমরুদের মশার মতো, অবিশ্রান্ত তার স্ট্যামিনা
হয়তো সে জিম করে, চেরি ড্রপে
তাকে দেখে চোয়াল ঝুলে পড়ে অন্যান্য পুরুষ মশার
কিন্তু আমার জন্য সে এক নিদারুণ যন্ত্রণা
মধুপুর গড়ের ভিতরের এক মদেলা রাত্তিরে
যখন চিত্তির হয়ে ঘুমানোর কথা খুব
ভীষণ আরামে চিৎকার করে ডাকার কথা
একটা বাঁজখাই নাকের
তখন পরিশ্রান্ত শৃগালের মতো চোখ
পেতে বসে থাকি আর শুনি মশাটির গর্বিত খুৎবা
যদিও শুদ্ধ আরবিতে না হওয়ায় তাতে ঢুকে
গেছে নানামুখী বিদআত, তবুও
একটি অমোঘ থাপ্পড়ে তার শ্বাসনালী উবে যাবে
অরণ্যের সন্ধ্যায় বাঘের উপস্থিতি টের পাওয়া প্রাণিকূলের
চেয়েও নিস্তব্ধ থাকবে তার রূহ
এই অপেক্ষায় ভোর হয়, অরণ্য জাগে
কিন্তু সেই মশাটা, আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না


সার্কুলার স্মৃতিপথে বিষণ্ণ শকট


হাঁটতে হাঁটতে অতিক্রম করলাম শাহবাগ
মনে হলো একটা যুগ স্যাঁত করে
পাশের লেন দিয়ে চলে গেল
আমরা সময় ও স্থানের আপেক্ষিকতা
সংক্রান্ত আলোচনায় লিপ্ত হওয়ার
দু’সেকেন্ড আগে, সস্তা আবেগের মতো
একটা লাকি স্ট্রাইক জ্বলে উঠল
কারো ঠোঁটে, কারণ মার্লবরো ফুরিয়ে যায়
রোজ, আমার বিভ্রান্ত যৌবনের মতোই
অথবা পরপর চারকাপ চা খেয়ে যেমন করে
গিলে ফেলতে চাই প্রাত্যহিক বিষণ্ণতা
যদিও জানা ছিল না, আরেকটু এগুলেই
বাংলা মোটর মোড়ে দেখা হতো আমার
লাশের সাথে, দুঃসহ সুনামের বোঝা বইতে
না পেরে সে লুটিয়ে পড়েছিল এক
নিথর সন্ধ্যায়, ঐ ভাগ্যাহত সুনাম বিষয়ক
বেশ কিছু স্মরণসভায় পরে অংশগ্রহণের
সৌভাগ্য হলেও, লাশটিকে শীঘ্রই
স্মৃতি থেকে অপসারণ করেছিলাম,
নগরীর অন্যসব কুৎসিত ভাস্কর্যের মতোই।


কাঠগড়ায় কৈবর্ত


মর্মন্তুদ বিশেষণে অভিহিত করেছি
তাকে বারংবার, অথচ
চুপচাপ মানুষটি ছিলেন তিনি
নির্বিরোধী, এমনকি ধরা পড়া ছিনতাইকারীর
নিরাপদ বক্সিং ব্যাগেও কখনো
হাত মকশো হয়নি তার।

বাজারের থলেটাই তার জীবনের
শ্রেষ্ঠ বিনোদন
যেন নিজস্ব প্যান্ডোরার বাক্স
যা থেকে একে একে বের হয়
এত এত কম জিনিস যে
টাকাগুলো কোথায় গেল সে আলাপই
প্রধান প্রহেলিকায় পরিণত হয়।

বিব্রত বেঁচে থাকার দীর্ঘ দুর্বল মুহূর্তে
কখনোই দীপ জ্বলেনি তার হৃদয়ে
শ্রেষ্ঠ সুগন্ধির ঘ্রাণ নিংড়ানোর সাধ
জাগেনি নাসারন্ধ্রের কভু, কেবল
পরবর্তী প্রশ্বাসের নিরাপদ চর্চায়
মুহূর্তগুলো স্থবিরতায় শতাব্দীকেও
হার মানিয়েছে অনেক আগেই।

চোখ মেলে আকাশ দেখার কাল
তার এসেছিল দুয়েকবার হয়তো
কিন্তু ব্যক্তিগত ব্যর্থতার দিগন্তে
সূর্যাস্তই দেখেছেন কেবল
ঐ চোখে শ্যামলিমা ধরা দেয়নি
কোনোদিন, হয়নি নেয়া কোনো
সুষম সুন্দরীর স্তনের মাপও।

তবুও তিনিই ছিলেন দেশের
প্রধানতম অপরাধী
দিনের প্রতিটি ক্ষণে এমনকি
রাত্রীকালীন ঘুমঘোরেও কাঠগড়ায়
অহর্নিশ হাজিরা
‘মহানুভব’, নাকি ‘ধর্মাবতার’ কী দিয়ে
শুরু করবেন আর কী দিয়ে শেষ
এ ধাঁধা মিলাতে গিয়ে অসমাপ্ত
রয়ে গেছে চিরকাল তার
জীবনের যা কিছু হিসেব নিকেশ।


ত্রিমূর্তি উপাখ্যান কিংবা একটি বিদায়ী চিরকুট


নিয়তির চেয়ে সত্য যে মৃত্যু
অথচ তার অস্তিত্বের প্রতিটি পরতে
বারংবার অস্বীকার করে জন্মের কথা
যেন জন্ম কেবল নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যেই
সৃষ্টির পরেই শুরু হয় ধ্বংসের প্রতীক্ষা
স্থবিরতার পাঁকে পড়ে ভুলে যায়
কেউ কেউ, ঈশ্বরের চেয়েও অমোঘ এ সত্য।

তবুও, ঐ সবুজ ঘাস, আকাশ, মিস্টি রোদ
কিংবা কারো হাত ধরে অনন্তকাল
বাঁচতে চাওয়ার অর্থহীন দাবীতে অবগাহন
করেনি যে অবুঝ কঙ্কাল তারও
পাঁজর ভেদ করে উঠে আসে নবীন উদ্ভিদ
হৃদয়ের রসে পুষ্ট হয় উদীয়মান
সবুজ পতঙ্গের দল।

ভাবনার অতলে হারিয়ে যে ভুলেছিল
পৃথিবী একটি নীলাভ বর্তুলের বাইরেও
পাখিদের সম্মিলিত সংগীত বা
কিশোরীর মন খারাপের বিকেল
হওয়াও অসম্ভব নয়
তারপরও তাকে ভেবে ভোরের শিশির
মাখা শিউলির সলজ্জ অভিমান
থেমে থাকেনি, আগমনী গান আর
বিদায়ী সুরের সখ্য যার মর্মে ধরা পড়েছে
জীবন আর মৃত্যু, আদি আর অন্ত
তার সচেতনতায় একটি বিন্দু হয়েই ধরা দেয়।

 


আদনান আলীর শৈশব কৈশোরের বড় অংশ কেটেছে ফেনীতে। তারপর থেকে ঢাকার বিবর্ণ আকাশই তার একান্ত ক্লোরোফিলের প্রিয় উপাদান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষে নৈমিত্তিক জীবনের পাকেচক্রে আপাতত আটকা পড়লেও, মূল আগ্রহের জায়গা লেখালেখি, সমাজপাঠ, মানব মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান।

প্রকাশিত কবিতার বই:
অহেতুক আলবালে জলসেচনে ক্ষতি নেই


থাম্বনেইল আর্টওয়ার্ক : রাজীব আহসান


 

শেয়ার