সিদ্ধান্ত যত পাকাপোক্তই হোক, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রস্তুতিই যে মূল কথা, বস্তাপচা হলেও এ সত্যটার মুখোমুখি এভাবে পড়তে হবে আগে ভাবিনি। লিফ্টের দরজা ফাঁক হতে ভাবলাম লোকজন বেরোনোর পর ধীরে-সুস্থে ঢুকব। কেউ বেরোলো না, পা বাড়িয়ে ভিতরে চোখ তুলে তাকাতে পেছনের দেয়াল ঘেঁষে যাকে দেখলাম তাতে চমকালামই না, একটা জোর ঝাঁকুনিও খেলাম। যাকে এ শহরের পথেঘাটে, গলিঘুঁজিতে কোথায় না খুঁজেছি, সেই মহিউদ্দিন আমার সামনে!
লিফ্টটা বড়সড়, অনায়াসে পনেরো-ষোলোজন ধরার কথা, তবে ভিতরটা বেশ ফাঁকা, আমি ও মহিউদ্দিন ছাড়া জনাচারেক নানাবয়সী পুরুষ, একজন হিজাবি মহিলাকেও দেখলাম। আমার যাওয়ার কথা দশতলায়, একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে মিনিট পাঁচেকের কাজ। বোতাম টিপতে হলো না, আগেই কেউ টিপে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। ঢোকার সময় চোখ যে সোজা মহিউদ্দিনের চোখে পড়েছে, দুজন দুজনকে দেখেছি, আর চেনা মানুষের সঙ্গে হঠাৎ চোখাচোখি হলে অজান্তে, বেখেয়ালে যে এক ধরনের চকমকি ফুটে ওঠে চোখে তাও সম্ভবত দুজনের চোখে ছিল। মহিউদ্দিনের মুখে পরিষ্কার সেরকম লক্ষণ ছিল, নিজের তো আমার মুখ দেখার উপায় ছিল না, তবে অজান্তে আমার মুখেও হয়তো সেরকম কিছু ছিল। কী করব ভেবে উঠতে পারছি না। মহিউদ্দিন থেকে অল্প তফাতে দাঁড়িয়ে আছি, এক সঙ্গে লিফ্টের চাপা বাতাস টানছি আর উপান্তরহীন হয়ে ভাবছি—সিদ্ধান্ত যত পাকাপোক্তই হোক, পরিবেশ-পরিস্থিতি …
বহু দিন না দেখলেও মহিউদ্দিনকে চিনতে এক নজর তাকানোই যথেষ্ট ছিল। চেহারাটা আগের মতোই, তবে রোগা হয়েছে অনেক, দাঁড়ানো অবস্থায় ওর ছোটখাটো শরীরটা কাঠি-কাঠি লাগছিল। একবার মাত্র তাকালেও ওর রোগাটে শরীর আমার নজর এড়ায়নি। লিফ্টটা যদি খালি হতো, মানে আর কেউ না, শুধু আমি আর ও, তাহলে কী এত দিন পুষে রাখা সিদ্ধান্তটা কাজে খাটিয়ে ফেলতাম? আমার পালোয়ানি শরীর, লিফ্ট বন্ধ করে ওকে কাবু করতে মিনিট দুয়েক লাগত, তারপর বুকে-পেটে হাঁটু গেঁথে দুই হাতের পাঞ্জায় ঘাড়-গলা পাকড়ে আরও বড় জোর দুই-আড়াই। ভাবছি বটে, তবে এভাবে হুট করে হয় না—সিদ্ধান্ত যত পাকাই হোক।
দশতলায় দরজা ফাঁক হতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম, হিজাবি মহিলাসহ দুজন বেরোলো, তিনজন ঢুকল। তাকিয়ে না দেখলেও মহিউদ্দিনের নড়াচড়া টের পাচ্ছি না। এর মধ্যে কার মোবাইল হঠাৎ বিকট চেঁচামেচি জুড়ে দিতে আবোলতাবোল কথাবর্তায় লিফ্টের ভিতরটা সরগরম হয়ে উঠল। লিফ্ট থেমে থেমে দুই-তিন ফ্লোর উপরে উঠল, দরজা খুলল, বন্ধ হলো। কে বেরোলো কে ঢুকল খেয়াল করার আগেই দেখলাম প্রায় মাঠ আকৃতির খাঁচায় আমি একা। মহিউদ্দিন কোন ফাঁকে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু দরজা পেরোনোর সময় আমার নজরে না পড়াটা খুবই আশ্চর্যের।
দশতলায় ট্র্যাভেল এজেন্সিতে যাওয়া মোটেও দরকারি মনে হলো না। তেমন জরুরি কিছু না, এদিকে এসেছিলাম বলে ভেবেছিলাম একবার ঢুঁ মেরে যাই, কাজটা ফোনে সেরে নেয়া যেত। কিন্তু এখন কী করি? বেরিয়ে যে গেল, তবে কোন ফ্লোরে বলতে পারব না। অবশ্য ওকে যদি বেরোনোর সময় খেয়াল করতাম, আমিও কি বেরোতাম?
পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে কী করতাম—নাম ধরে ডেকে দাঁড় করাতাম, বা নিজেই এগিয়ে গিয়ে বলতাম ওকে খুন করার জন্য বহু দিন ঘুম হারাম করে তক্কেতক্কে আছি?
হতাশা থেকেই এমন ভাবা। লিফ্ট টানা নিচে নামছে, গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে ঠেকতে বাইরে বেরিয়ে অযথাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে ভাবলাম মহিউদ্দিন এখানে কী করছে? আমার কি এখন নিচে অপেক্ষা করা উচিত? তা কেন? ওকে পেলে এ অবস্থায় কিছু করার কথা ভাবা যায় না। আশেপাশে লোকজন, সময়টা দুপুর বলে মানুষের হাঁটাচলায় টানটান ব্যস্ততা, রাস্তায় গাড়ি-টাড়ির অস্থির পেঁ-পোঁ। এতক্ষণে সুস্থির একটা চিন্তা মাথায় এল। এ জায়গায় খামোখা না দাঁড়িয়ে রাস্তার অপর পারে কাচ ঘেরা কফি-স্ন্যাকসের দোকানে গিয়ে এদিকে মুখ করে বসলে হয়। কতক্ষণ ভিতরে থাকবে, বেরোতে তাকে হবেই, তখন ভেবেচিন্তে যা মাথায় আসে করা যাবে। তফাতে থেকে পিছু নেয়াও চলতে পারে।
পাক্কা দুই ঘণ্টা পার হলেও মহিউদ্দিনের পাত্তা নেই। দূর থেকে চোখ রাখলেও আমার মাথায় ছিল ওর পরনের ইট রঙের ফুলহাতা শার্ট। আর কিছু মনে নেই, থাকার কথা নয়, এক ঝলকের চাওয়াচাওয়ি। দুই কাপ কফি শেষ করে উঠলাম। মনে মনে ঠিক করলাম এই কফি-কাম-স্ন্যাকসবারে অবার আসতে হবে, কবার কে জানে! কিন্তু এমন তো হতে পারে ওপারের ওই ষোলোতলা ভবনে মহিউদ্দিন আর আসবে না, হতে পারে আগে কোনোদিন আসেনি, আজই কেবল এসেছিল কারও সঙ্গে দেখা করতে।
ঘটনাটা দুই দিন আগের। মাথা ঠান্ডা করে কিছু ভাবতে গেলেই মনে হয়েছে মহিউদ্দিন দেশে কী করছে! শুনেছিলাম বিদেশ চলে গেছে, আর তা অন্য কোনো কারণে নয়, আমার ভয়ে। দেশে খোঁজাখুঁজির কিছু বাকি রাখিনি, চেনা-জানা লোকজন কেউই ওর খবর দিতে পারেনি, সবার এক কথা—নাই, দেশে নাই, টরন্টোতে ওর ভাইয়ের কাছে চলে গেছে। শুনে হতাশার মধ্যেও হাঁফ ছেড়েছিলাম। দিনের পর দিন নিজের কাজ-কর্ম বরবাদ করে খুনের নেশা মাথায় নিয়ে কাঁহাতক! ওর মরণ আমার হাতে থাকলে দেখা একদিন হবেই। হলো তো। ধরা-ছোঁয়ার দূরত্বে পুরানা পল্টনের এক ঝাঁ চকচকে ভবনের লিফ্টে—এক ঝলকের চোখাচোখি, আবার এক সঙ্গে নাকে-মুখে একই বাতাস টানা।
ছোটবেলার বন্ধুকে খুন করার সিদ্ধান্ত হুট করে মাথায় ভর করার কথা নয়। শত্রুতাটা কোন পর্যায়ে গেলে এমন জেদ পেয়ে বসে আমি ছাড়া কে বুঝবে! আর এও জানি খুনটা না করে যে আমার নিস্তার নাই, কথাটা মহিউদ্দিনও জানে। সেজন্যই আমার হাত থেকে বাঁচতে বিদেশে পালানো। কিন্তু ফিরে যে এলো! ও কি ভেবেছে খুনের রোখ আমার মাথা থেকে নেমে গেছে? এমনও কি ভেবেছে—ছোট দেশ, আজ হোক কাল হোক, কোথাও না কোথাও দেখা হবে, আমি তখন কী খবর বলে জড়িয়ে না ধরলেও, বা আগের মতো চোখ নাচিয়ে অন্তরঙ্গতা না দেখালেও ভদ্রতার খাতিরে ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক কী করছে-টরছে জানতে চাইব? কিন্তু মহিউদ্দিন এত বড় আহম্মক না যে এসব ভাববে। লিফ্টে এক নজর তাকাতাকিতে আমার বিশ্বাস সে জানে আমি যা করার করে ছাড়ব। আসলে লিফ্টে আমাকে দেখে সে কি কিছুটা হলেও সিঁটিয়ে যায়নি? আমার মন বলছে গিয়েছিল। সত্যিই, না আমার বানোয়াট চিন্তা?
তিন দিনের দিন দুপুরে একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। অচেনা নম্বর ধরি না; কী ভেবে ধরতেই চমকালাম। মহিউদ্দিন। নিরুত্তাপ, সুস্থির গলা। ও জানে পরিচয় দেয়ার দরকার নেই, ভূমিকা-টুমিকা ছাড়া বলে উঠল—খুব অবাক হয়েছ মনে হয়, হওয়ারই কথা। এত দিন পর এভাবে দেখা হবে আমিও ভাবি নাই। মহিউদ্দিন কয়েক সেকেন্ড থামল, তারপর শুরু করল—শরীর-গতর তো দেখলাম আগের চেয়ে তাগড়া। আমি ওয়েট কমিয়েছি, ছিলাম সাতাত্তর কেজি, এখন আটষট্টি, রেগুলার জিম করে কমাতে হয়েছে। অনেকে ভাবে অসুখ-বিসুখে রোগা হয়েছি। খালি তাগড়া শরীর থাকলে হয় না, তাকত থাকতে হয়, তাকত অন্য জিনিস।
আমার মুখে কথা ফুটছে না, ভাবতে পারছি না ও আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছে। ওর বুক কাঁপছে না? ফোন নম্বর পেল কোথায়? এই নম্বরটা যাকে-তাকে দিই না, কার থেকে জোগাড় করল? কী বলতে চায় ভাবতে গিয়ে আমি সাড়া-শব্দ না করে কান খাড়া রাখলাম। ওদিকে মহিউদ্দিন নিশ্চিত হতে চায় তার কথা শুনছি কিনা। ঠাট্টার গলায় বলল—আওয়াজ নাই যে, ডর লাগছে?
এতক্ষণে গলা খুললাম—কার ডর?
মহিউদ্দিন হাসল—যমের। চিন্তা করো না, এসে পড়লাম, দেশে ছিলাম না। গত সপ্তায় নামলাম। তারপর আলগা গলায় বলল—ক-বছরে ঢাকা বদলে গেছে, এত গ্যাঞ্জাম পথেঘাটে!
কী বলতে চায়? এমনভাবে কথা শুরু করেছে জুতমতো কিছু বলার সুযোগ পাচ্ছি না। যদি আগে আন্দাজ করতে পারতাম ওর ফোন, খুন করার সিদ্ধান্তে যে নড়চড় হয়নি তা প্রথমেই বলে ওর পিলে চমকে দিতাম।
উল্টো ও-ই আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, জিম করে শরীর ফিট করেছে, তাগড়া শরীরের চেয়ে তাকতের কথা শোনাচ্ছে। আবার বলছে, যম। কে? ও?
ফোন কেটে দিল মহিউদ্দিন। আমাকে পাল্টা কিছু বলতে না দিতেই এটা করল। কিছু সময় পরে ভাবলাম এভাবে ওকে ছেড়ে দেওয়া যায় না, অন্তত জানুক আমিই ওর যম। ও যেভাবে আলগোছে কথা বলেছে সেভাবে পারব না, আমাকে আমার মতোই বলতে হবে, আর সাফ্ বুঝিয়ে দিতে হবে ওকে শেষ না করে আমার শান্তি নাই। কিন্তু সে-সুযোগ ও আমাকে দিলো না। যে নম্বর থেকে ফোনটা এসেছিল, সেটা বন্ধ। রাগে কী করব বুঝতে পারছি না। কোথায় আমি ওর জন্য কুত্তাপাগল হয়ে ঘুরছি, এদিকে আমাকে শুনতে হচ্ছে ও আমার যম। তার মানে বিদেশে বছর কয়েক কাটিয়ে, জিম করে, ওজন কমিয়ে, ফিট হয়ে আমাকে খতম করতেই ওর ফিরে আসা। রাগের মাথায় হাসিও পেল। কাজটা করব আমি, এদিকে সে শোনাচ্ছে কাজটা তার। হিসাব মিলছে না।
রাতে ঘুম-টুম হলো না। কিছুতেই খেই পাচ্ছি না ভেবে, ওর যেখানে আমার ভয়ে পালিয়ে থাকার কথা, পালিয়ে বিদেশে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল, এখন কেন আমাকেই খুন করার ঘোষণা দিচ্ছে? শুধু ঘোষণা না, প্রস্তুত হয়ে বসে আছে, নইলে গলাটা এত শান্ত ও সুস্থির রাখতে পারত না, কথায় ওলটপালট করত।
খটকাটা এখানেই। মহিউদ্দিন আমাকে খুন করতে দেশে ফিরেছে। এমন হতে পারে কল্পনাও করিনি। যত হাস্যকরই লাগুক, কথাটা আর কারও না, ওর মুখ থেকে শোনা—রাখ-ঢাক ছেড়ে সোজাসাপটা বলেছে। একটা কারণ হতে পারে ভয় দেখানো, যাতে খুনের বিষয়ে এত বছর পর একটা রফায় আসি। যত ভাবি, আমি আমার সিদ্ধান্তের চেয়ে মহিউদ্দিনের মনোভাব নিয়ে খাবি খাই। আমি জানি, ওর জানার কথা কেন ওকে শেষ করতে চাই, কিন্তু ওর কি কারণ থাকতে পারে যে জিম-টিম করে ফিট হয়ে এসে ঘোষণা দিচ্ছে ও আমার যম? কিন্তু আমার ওপর তার রাগের কী কারণ যে রীতিমতো কুল কাস্টমার হয়ে ঘোষণা দিচ্ছে!
ব্যাপারটা আশ্চর্যের। আমি ওকে ছেড়ে নিজের কথা ভাবি, কী করেছি যে ওর মতো প্রায়-ভীতু একটা লোক ঠান্ডা মাথায় খুনের নেশায় তেতে আছে! থাকার কথা আমার, আছিও, কিন্তু ওর মাথায় কেন খুন চাপবে? ও বড়জোর মাফ চাইতে পারে, নিজে সাহস করে সামনে না এলেও কাউকে মাধ্যম ধরে, যাতে আমার মত পাল্টায়, যা কিছুতেই হওয়ার নয়। তারপরও চেষ্টা-তদবির তো করতে পারত, মরণ ঠেকানোর শেষ চেষ্টা।
ভেবে কূল পাই না। ও তো আমার হাত ফসকে চলেই গিয়েছিল, টরোন্টোয় ভাইয়ের কাছে ঠাঁই পেয়েছিল, বাকি জীবন নিশ্চিন্তে পার করে দিতে পারত। ওর আর আমার ব্যাপারটা তো আর কেউ জানে না। ফিরল কেন খুন হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে, এ চিন্তাই আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে।
আবার যখন ভাবি ফেরার কারণ তো জানিয়ে দিয়েছে, তখন হাসি পেলেও হাসিটা ধরে রাখতে পারি না। না, ভয়-ডরের ব্যাপার না, ওকে ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সমস্যাটা, খটকাটা অন্য জায়গায়। ওকে আমি দোষী করেছি, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রেখেছি, কিন্তু ও আমার বিরুদ্ধে এমন কী পেয়েছে যে মরা-বাঁচার তোয়াক্কা না করে আমার কারণেই ফিরে এসেছে—খুন হতে না, করতে!
এই প্রথম আমার ভিতরে একটা তালকাটা বাজনা ঝনঝনিয়ে ওঠে। আমার বিরুদ্ধে মহিউদ্দিনের কী অভিযোগ? সেটা কি আমার অভিযোগের চেয়েও বড়; আমি যে কারণে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বসে আছি, তার নিজের কারণটা কি আরও গুরুতর?
যদি আরেকবার ফোন করে, জবাবটা তো জানতে হবে। যেভাবেই বলুক, ওর জবানিতে জানা দরকার। ওর নিজেরও উচিত আমাকে জানানো। করবে কি ফোন?
মহিউদ্দিনের ফোন পাই না। দিনে দিনে ধৈর্য হারাতে থাকি, যদিও ধৈর্যহীন হয়ে কোনো ফায়দা হয় না। যে খটকায় (সমস্যাকে খটকা কেন বলছি?) পড়েছি, তার সমাধানের পথ আমার জানা নাই। নিজে যা এতদিন জানতাম তা এক তরফা, সেটা আমার দিক থেকে। এবার মহিউদ্দিনের তরফ থেকে জানাটা যে জরুরি; শুধু জরুরিই না, এই জানার ওপর নির্ভর করছে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। এমন কি হতে পারে, মহিউদ্দিন যা বলবে (যদি বলে) তাতে আমি এতটাই চমকে যাব, বা বলা যায় না, ভড়কেও যেতে পারি যা আমার এতদিনের হিসাব-নিকাশ ভণ্ডুল করে দেবে! শুধু নিজের কথা ভেবেছি বলেই এমন হতে পারে?
ফোন বাজলে কাছাকাছি না থাকলে ছুটে গিয়ে ধরি। দুটো মোবাইল পারতপক্ষে কাছছাড়া করি না। পরিচিত, চেনা মানুষের নম্বর ছাড়াও দিনেরাতে কত অচেনা নম্বর যে ধরি!
চুপ করে থেকে মহিউদ্দিন কি আমাকে শাস্তি দিচ্ছে? নিজে কিছু বলছে না, বরং চাইছে আমিই যেন ওর হয়ে জবাবটা খুঁজে বের করি—নিজের সামনে আয়না ধরি। ও কী করে ভাবছে আয়না ধরলেই দেখতে পাব! কী পাব? আয়নায় নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যায় না। আসলে ও চাচ্ছে ওর চোখে নিজেকে দেখি, আর তা করতে গেলে আমাকে কী করতে হবে? নিজেকে নিজের ভিতরে ঠেসে পুরে আঁতিপাতি খুঁজলে কাজ হবে?
ভাবতে গিয়ে কৌতূহল জাগল। অগত্যা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাই করি। প্রথমে ভেবেছিলাম খেলা, দেখা যাক খেলাটা কোথায় নিয়ে যায়। পরপরই টের পেলাম অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখা খেলা নয়। নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভেসে উঠি। ফের ডুব, ফের ভেসে ওঠা।
কী খুঁজছি নিজেই কি জানি? যা খোঁজার তা আমার নাগালে আসে না। না-কি আসার কথাও নয়?
ওয়াসি আহমেদ
গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ অক্টোবর, সিলেটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর। লেখালেখি শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। তাঁর একমাত্র কবিতার বই ‘শবযাত্রী স্বজন’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। এরপর ঝুঁকে পড়েন কথাসাহিত্যের দিকে। ১৯৯২ সালে প্রকাশ হয় প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছায়াদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য’, আর প্রথম উপন্যাস ‘মেঘপাহাড়’ বেরোয় ২০০০ সালে। ওয়াসি আহমেদের সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘প্রগতিশীলতার ইচ্ছাপূরণ’; প্রবন্ধের এই বইটি কথাপ্রকাশ থেকে বের হয়েছে ২০২৪ বইমেলায়। শিশিযাপন, রৌদ্র ও ছায়ার নকশা, বরফকল, The Over Takers, টিকিটাকা, শৈত্যপ্রবাহ, একা দোকা, বক ও বাঁশফুল, তলকুঠুরির গান, কালাশনিকভের গোলাপ, শীতপাখিরা, নির্বাচিত গল্প, ত্রিসীমানা, শিঙা বাজাবে ইসরাফিল, তেপান্তরের সাঁকো, বীজমন্ত্র ও এক যে ছিলাম আমি ওয়াসি আহমেদের অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থ।
বাঙলা সাহিত্য ও ভাষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৯ সালে কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়া আবু রুশদ সাহিত্য পুরস্কার, জেমকন সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার তাঁর পাওয়া উল্লেখযোগ্য সম্মাননা। তলকুঠুরির গান বইটির জন্যেই তিনি তিনটি পৃথক সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছেন।