অরণ্যের নিজস্ব সুরের টানে | মোস্তফা হামেদী

বৌদ্ধ পূর্ণিমাকেই মনে হয় লোকে গৃহত্যাগী জোছনা বলে। না হয় অচেনার জন্য এমন মন পোড়াবে কেন? জীবনের রহস্যগুলো বয়সের সাথে সাথে রং ওঠা কাপড়ের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ফলে মন দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমি ঘরের শিশুটিকে দেখেছি, ঘরের ভিতরের বিচিত্র জিনিসের ভিতর থেকেই কীভাবে রহস্য ও বিস্ময় আবিষ্কার করে অক্লান্ত থাকে। আমার মতো মাঝবয়সী লোকের জন্য নতুন কোনো বিস্ময় খুঁজে পাওয়া তার মতোই দরকারি হইলেও সোজা নয়।

শরীরের ক্লান্তি বিশ্রামে দূর করা যায়। কিন্তু মনের? সে বড় খতরনাক! ফেব্রুয়ারির বইয়ের বিজ্ঞাপন ও বেচাবেচির ক্লান্তির পর মনে হইলো রোজা এলে পড়ে-লিখে কাটাই। কিছু পড়া হইলে মন খিঁচে উঠলো। লিখতে গিয়া দেখলাম তথৈবচ। মন গেলো আরও বিগড়ে। বাড়ি গেলাম ঈদ অবকাশে। সে কেন হবে বাঙালির? যত বাদ-বিসস্বাদের নিষ্পত্তি তো হতে হবে ঈদে। আর গ্রাম প্রকৃতির নিস্পৃহতাকে ঢেকে ফেলে লোকের ঔদ্ধত্য-অশান্তির যত আয়োজন। যারা স্থায়ী তারা কীভাবে সে পুনরাবৃত্তিময় লাগালাগির জটাজালের মধ্যে বছর পার করে ভেবে পাই না। সপ্তাহ যাইতে যাইতেই হাঁপাই উঠি আমি। এই ক্লান্তির উপর ক্লান্তি চেপে মন ময়লা হয়ে ওঠে। তার মধ্যেই এলো পূর্ণিমা। মহান বুদ্ধের জন্মদিন। জানালার গ্রিলের ফাঁক গলে মশারির উপরে ঝিলকায় জোৎস্নার নরম আলো। আমি ব্যাকুল হয়ে উঠি সে ইশারায়। মনে মনে জপতে থাকি কোনো সাবানের-ক্লান্তির ময়লা দূর করার বস্তুর।

হেঁয়াকু এলাকাকে মনে হইলো খাগড়াছড়ির ঘোমটা। এইটা খুললেই যেন পাহাড়ের রূপের দেখা পাওন যায়।

এক.

কিছু কিছু বাসনা এতো দ্রুত কবুল হয়, শুকরিয়া না করে উপায় থাকে না। অনুজ সহকর্মী ইকরাম বহুদিন আগে দাওয়াত করে রাখছিল সকলেরে। এক দফা নানা অজুহাতে না যাওয়ায় বেচারা আর কারও কানে তোলে না। এইবার সুযোগটা নিলাম শুক্রবার সকালে। যেকোনো ভ্রমণের জন্য সঙ্গী খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুদের লগে সফরের একটা অফার ফিরাই দিছিলাম মোটরবাইকে যাওয়ার ঝুঁকি বিবেচনায়। সঙ্গী হিসাবে সহকর্মীরা খারাপ না আমার। সমমনা সবাইকে জানানো হইলো। কেউ বউয়ের সম্মতি পাইলো না, কেউ দূরবর্তী জায়গায় বলে তাৎক্ষণিক সাড়া দিতে পারলো না। সাড়া পাওয়া গেল দুইজনার-হাসান, শামীম। একজন বউরে ভুল বুঝাইয়া, আরেকজন বউরে শ্বশুর-শাশুড়ির হাওলায় রাইখা। ফলে আমিসহ তিন। স্পটে থাকতেছে একজন। চারজনের ছোট দল। যখন কুমিল্লা থেকে রওনা হই, আকাশে মেঘ থাকলেও বৃষ্টি আছিল না। ফেনীর দিকে যত আগাই বৃষ্টির ছাঁট তত গায়ে এসে লাগে। নোয়াখালী থেকে আসা চট্টগ্রামগামী বাসে বারৈয়ার হাট পোঁছাই। হেঁয়াকুর উদ্দেশে সিএনজিতে উঠি। বৃষ্টি ততক্ষণে হাত-পা খুলে ঝরতেছে। আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিহরণ খেলতেছে। পর্দা টানা হইলো ছাঁট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ফাঁক দিয়ে রুট চেনার চেষ্টা করি। যে কোনো জায়গায় গেলে রাস্তার সাইড ভিউ দেখতে দেখতে যাইতে ভালো লাগে আমার। মন যেন তখন কিছুটা হালকা হয়ে ওঠে এতে। একে তো প্রবল বৃষ্টি, তারপর রাস্তার অবস্থা সুবিধার মনে হইলো না। ডানপাশে বসাতে উল্টা দিক থেকে আসা ট্রাকগুলাকে জন্তুর মতো মনে হইতে লাগলো। যেন গটগট করে দাঁত-মুখ বার করে থাবা নিয়ে গায়ে হামলে পড়তেছে। কিছু সময় পরে নতুন পিচ দেওয়া রাস্তার দেখা পাইলাম। সাথে স্বস্তিরও। বৃষ্টি থেমে গেছে এদিকটায়। সাইড ভিউ অসম্ভব সুন্দর লাগা শুরু হইলো। পাহাড়ি পথের উঁচা-নিচা ভাইবটা পাওয়া শুরু করলাম। লতাপাতাগুলা মেঘের পানির ছোঁয়ায় তাজা হয়ে উঠছে। দক্ষ ড্রাইভার বাঁক আর উঁচানিচার সামঞ্জস্য রেখে রেখে আগাইতে লাগলো। ততক্ষণে পর্দা সরিয়ে পাহাড়ের নীরবতাকে উপভোগ করতে লাগলাম। ঘর থেকে বার হওয়া যে ঠিক আছিল, এইবার সত্যই মনে হইলো। প্রতিদিনকার দেখা থেকে ভিন্ন কিছু পেয়ে মন আনন্দে নেচে উঠলো। সুন্দর সুন্দর কত ব্রিজ আর জনপদ পার হয়ে সন্ধ্যা হয় হয় মুহূর্তে হেঁয়াকো বাজার নামলাম আমরা। ভাড়া গুণলাম সত্তর টাকা করে দুইশত দশ টাকা। সিএনজি স্টেশন থেকে একটা মোড় পার হয়ে ফটিকছড়ির স্ট্যান্ড। মাথার উপরে সন্ধ্যার অন্ধকারকে ভেদ করে একটা কৃষ্ণচূড়া দাঁড়ায়ে আছে। লাল লাল তার ফুল মাথা উঁচা করে সবার নজর কাড়তেছে। আমরাও বাধ্য হইলাম তারে গুণতে।

রাঙাপানি চা বাগানের ভিতরে

হেঁয়াকু এলাকাকে মনে হইলো খাগড়াছড়ির ঘোমটা। এইটা খুললেই যেন পাহাড়ের রূপের দেখা পাওন যায়। আমরা পাহাড়ের দিকে না যেয়ে পাশ কেটে সমতলের দিকে আগাইলাম ঘন্টাখানেক। সেখানে পেলা গাজীর মোড়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেছিল হোস্ট ইকরাম। তারে পাইয়াই আমাদের বুকের ছাতি বড় হয়ে উঠলো। কোনো কিছু নিয়াই ভাবতে হবে না আর। আমরা হইলাম এমেচার ট্রাভেলার। আর সে রীতিমতো পেশাদার। আমরা যাইতে রাজি হওয়ায় সে যে লম্বা ফর্দ পাঠাইলো তাতেই প্রমাণ পাইলাম। জুতা কয় প্রকারের নিতে হবে, তাও সে লিখে দিছিল। যাই হোক, আমরা হাজারিখিল যাওয়ার আগে দোকানপাড়ায় থাইমা পরোটা, ডিমপোচ খাইলাম। ঘণ্টা চারেকের জার্নিতে খিদা বেশ চাগা দিয়ে উঠছিল। এতক্ষণ ছিল মূলত গল্পের প্রবেশিকা। যখন সিএনজি নামাই দিয়ে চলে গেল, রাঙাপানি চা বাগানের ভিতরে ঢুকে পাইলাম কাঞ্চনদাকে। এই একটামাত্র লোক ছাড়া বনের মধ্যে মানুষ বলতে আর কাউরেই পাইলাম না। গাইড হিসাবে তিনি সঙ্গ দিবেন আমাদের। আমাদের থাকার জায়গা দেখাইতে নিয়া গেলেন পয়লা। টিনশেড অফিসঘরের পিছন দিয়ে ইটের সংকীর্ণ পথ। এক পাশে গভীর খাদ। খাদের পাড়ঘেঁষা বেতের বন। আরেক পাশে প্রকাণ্ড সব লোহা গাছ। আমরা মৃদু পায়ে হেঁটে একটা গভীর ছড়ার পাড়ে এসে থামলাম। দুই দিকে ছড়া। ওপারে বনের শুরু। ঝাঁপসা আলোয় ঘনঝোপ দেখা যায়। আর বড় বড় গাছের উঁচা মাথা। বিচিত্র পোকার আওয়াজ ধ্বনির সমস্ত জগতকে অধিকার করে আছে। এপারে তটের ঢালু থেকে কিছুটা উপরে খোলা জায়গা। ছোট ছোট ঘাস। পাশে টিনের ছাউনির নিচে কাঠের টুলে বসার ব্যবস্থা করা। আমাদের থাকার জন্য নির্ধারণ করা হইলো খোলা ঐ জায়গাটা। চারপাশে তাকায়ে আমি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলাম কী কী ভাবে ভয় পাওয়া যায়। মনে মনে নিজেরে খোদা তাআলার কাছে সমর্পণ করলাম। ক্যাম্পিংয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকায় ইকরাম সাহস দিচ্ছিলো। ক্যাম্প তৈয়ার করতে করতে আমরা বনের অন্য মুখটা ঘুরে আসতে গেলাম। মৃদু জোছনা। চন্দ্রগ্রহণের কারণে আলো কম। আকাশের মেঘও নিজের মহিমা জানান দিতেছে। রাঙাপানি চা বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বনের মুখটায় এসে বসলাম। চারপাশে নিঝুম পরিবেশ। অদূরে একটা পরিত্যক্ত চায়ের দোকান। কোথাও মানুষ নাই। কথা নাই। এমন একটা পরিবেশের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করলাম। উপরে আকাশ আর বিধাতা। পিছনে ঘন বন। বামে বিস্তৃত চা বাগান। মেঘ আর চাঁদের লুকোচুরি খেলার ফাঁকে ফাঁকে এই ফর্সা হয়, এই অন্ধকার। এক পর্যায়ে গা ছমছম করে উঠলো। আমরা ফিরলাম। মানুষ সাধারণত ফেরা বলতে ঘরে ফেরাকেই বোঝে । আজি আমরা বাইরে ফিরতে এসেছি। বাজার থেকে কাঞ্চন রাতের খাবার নিয়ে আসছে ততক্ষণে। ঝোল ঝোল মুরগির মাংস, কাঁচামরিচ পেঁয়াজ ডলা আলু ভর্তা, পাতলা ডাল। খাইলাম পেট ভরে।

ঘাড় কাত করে দেখি হলুদ পেটের এক জোঁক আমার হাতের শিরা খুঁজতেছে

মানুষও প্রকৃতিতে গৌণ হতে পারে সেদিন আবিষ্কার করতেছিলাম

ভাবলাম, লোকালয়ের দিকে খানিক হাঁটা যাক। গ্রামের মুখে আসার পর একটা কাঠের মাচা পাওয়া গেল। আমাদের জন্য কে যেন বানায়ে রেখে ঘুমাতে গেছে। পা মেলে শুয়ে আমরা আকাশ দেখতে দেখলাম। মেঘের দাপট বেশ কমে এসেছে। চাঁদও যেন রাতের খাবার সেরে ঝলক দেখানো আরম্ভ করলো। মাচার উপরে কাটায়ে দেওয়া যাইতো। এতো মন্থর, নীরব জায়গা। কিন্তু তাঁবুর দুর্নিবার টান আমরা উপেক্ষা করতে পারি নাই। হাসান বলতেছিলেো, চলেন যাই। ধরনটা এমন যেন ঘরে যাওয়ার কথা বলতেছে। শামীম উত্তর দেয়, ঘর তো আজকে বাইরেই। যাইবেন আর কই? নিজেদের মধ্যে হো হো করে হাসলাম। কার ঘড়িতে যেন রাত বারোটার সংকেত দিল। তাঁবুর ভিতরটা পরখ করলাম ভালো করে। কোথাও কোনো কিছু পেঁচিয়ে নেই তো! ঘুমাবো কি ঘুমাবো না এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হতে কাঞ্চন তেরপল নিয়া আসলো। দ্বিধা-দোলাচল কেটে জোছনা চরাচর অধিকার করে আছে। তার বিপুল বিস্তারের ভিতর আমরা চার মানুষ অতিথি। আরও কত প্রাণ ছড়ায়ে আছে আমাদের পাশ ঘেঁষে। মানুষও প্রকৃতিতে গৌণ হতে পারে সেদিন আবিষ্কার করতেছিলাম। সমস্ত মোহ-অহমিকার উর্ধ্বে উঠে আমরা পড়ে রইলাম তুচ্ছ কোনো কিছুর মতো। কতদিন ধরে এমন একটা কল্পনা আমার ভিতরে ঘনিয়ে উঠছিলো। বাস্তবে দেখতে লাগলাম অরণ্যে রাতের ঝকমারি। আমার মনে পড়তেছিলো ‘আরণ্যক’ উপন্যাসে সত্যচরণের ঘোড়ায় চড়ে বন চরে বেড়ানোর কথা। ধাওতাল সাহু, রাজু পাঁড়ে, ধাতুরিয়া…আরও কত চরিত্র! বহু দিন আগে বইয়ে পড়া সেই দিনগুলো দৃশ্যে ফিরে আসতে থাকে চোখের সামনে। জোছনা, রাত আর অরণ্য মিলেমিশে এতো সুন্দর একটা আবহ তৈরি করতে থাকে যে আমাদের ঘুম উবে যায়। প্রকৃতির অনবদ্য বিস্তারের মধ্যে আমরা রাতের সেতার হয়ে বাজতে থাকি। ভিতরের সমস্ত সুর কণ্ঠে ধরা দিতে থাকে। শরীর এতো পাতলা হয় যে আমরা যেন পলকা কোনো পাতার মতো উড়তে থাকি। জাগতিকতার ছেদ ঘটিয়ে অরণ্য বাস্তবতার ভিতর আবিষ্কার করি, জীবন বড় সুন্দর। প্রকৃতির ভিতরে আমাদের অস্তিত্ব একটা পাতা কিংবা পাখির মতোই;-মনে হয়।

দুইটা মতো বাজলে অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ে। আমার চোখের ঘুমভাব ততক্ষণে কেটে গেছে। অন্যদের ঘুমের শব্দ কানে বাজতেছে। এখন রাতের সমস্ত রূপ আমার ভিতরে স্পষ্ট হয়ে উঠতেছে। বিশেষত ভয়। গাছের শুকনা ডাল পড়ার শব্দ, পাতার খসখস, অচেনা শব্দেও গায়ের রোম খাড়া হয়ে উঠলো। একে চাঁদের রূপের মোহ, আরেকে রাতেরে সন্দেহ আমারে ঘুমাতে দেয় না। নির্জন পৃথিবীর এমন সুধা আমি সর্বাঙ্গে ধারণ করতে থাকি। এর মধ্যে কিছুটা তন্দ্রা পায়। তবে সে আর কতক্ষণ! পাখিরা ঘুম থেকে উঠে একে অপরকে তারস্বরে ডেকে তুলতে থাকে। এতো পাখির ডাক আমি শুনি নি কভু! একদা কবিতায় লিখেছিলাম, “এ ভরা ভোরের রূপ এসেছে গাভীর বাঁট বেয়ে”। সেই ভোরই যেন হাজির আমার চোখের সমুখে। এখানে প্রকৃতিই ঠিক করে দেয় ওঠা বা জাগার কাল। ফলে রোদের তাপ কিছুটা বাড়লে আমাদের শুয়ে থাকা সম্ভব হয় না আর।

পরে বুঝলাম এটা অরণ্যের নিজস্ব সুর

দুই.

নয়টার দিকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হাজারিখিল অভয়ারণ্যের ঝিরিপথ ধরে হাঁটা। ইকরাম যেভাবে বলতেছিল, যেন বাড়ির পাশের গড়ে হাঁটা। কিন্তু এখানে যতই আগাচ্ছি, ঘন বন আর নুড়িময় স্বচ্ছ জলের পথ সে ধারণাকে ভেঙে দিচ্ছিল। আস্তে আস্তে পথ কঠিন হয়ে উঠলো। লতাপাতায় ছাওয়া, চোখা কাঁটার বেতের আস্তরণ, বাঁশঝাড় আর নানাবিধ গাছালি পার হয়ে যেতে যেতে প্রত্যেকেই বাঁশের টুকরা কুড়িয়ে অবলম্বন তৈরি করে নিলাম। এই ধরনের হাঁটায় এটা বড় শক্তি ও সাহসের উপকরণ হয়ে উঠলো। প্রথম দিকে মানুষের কিছু ছোঁয়া পাওয়া গেল। লেবুপাতার ঘ্রাণ মনে করাইয়া দিল এখানে মানুষের-কাঁচি-কোদালের দাগ আছে। ধীরে ধীরে এই কৃত্রিমতা লুপ্ত হইলো। একেবারে আদি ও অকৃত্রিম অরণ্য। একটানা এক বাঁশির শব্দ বেজে চলেছে। আমি প্রথমে ভাবছিলাম গভীর কোনো শোরগোল। পরে বুঝলাম এটা অরণ্যের নিজস্ব সুর। সেই টানেই মনে হয় আমরা এখানে এসেছি। কিন্তু আমাদের যত পুলক, তার তাতে তত ভয়। কাছে যেতেই সে সুর থেমে গেল। সম্ভবত মানুষ ব্যাপারটা তাদের জন্য উপদ্রব হয়ে এসেছে। নাহয় আমাদের উপস্থিতি তাদের মূক করবে কেন? তাদের নমিত সুরের ভিতর দিয়ে আমরা আরও গভীরে যাই। নুড়িপথ রূপ নিয়েছে পাথর পথে। দুই পাশে তাকায়ে দেখলাম পাহাড়গুলি আগের থেকে বেশ উঁচা এইখানে। পথ সংকীর্ণ। পানির প্রবাহ বেশ। পাথরের খাঁজ বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে দূরের দেশের দিকে। নতুন একটা সুর কানকে মুগ্ধ করলো।

এই জনপদে পেলা গাজী এক রহস্য ও মিথের নাম

পুরা পথে আমরা চারজন মাত্র। সকালে দলে দলে নারী-পুরুষকে বনে ঢুকতে দেখছিলাম। আলাপে জানলাম এঁরা ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর। তারা কোথায় যে হারায়ে গেল! ঝিরিপথের এই দিকটা জনমানবশূন্য। গা ছমছম ভাবটা ফলে থেকেই যাচ্ছিল। সকালে দেখা আকাশের মেঘ ভাবটা একদম কেটে গেছে। পরিষ্কার রোদ গাছালি ও পাহাড়ের গা বেয়ে এইখানে পড়তেছে। এক অনিন্দ্য স্বর্গীয় শোভা ধারণ করেছে জায়গাটা। বড় দুইটা পাথরে বসে আমরা সাথে করে আনা কলা ও পানি খেলাম। চিবালাম বাগান থেকে ছিঁড়ে আনা সবুজ লেবু। তারপর আবার হাঁটা শুরু পৃথিবীর নির্জনতার দিকে। যত হাঁটি তত মুগ্ধ হতে হয়। কোথাও কোথাও দুইদিক থেকে পাহাড় এতই চেপে আছে  যে পথ সংকীর্ণ হয়ে গেছে। উপরে তাকালে খাড়া পাহাড়। কালো-পাথুরে। পানির স্রোত কেটে কেটে নকশা করে রেখেছে। ছবি তুললাম আমরা মনভরে।

আমাদের গ্রামপ্রকৃতি একদা অরণ্যের কত আপনার ছিল, আহা!

আন্ধার-আন্ধার ভাব। আমাদের গতিরোধ করার জন্য যথেষ্ট। তাছাড়া ততক্ষণে ঘণ্টা দেড়েক পথ হাঁটা হয়েছে। যেকোনো সফরে সম্ভবত পথ মাপা হয় সময় দিয়ে। কেননা অন্য কোথাও ঘোরার তাড়া থাকে। ফিরতি পথে হঠাৎই দুইটা লোক বনের কোণ থেকে মাথা বের করে জিজ্ঞাসা করলো আমরা কারা? হাতের দা চকচক করছে। যেন আমাদের দিকে তাক করা। তাদের চোখ সুবিধার মনে হইলো না। বনের পাহারাদার পরিচয় দিল। ভাবসাবে যে রুক্ষতা তাতে দস্যু ভাবলে দোষের হবে না। ইকরাম স্থানীয় ভাষায় জবাব দিলে তাদের কড়াভাব কিছুটা কমে আসে। কথা বলতে বলতে আমাদের হাঁটা চলতে থাকে। আচমকা আমার হাতের মধ্যে চুলকানি অনুভব করলাম। ঘাড় কাত করে দেখি হলুদ পেটের এক জোঁক আমার হাতের শিরা খুঁজতেছে। জোঁকে আমার আজন্ম আতঙ্ক। আকস্মিকতায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম। হাতের বাঁশের কঞ্চি দিয়ে ডলা দিতেই ওটা বাঁশে সওয়ার করে। অন্যরা প্রথমে লাফিয়ে ওঠে, পরে সহযোগিতা করে। বাঁশ থেকে জোঁক ছাড়িয়ে জোরে জোরে পা ফেলতে লাগলাম ফিরতি পথে। এবার পথ চেনা। ফলে গতি বেশি। বনের মধ্যে একটা স্থবিরতা চলে আসছে। নিঝঝুম দুপুর। ঝিরিপথ থেকে উঠতেই পাকা বসার জায়গা। জিরিয়ে নিলাম কিছুক্ষণ। মনে হইলো যেন বহুদিন একটানা বসে থাকা যায়। গাছের পাতা কিছুটা দুলতেছে। মৃদুমন্দ হাওয়া। দুই-চারজন করে বনকর্মীরা ঝোপ থেকে পাখির মতো হঠাৎ করে মুখ বার করে আসতেছে। যেন তারা কোথাও ছিল না সকালভর। আবির্ভূত হল মাত্র। আমরা বসে রইলাম বেশক্ষণ। পাশেই লোহার ছোট্ট একটা ব্রিজ। ব্রিজ বেয়ে পাকা সিঁড়ি দিয়ে ছোট একটা পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। ট্রাভেলারদের জন্য ওখানে দোলনা বানিয়ে রাখা হইছে। বেয়ারিংয়ের চাকা শিকলের দুই পাশে থাকায় দুলতে কোনো কসরত করতে হয় না। শুধু পা দিয়ে মাটিতে কিছুটা চাপ দিলেই হয়। চোখ মুদে দুললাম আমরা পালা করে করে। পাশেই খোলা একটা ইঁদারা। বিপদজনকভাবে মুখ হা করে আছে। বনবিভাগের লোকেরা কোনো অতীতকালে জনহিতে হয়তো খুঁড়েছিল। মানুষের কত তৃষ্ণাই না সে মিটিয়েছে। এখন তার ভিতরে পোকামাকড়, আবর্জনা! যুগের পরিবর্তনে কোনো কিছুর অর্থ ও ভূমিকা যে কত বদলে যায় ,এই ইঁদারা তার সাক্ষ্য দিতে যেন টিকে আছে এখনো। চূড়ার বিপরীত প্রান্তের সিঁড়িপথ দিয়ে নামলাম কিছুটা বনের দিকে। এই দিকে প্রাচীন সব গাছ। চারজনের হাতের বেড় দিয়েও ধরা যায় না। বয়স, সময়, গুণাগুণ কত কী ভেবে আমরা বেরিয়ে আসলাম। পথে নামতেই এক বড় জারুল গাছ তার বেগুনি সৌরভ নিয়ে আমাদের অভিবাদন জানালো। এতো সুন্দর জারুল আমি দেখিনি কখনো। ফুলগুলি ঘন। রঙ বেশ পাকা। সমতলের জারুল যেন আরও হালকা হয়। ফুলও এতো ঘন, বিন্যস্ত থাকে না। প্রাণভরে তার রূপের প্রশংসা করলাম। হয়তো নীরবে সে আমাদের শংসা ধারণ করে থাকবে। আহা! কত গাছের সাথেই না পরিচয় হলো। ডুমুর, কালো জাম গাছ কতদিন পরে দেখা হলো। ছোটবেলায় যেসব গাছের সাথে খেলা করেছি, তার অনেকগুলিই এখানে রয়ে গেছে। আমাদের গ্রামপ্রকৃতি একদা অরণ্যের কত আপনার ছিল, আহা!

চিরদিনের মতো অন্য লোকের ছবি এঁকে ফিরলাম

তিন.

ফরেস্টের পাওনা মিটায়ে আমরা চললাম পেলা গাজীর মোড়ে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা ওখানে করা হইছে। মোড়েই প্রাচীন এক দিঘি। হাটহাজারী হতে খাগড়াছড়ির দিকে আগাইলে এই দিঘির দেখা পাওয়া যাবে। পদ্মপাতা ভাসতেছে দিঘিজুড়ে। পূর্বপাড়ে হাইওয়ের পাশে পেলা গাজীর কবর। পশ্চিমপাড়ে মসজিদ। মোঘল আমলের বলে কথিত। এই জনপদে পেলা গাজী এক রহস্য ও মিথের নাম। তিনি এইখানে জনবসতির পত্তন করেছেন, এমনকি ইসলামেরও। এই গল্প শুনতে শুনতে খানিকক্ষণ ডুবাই দিঘিতে। গোসল সেরে পেলাগাজীর মসজিদে নামাজ পড়ি দুই রাকাত। রাস্তা থেকে কয়েক ফুট নেমে পড়তে হয় মসজিদে ঢুকতে গেলে। প্রাচীনতাকে রক্ষা করতে গিয়ে এই সুন্দর সামঞ্জস্য লোকেরা বজায় রাখছে দেখে ভালো লাগলো।

চাটগাঁইয়া খাবারের সুখ্যাতি বহু শুনেছি। আজ আবার প্রমাণ পাইলাম। ইকরামের মাতার মমতাভরা হাতের রান্নার স্বাদ বহুদিন মুখে লেগে থাকবে। খাওয়া শেষ করে আমরা রওনা হলাম শেষ গন্তব্য হালদা ভ্যালি চা বাগানের দিকে। পাহাড়কে চায়ের সারি সারি গাছ এমন চমৎকার করে ধরে আছে যে, মনে হয় যেন দারুণ কোনো চিত্রকর্ম। ছবির মতো সুন্দর চা বাগানের পথ ধরে হাঁটি খানিক। দুই-একদিন আগের বৃষ্টিতে নতুন কুঁড়ি এসেছে সমস্ত বাগান জুড়ে। একটি কুঁড়ি দুটি পাতা, যথার্থ প্রমাণ করতে যেন নিজেকে সাজিয়ে রেখেছে। সেই সজ্জা আমি মনে গেঁথে রাখলাম। আমার চোখ দৃষ্টি সংবরণের ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে অপলক তাকাতে লাগলো। যে কোণ থেকেই দেখি, শান্ত সবুজ।

চার.

আমি ফিরলাম। হৃদয়ে চিরদিনের মতো অন্য লোকের ছবি এঁকে ফিরলাম। নিত্যদিনের কোলাহলে, প্রাত্যহিকতা যখন ঝেঁকে ধরবে, মন হবে অশান্ত-অস্থির খুলে খুলে দেখবো সেই ছবির গাঢ় রেখাগুলি। অরণ্য-প্রকৃতির সুর তাতে মিশে আমার একঘেঁয়ে দিনগুলিকে রঙের আনন্দে ভরে তুলবে তখন।


মোস্তফা হামেদী

কবি, প্রাবন্ধিক

শেয়ার