অমিতরূপ চক্রবর্তীর গল্প ‘ধ্বনি’

মুরগীটা বেশি দূর ছুটতে পারল না । একটা পচন লাগা আস্তকুঁড়ের সামনে এসে কুকরটার নাগালে পড়ে গেল । কুকুরটাও হার্ডেল পেরোনো ঘোড়ার মতো ছন্দময় গতিতে দৌড়চ্ছিল অ্যাতোক্ষণ মুরগীটার পেছনে । আস্তকুঁড়ের জাজিমে সে মুরগীটাকে শুইয়ে ফেলল এবং একটা ডানা টেনে উপড়ে নিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে চিবোতে লাগল । রক্তাপ্লুত মুরগীটা তখনও গ্রাম্য বৌ-ঝিদের মতো ক্যাঁও ক্যাঁও করে চেঁচাচ্ছে । এই চেঁচানিটা বোধহয় কুকুরটার পছন্দ হল না । সে মুরগীটার পালকে ঢাকা হৃৎপিণ্ডের ভেতরে দাঁতগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে বসিয়ে দিল । উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার মতো গরম রক্ত ছিটকে উঠে ভিজিয়ে দিল কুকুরটার মুখমণ্ডল । এভাবে কুকুরটাকে দেখাচ্ছিল দোলের দিন মুখে রঙ মাখা মানুষের মতন ।

প্রচণ্ড শক্তিশালী একটা রোদের দিন । ক’দিন পরেই শীত ভারী সমুদ্রের মতো এসে পড়বে । রাতের বাতাসে তার পাইক-পেয়াদা, চৌকিদারেরা এসে হাঁক দিয়ে যায় । আকাশে তীক্ষ্ন নীল । এমন নীলের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না । চোখ জলাকার হয়ে যায় । তারপর আগে-পিছে তাকাও যদি সব ঝাপসা-ঝাপসা দেখায় । এমন তীক্ষ্ন নীল আকাশে । নির্বিচারে তেরছা হয়ে রোদ আসছে সূর্য নামক একটি ফায়ারবল থেকে । তেরছা হয়ে গাছপালার ফাঁক দিয়ে পড়ছে বাড়ির ছাদে, কার্নিশে, কলতলায়, জানালা দিয়ে বিছানায়, শ্যাওলা আক্রান্ত নালায় । নাইলনের দড়িতে টান করে মেলে দেওয়া ভিজে গামছায় । মিষ্টি খাবারের টুকরোর মতো সব আশেপাশের পাখিরা গাছের ইমামবারা থেকে ডাকছে । নিভা ছাদে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গলা উঠিয়ে চোখের আশেপাশের চামরা কুঁচকে তারে জামাকাপড় মেলছিল । ওর পায়ের কাছে একটা অ্যাক্রিলিক পেইন্টের সাদা বালতি । তাতে অজগরের মতো মোচড় খাওয়া জামাকাপড় যেমন আছে , তেমনি ফড়িং বা স্বপ্নলোকের বড় পাখনাওলা ব্রা প্যান্টি, মেয়ের ছোট্ট জাঙিয়া, বরের রুমাল- এসবও আছে । রোদের হলকায় নিভার নাকের আশপাশ লাল । ঘাড়ের দিকে চুলের গোড়ায় কাচগুঁড়োর মতো ঘাম । ভুরুতে গালের খোসায় জলের ফোঁটা । নাকের নীচে পুরুষালি হরমোনের অভাবে যে প্রায় দুর্লক্ষ লোম- তাতেও ঘাম আর জলের ফোঁটা ।

নিভাদের দেয়ালের রঙ লাইম ইয়োলো । বড় বড় গ্রিলের কাজ করা জানালা আছে সেই দেয়ালে । জানালার মাথায় ঘের দেওয়া টুপির মতো কার্নিশ । তার ওপরে ভেন্টিলেটর এবং তা ছাড়ালে ছাদ । কুকুরটা দেখল একটা মূর্তি সেখানে আকাশে উড়ন্ত বেলুন ধরা খেলার মতো নড়ছে । সে যে কোনও কারণেই হোক – হয়তো আদিম কোনও নির্দেশে বা কিছুটা পরিতৃপ্তির আদেশে ওই নড়াচড়া করা মূর্তিটার দিকে রক্তাক্ত মুখে তাকিয়ে রইল ।

বালতি থেকে আরও কয়েকটা কাপড় তুলতে গিয়ে নিভার নজরে পড়ল কুকুরটা । প্রায় ছাল ছাড়ানো খাসীর মতো কেতরে পড়ে থাকা মুরগীটা । নিভা চোখ না সরিয়েই চিৎকার করতে থাকল – বিজন বিজন , একবার শিগগিরই এসো ।

আজ ছুটির দিন । বিজন একটি স্যান্ডো গেঞ্জি আর লম্বায় খানিকটা ছোট হওয়া পাজামা পরে শোবার ঘরের বিছানায় হেলান দিয়ে একটি মেয়েদের মাসিক ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল । না, পড়া নয় শুধু পাতা উল্টে রকমারি বিজ্ঞাপন , মেয়েদের রূপচর্চার টিপস আর স্বল্পবাস মাদক মেশানো চোখের মডেলদের দেখছিল । একেকজনের কতরকম আলাদা আলাদা আহ্বান । কেউ বুকের ক্লিভেজ থেকে তর্জনি উঠিয়ে ডাকছে বা কেউ হয়তো ছোট্ট একটা বেতের মোড়ার ওপর পা তুলে । ছিন্ন কলার খোসার মতো দু-দিকে সরে গেছে গাউন আর সেখানে চকচক করছে উরু । ডান পায়ের গোড়ালির দিকটা এসব থেকে চোখ না সরিয়েই বারবার চুলকে নিচ্ছিল বিজন । এমন সময় ছাদ থেকে নিভার চিৎকারটা ভেসে এল ।

ছাদে সেই তেরছা হয়ে আসা রোদ । পাশের বাড়ির কয়েকটি গাছের ছোপ । সিঁড়িঘর দিয়ে বেরিয়ে এসে বিজন জিজ্ঞেস করল – কি, কি হয়েছে ?

নিভা বলল- দ্যাখো কী কাণ্ড !

বিজন দেখল কাণ্ডটা । এতে সে অবাক হবার মতো কিছুই পেল না । একটা মাংসাশী প্রাণী আরেকটা প্রাণীকে মেরেছে – এতো প্রকৃতির নিয়ম । গোটা প্রাণীজগতের কনভেনশনাল ইকোসিস্টেম । একজন মরে গিয়ে আরেকজনকে বাঁচতে দেবে । এতে অ্যাতো বিস্ময়ের কী থাকতে পারে ভেবে পেল না বিজন । সে কোনও কথা না বলে হেঁটে হেঁটে ছাদের আশপাশটা দেখতে লাগল । পেছন বাড়ির দিকটায় জংগল হয়েছে । ঠাকুমা নাতি-নাতনি সহ অনেক বুনো কচুগাছও তার চোখে পড়ল । ঢিবি হয়ে গ্যাছে আস্তাকুঁড়টা । ওটাও একদিন  লোক নিয়ে পুড়িয়ে চেঁছে পরিষ্কার করা দরকার । নাহলে পাঁচিলের ওপারেই সরকার কাকুদের বাড়ি । দুর্গন্ধ ছড়ালে ওঁরা এসে বলবেই । সরকার কাকু রিটায়ার্ড লোক । সপ্তাহে চারদিন লাল চেক কাটা গামছা পরে বাড়ির কোনা কোনা পরিষ্কার করে বেড়ান । শুকনো পাতায় আগুন দেন । সেই ধোঁওয়ায় সাদা হয়ে যায় অনেক বাড়ির মাথা । বিজনদের একেবারে সদরের গ্রিলের গেট অবধি সাদা-সাদা ড্রাগন উড়ে বেড়াতে থাকে । কখনও কী এক পাতা পোড়া ধোঁওয়া নাক দিয়ে গলায় চলে গেলে খকখক করে কাশি ওঠে । তাছাড়া কচুগাছগুলোও বিচ্ছিরি রকমের লম্বা হয়েছে ।

কেতরে পড়ে থাকা মুরগীটার দিকে চোখ দিল বিজন । বেশ নধর মুরগী । ছাল-পালক ছাড়িয়ে নেট সাতশো মাংস বেরোবে- এতে কোনও ভুল নেই । ওপেন করা হৃৎপিণ্ডের চারধারে পালকের রঙ কালো আর মেরুনে ব্লেন্ড করা । মাথার ঝুঁটি দেখেই বোঝা যায় ও নারী মুরগী । বিজন ছাদের ধারে এগিয়ে আসতেই কুকুরটা ওটা ফেলে পালিয়েছে । মারার ভঙ্গী দেখে আন্দাজ করা শক্ত কুকুরটি পুরুষ না নারী ।


খিদে অনেক সময় লিঙ্গ-ভেদকে লুপ্ত করে ফ্যালে । এমনিভাবে হৃৎপিণ্ডে দাঁত বসাতে পুরুষ কুকুর বা নারী কুকুর দু’জনেই পারে ।


নিভা বলল- দেখলে কীভাবে মুরগীটাকে মেরেছে ?

পাজামার পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল বিজন । তারপর সিগারেট ঠোঁটে চেপে ব্যার ব্যার করে বলল- এতে দেখার কী আছে ? কুকুরটার খিদে পেয়েছিল , মুরগীটাকে মেরেছে । তাছাড়া ওর আর করার কী । বাজারে গিয়ে কিনে আনবে ?

লোডশেডিং-এর পর হঠাৎ বিদ্যুত এলে যেভাবে বন্ধ মোটর আপনাআপনিই চলতে শুরু করে , নিভাও সেভাবে আবার কাপড় মেলে দেওয়ায় মন দিল । নিজের একটা ব্রা মেলে দিতে দিতে উর্দ্ধমুখ হয়েই বলল- টিনাকে আজ সন্ধেয় কোথাও ঘোরাতে নিয়ে যেও । সারাটা দিন বাড়িতে আটকা পড়ে থাকে মেয়েটা । খেলার সঙ্গী নেই । মোবাইল আর টিভিতে বোর হয়ে যাচ্ছে ও । রাতে সহজে ঘুমোতে চায় না । মোবাইল দেখে দেখে চোখ দুটোও যাচ্ছে ।

বিজন ঠাকুমা নাতি-নাতনিসহ কচুগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল- তুমিও তো কখনও ওকে একটু ঘুরিয়ে আনতে পার ।

নিভা বলল- সব কাজ শেষ করে আর এনার্জি পাই না । বিছানায় একটু গড়ালে আর উঠতে ইচ্ছে করে না ।

বিজন নিভার দিকে না তাকিয়েই বলল- নির্মলা কাজ করে যাবার পরেও অ্যাতো কী কাজ থেকে যায় তোমার ?

নিভা এবার বিজনের রুমালটা তারে মেলে ক্লিপ আটকাতে আটকাতে বলল- ওমা , নির্মলা কটা আর কাজ করে । সাত তাড়াতাড়ি বাসন আর জামাকাপড়গুলো কোনওরকমে কেচে দিয়েই তো চলে যায় । পরে আমি গিয়ে দেখি বাসনে স্টেইন , তোমার জামার কলারে রাজ্যের ময়লা , আমার নাইটি থেকে হলুদের দাগ মোছেই নি । আবার আমাকে সব ধুতে হয় । ঘুরিয়ে আবার শুরু থেকে সবই করতে হয়

বিজন বলল- তো, ছাড়িয়ে দিলেই তো পার।

নাঃ , করছে করুক । অনেকদিন তো হল কাজ করছে । ছাড়ালে বেচারি বিপদে পড়ে যাবে । ওর বরটা তো কিচ্ছু করে না । সকাল-সন্ধ্যা মদ খেয়ে পড়ে থাকে । ঘরে দুটো বাচ্চা । ছাড়িয়ে দিলে বাচ্চাগুলোকে উপোস করে থাকতে হবে ।

শক্তিশালী রোদে রোদে নিভার মুখ গরম লোহার মতো লাল এখন । ওদের মেয়ে টিনা আজ গেছে দিদার বাড়ি । নিভার মায়ের বাড়ি একই পাড়ার মধ্যে । যাতায়াত আছে , তবে তেমন বেশি নেই । নিভার বাবা এখনও বেঁচে আছেন । প্রায় সত্তরের ওপর বয়েস হল ওনার । রেলওয়েতে চাকরি করতেন । নিভারা দুই বোন , এক ভাই । ভাই মানে ওদের দাদা । নিভার বোনের অবশ্য দূরে বিয়ে হয়েছে । নিভার বাড়ির অমতে বিজনের সঙ্গে বিয়ে । সেই স্টিগমা আবছা হলেও এখনও যেন ওর দাদার মনে , বাবার মনে লেগে আছে । বিশেষত হয়তো নিভার দাদার । কেননা নিভা আর বিজনের মধ্যে যখন বাঁধভাঙা মেলামেশা চলছে – নিভার দাদা একবার বিজনের কলার চেপে ধরেছিল । ভরা দিনের রাস্তায় । নিভারা কোথাও হাঁটতে গিয়ে ফিরছে । সব দোকানপাট ক্যামেরার লেন্সের মতো । নিভার দাদা বিজনের কলার চেপে ধরে একটা স্ল্যাং উচ্চারণ করতেই বিজন সপাটে নিভার দাদার গালে চড় বসিয়েছিল । রক্তের রাসায়নিক কারণে এই ঘটনাটায় খুব দমে গিয়েছিল নিভা । মাস তিনেকেরও বেশি বিজনের ফোন ডাইভার্ট করে রেখেছিল । রাস্তাঘাটে বেরনোর সময় এমন একটা টাইমিং করেছিল যাতে বিজন ওকে ধরতে না পারে । একদিনও কোথাও বিজনের সঙ্গে দেখা হয়নি বা ওকে চোখেও পড়েনি । রক্তের রাসায়নিক যতক্ষণ তেজস্ক্রিয় ছিল – ততদিন অন্য দিকটা ভাবেই-নি নিভা । রাসায়নিকের তেজ কমে আসার পরে ওর মনে হয়েছিল বিজনও কি এমনই টাইমিং করেছিল যাতে নিভার সঙ্গে ওর দেখা না হয় । কেন ?

কল ডাইভার্ট ডিজেবল করে নিভাই একদিন ফোনে ধরার চেষ্টা করল বিজনকে । বিজনের কলারটিউনে একটা সুন্দর মার্গীয় সংগীত সেট করা ছিল , সেটা শুনলেই খুব ভাল লাগত নিভার । সেই সংগীতটা অনেকক্ষণ ধরে হল কিন্তু বিজন ফোন ধরল না । কয়েকবার এমন নির্বিঘ্নে ওই মার্গীয় সংগীত শোনার পর কেমন একটা শীতল ভয় ভেতরে উথলে উঠে এল নিভার মনে । মনে হল যেন তার ভেতরের সব আসবাব টুক করে একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে । কলেজের লম্বা টানা বারান্দার মতো একটা ফাঁকা করিডোর নিভাকে ফুঁড়ে ফেলছে। ওর কণ্ঠমণি সাঁড়াশির মতো দশটা আঙুলে পিষে ধরতে চাইছে । প্রায় ব্যধিঘোরের মতো বারবার ফোন করে গেল নিভা । বিজন ফোন ধরল না ।

 

নিভা যখন ছিঁড়ে যাচ্ছে, তখন একদিন বিকেলের দিকে বিজনের ফোন । ফোনটা সাইলেন্ট থাকায় বোঁও বোঁও করে কাঁপছে আর স্ক্রিনে বিজনের নামটা ফুটে উঠেছে । বিকিরিত হচ্ছে যেন বিজনের নামটা জলপাই রঙের একটা সমুদ্রে । ফোনটা ধরে হ্যালো বলার সময় নিভার গলাটা নড়বড় করে টলে উঠল । ফোনের ওপারে বিজন । ওর গলা স্টিলের রিবারের মতো । বিজন বলল- তুই কাল সাড়ে চারটায় কলেজের সামনে আসতে পারবি ? নিভার গলা ভেঙে পলেস্তারার মতো খসে খসে পড়ে যাচ্ছিল । ও মাথা কোনওরকম কাত করেই বুঝল এটা ফোন । ওপার থেকে বিজন তাকে দেখতে পাবে না । বিজন কোনও সাড়া না পেয়ে বলল- পারবি ?

নিভা কোনওরকমে হ্যাঁ বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দিয়েছিল বিজন ।

বিয়ের প্রায় সাত বছর পরে কখনও একলা দুপুরে , যখন বাইরেটা ঠাণ্ডা আগুনের মতো জ্বলতে থাকে- তখন কখনও নিভার মনে হয় নীরবতার সেই তিন মাস কী করছিল বিজন । বিজন তখনও ইস্কুলের মাস্টারির চাকরিটা পায়নি । ও তখন বাড়ি বাড়ি ঘুরে টিউশন পড়াতো আর একটা কী এজেন্সি অফিসে রিপোর্ট রিটার্নের কাজটা দেখত । সেই তিন মাস যে ও মন দিয়ে শুধু কাজে ডুবে থেকেছে- এমনটা বিশ্বাস হয় না নিভার । বিয়ের পর যখনই নিভা অনেক স্বর্গীয় মুহূর্তে বিজনের থুতনিতে বা রাবারের ছিপির মতো স্তনের চারদিকে নখ ঘোরাতে ঘোরাতে এই প্রশ্নটা করেছে , কোনও জবাব দেয়নি বিজন । যেন ওই তিন মাসের সব কথা , সব রেকর্ড ওর স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে । প্রশ্নটা নিভা রিপিট করলে বিজন পাশ ফিরে শুতে শুতে বলত- রাত হল, ঘুমিয়ে পড়ো ।

পরদিন বিকেল চারটেয় কলেজের সামনে এসে দাঁড়াল নিভা । নভেম্বর মাস শুরু হয়েছে । দিনের গায়ে ফুরোনো আলোর বিষণ্ণতা । রাস্তায় অসংখ্য হেমন্তের মানুষ । হেমন্তের মানুষেরা কেমন যেন চুপচাপ আর আবছা আবছা হয়। তেমনই সব অসংখ্য মানুষ । কেউবা ঘরমুখী , কেউবা বিপরীতগামী । অনেক ই-রিকশা, সাইকেল, বাইক ও অন্যান্য গাড়িঘোড়ার মিলিত এক গুঞ্জরণের শব্দ । কী এক উত্তেজনায় বুকের ভেতরটা ধকধক করছিল নিভার । হাত-পায়ের মাংসপেশী যেন খোলা প্লাগের মতো ঝুলে পড়েছে । কোথায় বিজন ?


নিভার ক্রিম-সাদা শাড়িতে বাতাস ঢুকে পড়ে ছটফট করছিল । আশেপাশে জলস্রোতের মতো মানুষ , যানবাহন অথচ বিজনকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও ।


দিদি – বলে একটি কোঁকড়া চুলের ছিপছিপে ছেলে কোনও আড়াল থেকে নিভার দিকে এগিয়ে এল । বলল- চিনতে পারছেন ? আমি সৈকত । প্রথমে ছেলেটাকে ঠাহর করে উঠতে পারল না নিভা । সৈকত নামের কোনও পরিচিত ছেলের নাম তার ক্রিয়াশীল স্মৃতির পৃষ্ঠায় নেই । নিভার অবস্থাটা বুঝতে পেরেই হয়তো ছেলেটা আবার বলল- পার্কের কাছে আমার চায়ের দোকান । এবার মনে পড়ল নিভার । পার্কের চেয়ারে বসে গল্প করার সময় এই ছেলেটাই চা এনে দিত । কখনও বিজনের সিগারেট বা বাদামের ঠোঙা । মনে পড়ার পর সৈকতের দিকে তাকিয়ে একটু কাঠ হাসল নিভা- কেমন আছ?

ভাল আছি । আপনি আমার সঙ্গে আসুন । বিজনদা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে ।

একটু অবাকই হল নিভা । বিজন তাকে এখানে ডেকে অন্য কোথায় অপেক্ষা করছে ? আর এই সৈকত নামের ছেলেটাকে ও পাঠিয়েছে নিভাকে রিসিভ করতে ? মুহর্তের জন্য সবটাকে কেমন জংধরা তারজালির মতো মনে হল নিভার । তবে মন থেকে সেটা উবে যেতেও সময় নিল না । বিজন আর যাই হোক নিভাকে ফাঁদে ফেলে সুযোগ নেবে না । সৈকত ছেলেটিও নিভাকে অনেকদিন চেনে । ও নিশ্চয়ই নিভাকে কোনও বিপদের দিকে ঠেলে দেবে না । তবুও নিভা জিজ্ঞেস করল- ও কোথায় ? তোমাকে কেন পাঠিয়েছে ? নিজে আসতে পারেনি?

সৈকত আগে আগে হাঁটছে । পেছনে হাওয়া ভেদ করে হেঁটে আসছে নিভা । সৈকত হাঁটতে হাঁটতেই মাথা ঘুরিয়ে হেসে বলল- কী জানি । গতকাল আমাকে বিজনদা ফোন করে আপনাকে রিসিভ করে ওর কাছে পৌঁছে দিতে বলল । ও আরেকটু এগিয়ে সেকেন্ড ফ্লোরে একটা বন্ধুর ফ্ল্যাটে আছে ।

সেকেন্ড ফ্লোরে এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে বিজন নিভার জন্য অপেক্ষা করছে ? একটা দ্রুতগামী মালগাড়ি নিভাকে উড়িয়ে এলোমেলো করে স্টেশন পেরিয়ে চলে যেতে থাকল যেন । কেন এমন পর্দা ? বন্ধুর ফ্ল্যাট- কোন বন্ধু ? বিজনের নামে কে অপেক্ষা করছে নিভার জন্য ? বিজন-ই তো ? নাকি অন্য কেউ ?

দুপাশে কেয়ারি করা একটা ছিমছাম রাস্তায় হেঁটে ওরা একটা প্রকাণ্ড গেটের সামনে এসে দাঁড়াল । গেটের পাশে পিলারে কালো পাথরে গোল্ডেনে খোদাই করে লেখা- সুচরিতা । এটা এই হাউজিংটার নাম । হাউজিংটা বিরাট বড় না হলেও বেশ বড় । প্রতিটি ফ্লোরে একটা করে দরজা , সামনে স্টিলের রেলিং দেওয়া সামান্য ব্যালকনি । কম্পাউন্ডে দেবদারু গাছ । তেমন কোনও একটা সাড়াশব্দ নেই । তবে আবাসিকরা যে আছে তার প্রমাণ ব্যালকনিতে মেলা জামাকাপড় । বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের টব । বড় গেটটা বন্ধ । তার একদিকে চারকোণা একটি ফ্লিপ গেট । সেটা খুলে সৈকত একটু মাথা ঝুঁকিয়ে ঢুকে ভেতরে গিয়ে নিভাকে বলল- আসুন । একটু দেখে আসবেন । নিভা মাথা নীচু করে গেটটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল । শুনশান পোর্টিকো । পাশেই ভেতরে ঢুকে যাবার প্যাসেজ । পোর্টিকোর দু-পাশে ফুলের টব বসানো । কোনও ওয়াচম্যান নেই । পোর্টিকোর পাশ দিয়ে ভেতরে যাবার প্যাসেজে আসতেই ওদের পায়ের তুচ্ছ শব্দ কত বড় মনে লাগল । সৈকত নিয়ম করে মাঝেমাঝেই পেছনে মাথা ঘরিয়ে নিভাকে দেখে নিচ্ছিল । নিভার মস্তিষ্ক আর কাজ করছিল না । সোমনামবুলিস্টের মতো সে সৈকতের নির্দেশ পালন করে হেঁটে যাচ্ছিল শুধু । এবার ডানদিকে হ্যান্ড্রেল দেওয়া উপরে উঠে যাবার একটি সিঁড়ি পড়ল । সৈকত তিন ধাপ উঠে তন্দ্রাচ্ছন্ন নিভাকে বলল- আসুন , এইদিকে । অত শুনশানতায় সৈকতের মিহি কণ্ঠস্বর গমগম করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল ।

 

৩.

বিজনের হাতে ভরা রাস্তায় চড়টা খাবার পর নিভার দাদার মুখটা লাল ফার্নসের মতো হয়ে উঠেছিল । প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপছিল ও । হতভম্ব হয়ে পড়েছিল নিভাও । অকস্মাৎ এমন একটি ঘটনা যে ঘটে যাবে ঘুণাক্ষরেও তার আন্দাজ পায়নি নিভা । একটি স্প্রিং-এর মতো আগুন দাপিয়ে জ্বলে উঠেছিল নিভার ভেতরে আবার অন্যদিক থেকে শোঁ-শোঁ করে একটা তুলকালাম বৃষ্টিও ছুটে এসেছিল । চড়টা মারার পর বিজন একটা ইটের গাঁথনির মতো সটান দাঁড়িয়ে আছে আর নিভার দাদা থরথর করে কাঁপছে । নিভা ওর সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় দাদার হাত মুঠো করে ধরে ওকে সামলে নেবার চেষ্টা করছিল । প্রচণ্ড রাগে, উত্তেজনায় নিভার দাদা যেসব কথাগুলো বিজনের দিকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল – তার সঙ্গে ওর গুঠকা খাওয়া খয়েরি থুথুও ছিটকে বেরোচ্ছিল । নিভা যখন দেখল আশপাশ থেকে কিছু একটা গন্ধ পেয়ে ছুঁচোর মতো সরু মুখের লোকজন এগিয়ে এসে ওদের দগদগে ক্ষতটাকে ঠোঁকরাতে চাইছে , সে তাড়াতাড়ি একটা ই-রিকশা ডেকে দাদাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল । ছুঁচোর মতো লোকের দেয়াল চারপাশে দাঁড়িয়ে যেতেই বিজন কোথায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল যেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে দাদাকে রিকশায় তুলে নিজেদের বাড়ির অ্যাড্রেস বলে দিয়েছিল নিভা । তখন এক কালো প্রলয়ের মতো অবস্থা ।


একটা চামচে তার তরল হৃৎপিন্ড টলবল করছে । ঘাম নেমে যাচ্ছে অন্তর্বাসের ভেতর দিয়ে । কিন্তু দাদাকে নিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছতে পারেনি নিভা ।


রিকশা ছাড়ার কিছুক্ষণ পরেই বিজনের উদ্দেশে আবারও একটা কদাকার শব্দ উগরে দিয়ে বুনো ষাঁড়ের মতো রিকশা থেকে নেমে গিয়েছিল নিভার দাদা । ঝড়ে চালা উড়ে যাওয়া ধ্বস্ত ঘরের মতো বাড়িতে ফিরেছিল একা নিভা । রাতে বালিশ আঁকড়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদার সময় নিভা শুনতে পাচ্ছিল জড়ানো গলায় দাদা জনহীন বসার ঘরে চিৎকার করছে । গোটা পাড়াটা নিঝুম । কেবল দাদার আক্রোশ সীমান্তের গোলাবর্ষণের মতো এই নৈঃশব্দ খানখান করে দিচ্ছিল ।

সেকেন্ড ফ্লোরে একটা বন্ধ দরজার কাছে নিভাকে এনে সৈকত বলল- যান, বিজনদা ভেতরে আছে । চকচকে বার্নিশ করা কাঠের দরজা । তার গায়ে সৈকত ও নিভার বিমূর্ত ছায়া পড়েছে । সৈকত হাসল- না না, ভয়ের কিছু নেই । বিজনদাই আছে । আপনি আসার আগে আমি ওকে সিগারেট এনে দিয়েছি ।

সৈকত চলে যাবার পর দরজার গোল হাতলটা ঘোরাতে গিয়ে একবার সহসা কেন জানি কেঁপে উঠল নিভা । ভয় না অন্য কোনও উত্তেজনা – তা ডিস্টিঙ্কলি বোঝার ক্ষমতা ছিল না নিভার । তবু তার হাত নিজেই নিজের মনিব হয়ে হাতলটা ঘুরিয়ে খুলে ফেলল দরজাটা । ভেতরে একটা বেড, একটা নীলচে ডিভান , একটা গ্লাসটপ টেবিল, কয়েকটা পলিভিনাইল চেয়ার । ডিভানের এককোণে যেখানে জানালার ওপর ভারী পর্দা টেনে দেওয়া- সেখানে একটা ছায়ামূর্তি বসে আছে । প্রত্নের মতো ।

এই ইতিবৃত্তের শুরু হয়েছিল একটা কুকুরের মুরগী শিকারের প্রসঙ্গ দিয়ে । ইকোসিস্টেমের মতো একটি অনিবার্য শাশ্বত প্রসঙ্গ দিয়ে । যেখানে ব্যাঙ জলচর প্ল্যাঙ্কটনদের খাবে । আবার সাপ ব্যাঙকে খাবে । ক্ষুধার্ত ময়ূর বেঁচে থাকার জন্য শিকার করবে সাপকে বা উদ্ভিদকে খাবে তৃণভোজীরা আবার তৃণভোজীদের শিকার করবে মাংসাশীরা । একজন মরে গিয়ে আরেকজনকে বেঁচে থাকতে দেবে । নিবৃত্ত করতে দেবে ক্ষিদে , অতৃপ্তি বা সিস্টেম যেমন প্রোগ্রামিং করে রেখেছে – তেমন কোনও আদিম বিক্ষোভ বা নিয়তি । নিভা দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই ছায়ামূর্তিটা প্রায় শূন্যে গা ভাসিয়ে তার দুই মস্ত থাবার তলায় বিছানায় ঠেসে দিল নিভাকে । বিজনের চোখের বরফে তখন দিগন্ত অবধি আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে । চুলের গোড়া থেকে বটের আঠার মতো ঘাম গড়িয়ে নামছে দুই গাল বেয়ে । গলার রগ ফুলে উঠেছে সামুদ্রিক ঢেউয়ের মতো । হিসহিস করে বিজন বলছে নিভাকে- তিনমাস , তিনমাস আমার সঙ্গে মিশবি না তুই ? ফোন ডাইভার্ট করে রাখবি ? এমন সময়ে বাড়ির থেকে বেরোবি যাতে আমার সঙ্গে দেখা না হয় ? বাপের লক্ষী মেয়ে হয়ে থাকবি ? দাদার আদুরে বোন হয়ে থাকবি ? দেন সুপাত্র দেখে তোর বাবা- দাদারা তাদের সচ্চরিত্র মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবে ? তাই , তাই নাকি ? আর আমি ফাঁসি দেব নয়তো ট্রেনে কেটে মরব ? ইজ দ্যাট সো ? নিভা সজোরে পিষে যেতে যেতে দেখল বিজনের চোখে- মুখে যেন হাসির ঝিলিক । মা-কালীর কৌতুকের মতো একটা লালচে আভা । প্রতিরোধ একটা সময় ইকোসিস্টেমে অকেজো হয়ে যায় । যেমন আমরা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানলে দেখি । নিভা টের পেল তার পালক ছুলে নেওয়া হচ্ছে । তার ব্রা ছিঁড়ে নেওয়া হচ্ছে । দুই পা দিয়ে সরসর করে নেমে যাচ্ছে তার প্যান্টি । এবং একসময় টের পেল সে যে-কোনও চতুষ্পদ স্ত্রী-জানোয়ারের মতো বুকে, হাতে ভর দিয়ে বিছানায় উবু হয়ে আছে । দেখছে একটু আগে যে পৃথিবী উল্টে ছিল, এখন তা সোজাই । তার চোখের সই-সই একটি জানালা । এই জানালায় পর্দা ততটা টানা হয়নি । জানালা দিয়ে ওপারে ভবিষ্যতের একটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । একটি লাইম ইয়োলো রঙের দোতলা বাড়ি । নীচের দেয়ালে গ্রিলের কাজ করা বড়ো-বড়ো জানালা । মাথায় টুপির মতো ঘের দেওয়া কার্নিশ আর তার ওপরে একটা খোলা ছাদ । দড়িতে মেলা দুই প্রজন্মের বিভিন্ন সাইজের জামাকাপড়। সে একটা বালতিতে ভেজা কাপড় এনে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে তারে মেলছে । আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা শক্তিশালী রোদে তার মুখ পুড়ে যাচ্ছে ।

নিভা বলল- ইশ, কাদের যে মুরগী এটা ।

বিজন চট করে নিভার দিকে ঘুরে বলল- বল যদি, তুলে আনি ? একটা কুকুরই তো ? প্রয়োজন তো মানুষকে কুকুর বানায় । কুকুরীও বানায় ।

নিভা দেখল বিজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে । নিভা সাদা অ্যাক্রিলিকের খালি বালতিটা তুলে ছাদ অতিক্রম করতে করতে মনে মনে বলল- হ্যাঁ , বানায় । আমার চেয়ে এটা আর ভাল কে জানে ।

হঠাৎ বিজন যেন বডি থ্রো করে এক হাতে নিভার ভেজা ফর্সা কবজি চেপে ধরল- কোথায় যাচ্ছ ?

নিভা না নড়ে বলল- টিনার দুধটা জ্বাল হয়নি এখনও । কিছুটা রান্নাও বাকি ।

ছাড়ো , যা হয়েছে- হয়েছে । টিনার দুধটা জ্বাল দাও । চল, বাইরে থেকে খাবার আনিয়ে নিই ।

হঠাৎ?- নিভা বলল ।

বিজন বলল- এই ঘটনাটার রি কনস্ট্রাক্ট করি । তুমি মুরগী হবে, আমি কুকুর । সেই, সে- দিনের মতো । বলেই যেন শয়তানের মতো হাসল ও ।

নিভা কোনও উত্তর দিল না । বিজন তো জানেই না সেদিন পায়ুছিদ্র চিরে গিয়েছিল নিভার । কতদিন একটু টান পড়লেই রক্ত বেরোত । টালমাটাল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছিল নিভা । চোখ দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ছিল । বাথরুমে ঢুকে জল ছোঁয়াতেই কী জ্বালা । নিভার মনে হয়েছিল এই নীরব তিনমাসে হয়তো এমন একটা জন্তুকেই মনে-মনে বড় করছিল বিজন । যে জন্তুটা নিভার ভেতরেও আরেকটা জেদী মরিয়া স্ত্রী জন্তুকে জাগিয়ে তুলেছিল অন্য পুরুষ জন্তুটাকে সারা জীবনের জন্য একটা মরণ কামড়ের প্রত্যাঘাত ফিরিয়ে দিতে । হয়তো ।

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা