কিছুদিন আগে, কবি অনুপম মণ্ডলের ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরি’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সুযোগ হয়। তারপর, একে একে তার অন্যান্য গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত কাব্যগুলোও পড়ে ফেলি। যত পড়েছি, তত টের পেয়েছি, নিজের ভিতরের অতিধীর এক মুগ্ধতাকে। আমি অনেকদিন তার কবিতাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, বুঝতে পেরেছি তার কবিতার সঙ্গে ধীরে ধীরে একটা সহধারণের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে আমার। যেহেতু আমি নিজে কবিতা লিখি, ফলে আরেকটি কবিমানসকে বুঝে নেয়ার অভীপ্সা আমার মজ্জাগত। আর এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আলাপের সূত্রপাত। ফলে, আলাপে আমি সেইসব প্রশ্নে লিপ্ত থেকেছি, যেখান থেকে তার কাব্যের অনুপ্রেরণা বা চেতনার যাত্রা শুরু। তার কাব্য আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা, ভাষাময়তা, রহস্য, নৈঃশব্দ্য, সাঙ্গীতিক অভিলাষ—সবই এখানে অল্পবিস্তর উঠে এসেছে। আর এসেছে বিবিধ বাস্তব অভিজ্ঞতা—যেখান থেকে তার কবিতারা আরো বেশি প্রাজ্ঞ ও নির্জন হয়ে ওঠে।
—নুসরাত নুসিন
অনেক অনেকদিন পরে যা দু’একটা মেয়েকে কাছ থেকে দেখেছি, রহস্য কেটে গেছে! আমি হতাশ হয়েছি! মূলত, ওই কারণেই আমি বাস্তব জীবনের কোনো মেয়েকে নিয়েই কবিতা লিখিনি!
নুসরাত নুসিন : পত্র পতনের সঙ্গে জীবনের গাঢ় কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি?
অনুপম মণ্ডল : একটি পাতা যখন গাছে থাকে, ঝরে যাওয়ার আগ-মুহূর্তে সে কী ভাবে? মাটিতে পড়ার আগে সে কী আর একবার ফিরে যেতে চায়, সেইখানটাতে যেখানে সে ছিল! যতক্ষণ সে শূন্যে ভাসমান, তার চিন্তার কী কী পরিবর্তন হয়? এইগুলো ভাবতে ভাবতে পাতার সাথে আমার একটা অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হতে থাকে।
নুসরাত নুসিন : পতনের প্রশ্নটি প্রথমে করলাম, কারণ আপনার কবিতায় ‘পতন’ বেশ আসে। আসে আর ক্ষণকালের সঙ্গে একটা অসীম আবেগে লিপ্ত হয়। যার সুরটি ক্ষীয়মাণ কোনো গোধূলির স্বরলিপিতে বাঁধা—এমন মনে হয়।
অনুপম মণ্ডল : একটা পাতার এই যে ঝরে পড়া, শেষ পর্যন্ত তা আমার কাছে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ধরা দেয়। কোনকিছুর সমাপ্তি, নতুন একটা সম্ভাবনা। আর মাঝের এক অনন্ত সময়।
নুসরাত নুসিন : পতনের অনুভূতি তো শেষমেষ নবপ্রেরণার অনুভূতিই আনে, তাই না? ধরুন, একটি বৃক্ষের থেকে একটি পাতা যখন খসে পড়ে, তখন সে একইসঙ্গে পতন ও আরেকটি নতুন পাতা গজানোর মুহূর্তকে টের পায়।
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ। সেটাই।
নুসরাত নুসিন : লক্ষ্য করেছি, শব্দেরা আপনার কাছে ধরা দেয় দিন শেষের সান্ধ্যসঙ্গীতের মতো। তারপর ধীরে ধীরে বিলীন হতে চায় গুঢ় কোনো অর্থময়তার ভিতরে। আপনার শব্দেরা তাই অনুচ্চ, অবনত। জীবনের কত আশ্রয় থাকতে শব্দের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লেন কেন?
অনুপম মণ্ডল : পরাজয়, নিঃশেষিত, ক্ষয়ে যাওয়া! এই শব্দগুলো, একটা ভীতি তৈরি করে! ঐ সমস্ত মুহূর্তের মুখোমুখি হতে চাইনি কখনও! অথচ, জীবনের সমস্ত পথের শুরুতে আমার ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে! আমি, কবিতা লিখতে চাইনি কখনও! কিন্তু, অন্য কিছু হতেও পারিনি! খুব ছোটবেলা থেকে একা-একা থাকতাম! কেননা, সবার সাথে মেশা আমার নিষেধ ছিলো! ফলে, নিজে-নিজেই কল্পনা করে নিতাম, আমার জগৎ! আমার বন্ধু, প্রেমিকা! বাবার স্কুলের ছোট্ট লাইব্রেরিটা আমাকে সাহায্য করেছে!
নুসরাত নুসিন : তাহলে ভীতি থেকে শব্দের সঙ্গে এই নিরন্তর ক্ষয়ে যাওয়া! সবার সঙ্গে মেশা নিষেধ ছিল কেন? এই সঙ্গহীনতাই কী মানুষ থেকে ক্ষাণিকটা দূরে থাকতে আপনার কবিতাকে প্রলুব্ধ করে? যেহেতু মানুষের সমাগম কম। কিন্তু বাস্তবতায় বিচিত্র মানুষ আছে তো! কবিতায় এই মানুষকে কিভাবে গ্রহণ করতে চান?
অনুপম মণ্ডল : মা’র ভয় ছিলো! আমি ভুল পথে যেতে পারি! আমার বাবারা ছয় ভাই! তিন বোন! আমি আমার সব ভাই-বোনদের সাথেও মিশতে পারতাম না! ওখানেও মা’র নিষেধ! আমাকে মিশতে হতো, বেছে-বেছে! আর সব থেকে বড়ো নিষেধ ছিলো, মেয়েদের প্রতি! আমার বোনদের বাইরে একটা দীর্ঘ সময় আমি মোটামুটি মেয়েদের থেকে একটা দূরত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছি! এতে যা হয়েছে, আমি তাদের রহস্যময়ী হিসেবে দেখেছি! অনেক অনেকদিন পরে যা দু’একটা মেয়েকে কাছ থেকে দেখেছি, রহস্য কেটে গেছে! আমি হতাশ হয়েছি! মূলত, ওই কারণেই আমি বাস্তব জীবনের কোনো মেয়েকে নিয়েই কবিতা লিখিনি!
নুসরাত নুসিন : ধীরে ধীরে সকল রহস্যই কেটে যায়। আপনি নিজেই কম রহস্য ধারণ করেন না! সম্ভবত, কবিতা তার থেকেও বেশি রহস্য ধারণ করে। কি মনে হয় আপনার?
অনুপম মণ্ডল : রহস্য, কবিতায় কিছু থাকতেই হয়! অন্তত আমি মনে করি! একেবারে সবটুকু দেখিয়ে দিলে, তাকে কবিতা মনে হয় না আমার! তবে, রহস্যের নামে তাকে আমি জটিল করতেও ইচ্ছুক নই!
নুসরাত নুসিন : রহস্য আসলে কী? অথবা কাব্যরহস্য বলতে কী বোঝেন?
অনুপম মণ্ডল : একটা, আড়াল! সব কিছু বলে না দেওয়া। একটা তৃষ্ণা জাগিয়ে রাখা। এইতো!
নুসরাত নুসিন : ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরি’ নিয়ে ফেসবুকে লিখেছিলাম, আপনার কবিতা কোলাহলের বাইরে চিরকালিন চিরধ্বনি। ওই যে শুকনো পাতার মর্মর, অরুণরথের দিকে অজস্র করুণা, সন্ধ্যাতারার খসে যাওয়া, বাসকলতা, এমনকি অহম ও অশ্রু সবই চিরন্তন অনুষঙ্গ। আমার মনে হয়, আপনার কবিতা চিরকালের আত্মাকে বহন করে চলেছে। আপনি নিজে আপনার কবিসত্ত্বার ব্যাখ্যা কিভাবে দিতে চান?
অনুপম মণ্ডল : অসাধারণ না হলেও, খুব সাজানো, ছিমছাম একটা শৈশব ছিলো আমার! আমাদের ঘরের পাশে একটা পুকুর ছিলো! বর্ষায় সেখানে আমি হলুদ ডোরাকাটা সাপের মুন্ডু দেখেছি! পুকুরের পাড়ে গাছে-গাছে, বাবুইপাখির বাসা হাওয়ায় দোলে! আর মামার বাড়ি ছিলো গাছগাছালিতে ভরা! বাঁশপাতা, খড়কুটো একসাথে করে শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়েছি! আমি সবসময় ভেবেছি, দুটো মলাটের মধ্যে আমার শৈশবকে গেঁথে রাখতে! সবটা সত্যি আমি বলতে পারিনি! আমাকে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে!
নুসরাত নুসিন : কল্পনার আশ্রয় প্রসঙ্গে তাহলে বলি, কল্পনাকে আমার খুব সত্য মনে হয়। ঘুমের ভিতরে যে স্বপ্নের জগৎ তাকেও খুব বাস্তব আর সত্য বলে মনে হয়। অন্য কোথাও বলেছিলেন, আপনার ডাকিনীলোক পুরোই কাল্পনিক। বাস্তবের চেয়ে কল্পনা কি অধিক সুন্দর?
অনুপম মণ্ডল : আমার কাছে তাই মনে হয়! শুধু ডাকিনীলোকই নয়, আমি যা লিখেছি, যা লিখছি প্রায় সবকিছুই কাল্পনিক! ওই জগৎটার সাথে আমার সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই! তবে ঐরকম একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, মায়াময় জগৎ আমি চেয়েছিলাম! বাস্তব আসলে আমার কাছে খুব সুখকর নয়!
মনোজগতের সবকিছুকে আমরা একসঙ্গে ধরতে পারি না। ক্রমে-ক্রমে তা ধরা পড়ে। যদি এই অর্থে বলি, একজন কবির সমস্ত কবিতাই আসলে সিকুয়্যাল।
নুসরাত নুসিন : বাস্তবের সঙ্গে অস্বস্তিটা কোথায়?
অনুপম মণ্ডল : আমার নিজের ভেতরেই হয়তোবা ত্রুটিগুলো রয়ে গেছে! আমি কোথাও, কারোর সাথেই খাপ খাওয়াতে পারিনি! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, আমি যা চেয়েছি, তার উল্টোটা প্রাপ্তি হয়েছে!
নুসরাত নুসিন : কল্পনায় কি সংঘাত নেই? কদর্য কিছু?
অনুপম মণ্ডল : না, নেই! আমি সংঘাত, বা কদর্য কিছুকে আমার কল্পনা থেকে দূরে রাখতে চেয়েছি সবসময়।
নুসরাত নুসিন : যখন আপনার কবিতা পড়ি, একটি শেষ করে আরেকটিতে যাই, মনে হয়, একটি কবিতার রেশ আরেকটিতে রয়ে গেছে। আপনার সমস্ত কবিতা কি সিক্যুয়াল?
অনুপম মণ্ডল : আমি আসলে অনেক দিনই কিছু লিখি না! উপকরণগুলো খাতায় জমতে থাকে! এই যে লিখি না, তার মানে লিখতে পারি না! সময়টা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর! আমি লিখতে চাই অথচ লিখতে পারি না! তারপর হুটহাট করে কিছু লেখা হয়ে যায়! যেহেতু কিছু বিরতি নিয়ে হলেও লেখাগুলো কাছাকাছি সময়ে তৈরি হয়ে যায়, জগৎটা হয়তো কাছাকাছি চলে আসে! হয়তোবা একটা বই, মুভি, বা কিছু মুহূর্তের মুখোমুখি হলেই লেখাগুলো আমি লিখতে পারি! হয়তোবা মিলটা ওই কারণেই চলে আসে!
নুসরাত নুসিন : আমি মনে করি , মনোজগতের সবকিছুকে আমরা একসঙ্গে ধরতে পারি না। ক্রমে-ক্রমে তা ধরা পড়ে। যদি এই অর্থে বলি, একজন কবির সমস্ত কবিতাই আসলে সিকুয়্যাল।
অনুপম মণ্ডল : আমার কাছে কিন্তু তেমন মনে হয় না। একই ভূমিতে ভিন্ন-ভিন্ন ফসল ফলতে পারে। একটা বাগানে ভিন্ন-ভিন্ন ফুলের সমারোহ থাকে। তেমন, একজন কবির ভিন্ন-ভিন্ন লেখা বিচিত্র হতেই পারে।
নুসরাত নুসিন : ‘অহম ও অশ্রুমঞ্জরি’র কবিতাগুলি প্রথমে সিক্যুয়াল ছিল? পরে বইয়ে শিরোনাম দেন?
অনুপম মণ্ডল : প্রথমে নাম ছাড়াই ছিল। পরে আমি নাম দিয়েছিলাম।
নুসরাত নুসিন : আপনার কবিতায় শব্দ আছে, কিন্তু সেসব শব্দের শব্দ নেই। অথবা আছে। কিন্তু আমাদের কান পর্যন্ত আসে না। ওই যে পাতাটি খসে পড়ল, তা তো ওখানেই মিলিয়ে গেলো। এই নিঃশব্দ ব্যঞ্জনা কি সচেতন সৃষ্টি? সাউন্ড আপনার কাছে কিরকম অর্থ বহন করে?
অনুপম মণ্ডল : আমি একা থাকতে পছন্দ করি! যদিও সেটা হয়ে ওঠে না! খুব কমই আমি একা থাকতে পেরেছি! তো, আমি যখন একা থাকি তখন কখনও কখনও খেয়াল করেছি, চারপাশ যখন নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন আমার ভেতর একটা ভয় তৈরি হতে থাকে! এটা ভূতের ভয় নয়! অন্য কিছু! তার ব্যাখ্যা আমি নিজেই জানি না! আমি তখন থেকেই ভাবলাম, নৈঃশব্দ্যই আসলে বেশি সাউন্ড তৈরি করে! এই যে একটা পাতা খসে পড়ছে, ফুল ফুটছে, গোধূলি তার আলো ফেলছে, নিশ্চয় তার একটা ধ্বনি আছে! আমারা শুনতে পাই না, তবুও আছে! আমার অন্তত তাই মনে হয়! আমি আসলে ও-ই জায়গাটাই গেঁথে তুলতে চেয়েছি!
নুসরাত নুসিন : নৈঃশব্দ্য যাকে বলি, অবশ্যই তারও শব্দ আছে। কিন্তু সত্য হলো, সব শব্দ আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। তবে মন পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে পৌঁছায়। যেমন ফুল ফোটার যন্ত্রণা। যেমন ব্যথা।
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ! আমরা হয়তোবা শুনতে পাই না! কল্পনা করতে পারি মাত্র! তবে শুনতে পেলে কেমন হতো কে জানে!
নুসরাত নুসিন : বাইরে ও নিজের ভিতরে ভায়োলেন্স তৈরি হত!
অনুপম মণ্ডল : উল্টোটাও হতে পারতো! ধরুন অদ্ভুত শান্ত কোনো সুর!
নুসরাত নুসিন : একদম। পাতার পতনকে আর টের পেতাম না তখন। সবই নৈঃশব্দ্যে লীন।
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ। তেমনই।
নুসরাত নুসিন : ‘ইঙ্গিত থেকে দু’একটি সুর ভেসে ওঠে। যেন কারো হিম সুষুপ্তির তলে তখন হরিৎ কোনো আলোকের আভাস।’ আপনার কবিতারা মোটামুটি ইঙ্গিতময়, যেমন ইঙ্গিতবাহী এই বাক্য। আপনার শব্দেরা কি অমীমাংসিত? এত ইঙ্গিতময়তা কেন?
অনুপম মণ্ডল : সবসময় অমীমাংসিত নয় নিশ্চয়! তবে, আমি যে পথটিকে আশ্রয় করে চলেছি, মোটামুটি যাদেরকে ছুঁয়ে-ছেনে আমার ভাষার কাঠামো গড়ে উঠেছে, এখানে ইঙ্গিত বা ইশারা একটা প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে! আমার মনে হয় একটুখানি দোলা, বা আন্দোলন অনেক বেশি দ্যোতনাময়!
নুসরাত নুসিন : যখন ‘ডাকিনীলোক’ পড়ছিলাম, লক্ষ্য করলাম, আপনি প্রশ্ন ও বিস্ময়চিহ্ন দ্বারা তাড়িত নন। শুরুতে কি এসব ক্রিয়া করত না? যদিও আপনার এখনকার কবিতার মধ্যে প্রশ্ন ও বিস্ময় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অনুপম মণ্ডল : না না তেমন নয়! আমি আসলে অনেক কিছুই আনতে পারিনি! বিষয়গুলো ভিতরে ক্রিয়াশীল ছিল! তবু কিভাবে তাকে খাতায় আঁকা যায় কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না! এমনকি এখনো! আমার লেখা পড়ে, মানে নিঃসঙ্গ কেতকীর মতো পাণ্ডুলিপি পড়ে, কবি রাশেদুজ্জামান বলেছিলেন, যদি কিছু চিন্তা, গল্পের ইশারা, হ্রস্ব না হয়ে যদি একটু দীর্ঘ হতো… আমি আসলে ভেবে দেখলাম এগুলো বোধ হয় আমাকে দিয়ে হবে না! এক একটা লেখা তৈরির সময় থেকেই একটা যন্ত্রণা আমি বয়ে নিয়ে চলি! লেখাটা শেষ করতে হবে! যতক্ষণ না সে সমাপ্তিতে পৌঁছাচ্ছে, কিছুতেই তাড়াতে পারি না তাকে! ফলে, যেটা হয়, কখনও কখনও তাকে মাঝ পথে ছেড়ে দিয়ে চলে আসি! নিরীক্ষা আর করা হয়ে ওঠে না!
নুসরাত নুসিন : বিস্ময় ও প্রশ্ন— জীবনের কোন বোধকে ব্যাখ্যা করে? কবিতায় এদের মাধ্যমে কোনো উত্তর জানতে পারেন কী?
অনুপম মণ্ডল : বিস্ময় বা প্রশ্ন এটা তো জ্বালানি কাঠের মতো! জীবনটাকে একটু-একটু করে উসকে দেয়! তবে, কবিতায় আমি চূড়ান্ত মীমাংসায় আসতে চাইনি! প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতে বা নিজের মুগ্ধতাটুকু জানাতে চেয়েছি মাত্র! এর বেশি চাইনি আমি!
নুসরাত নুসিন : যদি প্রশ্ন ও বিস্ময় না থাকত?
অনুপম মণ্ডল : সেই মুহূর্তের কথা জানি না! নিশ্চয় জড়বস্তুর মতো জীবন হতো সেটা! অন্তত, আমার তেমনটা মনে হয়!
নুসরাত নুসিন : ‘আমি কি বাসনা হতে মুক্ত?’ এই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলেন কি?
অনুপম মণ্ডল : শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত আমার খুব প্রিয় একটা বই! যে বইগুলো আমার লেখার উপর প্রভাব ফেলেছে এটা তার মধ্যে একটা! আমি বাসনা হতে মুক্ত হতে পারিনি!
নুসরাত নুসিন : ‘আর দেখো, এই এক ঘণ্টাধ্বনি, এমনই সুরহীন তারা ঝুলে থাকে, একজোড়া সমাগত সন্ধ্যা ঠেলে।’ আমার কাব্য পাঠের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম চোখে পড়লো, ‘একজোড়া সন্ধ্যা’ এরকম উপমা প্রয়োগ। ‘একজোড়া সমাগত সন্ধ্যা’ এ সম্পর্কে যদি একটুখানি বলতেন?
অনুপম মণ্ডল : এই লেখাটি আমার একেবারে প্রথম দিকের লেখা! ‘ডাকিনীলোক’ যে বইটি চৈতন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল! তো, পরে ও-ই লেখাগুলি আমি আর মেনে নিতে পারিনি! আমার ভেতরে একটা বড়ো পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে ততদিনে! আমি দেখলাম বইটি আমাকে আমৃত্যু পোড়াবে! ফলে, আবার কিছু লেখা জড়ো করে আগের সব লেখা বাদ দিয়ে বইটি প্রকাশ করেছিলাম কোলকাতা থেকে! কিন্তু কেন জানি না, এই ব্যর্থ লেখাটি আমি রেখে দিয়েছিলাম! তখন শব্দ দিয়ে খেলা আমার ভালো লাগতো! সাদা রাত, কালো সূর্যাস্ত এমনই কিছু! একটা ধাক্কা! পাঠককে, একটা উন্মুক্ত স্থানে রেখে যাওয়া! যেন, এখন থেকে যা কিছু ভেবে নেয়া যায়! সমাগত সন্ধ্যা বললে পাঠক পড়ে চলে যেত! কিন্তু ওই একজোড়া শব্দটাই একটা মুহূর্তের সামনে তাঁকে দাঁড় করালো, একটু অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করলো! এ-ই তো, আর কিছু নয়!
নুসরাত নুসিন : এখন থেকে কি ‘অহম ও অশ্রমঞ্জরি’কে প্রথম বই বলবেন?
অনুপম মণ্ডল : না! ডাকিনীলোক আমার প্রথম বই! যেহেতু পরে বইটি আমি কিছুটা ত্রুটি মুক্ত করতে পেরেছি! বইটি পরে প্রকাশিত না হলে হয়তো অহম ও অশ্রুমঞ্জরিকে আমার প্রথম বই বলতে হতো।
নুসরাত নুসিন : তবুও প্রয়াস থেকে ২০১৯ এ যখন ‘ডাকিনীলোক’ বের হলো সম্ভবত সেখানে উল্লেখ করা আছে প্রথম প্রকাশ। সে হিসেবে ২০১৮ প্রকাশিত অশ্রু ও অহম’ই প্রথম বই? বিষয়টি বুঝিয়ে বলবেন কি?
অনুপম মণ্ডল : এটা আমি হয়তো খেয়াল করিনি! তাছাড়া সংশোধিতরূপে ওটাকে প্রথম প্রকাশ-ও বলা যায়! পূর্ণাঙ্গ বই-ও বলা যেতো! যদি না আগের সংস্করণের একটা কবিতা এতে না থাকতো! সবাই হয়তো এটাকে দ্বিতীয় বই বলতে চাইবে, কেননা, সেটাই সুস্থ চিন্তা! কিন্তু আমার উদ্দেশ্যই ছিলো যেহেতু প্রথম বইয়ের ব্যর্থতা কিছুটা হলেও ঝেড়ে ফেলা! আমি তাকে প্রথম বইয়ের একটা সংস্করণ হিসেবে দেখতে চেয়েছি!
নুসরাত নুসিন : এই দ্বিতীয় ‘ডাকিনীলোক’ মানে সংশোধিত ‘ডাকিনীলোক’ নিয়ে এখন সন্তুষ্ট?
অনুপম মণ্ডল : না! আমি বইটি আবার নতুন করে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম!
নুসরাত নুসিন : আবার করতে চান?
অনুপম মণ্ডল : চেয়েছিলাম! পরে ভাবলাম, অনেক ব্যর্থতার মধ্যে এটাও একটা ব্যর্থতা হয়ে থাক! তবে, কখনো সব বইগুলো এক মলাটের মধ্যে আনলে (শেষ জীবনের কথা বলছি), সে সুযোগ যদি পাই, ওই ১৪ টা কবিতা থেকে দু’একটা কবিতা হয়তো ফেলে দেবো, দু’একটা কবিতা হয়তো এডিট করবো!
নুসরাত নুসিন : কবির মন মাধুরিতে ভরা! এক কবিতা তাহলে অনেকবার কাটাকুটি করা হয়?
অনুপম মণ্ডল : আমি এক বৈঠকে বসেই একটা লেখা লিখে ফেলেছি, এমনটা মনে পড়ে না! আমি প্রকাশককে পাণ্ডুলিপি দেয়ার আগ পর্যন্ত এডিট করি! এমনকি, প্রুফ দেখতে দেখতেও শব্দ বদলেছি আমি! ব্যাপারটা নিশ্চয় তাঁর জন্য অসুবিধার, তবু শেষ পর্যন্ত তাকে নিখুঁত করে তুলতে চাই!
নুসরাত নুসিন : একজন কবি তার কবিতার ভিতরে বেঁচে থাকেন?
অনুপম মণ্ডল : মানুষ তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকবে! আমি এমনটাই বিশ্বাস করতে চেয়েছি সবসময়! একটা তুচ্ছতম মুহূর্তও যদি সে কারোর ভেতর তৈরি করে রেখে যায়! সেই মুহূর্তটি রয়ে যায়, আরও আরও কিছু কাল!
নুসরাত নুসিন : কবিতা আর এই যে বেঁচে থাকা—কেমন এই যুগল অনুভূতি?
অনুপম মণ্ডল : দুটোর মধ্যে একটা মিল আছে! অমিলও! বেঁচে থাকাটা খুব সুখকর কোনো অনুভূতি নয় আমার কাছে! তেমনি একটা লেখা যতক্ষণ না তৈরি হয়ে উঠছে! এটুকুই মাত্র! কবিতায় আমার উপকরণগুলো এমনভাবেই সাজিয়েছি, যেন, দিনের শেষে সেখানে একটু নিশ্বাস আমি নিতে পারি!
নুসরাত নুসিন : কবিতাকে কী কখনো ফাঁদ বলে মনে হয়? কবিতা লেখার মুহূর্তে আত্মধ্বংসের কোনো আশঙ্কা পায়?
অনুপম মণ্ডল : না! আমি কখনও এইভাবে কবিতাকে দেখিনি! তবে, যখন লিখতে পারি না বা একটা লেখা তৈরি হতে থাকে একটা বেদনাবোধ আমাকে একটু একটু করে আঁকড়ে ধরে! আমি আমার লেখার কাছে তেমন কিছুই চাইনি! মানে তাকে কালজয়ী কিছু একটা হতে হবে বা এমন কিছু!
নুসরাত নুসিন : কবিতার চোখ দিয়ে মৃত্যুকে দেখেন কি?
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ! আমি একটা সময় মৃত্যু চিন্তা নিয়ে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম! ডাকিনীলোক, প্রথম যে সংস্করণ বার হয়েছিল, ওইখানে ছিলো! এখনো নেই তা নয়! তবে, কবিতায় তাকে লিখতে ইচ্ছে করে না আর!
নুসরাত নুসিন : কবিতায় কি সাধনার আনন্দ আছে?
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ! আছে! সৃষ্টির আনন্দ আছে! একটা অলৌকিক জগৎ তৈরির আনন্দ! আমি যা লিখেছি তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না! তবুও কেউ কেউ বিশ্বাস করে ফ্যালে! এমনকি আমিও কখনও কখনও!
নুসরাত নুসিন : কবিতা মানুষকে যা দিতে পারে, তা কী কী?
অনুপম মণ্ডল : মানুষকে কি দিতে পারে বলতে পারি না, তবে আমাকে সে আশ্রয় দিয়েছে। বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে।
ভাষা না থাকলে শুধু বোধ দিয়ে অনুভূতি ঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে!
নুসরাত নুসিন : ‘এই বক্ষ, গ্রীবা, মস্তক, অনন্তকাল থেকে শুধু দেহ বদলে চলেছে। তুমি তুলে ধরো তাকে, বীণার সুরের দিকে পৌঁছে দাও।’—এটা কি সাঙ্গীতিক লীলাময়তার কোনো আকাঙ্খা?
অনুপম মণ্ডল : আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমি সঙ্গীতের তেমন কিছুই বুঝি না! আমি শুধু এটুকু বুঝি, গান আমাকে তৃপ্তি দেয়! আমি প্রচুর গান শুনি! আমার মনে হয়েছে এই নশ্বর দেহটাকে যদি ওই সুরের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়! যদি তার পরে, ছিটকে এসে পড়ে সুরের প্রহার…
নুসরাত নুসিন : সুরের প্রহার…সুন্দর বললেন। সংগীতে কথা নাকি বাণীহীন সুর কোনটা বেশি মগ্ন করে?
অনুপম মণ্ডল : আমি গীতবিতান পড়ে দেখেছি! আবার গানগুলো শুনেও…. আমার মনে হয়, দুটো আলাদা অনুভূতি তৈরি করে! একে ঠিক কম্পেয়ার করতে পারবো না আমি! তবে গানটা যখন পড়ি, তখন ও-ই গানটাই লতার মতো সুর হয়ে কোথাও যেন দুলে দুলে বেজে ওঠে!
নুসরাত নুসিন : ‘যে সন্ধ্যা একদিন দুর্বোধ্য ছিল জীবনে আরেকবার ভাষাহীনতার মধ্যে পেলাম তাকে।’ বেশি অর্থপূর্ণ লাগে ভাষার ভিতরে পাওয়াকে, না ভাষাহীনতায় পাওয়াকে?
অনুপম মণ্ডল : কখনও কখনও বিকেলে ঘুরতে বেরোলে, (যখন গ্রামের বাড়ি থাকি) ও-ই সন্ধ্যার আলোর বিলের শান্ত ঢেউয়ের পরে শুয়ে থাকা, পাখিদের নীড়ে ফেরা, নদীতে ভেসে ভেসে কোনো নৌকার চলে যাওয়া, গেওয়া গাছের ভেতর পাখিদের ডাক, এর কোনো ব্যাখ্যা ছিলো না আমার কাছে!
নুসরাত নুসিন : এখনো কী নেই?
অনুপম মণ্ডল : না, নেই! তাকে প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি! তবে আমি তাঁকে আঁকতে চেষ্টা করেছি! অন্তত আমার চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলো না!
নুসরাত নুসিন : একজন কবির বড় সম্পদ বোধ না ভাষা?
অনুপম মণ্ডল : ভাষা না থাকলে শুধু বোধ দিয়ে অনুভূতি ঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় কিনা আমার সন্দেহ আছে! দুটোর মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আমি টের পাই! আমি খেয়াল করেছি, আমি কিছু বলতে চাইছি অথচ শব্দ নেই আমার কাছে, যা দিয়ে একটা বাক্য তৈরি করতে পারবো আমি! আমি লিখতে পারি না! মাথা ঝিমঝিম করে! ঠিক ওইরকম অনুভূতি তৈরি হয় যখন খাতা ভর্তি উপকরণ থাকে কিন্তু কোনো প্লট থাকে না! এই দুই পরিস্থিতিই আমার জন্য ভয়ানক!
নুসরাত নুসিন : অভিযোগ আছে, আপনার কবিতায় মানুষ নেই। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়, মানুষ আছে, এবং প্রায় কবিতাতেই আছে। আপনি কেবল মানুষের কলরবকে সরিয়ে রেখেছেন। মানুষই তো প্রধান। একটি মহৎ একাকীত্বে একজন মানুষ প্রথমে যাকে অনুভব করতে চায়, তা আরেকজন মানুষকেই। অথবা নিজেকে। হ্যাঁ, আপনার কবিতায় মানুষের সমাগম কম। কিন্তু আপনি কোনো না কোনোভাবে তাদের আহবান করেছেন কবিতায়। যেমন, ‘তার নেত্রের আভা/মুখচ্ছবিচূর্ণ কোনো ধড়ের পানে ঝুলে আছে’, মাঠের এই শীর্ণ পথ ধরে যারা ফিরেছে সন্ধ্যার কিছু আগে/ তাদের মাথার উপর আশ্রয়হীন খড়ের ঘরখানি’, ‘আমাদের ক্রন্দনের অবসরে মেঘ ওড়ে/ যেন, সকল যাত্রী চলে গেছে, আর ওই প্রদীপের উন্মমত্ততা তারা লক্ষ করেনি’ এরকম কত উদাহরণ দিতে পারব। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলুন।
অনুপম মণ্ডল : মানুষ নেই এটা সম্ভবত আমি বলেছিলাম প্রথম! মানুষ নেই বলতে, আমার পরিচিত কেউ তো নয়! অপরিচিতও নেই! আমি একটা অবয়ব কল্পনা করে নিই! আমার আসলে তাকে তৈরি করে নিতে ভালো লাগে! কেননা, তাঁর কাছ থেকে আঘাত প্রাপ্তির সম্ভাবনা কম থাকে!
নুসরাত নুসিন : এই যে অবয়ব কল্পনা করে নেন, এই অভিজ্ঞতা তো চেনা মানুষ থেকেই পান, নাকি?
অনুপম মণ্ডল : না! তেমনটা নয়! যেহেতু তাদের চোখ কান নাক মুখের আমার তেমন প্রয়োজন হয়নি! তাদের বাস্তব থেকে নেয়ার দরকার ছিল না আমার!
নুসরাত নুসিন : ‘আর কারো শূন্য গৃহকোণে, তার ক্ষুদ্র শরীরটুকু নিয়ে, মাটির প্রদীপখানি জ্বলছে।’ কামনা— আপনার কবিতায় সন্ধ্যার সাঁঝবাতিটির মতো, যেন নিভৃতে জ্বালিয়ে রেখেছে শিখা। ‘আমি কি বাসনা হতে মুক্ত’ এই বাসনা কি কাম অর্থে?
অনুপম মণ্ডল : যখন, কথামৃত পড়ি তখন এ-ই শব্দটা ঘুরে ফিরে সামনে পড়ে, ‘কামিনীকাঞ্চন’! এটা থেকে মুক্ত হওয়ার কথা বলেছেন উনি! উনি একটা অর্থে হয়তো বলছেন! আমি ঠিক কাম নয় কোনো কিছু আশা করা, এই অর্থটা বোঝাতে চেয়েছি!
নুসরাত নুসিন : ‘দুটি শীর্ণ বাহুসমেত আমরা—শীতে কাঁপছি। খরোষ্টিলিপি—আমাদের সমস্ত গান—বস্ত্রহরণের স্মৃতি, পথে, ধুলোয় ভরে আছে।’ এই কবিতাটি যেনো পারিবারিক দুঃখ-কষ্টের সম্পর্ককে ধারণ করে আছে। এখানে খরোষ্টিলিপির সম্পর্কটি ঠিক কী?
অনুপম মণ্ডল : এখানে দুটো ঘটনা পাশাপাশি রাখা হয়েছে! সেটা দারিদ্রতা আর দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ! দুটোর মধ্যে হয়তো মিল নেই! তবে দুটো ঘটনাই আমাকে পীড়া দেয়! এখানে আমার লিখন ভঙ্গিমার কথা বলতে চেয়েছি! ‘খরোষ্টিলিপি’ শব্দটা দিয়ে! যা ঠিক ঠিকভাবে ওই ঘটনা দুটিকে ব্যাখা করতে পারেনি!
নুসরাত নুসিন : ‘বাক্যরক্ষার ছলে তার কাছে আসি’ সেরকমই কোনো ছল ও ছিন্ন মনোলোকে কবিতায় আপনি নির্জন স্বরে চুপিচুপি কথা বলেন। পাঠক এতটা অবগুণ্ঠন সইবে?
অনুপম মণ্ডল : আমার পাঠক কম! খুবই কম! আমি এটা নিয়ে ভাবিনি! কেউ ভালো বললে আনন্দ পেয়েছি! ভালো লাগেনি বললেও দুঃখ পাইনি! আমি লিখেছি! কেউ পড়বে, এটা তেমন মাথায় কাজ করেনি!
নুসরাত নুসিন : কবির দেখা ও কাব্যপাঠকের দেখা কি এক হয় কখনো?
অনুপম মণ্ডল : বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আলাদা হয়। একজন যখন লেখেন, বা লেখাটা তার ভেতর তৈরি হতে থাকে তার ভেতরের ঘটনা বা দৃশ্যের যে দ্বন্দ্ব, তা পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। যদি কবি না চান।
নুসরাত নুসিন : কাব্যের অনুপ্রেরণায় বিশ্বাস করেন?
অনুপম মণ্ডল : নিশ্চয়।
নুসরাত নুসিন : লিপিকা, রসাতল, উপনিষদ, শ্রীগীতা, রামকৃষ্ণ কথামৃত, গল্পগুচ্ছ, বিভূতি, গৌতম বসু, কালীকৃষ্ণ গুহ এদের কাছে ঋণী আপনি?
অনুপম মণ্ডল : হ্যাঁ! বলা যায়! আরও একটা বইয়ের নাম মনে পড়ছে, অক্ষয় মালবেরি! তবে লোরকা হিমেনেথ বা মাচাদোর নামও আনতে হবে!
নুসরাত নুসিন : বেঁচে আছে, এমন কারো নাম…
অনুপম মণ্ডল : গৌতম বসু।
নুসরাত নুসিন : কোন বৈশিষ্ট্যর জন্য গীতা আর উপনিষদকে উত্তম কাব্য বলেছিলেন?
অনুপম মণ্ডল : গীতা বা উপনিষদ আমার খুবই ভাসা-ভাসা পড়া! তা-ও প্রয়োজনে! আমি ওর অনেক কিছুই কবিতায় আনতে পেরেছিলাম! মূলত প্রকাশভঙ্গি আর ভাবের দিক থেকে আমার বই দুটিকে কাব্য ব’লে মনে হয়েছে!
নুসরাত নুসিন : কাব্যই শিল্পের শীর্ষ—এ বিষয়ে আপনি একমত?
অনুপম মণ্ডল : বিতর্কে যাব না, কিন্তু কবিতা, চিত্রকলা, সঙ্গীত তিনটাকেই আমার সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়।
নুসরাত নুসিন : ভবিষ্যতে আপনার ভাষাভঙ্গিমা এমনই থাকবে, নাকি পাল্টে যেতে পারে?
অনুপম মণ্ডল : এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। কেননা, আমি প্রায়ই ভাবি নতুন কিছু লিখব। কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠে না। যাই লিখি, গাছ, লতা আর ফুলের কথা হয়ে ফুটে ওঠে।
নুসরাত নুসিন : কবিতাকে বিশেষ ছন্দে ছন্দোবদ্ধ করার ইচ্ছে আছে?
অনুপম মণ্ডল : আমি ছন্দ বুঝি না! দু-তিনটে বই পড়ার চেষ্টা করে দেখলাম ব্যাপারটা গণিতের মতো জটিল মনে হচ্ছে! নিশ্চয় ছন্দ শেখার চেষ্টা করবো শেষ বয়স পর্যন্ত! লিখবো কিনা জানি না!
নুসরাত নুসিন : নিজের কবিতা নিয়ে কোনো আত্মসমালোচনা আছে কি?
অনুপম মণ্ডল : আছে! আমি খুবই পুনরাবৃত্তিপ্রবণ! আরও একটা কথা বলা যায়, যা লিখতে চেয়েছি, তার সবটুকু পারিনি! আরও অনেক কিছুই বলা যায়, থাক সেটুকু!
নুসরাত নুসিন : আপাতত, এই পর্যন্তই আলাপ থাক। ভবিষ্যতে আরো বৃহৎ কোনো আলাপের অপেক্ষা আমরা করতেই পারি। কি বলেন?
অনুপম মণ্ডল : নিশ্চয়! নিশ্চয়!
৩১. ০৫. ২০২০